ইনসেটে, মার্স ২০২০ রোভার প্রকল্পের কর্ণধার অ্যাডাম স্টেলটজ্নার। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
আর কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর সঙ্গে যৌথ ভাবে মঙ্গল, শুক্র ও চন্দ্রাভিযানে নামবে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। শুধুই একে অন্যের মহাকাশযানে কয়েকটি গবেষণার যন্ত্রপাতি পাঠানোর মধ্যেই সেই সব অভিযান সীমাবদ্ধ থাকবে না। সেগুলি আক্ষরিক অর্থেই হবে যৌথ অভিযান। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (‘এসা’) সঙ্গে এখন যে ধরনের যৌথ মহাকাশ অভিযানে নামে নাসা, ঠিক সেই রকমই।
নাসার এ বারের সাড়াজাগানো মঙ্গল অভিযানের (‘মার্স ২০২০ রোভার পারসিভের্যান্স’) মূল কান্ডারি, গোটা প্রকল্পের কর্ণধার চিফ ইঞ্জিনিয়ার অ্যাডাম স্টেলটজ্নার এ কথা জানিয়েছেন। পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরি (জেপিএল) থেকে ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে টেলিফোনে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে।
‘ইসরো’জ পারফরম্যান্স জাস্ট অ্যামাজিং’
মহাকাশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকে যে ভাবে উত্তরোত্তর অগ্রাধিকার দিতে শুরু করেছে ইসরো, তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন নাসার এ বারের মঙ্গল অভিযানের মূল কান্ডারি।
স্টেলটজ্নার বলেছেন, ‘‘ইসরো’জ পারফরম্যান্স ইজ জাস্ট অ্যামাজিং। ইসরোর কাজকর্ম আমাদের চমকে দিয়েছে। এত অল্প সময়ে ইসরো এত দ্রুত গতিতে মহাকাশ গবেষণায় বিশ্বের প্রথম দু’-তিনটি দেশের মধ্যে যে জায়গা করে নিতে পেরেছে, তা যথেষ্টই কৃতিত্বের দাবি রাখে। মহাকাশ গবেষণায় পৃথিবীর পথিকৃৎ সবক’টি দেশই আজ রীতিমতো সম্ভ্রমের চোখে দেখে, সমীহ করে ইসরোকে। আর এটা হয়েছে মাত্র ২০/২৫ বছরে। যা মোটেই সহজ কাজ নয়।’’
চাঁদে, মঙ্গলে যৌথ অভিযানে যাবে নাসা, ইসরো
স্টেলটজ্নার জানিয়েছেন, ‘নিসার’ ও ‘সিএমবি ভারত’-এর মতো কয়েকটি অভিযানে ইতিমধ্যেই দারুণ ভাবে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে নাসা ও ইসরোর মধ্যে। আর পাঁচ/সাত বছরের মধ্যে তা আরও এতটাই বেড়ে যেতে চলেছে যে তা সকলেরই নজর কেড়ে নেবে।
স্টেলটজ্নারের কথায়, ‘‘আমি সেই ভবিষ্যতের ছবিটা এখনই দেখতে পাচ্ছি। কারণ, তার প্রস্তুতি-তোড়জোড় গত কয়েক বছর ধরেই শুরু হয়ে গিয়েছে। আগামী দিনে চাঁদে ও মঙ্গলে যৌথ অভিযানে যেতে পারে নাসা ও ইসরো। শুক্রেও যৌথ অভিযানের সম্ভাবনা রয়েছে।’’
আরও পড়ুন- মঙ্গলের আকাশ ভরে যাবে ড্রোনে-কপ্টারে, জানাল নাসা
আরও পড়ুন- এ বার মঙ্গল অভিযানে নাসার বড় ভরসা ভারতের বলরাম
‘মার্স ২০২০ রোভার’ প্রকল্পের মূল কর্ণধার এও জানিয়েছেন, শুধুই নাসার সঙ্গে কেন, জাপানের মহাকাশ সংস্থা ‘জাক্সা’, এসা, এমনকী, রুশ মহাকাশ সংস্থা ‘রসকসমস’-এর সঙ্গেও হয়তো আগামী এক দশকে চাঁদ ও মঙ্গলে যৌথ অভিযানে যেতে পারে ইসরো।
মহাকাশ কারও একার নয়, গোটা সভ্যতার…
‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে স্টেলটজ্নার জানিয়েছেন, মহাকাশে মানবসভ্যতার অভিযান শুরু হয়েছিল কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে। তার কারণটা ছিল সেই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা। কিন্তু গত ৬০ বছরে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন মহাকাশ অভিযানের অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, মহাকাশকে কোনও দেশ বা বিশেষ কোনও রাষ্ট্রজোট তাদের ‘নিজেদের এলাকা’ মনে করলে মস্ত ভুল করবে। মনে রাখতে হবে, মহাকাশ গোটা সভ্যতারই ভবিষ্যত। পৃথিবীতে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার। ফুরিয়ে আসছে জ্বালানি। প্রচলিত জ্বালানির হাত থেকে পৃথিবীর পরিবেশকে বাঁচানোর জরুরি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ফুরিয়ে আসছে সহজে কম খরচে উত্তোলন করা যায়, সোনা, হিরে, প্ল্যাটিনামের মতো অতি মূল্যবান ধাতুর ভাঁড়ারও।
কম্পিটিশন নয়, কোঅপারেশন্স, কোলাবরেশন্স: স্টেলটজ্নার
স্টেলটজ্নারের কথায়, ‘‘উই নো মোর নিড কম্পিটিশন। উই জাস্ট নিড মোর কোঅপারেশন্স, মোর অ্যান্ড মোর কোলাবরেশন্স। যাবতীয় সংকট থেকে মুক্তি পেতে চাইলে সভ্যতাকে নির্ভর করতে হবে মহাকাশেরই উপর। আর তার জন্য প্রতিযোগিতা, রেষারেষির পথ থেকে সরে আসতে হবে বিভিন্ন দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলিকে। প্রয়োজন হবে উত্তরোত্তর আরও বেশি সহযোগিতা, সমঝোতা, সাহচর্য। আরও বেশি পারস্পরিক বোঝাপড়া, নির্ভরতা।’’
রক অ্যান্ড রোল গাইতে গাইতে মন মজল মহাকাশে!
স্টেলটজ্নার জানালেন, ছোটবেলা থেকে তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল না মহাকাশ নিয়ে। গানেই মজে থাকতেন দিন-রাতের বেশির ভাগ সময়। রক অ্যান্ড রোল খুব পছন্দের ছিল। কাছেপিঠে রক অ্যান্ড রোলের নামডাকওয়ালা শিল্পীরা এলেই ছুটে যেতেন তাঁদের গান শুনতে। শুনতে শুনতেই নিজেও এক দিন হয়ে উঠলেন রক অ্যান্ড রোল সিঙ্গার। পারফর্মার। তখন বয়স মেরেকেটে বছর কুড়ি। কলেজে পড়ছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং। এক রাতে স্টেজ শোয়ের পর ক্লান্ত হয়ে ফিরছিলেন বাড়িতে। হঠাৎই চোখ চলে গেল আকাশে ‘রায়ান’ নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে। অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন অনেক ক্ষণ।
স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামের অধিকর্তার কাছ থেকে জাতীয় পদক পাচ্ছেন অ্যাডাম স্টেলটজ্নার (বাঁ দিকে)। ক্যালিফোর্নিয়ায়।
বললেন, ‘‘কোথা দিয়ে যে ঘণ্টাখানেক সময় পেরিয়ে গিয়েছে জানি না। সম্বিৎ ফিরল মায়ের ফোন পেয়ে। বা়ড়ি ফিরব কখন, জানতে চাইলেন মা। বাড়ি ফিরতে ফিরতেই ঠিক করে ফেললাম, মহাকাশে পৌঁছনোর জন্যই এ বার সঁপে দেব নিজেকে। তার পর থেকেই মহাকাশ নিয়ে পড়শোনার শুরু। নাসার বড় বড় বিভিন্ন মিশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেছি গত ১৫/২০ বছর ধরেই। এখন বয়স ৫৫। দায়িত্ব পেলাম মার্স ২০২০ রোভার পারসিভের্যান্স-এর চিফ ইঞ্জিনিয়ারের।’’
‘এ বারের মঙ্গল অভিযান একেবারেই অভিনব’
এ বারের অভিযান নিয়ে গত ৪৫ বছরে মঙ্গলে নাসা মোট ৯টি ল্যান্ডার আর ৫টি রোভার পাঠাতে চলেছে।
‘‘কিন্তু এ বার আমাদের মঙ্গল অভিযান একেবারেই অভিনব। এমন কয়েকটি পরীক্ষানিরীক্ষা করা হবে, যা আগের অভিযানগুলিতে হয়নি। করা হবে মঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নুড়ি, পাথর সংগ্রহ করা হবে। যেগুলি পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে পরে, গবেষণার জন্য। আগামী দিনে মানুষ যাতে শুধু পদার্পণই নয়, লাল গ্রহে গিয়ে কিছু দিন কাটাতে পারে নিরাপদে, তার জন্য যা যা প্রয়োজনীয়, সেগুলি মঙ্গলে বানিয়ে নেওয়া সম্ভব কি না তারও পরীক্ষানিরীক্ষা চলবে এ বারের অভিযানে। এ সব আগের কোনও অভিযানে হয়নি। অন্য কোনও গ্রহে ওড়ানো হবে হেলিকপ্টার, এই প্রথম। যার ভাবনাটা প্রথম মাথায় এসেছিল এক ভারতীয়েরই (জে বব বলরাম) মাথায়’’, বললেন স্টেলটজ্নার।
৩৫ বছর আগে রক অ্যান্ড রোলের স্টেজ শো সেরে বা়ড়ি ফেরার পথে সেই রাত আমূল বদলে দিয়েছিল স্টেলটজ্নারের জীবনের গতিপথ। নাসার এ বারের মঙ্গল অভিযানও হয়তো তেমন ভাবেই লাল গ্রহে মানুষের পাকাপাকি ভাবে পদার্পণের মাইলস্টোন হয়ে যেতে চলেছে।
যার সূচনা হবে ১৫ বছর পর। মার্কিন মহিলা মহাকাশচারী মঙ্গলে পা ছোঁয়ালে।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
ছবি সৌজন্যে: নাসা।