টিএমটি: শিল্পীর কল্পনায়
কোনটা বেশি শক্তিশালী— বিজ্ঞান না রাজনীতি? কার ক্ষমতা বেশি— গবেষণা, না পরিবেশচিন্তা? ভারতে অবশ্য আমরা উত্তর পেয়েছি প্রশ্নগুলোর। পেয়েছি ইন্ডিয়া-বেস্ড নিউট্রিনো অবজ়ারভেটরি (আইএনও) তৈরির কিস্সায়। নিউট্রিনো হল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক কণা, যা ব্রহ্মাণ্ডজুড়ে ছোটাছুটি করছে। এই পৃথিবীর পাহাড়-পর্বত, মায় আমাদের দেহও, এফোঁড়-ওফোঁড় করছে, কোনও ক্ষতি না করেই। ক্ষতি করতে হলে অন্য কণার সঙ্গে বিক্রিয়া করতে হয়। নিউট্রিনো কারও সঙ্গে বিক্রিয়া করে না। এই বৈশিষ্ট্য নিউট্রিনোকে করেছে মহান। আবার, নিউট্রিনোর চরিত্র বুঝলে এই ব্রহ্মাণ্ডের অনেক রহস্যের সমাধান হয়। সেই জন্য ভারতীয় বিজ্ঞানীরা হাতে নিয়েছিলেন আইএনও প্রকল্প। ১৫০০ কোটি টাকার উদ্যোগ।
কী করা হবে? মাটির ১,২০০ মিটার গভীরে যন্ত্রপাতি সাজিয়ে বসে থাকবেন গবেষকরা। যন্ত্রে শনাক্ত হবে নিউট্রিনোর বৈশিষ্ট্য। তামিলনাড়ুর থেনি জেলায় এখন তৈরি হচ্ছে ওই গহ্বর। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পরে, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে, বিজ্ঞানীরা নেমেছেন কাজে। সে এক ইতিহাস।
নিউট্রিনো কণা গবেষণার জন্য বিখ্যাত দুই ল্যাবরেটরি। কানাডার সাডবারি নিউট্রিনো অবজ়ারভেটরি (এসএনও) এবং জাপানের সুপার-ক্যামিওকান্ডে ডিটেকটর। ও রকম গবেষণাগার যে ভারতেও গড়ে তোলা যায়, সে কথা ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বলে আসছিলেন সেই ১৯৮৯ সাল থেকে। অবশেষে ২০০১ সালে বিজ্ঞানীরা নিজেরা ভাগ করে নেন আইএনও তৈরি হলে কে কোন দিক সামলাবেন। ২০০২ সালে ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন (যে হেতু আইএনও-তে নেতৃত্ব দেবে যে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো, সবাই ওই কমিশনের অধীনস্থ) ঠিক করে আইএনও গড়া হবে। অর্থ জোগাবে পরমাণু শক্তিমন্ত্রক (কমিশন ওই মন্ত্রকের অধীন)। কোথায় গড়া হবে আইএনও? নীলগিরি পর্বতের সিংগারা।
প্রস্তাব আসা-ইস্তক পরিবেশকর্মী এবং বন্যপ্রাণীপ্রেমীরা আপত্তি তুললেন। অজুহাত? জায়গাটা টাইগার রিজার্ভ-সংলগ্ন। তা ছাড়া, হাতিরাও চলাফেরা করে ওই এলাকায়। আইএনও গড়া হলে বিশাল মালবাহী লরি চলাচল করবে হাইওয়ে দিয়ে। বাঘ এবং হাতির অসুবিধের উৎস হবে আইএনও। ২০০৯ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ জানিয়ে দিলেন, আইএনও গড়ার অনুমতি দেওয়া যাবে না।
তা হলে কোথায় হবে আইএনও? ২০১০ সালের শেষে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক জানাল, জায়গা দেওয়া হবে তামিলনাড়ুর থেনি জেলায়। ২০১২ সালের গোড়ায় ঘোষণামতো পাওয়া গেল জমি। আইএনও-র প্রধান মুখপাত্র মুম্বই-তে টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর বিজ্ঞানী নব কুমার মণ্ডল জানালেন, প্রাক-প্রকল্পের কাজ (রসিংগাপুরম থেকে পত্তিপুরম পর্যন্ত রাস্তা বানাতে সরকার থেকে ৬৬ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছে)। আইএনও গড়ার কাজ শেষ হবে ২০১৫ সালের মধ্যে। বেঁকে বসলেন কেরলের বর্ষীয়ান সিপিআই(এম) নেতা ভি এস অচ্যুতানন্দন। তাঁর দাবি, তামিলনাড়ু ও কেরলের বর্ডারে আইএনও গড়া যাবে না। পরিবেশ নষ্ট হবে। আর, আইএনও থেকে নাকি তেজস্ক্রিয়তা ছড়াবে। আইএনও-র সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা ওঁর অভিযোগের উত্তর দিলেন।
ইন্ডিয়া-বেস্ড নিউট্রিনো অবজ়ারভেটরি (আইএনও) তৈরির কাজ শুরু হয়েছে এত দিনে। কবে শেষ হবে, তা কে জানে
কেটে গেল আড়াইটা বছর। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অনুমোদন করলেন আইএনও। ২০ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা করল, আইএনও যে পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়েছে, তা বৈধ নয়। ২৬ মার্চ মাদ্রাজ হাইকোর্টের মাদুরাই বেঞ্চ ঘোষণা করল, আইএনও প্রকল্পে কাজ শুরু করা যাবে না। শুরুর আগে তামিলনাড়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অনুমতি নিতে হবে। কাটল আরও তিন বছর। ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক ‘স্পেশাল কেস’ হিসেবে আইএনও-কে ছাড়পত্র দিল।
রাস্তা তৈরি, খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে গত বছরের শেষে। কবে কাজ শেষ হবে, বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণা শুরু করবেন, তা এক্ষুনি বলা যাচ্ছে না। যে গবেষণা শুরু হতে পারত গত দশকের গোড়ায়, তা শুরু হবে হয়তো ১০-১২ বছর বিলম্বে।
আইএনও-র কথায় মনে পড়ছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাঙ্ক্ষিত আর এক মানমন্দিরের প্রসঙ্গ, যা বিরোধী আন্দোলনের চাপে বানচাল হতে চলেছে। আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের বিগ আইল্যান্ডে প্রস্তাবিত থারটি মিটার টেলিস্কোপ-এর কথা বলছিলাম। উদ্যোগের পুরোভাগে রয়েছে আমেরিকার ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সঙ্গে অর্থ ঢালার প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির কানাডা, চিন, জাপান এবং ভারত। ওই চার দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে চান ওই মানমন্দিরে।
টিএমটি হল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবিত তিনটে বৃহত্তম টেলিস্কোপের অন্যতম। আর দুটো হল জায়ান্ট ম্যাগেলান টেলিস্কোপ (জিএমটি) এবং ইউরোপিয়ান এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ (ই-ইএলটি)। তিনটে টেলিস্কোপই এখনকার বৃহত্তম দূরবিনগুলোর চেয়ে তিন গুণ বড়। জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় টেলিস্কোপের আকার একটা বড় ব্যাপার। এর আয়না যত বড় হবে, ততই তা দূরের জিনিস দেখতে পাবে। হিসেব বলছে, টেলিস্কোপে আয়নার ব্যাস তিন গুণ বাড়ালে তা মহাশূন্যে ন’গুণ বেশি দূরের বস্তু দেখতে পাবে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং রাতের পরিষ্কার আকাশের জন্য হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে লোভনীয়। ওখানে আগে গড়া হয়েছে ১৩টা মানমন্দির। সেগুলো কাজও করছে। তৈরি হলে চোদ্দো নম্বর মানমন্দির হত টিএমটি (এর আয়নার ব্যাস ৩০ মিটার বলে নাম ও রকম)। তৈরি হলে টিএমটি দেখতে পেত দূরে কোনও নক্ষত্র-আবর্তনকারী গ্রহ অথবা ব্রহ্মাণ্ডের অনেক দূর পর্যন্ত।
কিন্তু টিএমটি আদৌ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিগ আইল্যান্ডের আদিবাসীরা মনে করেন ওই দ্বীপ পবিত্র, টিএমটি গড়া হলে সেই পবিত্রতা নষ্ট হবে। টিএমটি-র প্রস্তাবিত স্থান হল মনা কেয়া পাহাড়। আন্দোলনকারীরা নিজেদের বলেন ‘কিয়াই’। মানে, ওঁরা হলেন পাহাড়টির ‘রক্ষক’। ঝামেলা শুরু প্রস্তাব থেকেই। টিএমটি গড়ার প্রথম চেষ্টা ২০১৫ সালে। ‘কিয়াই’দের আপত্তিতে সে চেষ্টা বানচাল। মামলা ওঁদের তরফে। ২০১৮ সালে হাওয়াই সুপ্রিম কোর্টের রায়— টিএমটি গড়ার প্রস্তাব বৈধ। তা অনুযায়ী, গত বছর জুলাই মাসে টিএমটি গড়ার সরঞ্জাম নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পাহাড়ে উঠতে গেলে ‘কিয়াই’দের তরফে পথ অবরোধ। পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি। ৩৮ জন গ্রেফতার।
‘কিয়াই’দের আশঙ্কা বা ভুল ধারণা অনেক। টিএমটি গড়তে পাহাড়ে ড্রিলিং করতে হবে, ডিনামাইট ফাটানো হবে, টিএমটি পরমাণু শক্তি ব্যবহার করবে। টিএমটি-কে আমেরিকা প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহার করবে, শত্রুদেশের ছোড়া মিসাইল ওখান থেকেই মহাশূন্যে ধ্বংস করা হবে— এ রকম কয়েকটি ভুল ধারণা। ও সব যে ভুল, তা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ‘কিয়াই’দের বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ।
গত জুলাইয়ের পর থেকে ছ’মাস ধরে চলেছে ‘কিয়াই’দের অভিনব প্রতিবাদ। মনা কেয়া-র হাইওয়ে-র ওপরেই ছাউনি গড়ে বসে আছেন ওঁরা। এই শীতে মাইনাস টেম্পারেচার উপেক্ষা করেও। ছাউনির মধ্যে বসেই গাইছেন গান, বাজাচ্ছেন বাজনা। মাঝে মাঝে শাঁখে ফুঁ। যেন মধ্যযুগে প্রবল ঠান্ডায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি। ছাউনিতে বসেই ‘কিয়াই’দের নেতা জোশুয়া লানাকিলা মাংগাউইল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আকাশের দিকে তাকানোর আগে মাটির দিকে তাকানো জরুরি।’
ইঙ্গিত স্পষ্ট। জ্যোতির্বিজ্ঞান নয়, পরিবেশ বড়। মাটি না আকাশ, কোনটা বড়? কোন দিকে তাকানো বেশি জরুরি?