Science

শেষে হেরেই গেলেন উসেইন বোল্ট?

শেষ পর্যন্ত হেরেই গেলেন উসেইন বোল্ট! সময়ের কাছে। দৌড়তে দৌড়তে কখনও ভাবেননি বোল্ট হেরে যাবেন সময়ের কাছে। টানা ৯ বছর ধরে সময়কে পিছনে ফেলে দিয়ে নিজেরই গড়া একের পর এক রেকর্ড ভেঙে গড়েছেন নতুন নতুন সময়ের রেকর্ড। আজ, রবিবার শেষ কিস্তি।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১৬:০৮
Share:

বিদ্যুৎ বোল্ট!

শেষ পর্যন্ত হেরেই গেলেন উসেইন বোল্ট! সময়ের কাছে। দৌড়তে দৌড়তে কখনও ভাবেননি বোল্ট হেরে যাবেন সময়ের কাছে। টানা ৯ বছর ধরে সময়কে পিছনে ফেলে দিয়ে নিজেরই গড়া একের পর এক রেকর্ড ভেঙে গড়েছেন নতুন নতুন সময়ের রেকর্ড। সেই সময়ের কাছেই যে তাঁকে হার মানতে‌ হবে, কে জানত?

Advertisement

ভুল বললাম। উসেইন বোল্ট নিজেও জানতেন সে কথা। অনেক দিন আগেই। তাঁকে যাঁরা গড়ে তুলেছিলেন, প্রতিটি দিন, প্রতিটি পল, অনুপলে যাঁরা তাঁর ওপর নজর রেখে চলেন, চলেছেন, সেই ক্রীড়া বিজ্ঞানী, চিকিৎসকরা বহু দিন আগেই বোল্টকে জানিয়ে দিয়েছিলেন এই নির্মম সত্যটা। জানিয়ে দিয়েছিলেন, এক সময় বোল্টকে হার মানতেই হবে, সময়ের কাছে।


ট্র্যাকে উসেইন বোল্ট

Advertisement

সেই সময়টা কত জানেন?

একশো মিটার কিছুতেই কোনও মানুষ কোনও দিন এখনকার সর্বাধিক ক্ষমতায় ৮.৬৩ সেকেন্ডের কম সময়ে দৌড়তে পারবে না। ওটাই স্প্রিন্টারদের ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ বা ‘এলওসি’। জাপানি জীববিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে মানুষের শারীরিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ মানাঙ্কগুলিকে কম্পিউটারে ফেলে অঙ্ক কষে দেখেছেন, ৮.৬৩ সেকেন্ডের চেয়ে কম সময়ে একশো মিটার দৌড়তে গেলে সেই স্প্রিন্টারের পায়ের হাড় একেবারে চুরচুর করে ভেঙে যাবে। পায়ের হাড়ের গঠন কাঠামো আর তার সর্বাধিক সহনশীলতা কিছুতেই স্প্রিন্টারের ওই ‘আলোর গতি’র অভিঘাত সহ্য করতে পারবে না। ফলে, ওই সময়ের ‘লাইন অফ কন্ট্রোলে’ই থমকে যেতে হবে উসেইন বোল্টকে।


টাইম স্কেলে বোল্টের ‘ভোল্ট-মিটার’


আর কত? হার মানার সময় এসে গেল!

এর মানে হল, বিরল প্রতিভা, কঠোর অনুশীলন, চিকিৎসা, বৈধ ওষুধ, বিশেষজ্ঞদের সঠিক সময়ে পরামর্শ ক্রীড়াবিদের শারীরিক কাঠামো বা তাঁর শৈশবের জিন কাঠামোকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে না। জিনের কারিকুরিকে (জিন এডিটিং বা পরিবেশ দিয়ে জিনকে প্রভাবিত করার যাবতীয় পদ্ধতি) এক সময় হার মেনে নিতেই হবে জন্মের সময় প্রতিটি মানুষের শরীরে ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজকর্ম শুরু করা জিনগুলির অদৃশ্য নিয়মের বেড়ি-বাঁধনের কাছে।

এমনটাই বলছেন ভারতের বিশিষ্ট জিন বিশেষজ্ঞ, ভেলোরের খ্রিস্টান মেডিক্যাল কলেজের অধিকর্তা অলোক শ্রীবাস্তব। প্রায় তাঁর সুরে সুর মিলিয়েও আজীবন ক্রীড়া বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণায় মগ্ন বিশিষ্ট ক্রীড়া চিকিৎসক কল্যাণ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘পুরোপুরি না হলেও, ক্রীড়াবিদের শৈশবের জিন কাঠামোকে বদলাতে পারে অনেকগুলি ফ্যাক্টর। তার মধ্যে রয়েছে, খাদ্য, ওজন সহ ও ওজন ছাড়া দু’ধরনের প্রশিক্ষণ, অনুশীলনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ক্রীড়া সরঞ্জাম, ক্রীড়াবিদদের ‘অ্যাটিটিউড’ আর তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা। তবে এর পরেও রয়েছে বেশ কয়েকটি ‘এক্স ফ্যাক্টর’ বা ‘আননোন ফ্যাক্টর’। দেখতে হবে অনুশীলনে বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়াকর্মের সময় কতটা করে অক্সিজেন নিতে পারেন ক্রীড়াবিদরা। সব ধরনের খেলার জন্য সেই পরিমাণটা সমান হয় না। সে কথাটা মাথায় রেখেই কোন ক্রীড়াবিদ কোন খেলায় গেলে তাঁর সাফল্য সর্বাধিক হবে, সেটা আঁচ করতে হবে জহুরিদের। এই ক্ষমতাটাকে কঠোর অনুশীলন, বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলা যায়। যেমন, কোনও প্রশিক্ষণ নেয়নি, এমন গড়পড়তা সুস্থ পুরুষ প্রতি মিনিটে ৩ হাজার ৬০০ সিসি অক্সিজেন নিতে পারেন। আর অ্যাথলেটিক্সের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এমন পুরুষ গড়ে প্রতি মিনিটে অক্সিজেন নিতে পারেন ৪ হাজার সিসি। পুরুষ ম্যারথনাররা প্রতি মিনিটে

অক্সিজেন টানতে পারেন ৫ হাজার ১০০ সিসি করে। আর কোনও খেলাধুলো করেন না, কোনও অনুশীলন, প্রশিক্ষণের ধার ধারেন না, এমন গড়পড়তা পুরুষ তাঁর বিশ্রামের সময় প্রতি মিনিটে বাতাস থেকে ২৫০ সিসি করে অক্সিজেন টানেন। বাতাস থেকে এই বাড়তি অক্সিজেন টেনে নেওয়ার ক্ষমতাটাই বাড়ে কঠোর অনুশীলন আর বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। আর সেটা বাড়লেই পারফরম্যান্স ভাল হয়। বাতাস থেকে অক্সিজেন টানার ক্ষমতা যত বাড়ে, ততই কোনও ক্রীড়াবিদের পারফরম্যান্স উন্নত থেকে উন্নততর হয়। এটা দেখে গিয়েছে অনুশীলন, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাতাস থেকে অক্সিজেন টানার ক্ষমতা অন্তত ২০ গুণ বাড়ানো যায় ক্রীড়াবিদদের। প্রশিক্ষণের সময়ের নিরিখে (সপ্তাহে দুই, চার বা সাত দিন) বাতাস থেকে কোনও ক্রীড়াবিদের অক্সিজেন টানার হারকে বলে ‘ভিও-টু ম্যাক্স’। এর ওপর নজর রেখেই কোনও স্প্রিন্টার, লং ডিসট্যান্স রানার, ম্যারাথনার, অ্যাথলিট, জিমন্যাস্টদের কোচিং দেওয়া উচিত।’’

কিন্তু ভারতে মোটেই এ ভাবে সব ক্রীড়াবিদের প্রশিক্ষণ হয় না। ‘স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া-ইস্ট জোন’ (সাই)-এর অ্যাথলেটিক্সের অবসরপ্রাপ্ত কোচ কুন্তল রায় বলছেন, ‘‘জমিতে কোনও ফসলের ভাল ফলনের জন্য প্রথমে প্রয়োজন হয় বীজের। তার পর দেখতে হয় সেটা কোন জমিতে ছড়ানো হবে। তার পর দিতে হয় ভাল সার। দিতে হয় ভাল পরিবেশ। তার পরেই সঠিক সময়ে সেই ফসলে মাঠ ভরে যেতে পারে।’’

আরও পড়ুন-

বিশ্বের পা মঙ্গলে, ভারত আলোর গতিতে ফিরে যাচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে!

চাইলেই ভাল স্প্রিন্টারকে কি আমরা বানাতে পারব পদকজয়ী ম্যারাথনার?

জিন, হরমোন, পরিবেশ পিছিয়ে রাখছে ভারতীয় অ্যাথলিটদের?

বীজের সন্ধান থেকে শুরু করে ফসল তোলা, কোনও ধাপেই বিজ্ঞানকে ভারতের ক্রীড়াক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে না।

ফলে, বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে বরবাদ হয়ে যাচ্ছে ভারতের বহু ক্রীড়া-প্রতিভা। অকালেই।

----------------------------------------------------------------------------------------

ঋণ স্বীকার: ক্রীড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানী কল্যাণ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা,

জিন বিশেষজ্ঞ মহেন্দ্র রাও, ‘ইনস্টেম’, বেঙ্গালুরু,

জিন বিশেষজ্ঞ অলোক শ্রীবাস্তব, খ্রিস্টান মেডিক্যাল কলেজ, ভেলোর

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement