ভাই আর বাবার সঙ্গে খোশমেজাজে অগ্নিজ।
স্টিফেন হকিং ও আইনস্টাইনের চেয়ে যার ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট বা আইকিউ দু’নম্বর করে বেশি, সেই অগ্নিজ লাউচিংড়ি আর পোস্ত পেলেই গোগ্রাসে মুখে তোলে ভাত। আর খুব ভালবাসে বিরিয়ানি আর চাইনিজ খেতে। সঙ্গে নানান রকমের মিষ্টি। জামাকাপড়েরও কোনও বাছবিচার নেই এক্কেবারে সাধারণ অগ্নিজের। ১৭ বছর বয়সেই গোটা বিশ্বকে অঙ্কে তাক লাগিয়ে দেওয়া অগ্নিজকে তার বাবা-মা দু’জনেই বলেন ‘পেটুক’। বাবা চিকিৎসক শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ‘‘ছেলে আমার রাক্ষস। যা পায় তা-ই খায়। জানেন, পার্ক স্ট্রিটে পিটার ক্যাটে চেলো কবাব খাবে বলে ৪০ মিনিট ঠায় বসেছিল চেয়ারে।’’
স্কটল্যান্ডে সেই অগ্নিজই দিনে-রাতে যখনই থাকে ঘরে, সব সময় খবর নেয় তার ১২ বছরের ভাই আরিয়ানের। আরিয়ান জন্মাবধি ভাল করে কথা বলতে পারে না, ডাউন সিন্ড্রোমের রোগী। অটিজমেরও। আধো আধো কথা বলা আরিয়ানকে ঘরে থাকলে সব সময় চোখে চোখে রাখে তার থেকে ৫ বছরের বড় অগ্নিজ। যেন ‘দাদাগিরি’। পরীক্ষা দিতে বিদেশে গেলেও রোজ মা’কে দিনে-রাতে বার কয়েক ফোন করে অগ্নিজ। মা’য়ের সঙ্গে দু’য়েক কথার পরেই বলে ‘‘ভাইকে দাও। কথা বলি। ও কেমন আছে?’’ আর বাড়িতে থাকলে তো কথাই নেই। জন্মাবধি অসুস্থ ভাই আরিয়ানকে জামা কাপড় পরিয়ে দেওয়া, খাওয়ানো সব নিজে হাতে করে অগ্নিজ। শুভায়ু ও তাঁর স্ত্রী প্রণীতাকে বুঝতেই দেয় না যে তাঁদের আরও একটি সন্তান আছে। আর বুঝতেই দেয় না আরেক ছেলে জন্মাবধি গুরুতর অসুস্থ।
শনিবারই কলকাতার নাকতলায় ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করেছে অগ্নিজ। অগ্নিজ ও তার ভাই আরিয়ান এখন দুর্গাপুরে বাবার মামার বাড়িতে। অগ্নিজের ঠাকুমা বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ভূতপূর্ব প্রধান মুকুল বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বুধবার তারা আবার নাকতলার বাড়িতেই আসবে এবং ১১ তারিখ পর্যন্ত কলকাতাতেই থাকবে।
এইটুকু বললেই আন্তর্জাতিক অঙ্ক অলিম্পিয়াডে এ বছর সোনাজয়ী ১৭ বছরের অগ্নিজ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে সব কিছু বলা হয়ে যায় না। আজ থেকে ঠিক বছর দু’য়েক আগে অগ্নিজ কী করেছিল জানেন? সেটা ২০১৬। অগ্নিজ আর আরিয়ানকে নিয়ে স্কটল্যান্ড থেকে শুভায়ু ও প্রণীতা কলকাতায় এলেন বড় ছেলের পৈতে দিতে। পৈতের অনুষ্ঠান হল নাকতলায়, ৩৮৫ নম্বর গাঙ্গুলিবাগানে, মেঘা অ্যাপার্টমেন্টের ঠাকুমা-ঠাকুরদার ফ্ল্যাটে। সেখানে এক পিসিও থাকেন অগ্নিজের। পৈতেতে উপহার হিসেবে লাখখানেকেরও বেশি টাকা পেয়েছিল অগ্নিজ। একটা ১৫ বছরের ছেলে অতগুলো টাকা দুম করে হাতে পেলে কী করে? ওড়ায়, তাই তো? অগ্নিজ কী করেছিল জানেন? চলে গিয়েছিল হাড়কাটা গলিতে। সেখানে যে সংগঠন অনাথ শিশুদের লেখা পড়া শেখায়, দিন-রাতের একটা বড় অংশ রাখে সুস্থ পরিবেশে, সেই ‘হামারি মুসকান’-এর হাতে গিয়ে তুলে দিয়ে এসেছিল পৈতেতে উপহার হিসেবে পাওয়া সব টাকা। দুর্গাপুরের বিধাননগরের মামারবাড়িতে বসে অগ্নিজের বাবা শুভায়ু বললেন, ‘‘২০০০ সালের পয়লা অক্টোবর আলিপুর নার্সিংহোমে জন্ম অগ্নিজের। খুশি ছিলাম না বলে সেই সময়ে শিমলায় ডাক্তারির চাকরি ছেড়ে আমরা চলে আসি নাকতলায়। জন্মের পর পৌনে দু’বছর অগ্নিজ ছিল কলকাতাতেই। ২০০২-এর সেপ্টেম্বরে আমরা চলে যাই স্কটল্যান্ডে।’’ প্রথমে স্কটল্যান্ডের আয়ারশায়ারে গিয়ে একটি সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারের কাজ শুরু করেন অগ্নিজের বাবা। তার পর সেখান থেকে গ্লাসগোয়ে। ২০১১ সালে গ্লাসগোর অ্যাবার্ডিন হসপিটালে কনসালটেন্ট চিকিৎসক হন শুভায়ু।
আরও পড়ুন: কেন বাঙালির হাতে উঠছে না ফিল্ডস মেডেল, অ্যাবেল প্রাইজ
কবে থেকে অগ্নিজের মধ্যে এই গণিত প্রতিভার হদিশ মিলল?
শুভায়ু বললেন ‘‘তিন সাড়ে তিন বছর বয়সে যখন ও খুব বায়না আর কান্নাকাটি করত, তখন আমি মুখে মুখে ওকে এক-দুই-তিন গোনা শেখাতাম। অবাক হয়ে দেখতাম এক-দুই-তিন-চার বললেই ওর কান্না থেমে যেত, বায়নাও। একরকম খেলায় ডুবে যেত। তার পর চার সাড়ে চার বছর বয়সে ওকে ডাইনোসরের একটা পোস্টার এনে দিয়েছিলাম। তার পর নিজেই নানা রকমের ডাইনোসরের ছবি এঁকে আমাকে বলত, এই ডাইনোসরের প্রজাতির নাম এই, এর এত যুগ আগে ছিল। ওর যখন বয়স ছয় সাড়ে ছয় তখন ওকে কিনে দিয়েছিলাম রায়ায়নিক মৌলের পর্যায় সারণি (পিরিয়ডিক টেবিলের একটা ক্যালেন্ডার)। ১৫ দিনের মধ্যে দেখলাম ও গড়গড় করে বলে যাচ্ছে ওই টেবিলের গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত কোন মৌলিক পদার্থ কোন স্থানে আছে। তাদের আগে পরে কারা কারা আছে? তাদের নিজেদের রাসায়নিক ধর্ম কী কী, মুখস্থ বলে যাচ্ছে।’’
উইয়্যার্ড ম্যাথ (Weird Math) বইটি লঞ্চের সময় গ্লাসগো-তে ভাই আর ডক্টর ডেভিড ডার্লিংয়ের সঙ্গে অগ্নিজ।
অগ্নিজের মা প্রণীতার অভিজ্ঞতা কী রকম?
প্রণীতা বললেন ‘‘ও যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, তখন গ্লাসগোর স্কুল ‘গ্রুভ অ্যাকাডেমি’র শিক্ষক-শিক্ষিকারা ওকে অঙ্কের ক্লাসের জন্যে পাঠাতেন ক্লাস এইটের ছাত্রদের ঘরে। ২০১২ সালে ব্রিটেনের সব শিশুদের একটি আইকিউ পরীক্ষা নেয় ‘মেন্সা’ নামের একটি আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সংগঠন। সেই পরীক্ষায় স্টিফেন হকিং ও আইনস্টাইনের চেয়ে অগ্নিজের আইকিউ দেখা যায় দু’ নম্বর করে বেশি। ১৬২। আমরা অবাক হয়ে যাই।’’
অগ্নিজের বাবা আরও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন এক জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করা খ্যাতনামা বিজ্ঞান লেখক ডেভিড ডার্লিঁয়ের কথা শুনে। শুভায়ু বললেন ‘‘আমার বিদ্যেবুদ্ধি দিয়ে ছেলেকে পড়াতে পারব না বুঝে ছেলেকে অঙ্ক শেখাতে ডার্লিংয়ের কাছে। ছ’মাস পর ডার্লিং বললেন ওঁর যা বিদ্যেবুদ্ধি, ক্ষমতা তা দিয়ে অগ্নিজকে অঙ্ক শেখানো সম্ভব নয়।’’
আরও পড়ুন: অঙ্কে বিশ্বজয় বঙ্গসন্তানের, নিখুঁত স্কোরে আনলেন সোনা
২০১৫ সালে অগ্নিজকে সঙ্গে করেই একটি বই লিখতে শুরু করেন এই ডার্লিং। যে বইটি এ বছরে জুলাইয়ে ভারতে প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের নাম উইয়্যার্ড ম্যাথ (Weird Math)। আগামী বছরে মার্চে বেব়বে অগ্নিজের লেখা দ্বিতীয় বই উইয়্যার্ডার ম্যাথ (Weirder Math)। আর ২০২০ তে বেরবে অগ্নিজের তৃতীয় বই উইয়্যার্ডেস্ট ম্যাথ (Weirdest Math)।
অগ্নিজ বলে, ‘‘আমি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে বিশুদ্ধ গণিত নিয়েই পড়তে ও গবেষণা করতে চাই। শিক্ষকতা বা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো কোনও লোভনীয় পেশায় যেতে চাই না। আর আমার এখন অঙ্কের যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে তার নাম ‘কম্বিনাটোরিক্স’ (Combinatorics)।’’
ছবি: শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়