স্টিফেন হকিং। ফাইল চিত্র।
চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি মানুষটিকে। স্বয়ংক্রিয় হুইলচেয়ারে বসে রয়েছেন। যেন কল্পনার ভারে মাথাটা সামান্য কাত হয়ে রয়েছে। ছবিটা এতই পরিচিত, বোধ হয় ছোট্ট শিশুও বলে দেবে, মানুষটি স্টিফেন হকিং। ১৪ মার্চ ২০১৮ ছিয়াত্তর বছর বয়সে চলে গেলেন তিনি। অথচ, মাত্র একুশ বছর বয়সে জেনেছিলেন, আর বড়জোর দু’বছর তাঁর পরমায়ু। ধন্যবাদ জানাই সে সব ডাক্তারদের যাঁরা এই বিজ্ঞানীকে দীর্ঘ জীবনদান করেছিলেন। সেই সুবাদেই সারা পৃথিবী দেখল এক অসামান্য প্রতিভা আর হার না মানা মানসিকতার যুগলবন্দি।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৪২। সমাপতন বোধহয় মনীষীদের জীবনেই ঘটে। তিনশো বছর আগে এই দিনটিতেই গ্যালিলিও প্রয়াত হন। আবার ১৪ মার্চ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্মদিন। আগামী বছর থেকে বিশ্ববাসী আইনস্টাইনের জন্মদিন ও হকিংয়ের মৃত্যুদিন এক সঙ্গে পালন করবে। আসলে গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন আর হকিং নামগুলি এক সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তাঁদের কাজের পরম্পরার জন্য।
কিন্তু হকিংয়ের কাজটা কী? প্রচলিত ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে এক মহা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। বিস্ফারিত বস্তুপিণ্ড মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের চেনা-জানা পদার্থের থেকে এই বস্তু কিন্তু আলাদা। বিস্ফোরণের অপরিসীম তাপ ও চাপ এদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণায় ভেঙে রেখেছে। মহাকর্ষ বল এদের এক জায়গায় টেনে জড়ো করছে। জন্ম নিচ্ছে নতুন নক্ষত্রমণ্ডলী। সূর্যের মতো নক্ষত্র, সূর্যের চেয়ে আকারে বড় বা ছোট— নক্ষত্রদের এক দিন মৃত্যু হবে। সূর্যের চেয়ে ছোট নক্ষত্রের মৃত্যুর জবানবন্দি রচনা করেছেন সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর, যাকে আমরা জানি ‘চন্দ্রশেখর সীমা’ নামে।
বড় নক্ষত্রেরা ভেঙে যায় হকিং-এর নির্দেশ করা নিয়মে। সূর্যের চেয়ে অনেক বড় নক্ষত্রেরা (সুপারনোভা) ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে শেষ হয়। নক্ষত্রের অবশিষ্ট অংশ মহাকর্ষের টানে ছোট হতে শুরু করে। বহু সূর্যের ভর এক সঙ্গে জুড়ে তৈরি হয় এক বস্তু যার ভিতরের মহাকর্ষের টান এতখানি যে সেখান থেকে আলোও বেরিয়ে আসতে পারে না। আর যেখান থেকে আলো পর্যন্ত আসতে পারে না, সে তো অন্ধকার। একেই বিজ্ঞানীরা বলেন ‘ব্ল্যাকহোল’ বা কৃষ্ণগহ্বর। স্টিফেন হকিংয়ের উল্লেখযোগ্য কাজ এই কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে।
পদার্থবিদ্যা বলে, দু’টি কৃষ্ণগহ্বর যদি মহাবিশ্বে কাছাকাছি আসে তবে একটি অন্যটিকে গ্রাস করতে উদ্যত হবে। এই সময়ে প্রচুর শক্তি বিনিময় ঘটবে। এত দিন আমরা জানতাম, কৃষ্ণগহ্বর থেকে কিছু ফেরত আসে না। কিছু ফিরিয়ে দেওয়া তার ধর্মে নেই। আগেই বলেছি, তার প্রবল টান আলোই উপেক্ষা করতে পারে না। এখানেই নতুন কাজ করলেন হকিং। তবে একা নন, সঙ্গে ছিলেন রজার পেনরোজ। হকিং এবং পেনরোজ জুটি দেখালেন, এই ফিরিয়ে না-দেওয়ার ধারণা ঠিক নয়। কৃষ্ণগহ্বর কিছু বিকিরণ ফিরিয়ে দেয়, যা ঘটে ওই শক্তি বিনিময়ের সময়ে। এই কাজ করতে গিয়ে ‘থিয়োরি অব রিলিটেভিটি’ এবং ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্স’ মিশিয়ে দিলেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন, প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন
আমরা জানি, ‘থিয়োরি অব রিলেটিভিটি’ মহাবিশ্বে গ্রহ-নক্ষত্রের চলন-সহ নানা বিষয় ব্যাখ্যা করে। আর ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্স’ কণা-পদার্থবিজ্ঞানের গভীরে গিয়ে কাজ করে। কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই দুই বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে নতুন দিশা জোগালেন হকিং। এমনই মৌলিক ছিল এই কাজ যে প্রথমে নিজের আবিষ্কার নিজেই বিশ্বাস করতে পারেননি, এমনই জানিয়েছেন স্বয়ং হকিং।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি এই কাজ পদার্থবিদ্যার জগতে ঝড় তোলে। শুরু হয় নতুন গবেষণা। বিজ্ঞানী হকিংয়ের নামে এই বিকিরণের নাম ‘হকিং রেডিয়েশন’। এ কাজের জন্য তিনি নানা পুরস্কার পেয়েছেন। পদার্থবিজ্ঞানের জগতে কিংবদন্তী পর্যায়ে পৌঁছে যান। কিন্তু নোবেল পুরস্কার তিনি পাননি। কারণ, ‘হকিং রেডিয়েশন’ শনাক্ত করার মতো প্রযুক্তি এখনও তৈরি হয়নি। আর পরীক্ষায় তত্ত্ব প্রমাণিত না-হলে নোবেল মেলে না।
তবে শুধু তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার গবেষণাই নয়, বিজ্ঞান জনপ্রিয় করতেও হকিংয়ের অবদান অনস্বীকার্য। লিখেছেন ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’, যে বই ৪০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিক্রি হয়েছে ১০ কোটিরও বেশি। এ ছাড়া, লিখেছেন ‘ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’, ‘অন দ্য শোল্ডার্স অব জায়ান্টস’ ইত্যাদি।
ছিলেন সামাজিক বিষয়েও সচেতন। আমরা তাঁকে চিনি ভিয়েতনাম ও ইরাক যুদ্ধের প্রতিবাদী হিসেবে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিবাদী মানবদরদী বিজ্ঞানী হিসেবে। আজকের বিধ্বস্ত দুনিয়ায় তাঁর বার্তা— ‘There is a fundamental difference between religion, which is based on authority, and science, which is based on observation and reason. Science will win because it works’ (কর্তৃত্ববাদ থেকে তৈরি হওয়া ধর্ম এবং পর্যবেক্ষণ ও যুক্তি থেকে জন্মানো বিজ্ঞানের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বিজ্ঞান জিতবে কারণ তা কার্যকরী)।
লেখক এমইউসি উইমেন্স কলেজের পদার্থবিদ্যার প্রাক্তন শিক্ষক