ত্রয়ী: বাঁ দিক থেকে, চিরঞ্জীব পাল, সুশান্তশেখর অধিকারী ও দেবারতি মুখোপাধ্যায়।
শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞানের ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্যই বলা হোক বা সৃষ্টিশীল উত্তরাধিকার, সমানে বহন করে চলেছে কলকাতা। প্রায় একশো বছর আগে এই শহরে বসেই কালাজ্বরের ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। এ বার সেই শহরেরই এক দল গবেষক নতুন দিশা দেখাচ্ছেন কালাজ্বরের চিকিৎসায়।
কালাজ্বরের চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ধরেই যে-ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। একটি ওষুধ আবার শিরায় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দিতে হয় এবং তার জন্য চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক চিরঞ্জীব পাল এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক সুশান্তশেখর অধিকারীর নেতৃত্বে এক দল গবেষক ফেরোসেনিলকুইলোনিন নামে যে-ওষুধ আবিষ্কার করেছেন, তা সাধারণ ওষুধের মতোই মুখ দিয়ে খাওয়া যাবে। সর্বোপরি নতুন ওষুধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই।
বাঙালি বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়টি ‘জার্নাল অব মেডিক্যাল কেমিস্ট্রি’ নামে আমেরিকার এক গবেষণা পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। চিরঞ্জীববাবু জানান, তাঁরা পেটেন্টের আবেদন করেছেন। সেটি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ওষুধের স্তরে নিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। বস্তুত, ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কারের পরে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণে এলেও মালদহ, মুর্শিদাবাদ জেলা এবং বিহারের সমস্তিপুর-সহ কিছু এলাকায় এখনও এই রোগের প্রকোপ রয়েছে।
আরও পড়ুন: দ্রুত বাড়ছে সংক্রমণ, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, স্বীকার করল ব্রিটেন
গবেষণাপত্রটির অন্যতম লেখক, ওই বিজ্ঞানী দলের সদস্য দেবারতি মুখোপাধ্যায় এবং মহম্মদ ইউসুফ। দেবারতিদেবী জানান, কালাজ্বর দেখা যায় মূলত অতিদরিদ্র শ্রেণির মধ্যেই। বিশেষত যাঁরা মাটির ঘরে বসবাস করেন। কারণ, কালাজ্বরের বাহক বেলেমাছি মাটির দেওয়ালেই বাসা বাঁধে। বর্তমানে এই রোগের যে-সব দামি এবং শিরার মাধ্যমে দেওয়ার ওষুধ চালু আছে, একেবারে প্রান্তিক স্তরের ওই বাসিন্দাদের পক্ষে তার সুযোগ নেওয়া সম্ভব নয় আর্থিক কারণেই। হাসপাতালেও ভর্তি হওয়া সহজ নয়। অন্যান্য ওষুধ যকৃৎ, কিডনির মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গে কুপ্রভাব ফেলে। তা ছাড়া, দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে শরীরে ওষুধগুলির ক্রিয়াদক্ষতা কমে যায়, যাকে বলা হয় ‘রেজ়িস্ট্যান্স’ তৈরি হওয়া। তাঁদের আবিষ্কৃত ফেরোসেনিলকুইলোনিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এবং তা জলে দ্রবীভূত হয়ে যায়। ফলে অনেক সহজে সেই ওষুধ খাওয়া যেতে পারে এবং বাজারে তার দামও হতে পারে বেশ কম। ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকেও সেটি উপযোগী হবে বলেই জানাচ্ছেন দেবারতিদেবীরা।
আরও পড়ুন: টিকা-জুজু দেখালেন প্রেসিডেন্ট!
চিরঞ্জীববাবু জানান, ২০১২-১৩ সালে তাঁদের গবেষণা শুরু হয়েছিল। নানা ধাপ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত এই আবিষ্কার করেছেন তাঁরা। তাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন সোমাদিত্য দে, সন্দীপন চক্রবর্তী এবং অঙ্কুর চৌধুরী নামে আরও তিন গবেষক। “শুধু ওষুধ আবিষ্কার করে ভেক্টরবাহিত রোগ নির্মূল করা সম্ভব নয়। তার জন্য চাই ভেক্টর ম্যাপিং। কিন্তু এ রাজ্যে সেই কাজ হয় না বললেই চলে,” বলেন চিরঞ্জীববাবু।