কে বলল সময় পিছনের দিকে ছোটে না? ভারত দেখিয়ে দিল, সময় শুধুই সামনের দিকে এগিয়ে চলে না! সময় পিছনেও ছোটে!
গোটা বিশ্ব যখন প্রায় ‘মঙ্গল বিজয়’ করে ফেলল খেলাধুলোয়, তখন ভারত দুদ্দাড়িয়ে ছুটে চলেছে প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি বছর আগেকার সময়ে! যখন পৃথিবীর জন্ম হচ্ছে। সৃষ্টির সময় আর যা-ই হোক, খেলাধুলো তো ছিল না!
বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে সময়ের নিরিখে কোটি কোটি বছর পিছিয়ে পড়লে কী হবে, অলিম্পিক্স, এশিয়াড, কমনওয়েলথ গেমসের মতো আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চগুলিতে কিন্তু ‘সোনার মারীচ’ ধরার স্বপ্ন দেখায় খামতি নেই ভারতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রের কর্তাব্যক্তিদের। ঘাসে শুয়ে চাঁদে অট্টালিকা বানানোর স্বপ্ন দেখার সাহসে অন্তত ঘাটতি নেই ভারতীয়দের! এর পরেও কি বলা যাবে, ‘বিশ্বে অন্য অভাব অনেক আছে, শুধু নিন্দুক আছে যথেষ্টই’?
শুরু সেই শৈশবে। কার্ল লুইস।
গোটা বিশ্ব শুরুটা করে তিন থেকে চার বছর বয়সে। আমরা শুরু করি ১৭/১৮ বা ১৯-এ। স্প্রিন্ট, দূর পাল্লার দৌড়, ম্যারাথন, হেপটাথেলন, স্টেপ্ল চেজ, পেন্টাথেলন, অ্যাথলেটিক্সের মতো ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড’ আর ভারোত্তলন, জিমন্যাস্টিক্সের মতো ইনডোর গেমসের সব ক্ষেত্রেই ভারত ছুটছে পিছনের দিকে। তার ফলে, অলিম্পি
তাঁরা বলছেন, আমরা সফল হতে পারছি না নিজেদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রেই আমাদের ‘গোড়ায় গলদ’টা থেকে যাচ্ছে বলে। আর সেই ফাঁকটা দিন কে দিন আরও বড় হচ্ছে। বৃহত্তর হচ্ছে।
সল্টলেকে স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ায় (সাই) প্রশিক্ষণ
‘স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া-ইস্ট জোন’ (সাই)-এর অ্যাথলেটিক্সের অবসরপ্রাপ্ত কোচ কুন্তল রায় বলছেন, ‘‘ক্রীড়া প্রতিভা খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমরা কোনও দিনই বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিইনি। এখনও দিচ্ছি না। ক্রীড়া প্রতিভা খোঁজা আর তাঁদের ‘গ্রুমিং’ বা পালিশ করার জন্য নিয়মিত ভাবে চিকিৎসক, ক্রীড়াবিজ্ঞানী, জিন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কে থাকা একটি বিশেষ ধরনের নিউরন। যার নাম- মোটর নিউরন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ওই মোটর নিউরনগুলির দু’টি জিনিসকে বদলানো যায়। বাড়ানো-কমানো যায়। একটা তার ‘এবিলিটি’ বা সক্ষমতা। যাকে বলে ‘মোটর নিউরন এবিলিটি’। অন্যটি তার ‘কোয়ালিটি’ বা গুণাগুণ। একে বলে ‘মোটর নিউরন কোয়ালিটি’। মোটর নিউরন এবিলিটির রয়েছে ৫টি অংশ। শক্তি (স্ট্রেংথ), গতি (স্পিড), সহনশীলতা (এনডিওরেন্স), নমনীয়তা-চলনশীলতা-ক্ষিপ্রতা (ফ্লেক্সিবিলিটি-মোবিলিটি-এজিলিটি) ও ক্ষমতা (পাওয়ার)। আর মোটর নিউরন কোয়ালিটির থাকে দু’টি অংশ। দক্ষতা (স্কিল) ও পদ্ধতি বা কৌশল (টেকনিক)। মোটর নিউরনের সবক’টি এবিলিটি ও কোয়ালিটি একই সঙ্গে গড়ে ওঠে না। তারা গড়ে ওঠে ধাপে ধাপে। এবিলিটির মধ্যে প্রথমেই তিন বছর বয়স থেকে ক্ষমতা বাড়তে শুরু করে। তার পর বাড়তে শুরু করে গতি। ৬ থেকে ৮ বছর বয়সের মধ্যে। এর পর ৮ থেকে ৯ বছর বয়সের মধ্যে একটু একটু করে বাড়তে শুরু করে নমনীয়তা, চলনশীলতা, ক্ষিপ্রতা। তার পরেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শক্তি বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করে দেয় মোটর নিউরনগুলি। ৯ থেকে ১১ বছর বয়সের মধ্যে। তার মানে, মোটামুটি ১১ বছর বয়সের মধ্যেই মোটর নিউরনের এবিলিটির চারটি অংশ মোটামুটি ভাবে তৈরি হয়ে যায়। বাকি থাকে শুধু একটি অংশ। তার নাম সহনশীলতা।
মস্তিষ্কের সেই মোটর নিউরন। আমাদের কাজকর্মের নিয়ন্ত্রক।
কিন্তু সেটাকে বাড়ানোর আগেই বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া মোটর নিউরনের কোয়ালিটির দু’টি অংশ- স্কিল আর টেকনিককে বা়ড়াতে শুরু করে দেয় ১১ থেকে ১৩ বছর বয়সের মধ্যে। আর সেটা হয়ে গেলেই এবিলিটির বাকি অংশ- সহনশীলতাকে বাড়ানোর কাজে মন দেয় মোটর নিউরনগুলি। সেটা ১৬/১৮ বা ২০ বছর বয়স পর্যন্ত চলে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে চলে মোটর নিউরনের এবিলিটি বাড়ানোর কর্মযজ্ঞ চলার সময়েই। পেশিগুলি গড়ে উঠতে শুরু করে একটু একটু করে। শরীরের এই অঙ্ক বা বিজ্ঞানটাকে বুঝে নিয়েই খুঁজে পাওয়া ক্রীড়া প্রতিভাদের গড়ে তোলার কাজে হাত দেওয়া উচিত। না হলে মাটির তাল পেলেও ঠিকঠাক ভাবে মূর্তি গড়া যাবে না। সেই প্রতিভাগুলি হয়তো খুব অল্প বয়সে ভেল্কি দেখিয়ে চমকে দেবে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে সেই সাফল্যকে ধরে রাখতে পারবে না বা সেই সাফল্যের মান আরও বাড়াতে পারবে না। এইখানেই বড় ভূমিকাটা থাকে জহুরির।’’
স্প্রিন্টার, ম্যারাথনার: প্রয়োজনীয় শক্তি তৈরি হচ্ছে দু’ভাবে
কুন্তলবাবুর কথারই প্রতিধ্বনি শুনলাম ক্রীড়াবিদদের মুখে।
হেপটাথেলনে এক সময়ের সাড়াজাগানো ক্রীড়াবিদ ক্স, এশিয়াড, কমনওয়েলথ গেমসের মতো আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চগুলিতে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের পদক জয়ের স্বপ্নটা শেষ পর্যন্ত স্বপ্নই থেকে যায়। থেকে যাচ্ছে। এমনটাই বলছেন ক্রীড়াবিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, জিনতত্ত্ববিদ আর বায়োলজিস্টরা। বলছেন দীর্ঘ দিন ধরে খেলাধুলোয় জড়িত বিশিষ্ট মানুষজন।সোমা বিশ্বাস বললেন, ‘‘যেখানে বিদেশে তিন/চার বছর বয়স থেকেই প্রতিভা খুঁজে নিয়ে তাদের বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়, সেখানে আমার ক্ষেত্রেই তো অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমার শুরুটা হয়েছিল ১৭ বছর বয়সে। মানে, যখন হওয়া উচিত, তার চেয়ে আরও ১৪ বছর পর। বেসিক ট্রেনিংটা তার অনেক আগে না হয়ে থাকলে খুবই অসুবিধা হয়। আন্তর্জাতিক মান বা ভিন দেশের সমবয়সী প্রতিযোগীদের চেয়ে প্রয়োজনীয় শারীরিক গঠনের নিরিখে বেশ কিছুটা পিছিয়ে থাকতে হয়।’’
অক্সিজেনের প্রয়োজন: কোথায়, কতটা
একই কথা শোনা গেল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চে অংশ নেওয়া প্রতিভাময়ী জিমন্যাস্ট প্রণতি নায়েকের মুখে। প্রণতির কথায়, ‘‘যে সময়ে আমার জিমন্যাস্টিক্সটা শুরু করা উচিত ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি বয়সে আমি তা শুরু করেছি। আমি শুরু করেছিলাম ৯/১০ বছর বয়সে। এখন ২১। এর মানেটা হল, প্রশিক্ষণ শুরুর নিরিখে বয়সের যে আন্তর্জাতিক মান রয়েছে, আমি তার চেয়ে অন্তত ৬/৭ বছর পিছিয়ে থেকে শুরু করেছি। গাছে ফল পাকতো তো একটা সময় লাগে। হুট করেই তো আর গাছে ফল এসে যায় না। তেমনই জিমন্যাস্টিক্সে একটানা ৫/৬ বছর নিবিড় অনুশীলন না করলে আন্তর্জাতিক মান তো দূর অস্তই, জাতীয় মানও ছোঁয়া যায় না। বোঝার ওপর শাকের আঁটি, প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের বিভিন্ন অ্যাপারেটাসের হাল। এমন কিছু জিমন্যাস্টিক্স রয়েছে, যার অনুশীলনের জন্য সর্বাধুনিক অ্যাপারেটাস যা যা লাগে, তার সবক’টা তো পাওয়ার আশা করি না। কিন্তু যেগুলো রয়েছে, সেই সব অ্যাপারেটাস দিয়েও অনুশীলন করা যায় না। সেগুলোর বেশির ভাগই ভেঙে বা অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে।’’
ডেকাথেলনের এক সময়ের মেগাস্টার: ডালে থম্পসন
এই ঠিক বয়সে প্রশিক্ষণের ধাপগুলিতে যে বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ম-নীতিগুলো মেনে অনুশীলনের সুযোগ পাচ্ছেন না অ্যাথলিট বা জিমন্যাস্টরা, আগামী দিনে আন্তর্জাতিক ইভেন্টগুলিতে অংশ নিয়ে তারই খেসারত দিতে হচ্ছে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের।
ভেলোরের খ্রিস্টান মেডিক্যাল কলেজের অধিকর্তা, দেশের বিশিষ্ট জিন বিশেষজ্ঞ অলোক শ্রীবাস্তব বলছেন, ‘‘আমাদের শরীরে যাবতীয় কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে জিন। তা সে মস্তিষ্কের মোটর নিউরনই হোক বা অন্য নিউরনগুলো। জন্মের পর (আরও সঠিক ভাবে বললে, গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের মস্তিষ্ক গড়ে ওঠার পর থেকেই) মোটর নিউরনের বিকাশের যে পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো থাকে, বয়সের সীমা ধরে ধরে সেই প্রতিটি ধাপের বিকাশ ও তাদের কাজকর্মের প্রতিটি পদক্ষেপই থাকে জিনের কড়া নজরে। আর প্রতিটি ধাপ বা তার প্রতিটি কাজের ওপর নজরদারির জন্য নির্দিষ্ট জিন সিকোয়েন্সিং বা জিন-সজ্জা থাকে। থাকে নির্দিষ্ট জেনেটিক অর্ডার বা জিনের নিজস্ব কিছু নিয়ম। কে আগে কাজ করবে, কে আগের কাজের গতি বাড়াবে, কে পরের কাজটা আগে করার ভুলটা ধরিয়ে দেবে, সেই সব দায়িত্বই জিনগুলোর মধ্যে একেবারে গাণিতিক নিয়মে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেওয়া থাকে। ফলে, মস্তিষ্কের মোটর নিউরনের ‘এবিলিটি’ আর ‘কোয়ালিটি’র ধাপগুলোয় গন্ডগোল হয়ে গেলে, সেই জিন-সজ্জায় ‘ডিসটর্শন’ হয় বা জিন-সজ্জায় ‘ঝাঁকুনি’ লাগে। তাতে পরে বিস্তর পরিশ্রম, অনুশীলন করলেও ‘বিব্রত’ জিনগুলোর সে ভাবে ‘মন ফেরানো’ যায় না। সেটাই ভবিষ্যতে অ্যাথলিট বা জিমন্যাস্টদের প্রত্যাশিত মানে পৌঁছতে দেয় না।’’
মাইকেল ফেল্পস
এই জন্যই সবার আগে প্রয়োজন একেবারে শৈশবে (৩/৪ বছর বয়স) ক্রীড়া প্রতিভার সন্ধান। তার পরের প্রয়োজনটা হল, ক্রীড়াক্ষেত্রে কোন দিকে গেলে তার পারফরম্যান্স সবচেয়ে ভাল হতে পারে, সে ব্যাপারে সঠিক সময়ে সেই প্রতিভাকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ দেওয়া।
বেঙ্গালুরুর ‘ইনস্টিটিউট অফ স্টেম সেল বায়োলজি অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন’ (ইনস্টেম)-এর জিন বিশেষজ্ঞ মহেন্দ্র রাওয়ের কথায়, ‘‘স্টেফি গ্রাফ অত বড় টেনিস প্লেয়ারই হতে পারতেন না, যদি দু’বছর বয়সে তাঁর পারিবারিক চিকিৎসক স্টেফির মা, বাবাকে না বলতেন, ‘‘এই বাচ্চা মেয়ের হাতের কব্জির গঠন এত ভাল, এ বড় হয়ে টেনিস প্লেয়ার হবেই। মেয়েকে টেনিস খেলাবেন। তার মানে, ভাল টেনিস প্লেয়ারের কব্জির গঠন যেমন হওয়া উচিত, আর তার জন্য যে জিনগুলোর বড় ভূমিকা থাকে, তাদের সক্রিয়তা ওই একরত্তি স্টেফির শরীরে শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেটাই স্টেফির শরীরের জিন সিকোয়েন্সিং।
স্টেফি গ্রাফ
ফুটবলার, বাস্কেটবলারের ক্ষেত্রে তা তো কিছুটা আলাদা হবেই। কারণ, ফুটবলার, বাস্কেটবলারদের হাতের কব্জির অমন গঠনের প্রয়োজন হয় না। তাই স্টেফিকে বাস্কেটবল কোর্টে প্র্যাকটিস করতে পাঠালে সেই সময় সেই জিন-সজ্জায় কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। আর ওই বয়সেই স্টেফিকে টেনিস খেলা শেখানো না শুরু হলে একটি আদর্শ টেনিস প্রতিভা অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যেত।’’
আরও পড়ুন- চাইলেই ভাল স্প্রিন্টারকে কি আমরা বানাতে পারব পদকজয়ী ম্যারাথনার?
জিন, হরমোন, পরিবেশ পিছিয়ে রাখছে ভারতীয় অ্যাথলিটদের?
ঠিকই, ’৫২ সালের পর ’৯৬-এই প্রথম কোনও অলিম্পিক্সে ব্যাক্তিগত ইভেন্টে মেডেল পেয়েছিলেন কোনও ভারতীয় ক্রীড়াবিদ। কিন্তু তাঁর সেই সাফল্যটা এসেছিল ব্যাক্তিগত উদ্যোগেই। একেবাবে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণের সুযোগ তিনি পাননি। তবে এত সব প্রতিবন্ধকতার পরেও ভারতের কোন কোন এলাকা থেকে ক্রীড়াক্ষেত্রের কোন কোন দিকের প্রতিভার সন্ধান মিলতে পারে আর তাঁদের কী ভাবে বা কোন কোন গুণমানের ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করব শনিবার।
ঋণ স্বীকার: ক্রীড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানী কল্যাণ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা,
জিন বিশেষজ্ঞ মহেন্দ্র রাও, ‘ইনস্টেম’, বেঙ্গালুরু,
জিন বিশেষজ্ঞ অলোক শ্রীবাস্তব, খ্রিস্টান মেডিক্যাল কলেজ, ভেলোর
(চলবে)