-ফাইল ছবি।
চাঁদে মরচে পড়ছে। হালফিলের ঘটনা নয়। চাঁদে মরচে পড়ছে বহু কোটি বছর ধরেই। ইসরোর ‘চন্দ্রযান-১’ দিল এই মন খারাপ করা খবর।
এই প্রথম জানা গেল, মরচে ধরেছে চাঁদে। ক্ষয়-রোগের ছোবল থেকে বাঁচাতে পারেনি নিজেকে।
এই ভাবে ক্ষয়ে যেতে যেতেই আমাদের ছেড়ে একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে স্বপ্নের চাঁদ।
ইসরো, নাসার যুগলবন্দি
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর ‘চন্দ্রযান-১’-এর পাঠানো ছবি ও তথ্যাদি এই চাঞ্চল্যকর খবর দিয়েছে। নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরির (জেপিএল) বানানো ‘মুন মিনার্যালোজি ম্যাপার ইনস্ট্রুমেন্ট (এম-থ্রি)’ দিয়েই চাঁদে বরফ হয়ে থাকা জল ও বিভিন্ন খনিজের প্রথম হদিশ পেয়েছিল চন্দ্রযান-১। ২০০৮-এ। সেই সব ছবি আর তথ্যাদি বিশ্লেষণ করার পর এ বার চোখ কপালে উঠে গিয়েছে আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শুয়াই লি-সহ গবেষকদলের। তাঁরা দেখেছেন, চাঁদে মরচে ধরেছে। আর তা হালফিলের ঘটনা নয়। বহু কোটি বছর ধরেই মরচেতে ক্ষয়ে যেতে শুরু করে আমাদের চাঁদ। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জানাল ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এ।
যার হাত ধরে আকাশ দেখার কৌতূহলের জন্ম হয়েছিল সভ্যতার, সেই চাঁদে ছিটেফোঁটাও বায়ুমণ্ডল, অক্সিজেন না থাকার পর, তরল জলের অস্তিত্ব এখন কার্যত অসম্ভব হওয়ার পরেও কী ভাবে চাঁদে মরচে ধরল, এখন তা নিয়েই তুমুল ধন্দে পড়ে গিয়েছে নাসা ও ইসরো। মরচে ধরে ক্ষয়ে যেতে গেলে যে লোহার জল আর অক্সিজেন দু’টোই লাগে। বহু কোটি বছর আগে যৎসামান্য বায়ুমণ্ডল হয়তো ছিল চাঁদে। কিন্তু মাধ্যাকর্যণ বল প্রায় নেই বললেই চলে (পৃথিবীর ৬ ভাগের এক ভাগ) বলে চাঁদ সেই বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে পারেনি।
এখনও ফল্গুধারা? কে জোগাচ্ছে অক্সিজেন?
ফলে, এমন সন্দেহও উঁকিঝুঁকি মারছে, চাঁদে কি এখনও বইছে জলের ফল্গু ধারা? লুকিয়ে? আমরা এখনও যার হদিশ পাইনি। চাঁদে কি বায়ুমণ্ডলও আছে, এখনও? না হলে লোহায় মরচে ধরানোর জন্য অক্সিজেন আসছে কোথা থেকে?
যদি বরাতজোরে চাঁদে চোরাগোপ্তা থেকেও থাকে অক্সিজেন, তার তো টিঁকে থাকার কথা নয়। কারণ, বায়ুমণ্ডল নেই বলে চাঁদকে প্রতি মুহূর্তে সহ্য করতে হচ্ছে সৌরবায়ু বা সোলার উইন্ড আর সৌরকণাদের ঝাপ্টা। প্রতি মুহূর্তে বিষাক্ত সৌরকণাদের নিয়ে সূর্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে সৌরবায়ু। ছড়িয়ে পড়ছে প়ৃথিবী, চাঁদ-সহ সৌরমণ্ডলের সব প্রান্তে। পৌঁছে যাচ্ছে সৌরমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে।
সৌরবায়ুতে থাকে হাইড্রোজেন আয়ন। চাঁদে চোরাগোপ্তা অক্সিজেন বরাতজোরে থাকলেও যা নিমেষে উড়িয়ে দিত ফুৎকারে। বানিয়ে দিত জল।
চাঁদের দুই মেরুর যেখানে জলের হদিশ মিলেছে (নীল রং), যেখানে ধরেছে মরচে (কালচে রং)।
তা হলে চাঁদে মরচে ধরার জন্য লোহাকে অক্সিজেন জোগাচ্ছে কে? কী ভাবে? চাঁদ অক্সিজেন পাচ্ছে আর কোথা থেকে?
হিমাটাইটের যম রয়েছে চাঁদে, তবু..
পাসাডেনায় জেপিএল-এর সিনিয়র সায়েন্টিস্ট গৌতম চট্টোপাধ্যায় ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে জানাচ্ছেন, অ্যাপোলো মিশনগুলির দৌলতে আমাদের অনেক আগেই জানা ছিল, লোহায় ভরা পাথরের অভাব নেই চাঁদে। কিন্তু চন্দ্রযান-১-এর পাঠানো ছবি ও তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে এই প্রথম হদিশ মিলল ‘হিমাটাইট’-এর। একটি খনিজ পদার্থ। যা লোহার এক ধরনের অক্সাইড যৌগ। আয়রন অক্সাইড। আমরা যাকে মরচে বলে জানি।
গৌতমের বক্তব্য, গবেষকরা দেখেছেন, চাঁদের দুই মেরুতেই মরচে পড়েছে বেশি। মরচে পড়ে চলেছে। যেখানে বরফ অবস্থায় থাকা জলের হদিশ প্রথম পেয়েছিল চন্দ্রযান-১। কিন্তু যে পরিমাণে চাঁদের পিঠে আছড়ে পড়ছে সৌরবায়ু, আর তা ঠেকানোর কোনও ‘বর্ম’ (বায়ুমণ্ডল)-ই যখন নেই চাঁদের, তখন হিমাটাইট তৈরি হচ্ছে কী ভাবে চাঁদে? সৌরবায়ুতে থাকা হাইড্রোজেন আয়ন তো হিমাটাইটের যম! চন্দ্রযান-১-এ থাকা এম-থ্রির পাঠানো ছবি ও তথ্যাদি এ বার এর উপরেই আলো ফেলল।
ফুঁ দিয়ে অক্সিজেন ওড়াচ্ছে পৃথিবী!
কারণ খুঁজতে খুঁজতে চাঁদের সবচেয়ে ‘আপনজন’ পৃথিবীর দিকেই নজর প়ড়ে গবেষকদের। কারণ, চাঁদের কাছে-পিঠে থাকা কোনও গ্রহে যদি অক্সিজেন থাকে, তা হলে তা আমাদের এই নীলাভ গ্রহই। এটাও জানা ছিল, যৎসামান্য হলেও পৃথিবী তার বায়ুমণ্ডলে থাকা সেই অক্সিজেন খোয়াচ্ছে।
গৌতমের কথায়, ‘‘পৃথিবীর খোয়ানো সেই অক্সিজেনই পৌঁছেছে চাঁদে। পৃথিবীকে ঘিরে থাকা সুবিশাল চৌম্বক ক্ষেত্র ম্যাগনেটোস্ফিয়ার যেন ফুঁ দিয়ে সেই অক্সিজেন উড়িয়ে দিচ্ছে চাঁদের দিকে। ২০০৭ সালে জাপানের ‘কাগুয়া’ মহাকাশযানই প্রথম আবিষ্কার করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একবারে উপরের স্তর থেকে অক্সিজেন চলে যাচ্ছে ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের একটি অংশে। যার নাম ‘ম্যাগনেটোটেল’। গন্তব্য ২ লক্ষ ৩৯ হাজার মাইল বা ৩ লক্ষ ৮৫ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা চাঁদ আর তার আশপাশের মহাকাশ।’’
পূর্ণিমাতেই চাঁদের কালবেলা!
কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর অধিকর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী জানাচ্ছে্ন, পৃথিবী যখন তার নিজের কক্ষপথে আবর্তন করে তখন তার সঙ্গে পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ারও আবর্তন করে। সেই আবর্তনের সময় পৃথিবীর রাতের দিকের অংশে ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের বিস্তৃতি হয় ৬৩ লক্ষ কিলোমিটার পর্যন্ত। আর দিনের দিকের অংশে ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের বিস্তৃতি হয় অনেক কম। মাত্র ৬৫ থেকে ৯০ হাজার কিলোমিটার। পূর্ণিমায় চাঁদ পড়ে যায় এই রাতের দিকের অংশে। যার নাম ম্যাগনেটোটেল। আর পৃথিবী থেকে যে অক্সিজেন আয়ন হিসাবে মহাকাশে বেরিয়ে যাচ্ছে, তা বেরিয়ে যায় দুই মেরু দিয়েই। যা রাতের দিকের অংশে পড়ে। সেই অক্সিজেন অবিকৃত ভাবেই চাঁদে পৌঁছতে পারে। যেহেতু পৃথিবীর রাতের দিকের অংশে থাকা চাঁদে সেই সময় সৌরবায়ুতে থাকা হাইড্রোজেন আয়ন পৌঁছতে পারছে না। ফলে, সেই অক্সিজেন আয়নকে জলে বদলে দিতেও পারছে না। এ জন্যই চাঁদের যে পিঠটি থাকে সব সময় পৃথিবীর দিকে তাতে অক্সিজেন বেশি পরিমাণে পৌঁছতে পারে। যে পিঠটা আমাদের দিকে থাকে না, সেই পিঠে পৌঁছয় তুলনায় অনেক কম। ম্যাগনেটোস্ফিয়ার যে শুধুই আমাদের অক্সিজেনের কিছুটা চাঁদের চালান করে দিচ্ছে তা-ই নয়; পুর্ণিমার সময় তা সৌরবায়ুকে রুখে দেয় অন্তত ৯৯ শতাংশ। তার ফলে, চাঁদে মরচে পড়ার সুযোগটা বেড়ে যায়।
পার্থিব অক্সিজেনের সঙ্গে চাঁদের লোহার হানিমুন!
সন্দীপের রসিকতা, ‘‘বলতে পারেন পৃথিবীর অক্সিজেন হানিমুন করতে চলে যায় চাঁদের লোহার সঙ্গে!’’
চাঁদে মরচে ধরানো, হিমাটাইট তৈরি করার পিছনে রয়েছে অক্সিজেনই। সে জন্যই চাঁদের যে পিঠটা সব সময় থাকে পৃথিবীর দিকে সেই দিকেই হিমাটাইটের পরিমাণ বেশি। চাঁদের অন্য পিঠের হিমাটাইটের তুলনায়।
যেহেতু কয়েক কোটি বছর ধরে চাঁদ ইঞ্চি ইঞ্চি করে আমাদের ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে, তাই অনুমান, কয়েক কোটি বছর আগে যখন চাঁদ আমাদের খুবই কাছে ছিল, তখনই বেশি পরিমাণে মরচে ধরতে শুরু করে চাঁদে।
চাঁদকে কাছে রেখেই তার গায়ে মরচের দাগ লাগিয়েছে পৃথিবী!
মরচে পড়ছে বরফ-রাজ্য থেকে দূরে!
আরও একটা অবাক করা ঘটনা দেখেছেন গবেষকরা। চাঁদের দুই মেরুতে যেখানে বরফ রয়েছে বা রয়েছে বরফ অবস্থায় থাকা জলের অস্তিত্ব, চাঁদের মরচে ধরেছে তার থেকে দূরে।
চাঁদের গায়ে দাগ লেগেছে...
তা হলে লোহায় মরচে ধরানোর জন্য জলের জোগান আসছে কোথা থেকে?
চাঁদের পিঠে জলকণার হদিশ মিলেছিল আগেই। তাই অনুমান, দ্রুত ধাবমান ধূলিকণাই সেই জলকণাকে লোহার কাছে নিয়ে গিয়েছে।
গৌতমের বক্তব্য, চাঁদের মাটির নীচে এখনও একটু আধটু জল তরল অবস্থায় রয়েছে, এটা জানা আছে। কোনও উল্কাপিণ্ডের আঘাতে তা মাটি ফুঁড়ে উপরে উঠে আসে। সেই জলকণাই চাঁদের পিঠে থাকা ধুলোর টুকরোগুলি নিয়ে গিয়েছে লোহার কাছাকাছি।
সন্দীপ বলছেন, ‘‘চাঁদের নিম্ন অক্ষাংশের এলাকাগুলিতে সৌরবায়ু আছড়ে পড়ে অনেক বেশি পরিমাণে। ওই এলাকাগুলিকে সূর্যের তাপও সইতে হয় অনেক বেশি। তাই ওই সব এলাকায় জলের তরল অবস্থায় থাকা অসম্ভবই। তরল বা বরফ যে অবস্থাতেই হোক, জল থাকতে পারে তাই চাঁদের দুই মেরুতে। তাই মেরুতেই চাঁদের মরচে পড়ার হদিশ মিলেছে। পৃথিবীর অক্সিজেনের সঙ্গে হানিমুন হয় চাঁদের লোহার! আর সেটা ভাল হয় পূর্ণিমাতেই! কারণ, ওই সময় সৌরবায়ুর রাক্ষস হাইড্রোজেন থাকে না। ফলে, পৃথিবী থেকে পালানো অক্সিজেন জলে পরিণত হয়ে যেতে পারে না। হতে পারে না হাইড্রক্সিল আয়নও। তবে শুধুই আয়রন অক্সাইড নয়, একই কারণে আরও অনেক ধরনের অক্সাইডেরই হদিশ মিলবে চাঁদে।’’
তবে চাঁদে মরচে পড়ার আদত কারণ কী বা কী কী তা নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি বলেই মনে করছেন সন্দীপ ও গৌতম।
দু’জনেই বলছেন, ‘‘চাঁদের গায়ে দাগ লেগেছে, আমাদের না ভাবলে হয়?’’
ছবি সৌজন্যে: নাসা।