গ্রাফিক: শান্তনু ঘোষ।
শীতে এ বার অন্য রকমের বৃষ্টি হল কলকাতায়!
টিপটিপিয়ে বিরক্তিকর বৃষ্টি নয়। আবার জলে কোমর ডুবে যাওয়ার মতো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিও নয়। একেবারেই অন্য রকমের। ‘নোবেল’ বৃষ্টি! ঝাঁপিয়ে, দু’সপ্তাহ ধরে। এমন হয়নি গত কয়েক দশকে।
যেন হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ হয়ে গিয়েছে কলকাতা! যেন বিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে একের পর এক পথ-দেখানো, সাড়া ফেলে দেওয়া গবেষণাপত্রের জন্ম হচ্ছে ‘দুয়োরানি’ কলকাতায়! ঘনঘন।
যাঁরা এসেছিলেন
দিনপনেরোর মধ্যে পাঁচ জন নোবেল পুরস্কারজয়ী ঘুরে গেলেন কলকাতায়। যাঁদের মধ্যে দু’জন আমাদের ঘরের ছেলে। এক জন কলকাতার। অন্য জন শান্তিনিকেতনের। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমর্ত্য সেন। আগুপিছু এলেন ২০১৭-য় অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী রিচার্ড থ্যালার। এলেন বিজ্ঞানে দুই নোবেলজয়ী বিদেশি জোয়াকিম ফ্র্যাঙ্ক ও এরিক ভায়েসকাউস।
আইসার-কলকাতার অনুষ্ঠানে শহরে এসেছিলেন নোবেলজয়ী ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজিস্ট এরিক ভায়েসকাউস।
পনেরো দিনে পাঁচ জনকে পেয়ে এ বার কার্যত, অনন্য শীত পেল কলকাতা! ‘নোবেল বৃষ্টি’ সঙ্গে নিয়ে!
‘এখানে বসে কিছুই হয় না’, বাঙালির দীর্ঘ দিনের এই ক্ষোভ, অভিমানকে যা সাময়িক ভাবে হলেও প্রশমিত করতে পারে, এমনটাই মনে করছেন কলকাতার বিশিষ্টজনরা।
আরও পড়ুন- বিজ্ঞানে কেন নোবেল নেই বাঙালির ঘরে?
শীত এলে পরিযায়ী পাখিরা এখনও আসে সাঁতরাগাছির ঝিলে। গত বেশ কয়েক বছর ধরে সংখ্যাটা কমছিল। খবর, একটু বেড়েছে এ বছরে। ভারতে গত কয়েক বছর ধরে বিদেশি নোবেল পুরস্কারজয়ীদেরও আসা-যাওয়া করতে দেখা যাচ্ছে। শীতে, কলকাতাতেও। আর হ্যাঁ, সেই সংখ্যাটা কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরেই উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে।
নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের আনাগোনা বেড়েছে কেন?
বিদেশি পরিযায়ী পাখিদের মতোই বিদেশি নোবেল পুরস্কারজয়ীরাও ভারতে আসেন, কলকাতায় আসেন যথেষ্ট খবরাখবর নিয়ে।
বিদেশি পরিযায়ীরা যেমন আগেভাগেই খবরাখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে শীতে যাবে কোন গন্তব্যে? ‘‘বিদেশি নোবেলজয়ীরাও খবর পান, ভারত বা কলকাতার বিজ্ঞান গবেষণার পরিবেশ বদলেছে। বদলাচ্ছে। এখানেও মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা আসছেন, থেকে যাচ্ছেন বিজ্ঞানের গবেষণায়। ফলে, ভারতে আসা, কলকাতায় আসার ব্যাপারে বিদেশি নোবেলজয়ীদের আগ্রহ বেড়েছে। উগান্ডা বা মাদাগাস্করের চেয়ে তাঁদের কাছে ফেভারিট ডেস্টিনেশন হয়ে উঠতে পেরেছে ভারত’’, বলছেন কলকাতার প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (আইএসিএস)’-এর অ্যাকাডেমিক ডিন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী সৌমিত্র সেনগুপ্ত।
‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ কলকাতা (আইসার)’-র অধিকর্তা অধ্যাপক সৌরভ পালের বক্তব্য, মধ্যমেধার বাহুল্য থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা শুরু হয়েছে। উচ্চমেধার ছাত্রছাত্রীরা যাতে বাড়তি উপার্জনের মোহে বিলাসবহুল জীবনযাপনের ইশারায় বিজ্ঞানের রাস্তাটা ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে না যায় প্রযুক্তি বা তথ্যপ্রযুক্তির দিকে, তার জন্যই নিয়ে আসা হচ্ছে নোবেল পুরস্কারজয়ীদের। উচ্চমেধার ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের গবেষণায় আসা ও সেখানে থেকে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে।
তিন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের মধ্যে অমর্ত্য মাঝেমধ্যেই আসেন কলকাতায়। যান শান্তিনিকেতনে। এ বছর নোবেলপ্রাপ্তির পর অভিজিতের কলকাতায় আসাটাও নতুন কিছু নয়। মা থাকেন। এ বার নতুনত্ব এইটুকুই সদ্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। আর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ রিচার্ড থ্যালারও কলকাতায় এসেছিলেন বিশেষ একটি আমন্ত্রণে।
এ বার শীতের কলকাতায় যে দুই বিদেশি নোবেলজয়ী অনেকেরই নজর কেড়েছেন, তাঁদের এক জন জোয়াকিম ফ্র্যাঙ্ক। ‘ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি’র মাধ্যমে বিভিন্ন জৈব অণুর গঠনের খুঁটিনাটি জানার পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য ২০১৭ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান জার্মানিতে জাত অধুনা মার্কিন নাগরিক জোয়াকিম। এ বার বরাহনগরে ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)’-এর সমাবর্তনে মুখ্য অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন জোয়াকিম।
শীতের কলকাতায় এ বার আর এক অতিথি ছিলেন এরিক ভায়েসকাউস। ড্রসোফিলা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৫ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এভোলিউশনারি ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজিস্ট ভায়েসকাউস। তাঁকে মুখ্য অতিথি হিসেবে আনা হয়েছিল মোহনপুরের ‘আইসার কলকাতার ‘লিপ-২০২০’ অনুষ্ঠানে।
কেন আনা হচ্ছে নোবেলজয়ীদের? কাজ হচ্ছে?
বরাহনগরে আইএসআই-এর অধিকর্তা সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এই নোবেলজয়ীদের দেখেই তো কলেজে পড়া বা সদ্য কলেজের গণ্ডি পেরনো ছাত্রছাত্রীরা নোবেল, ফিল্ডস মেডেল, টুরিং প্রাইজ, অ্যাবেল প্রাইজ পাওয়ার স্বপ্নটা দেখতে শুরু করতে পারে, তাই না? হয়তো সবাই সেই স্বপ্নটা দেখবে না। কিন্তু সংখ্যায় খুব নগণ্য হলেও তো কেউ কেউ সেই স্বপ্নটা দেখতেই পারে। কে-ই বা বলতে পারেন, তার ফলে এই কলকাতা থেকেও কেউ সেই স্বপ্নটা পূরণ করে ফেলতে পারবে না? নোবেলের মতো পুরস্কার পাওয়া যাবে ভেবে তো কেউ গবেষণা করেন না। গবেষণার অভূতপূর্ব ফলাফল আর পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে তার স্বীকৃতি আচমকাই এই স্বীকৃতিটা এনে দেয়। কারণ, গবেষণার ফলাফলের যেমন ১০০ ভাগ সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া যায় না, তেমনই পরীক্ষায় তা প্রমাণিত হবে, হলে কবে, সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না আগেভাগে।’’
নতুন ভাবনা আনেন যে তাঁরা...
আমন্ত্রিত হয়ে যিনি তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রটি নিয়ে বলতে গিয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইসার-কলকাতার সেই বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দিব্যেন্দু নন্দী মনে করেন, নোবেলজয়ীদের আরও বেশি সংখ্যায় ভারতে বা কলকাতায় আনার প্রয়োজন। তাঁরা যত বেশি আসেন, ততই মঙ্গল। এতে আমাদের জানার জানলাটা আরও খুলে যায়।
কেন? দিব্যেন্দুর কথায়, ‘‘এঁরা নতুন ভাবনাচিন্তা নিয়ে আসেন। তাঁদের ক্ষেত্রে বিশ্ব জুড়ে যে যে ধারায় গবেষণা চলছে, সেই সবই তো আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিদেশি বিজ্ঞান-জার্নাল বা আর্কাইভে থাকা গবেষণাপত্র পড়ে জানতে পারি। আমাদের ছাত্রছাত্রীরাও জানতে পারেন। কেউ কম, কেউ বেশি। সুযোগ বা যোগাযোগের অভাবে বা আতিশয্যে। কিন্তু নোবেলজয়ী বা অন্যদের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা বিদেশি বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ গবেষণার প্রচলিত ধারাগুলি থেকে একেবারেই অন্য ভাবে ভাবার ক্ষমতা রাখেন। ভাবতে পারেন, অন্যদেরও ভাবাতে পারেন। তাই আমরা ওদের আমন্ত্রণ জানাই। একই ভাবে ওরাও আমাদের আমন্ত্রণ জানান। আমার মতো আরও অনেক ভারতীয়, অনেক বাঙালি বিজ্ঞানী এমন আমন্ত্রণ প্রায় নিয়মিতই পান বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে।’’
নোবেলজয়ী দেখেই আশ মিটছে ছাত্রছাত্রীদের?
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের অন্যতম, কলকাতার ‘এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস (এসএনবিএনসিবিএস)’-এর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী পার্থ ঘোষ বলছেন, ‘‘আমার মনে হয়, তেমন কাজ হচ্ছে না। কারণ, শুধু তো উদ্বুদ্ধ করলেই হবে না। নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞানের গবেষণার প্রতি আগ্রহটা জিইয়ে রাখতে হবে। তার জন্য চাই অত্যন্ত উন্নত মানের গবেষণাগার। তার জন্য চাই আরও বেশি অর্থবরাদ্দ। নতুন গবেষকদরে গাইড করার জন্য আরও দক্ষ অধ্যাপক, রিসার্চ-গাইড। এমনকি, সেই রিসার্চ-গাইডদেরও নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।’’
একই সুর শোনা গেল আইএসআই-এর এক ছাত্রীর। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রীটি বললেন, ‘‘শুধু অনুপ্রাণিত হয়ে হবেটা কী? আগুনটা জ্বলতে জ্বলতে এক সময় নিভে যাবে। আগুনটাকে জ্বালিয়ে রাখার জন্য চাই হাওয়া-বাতাস। আরও ভাল অধ্যাপক, রিসার্চ-গাইড। আরও ভাল গবেষণাগার। না হলে এ দেশে কিছুই হবে না ভেবে আমরা হয় বিদেশে চলে যাব গবেষণার সুযোগসুবিধা পাব বলে। না হলে টাকা, ডলার, পাউন্ড, ইউরো, ডয়েশমার্ক রোজগারের জন্য চলে যাব তথ্যপ্রযুক্তির ঝাঁ চকচকে পথে।’’
ভিত হয়েছে, বাড়ি বানানোর লোক কই?
আমেরিকায় ‘ইউনাইটেড সোলার ওভনিক কর্পোরেশন’-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান, সৌরশক্তি বিশেষজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ শুভেন্দু গুহ মনে করেন, কলকাতায় আগের চেয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণার পরিবেশ কিছুটা বদলেছে। বেস ক্যাম্প তৈরি হয়েছে। কয়েকটি উন্নত মানের গবেষণাগারও তৈরি হয়েছে। ওইটুকুই।
আরও পড়ুন- এ বার সব ক্যানসার সারবে একই উপায়ে? যুগান্তকারী আবিষ্কার
শুভেন্দুর কথায়, ‘‘সেটা তো বেস ক্যাম্প। সেখান থেকে এ বার ট্রেকিং করার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার নেমে এলে ট্রেকিং করা সম্ভব হবে না। তার জন্য গাইড (পড়ুন রিসার্চ-গাইড, অধ্যাপক) জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ করতে হবে। যাঁরা ট্রেকিং করবেন, সেই তরুণ প্রজন্মের গবেষকদের হাতে তুলে দিতে হবে উন্নত মানের দড়ি। আইস-এক্স। শেখাতে হবে কখন কী ভাবে ছুড়তে হবে আইস-এক্স। সেই সব দেওয়া হচ্ছে না। শিবপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (আইআইইএসটি)’তে সৌরশক্তি ব্যবহারের অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য একটি উন্নত মানের গবেষণাগার তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেখানে আমি যে গুণমানের অধ্যাপক নিয়োগ চেয়েছিলাম, তা হয়নি। বার বার বলা সত্ত্বেও হয়নি। ফলে, কিছুটা যে হতাশ, বলতে বাধ্য হচ্ছি। ফলে, ভিত গড়া হলেও বাড়ি বানানোর লোক পাওয়া যাচ্ছে না।’’
উচ্চমেধার গাইড চাই ট্রেকিংয়ের জন্য...
পার্থর বক্তব্য, সেটা করতে গেলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তারই আসন টলে উঠতে পারে। কারণ, এখন বেশির ভাগ জায়গাতেই চলছে মধ্যমেধার দাপট। পার্থর কথায়, ‘‘মধ্যমেধার কোনও অধিকর্তা কী ভাবেই বা তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চমেধার অধ্যাপক আনার সাহস দেখাতে পারেন? তা হলে তাঁর নিজের জায়গাটি নিয়েই এক সময় প্রশ্ন উঠে যেতে পারে।’’
অথচ, স্বাধীনতার পর ভারতে এই অবস্থাটা ছিল না। তখন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা আর বিক্রম সরাভাইয়ের মতো পথিকৃৎ বিজ্ঞানীরা ভাল ভাল অধ্যাপক নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। তাই মুম্বইয়ে গড়ে উঠতে পেরেছিল ‘টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)’-এর মতো শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গড়ে উঠতে পেরেছিল ইসরো, জানাচ্ছেন শুভেন্দু।
অনুসরণ নয়, ভাবানোর কথা ভাবাতে হবে
ভাবতে শেখানো হচ্ছে না। শুধুই বলা হচ্ছে বিদেশের গবেষণার পথগুলিকে অনুসরণ করে যেতে। ফলে, নতুন নতুন গবেষণাগার হলেও সেখানে কাজ হচ্ছে বিদেশি গবেষণার পথ ধরেই।
‘‘তাতে আন্তর্জাতিক গবেষকদলে ঠাঁই পাচ্ছেন গবেষকরা। নানা জার্নাল, সংবাদপত্রে তাঁদের গবেষণাপত্র, ছবি ছাপানো হচ্ছে। বিদেশের সেমিনার, কনফারেন্সগুলিতে তাঁরা ডাক পাচ্ছেন। তাঁদের যোগাযোগ, খ্যাতি বাড়ছে। কিন্তু নিজে ভেবে নতুন কোনও পথ বের করার ভাবনাটা তরুণ গবেষকদের আর মাথায় থাকছে না। অথচ, পশ্চিমি দেশগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের স্কুল স্তর থেকে ভাবতে শেখানো হয়। প্রচলিত ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে উৎসাহিত করা হয়, বললেন পার্থ ও শুভেন্দু।
গণতন্ত্রই ক্ষতিকারক বিজ্ঞানের উদ্ভাবনী গবেষণার!
আইসার-কলকাতার অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী মনে করেন, ‘‘খুব বেশি গণতন্ত্রও ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে বিজ্ঞানের গবেষণার পক্ষে। বিজ্ঞানের গবেষণায় সকলকে সমান চোখে দেখা সম্ভব নয়। যিনি মেধাবী, যিনি কিছুটা অন্য চোখে বিশ্বকে দেখেন, অন্য ভাবে ভাবার চেষ্টা করেন সব সময়, তাঁকে বাকিদের সঙ্গে এক ভাবে দেখা হলে তিনি হাঁফিয়ে উঠবেন। তাই তাঁকে অন্য ভাবে দেখতে হবে। তাঁকে স্পেস ও টাইম দিতে হবে। এটা আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলিতে হয়। ভারতে কিন্তু সেটা হয় না বললেই চলে। হলেই হইহই করে উঠবেন একদল বিজ্ঞানী, গবেষক, অধ্যাপক। ফলে, পশ্চিমিদের অনুসরণের সহজ পথেই থেকে গিয়েছি আমরা, অন্তত মৌলবিজ্ঞানের গবেষণায় তো বটেই।’’
সায়েন্টিস্ট কমিউনিটি তৈরি হয়নি এ দেশে
মৌলবিজ্ঞানের গবেষণাকে কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, গুরুত্ব দিতে হবে কোন কোন ক্ষেত্রগুলিকে, তা বেছে দেওয়ার জন্য পশ্চিমি দেশগুলিতে সায়েন্টিস্ট কমিউনিটি তৈরি হয়েছে। বেড়ে উঠেছে। যা আমাদের দেশে এখনও ততটা হয়নি। ফলে, কার্যত অসংগথিত ভাবেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে ভারতের নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞান গবেষকদের। এমনটাই মনে করেন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (আইএসিএস)’-এর অ্যাকাডেমিক ডিন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী সৌমিত্র সেনগুপ্ত।
যেটুকু হয়েছে, বাঁচার তাগিদে!
স্বাধীনতার পর আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলি আমাদের মহাকাশ প্রযুক্তি দিতে চায়নি। দিতে চায়নি পারমাণবিক প্রযুক্তিও। তাই উন্নয়নের তাগিদে আমরা শুধু ওই দু’টি প্রযুক্তির গবেষণাতেই কিছুটা এগতে পেরেছি। কিন্তু সঠিক দিশার অভাবে, উদ্ভাবনী ভাবনাচিন্তার অভাবে দু’-একটি বাদে মৌলবিজ্ঞানের গবেষণায় আমরা পশ্চিমিদের অনুসরণ করা ছাড়া পথ দেখানোর মতো তেমন কিছু করে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয় না, জানাচ্ছেন দিব্যেন্দু।
ফুল ফুটুক না ফুটুক...
কলকাতায় সদ্য শেষ হওয়া আইসার-কলকাতার ‘লিপ-২০২০’ অনুষ্ঠানের অন্যতম কার্যনির্বাহী কর্ত্রী, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অনিন্দিতা ভদ্র বলছেন, ‘‘হিরো ওয়ারশিপ (বীরপূজা)-এর প্রথাই আমাদের উদ্বেগের মস্তবড় কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমি দেখেছি, নোবেল পুরস্কারজয়ীদের প্রণাম করছেন আমাদের অধ্যাপক, গবেষক, ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ। তাতে নোবেলজয়ীরাও হকচকিয়ে গিয়েছেন। আমি ভাটনগর পুরস্কারজয়ীদের সামনেও ঝুঁকে পড়তে দেখেছি ভারতীয় বিজ্ঞানীদের। এটা খুবই হাস্যকর। পুরস্কারের জন্য নয়, কোনও বিজ্ঞানীকে শ্রদ্ধা করা উচিত তাঁর কাজের জন্যই। অন্য কিছুর জন্য নয়।’’
কলকাতায় কেমন কাটালেন নোবেলজয়ীরা?
বাঙালি খাওয়াতে ভালবাসেন। অনিন্দিতা জানিয়েছেন, তাঁরা নোবেল পুরস্কারজয়ী এরিক ভায়েসকাউসকে খাইয়েছেন ভেটকি পাতুরি, তোপসে মাছ ভাজা, মালাই, চমচম আর মিষ্টি দই। ভায়েসকাউস এসেছিলেন সস্ত্রীক। দু’জনেরই কলকাতা, কলকাতার বাসিন্দাদের ভাল লেগেছে।
নোবেলজয়ী রসায়নবিদ জোয়াকিম ফ্র্যাঙ্ক। ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট’-এর সমাবর্তনে। গত সপ্তাহে, বরাহনগরে।
খাইয়েছি। ‘পুজো’ করেছি। প্রণামও করেছি নোবেলজয়ীদের। ‘‘আতিথ্যে কার্পণ্য হয়নি’’, জানাচ্ছেন আইএসআই এবং আইসার-কলকাতা কর্তৃপক্ষ।
শীতের কলকাতায় এসে তা হলে নোবেলজয়ীদের আক্ষেপ করতে হয়নি!
কিন্তু এই শীতের এই ‘নোবেল বৃষ্টি’ আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব? কতটা ঘরে তুলতে পারব তার সুফল? তা নিয়ে সংশয়টা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারলেন কি কলকাতার বিজ্ঞানীরা?
যাঁদের জন্য এত সবের আয়োজন, সেই ছাত্রছাত্রীরাও, ‘শিশু ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলো’ বলছেন না তো মনে মনে?
ছবি সৌজন্যে: আইসার-কলকাতা ও আইএসআই, বরানগর
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস