চাঁদের মাটিতে চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞান। ছবি: ইসরো।
ইসরো কেন চাঁদে মহাকাশযান পাঠাল, উদ্দেশ্য কী কী ছিল, কতগুলিই বা সাধন করা গিয়েছে— শনিবার সন্ধ্যায় তার খতিয়ান দিল ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। তালিকা ধরে ধরে ইসরো দাবি করল, মোট তিনটি লক্ষ্য ছিল এই চন্দ্র অভিযানের। ইতিমধ্যে দু’টি লক্ষ্য পূরণ হয়ে গিয়েছে। বাকি আছে কেবল একটি। শনিবার সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ইসরো টুইট করে জানিয়েছে, তাদের চন্দ্রযান-৩ অভিযানের মোট তিনটি লক্ষ্য ছিল। এক, চাঁদের মাটিতে নিরাপদে পাখির পালকের মতো মহাকাশযানের অবতরণ (সফ্ট ল্যান্ডিং)। সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। দুই, চাঁদের মাটিতে রোভারকে ঘোরানো। তা-ও সফল। শনিবারই সেই ভিডিয়ো প্রকাশ করেছে ইসরো। তৃতীয় উদ্দেশ্যটি এখনও পূরণ বাকি রয়েছে— চাঁদের মাটিতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা। সেই কাজ চালাচ্ছে চন্দ্রযান-৩-এর রোভার প্রজ্ঞান। তার মধ্যেকার সমস্ত পেলোডগুলি স্বাভাবিক ভাবে কাজ করছে বলে জানিয়েছে ইসরো।
চাঁদে এখনও পর্যন্ত ইসরোর পরিকল্পনামাফিকই সব চলছে। কোথাও কোনও বিচ্যুতি ঘটেনি। ফলে তৃতীয় লক্ষ্যটিও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পূরণ হবে বলে আশা রাখছেন বিজ্ঞানীরা। শনিবার বিকেলে প্রজ্ঞানের গতিবিধির একটি ভিডিয়ো টুইট করেছে ইসরো। সেখানে দেখা গিয়েছে, ল্যান্ডারের ঢালু পথ বেয়ে চাঁদের মাটিতে পা রেখেছে প্রজ্ঞান। ছয় চাকায় ভর দিয়ে ধীর গতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটি। কিছুটা পথ সোজা গিয়ে বাঁ দিকে মোড় ঘুরতেও দেখা গিয়েছে রোভারটিকে। প্রজ্ঞানের চাকায় এক দিকে ইসরোর লোগো এবং অন্য দিকে অশোকস্তম্ভের ছবি খোদাই করা আছে। চাঁদের মাটিতে সেই চিহ্নের ছাপ আঁকা হয়ে যাওয়ার কথা। যদিও ইসরোর ভিডিয়োতে কোনও চিহ্ন স্পষ্ট করে বোঝা যায়নি। দেখা গিয়েছে কেবল রোভারের চাকার দাগ।
বিদেশ থেকে ফিরে শনিবার সকালেই সোজা বেঙ্গালুরুতে ইসরোর অফিসে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। চন্দ্রযানের কারিগরদের ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী ২৩ অগস্ট চন্দ্রযান-৩-এর চাঁদে পা রাখার দিনটিকে জাতীয় মহাকাশ দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছেন। এ ছাড়া, চাঁদে যেখানে ল্যান্ডার প্রথম পা রেখেছিল, সেই স্থানটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শিবশক্তি’। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, চার বছর আগে চাঁদের যেখানে চন্দ্রযান-২ ভেঙে পড়েছিল, সেই স্থানের নাম হবে ‘তেরঙা’। চাঁদের সাফল্যে ইসরো তথা ভারতকে অভিনন্দন জানিয়েছে পড়শি পাকিস্তানও। পাক সংবাদমাধ্যমে ভারতের প্রশংসা শোনা গিয়েছে বার বার। এমনকি, পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মুমতাজ জহরা বালোচ জানিয়েছেন, চন্দ্রজয়ের জন্য ইসরোর বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন প্রাপ্য।
চাঁদে ‘শিবশক্তি’
চাঁদের মাটিতে যে জায়গায় ভারতের তৃতীয় চন্দ্রযানটি অবতরণ করেছে, তার নাম এখন থেকে ‘শিবশক্তি’। শনিবার সকালে ইসরোর দফতরে গিয়ে এই নামকরণ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘যেখানে চার বছর আগে চন্দ্রযান-২ ভেঙে পড়েছিল, তার নাম হবে ‘তেরঙা’। এই স্থানটি মনে করাবে, ব্যর্থতাই শেষ নয়। তার পরেও সাফল্যের পথ খোলা থাকে।’’ ২৩ অগস্ট চন্দ্রযান-৩-এর অবতরণের দিনটিকে এখন থেকে জাতীয় মহাকাশ দিবস হিসাবে পালন করা হবে বলেও ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
অশ্রুসজল মোদী
গ্রিস থেকে ফিরে শনিবার সকালেই বেঙ্গালুরু পৌঁছন প্রধানমন্ত্রী। ইসরোর অফিসে গিয়ে তিনি চন্দ্রযানের কারিগরদের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের শুভেচ্ছা জানান। বিমানবন্দরে নেমেই তিনি বলেন, ‘‘জয় বিজ্ঞান, জয় অনুসন্ধান’’। এর পর জনগণের উদ্দেশে স্বল্প সময় ভাষণ দেন। বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলার সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন মোদী। তাঁর চোখে জল চলে আসে। এমনকি, কথা বলতে বলতে কয়েক বার কান্নায় গলা ভেঙে আসে প্রধানমন্ত্রীর। ইসরোর বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানিয়ে মোদী বলেন, ‘‘ইসরোর বিজ্ঞানীদের ধৈর্য, পরিশ্রম দেশকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে, তা সাধারণ নয়। ভারতীয় বিজ্ঞানের অগ্রগতির ‘শঙ্খনাদ’ শোনা যাচ্ছে। আমরা চাঁদের যে জায়গায় পৌঁছেছি, সেখানে আগে কেউ পৌঁছয়নি। সারা বিশ্ব ভারতীয় প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের প্রশংসা করছে। চন্দ্রযান-৩ ভারতের না, মানবতার সাফল্য।’’
ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রজ্ঞান
চাঁদের মাটিতে বহাল তবিয়তে রয়েছে ইসরোর চন্দ্রযান-৩-এর রোভার প্রজ্ঞান। শনিবার বিকেলে ইসরো একটি ভিডিয়ো টুইট করে দেখিয়েছে, প্রজ্ঞান দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। সেই সঙ্গে চাঁদের মাটিতে কেটে যাচ্ছে মোটা দাগ। ল্যান্ডার বিক্রমের ক্যামেরায় সেই দৃশ্য ধরা পড়েছে। ইসরো জানিয়েছে, তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সব চলছে। কোনও সিস্টেমে কোনও সমস্যা দেখা দেয়নি। মোট ১৪ দিন চাঁদে ঘুরে ঘুরে এ ভাবেই তথ্য সংগ্রহ করবে প্রজ্ঞান।
পাকিস্তানের অভিনন্দন
ইসরোর সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়েছে পড়শি দেশ পাকিস্তানও। পাক বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মুমতাজ জহরা বালোচ বলেন, ‘‘এটি একটি বিরাট বৈজ্ঞানিক সাফল্য। যে কৃতিত্বের জন্য অভিনন্দন প্রাপ্য ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর বিজ্ঞানীদের।’’ পাক সংবাদমাধ্যমও ইসরোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পাকিস্তানের একাধিক প্রথম সারির সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল ভারতের চন্দ্রজয়ের কথা গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। ‘দ্য ডন’ সংবাদপত্রে প্রথম পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘‘তুলনা অসম হলেও মহাকাশ গবেষণায় ভারতের এই সাফল্য থেকে পাকিস্তানের অনেক কিছু শেখার রয়েছে।’’ চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্যকে প্রকাশ্যে কুর্নিশ জানিয়েছেন পাক নাগরিকদের একাংশও।
বাঙালি বিজ্ঞানীদের সংবর্ধনা
বাংলার যে সব বিজ্ঞানী ইসরোর চন্দ্রযান-৩ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সংবর্ধনা দিতে চান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২১ জন বাঙালি বিজ্ঞানীকে আলাদা করে চিঠি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কবে ওই সংবর্ধনার আয়োজন হবে বা কোথায় হবে, সে সব অবশ্য এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ ছাড়া, মমতা ইসরোর প্রধান পি এস সোমনাথকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। বাংলার ভূমিপুত্র নন, এমন বিজ্ঞানীদের কাছেও যাচ্ছে মমতার শুভেচ্ছাবার্তা।
মহাকাশে ‘ব্যোমমিত্রা’
মহাকাশে ইসরোর পরবর্তী লক্ষ্য ‘ব্যোমমিত্রা’। এটি কোনও নতুন অভিযান নয়। বরং একটি রোবটের নাম। গগনযান প্রকল্পের মাধ্যমে মহাকাশে এই মহিলা রোবটটি পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ইসরোর। তেমনটাই জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ। তিনি আরও জানান, অক্টোবর মাসের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সপ্তাহে পরীক্ষামূলক ভাবে একটি মহাকাশযান মহাকাশে পাঠানো হতে পারে। সেটি সাফল্য পেলে মহিলা রোবট পাঠানোর দিনক্ষণ চূড়ান্ত হবে।
ইসরোর সূর্য অভিযান
চন্দ্র অভিযানের সাফল্যের পর সূর্যজয়ের হাতছানি ইসরোর সামনে। সেপ্টেম্বর মাসে সূর্যের কাছে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাচ্ছে ইসরো। তার নাম আদিত্য এল১। সূর্যের কাছে একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত যাবে সেটি। সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করে নানা তথ্য সংগ্রহ করবে এবং তা পৃথিবীতে পাঠাবে। আগামী ২ সেপ্টেম্বর এই উপগ্রহ উৎক্ষেপণের কথা রয়েছে।