মোবাইল ছাড়া আজকাল কোথাও চলার উপায় নেই। আট থেকে আশি— সব বয়সের সব রকমের মানুষের হাতে এখন মোবাইল ফোন। এই ফোনের অধিকাংশ কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পৃথিবীর মাটিতে আছে অজস্র সেল টাওয়ার। আর আকাশে স্যাটেলাইট। আপনি যখন অলিগলির মধ্যে বাড়ি খোঁজার জন্য কিংবা উব্র-ওলার ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য জিপিএস ব্যবহার করেন, তার প্রাণকাঠি নাড়ায় এই স্যাটেলাইট। লো আর্থ আর জিও সিনক্রোনাস কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র ছোট-বড় কৃত্রিম উপগ্রহ। জিওস্যাট, মাইক্রোস্যাট, স্পাইস্যাট, ন্যানোস্যাট, কিউবস্যাট। এ ছাড়া আছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন, হাবল স্পেস টেলিস্কোপ, মির স্পেস স্টেশন। আরও কত!
একটা প্রশ্ন স্বভাবত মনে আসে। এই স্যাটেলাইটগুলো কী ভাবে মহাকাশে দরকারমতো এ দিক-সে দিক ঘোরাফেরা করে? মহাকাশে তো মাটি নেই যে বাস-ট্রেন চলবে। বাতাস নেই, যার উপর ভর করে এরোপ্লেন উড়বে। মেরু অঞ্চলের বরফ কী ভাবে গলছে, তা জানার জন্য দীর্ঘ সময় শুধুমাত্র মেরুপ্রদেশেই ক্যামেরা তাক করে রাখা দরকার। এ জন্য কোনও বিশেষ স্যাটেলাইটের ‘অ্যাটিটিউড’ বদলানো, অর্থাৎ ঘাড় ঘোরানো প্রয়োজন। কোনও গোয়েন্দা মহাকাশযান থেকে পৃথিবীর কোনও বিশেষ অঞ্চলে নজর রাখতে গেলেও তা-ই। নির্দিষ্ট ‘স্টেশন কিপিং’ কক্ষপথে শুধু ভেসে বেড়ালে চারপাশের অণুদের সংঘর্ষে স্যাটেলাইটের শক্তিক্ষয় হয়। দীর্ঘকাল মহাকাশে ভাসমান ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের ক্ষেত্রে যেমন। ফলে ক্রমাগত কক্ষচ্যুতির সম্ভাবনা। এ ছাড়া নিয়মিত উল্কা ও অন্য মহাকাশ অভিযানের পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষ পাশ কাটিয়ে যাওয়া দরকার। সে জন্য কখনও পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টারের নির্দেশ অনুযায়ী কখনও বা নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম উপগ্রহগুলিকে নাড়াচড়া করানো হয়।
আর এ কাজের জন্য আছে বিভিন্ন রকম ভাবে থ্রাস্ট বা বল-সৃষ্টিকারী ইঞ্জিন। ‘থ্রাস্টার’। এই ইঞ্জিন চালাতে জ্বালানি প্রয়োজন। রাসায়নিক, বৈদ্যুতিক, পারমাণবিক ইত্যাদি হরেক রকম জ্বালানি। মাটি থেকে পাঠানো রকেট যেমন ব্যবহার করে রাসায়নিক জ্বালানি। মহাকাশেও এই জ্বালানি চলে। মনোপ্রোপাল্যান্ট থ্রাস্টারে হাইড্রাজিন নামে এক রাসায়নিকের ব্যবহার হয়।
থ্রাস্টার-সমেত এস্টোনিয়ান কিউবস্যাট
আমি যখন নাসার প্রোপালশন ব্রাঞ্চে কাজ করেছি, সে সময় লিভার, কিডনি ও নার্ভাস সিস্টেমের পক্ষে ক্ষতিকর বলে এই গ্যাস নিয়ে পরীক্ষা বন্ধ ছিল। তবে মহাকাশে এর ব্যবহার অব্যাহত। শুধু হাইড্রাজিন নয়। হাইড্রোজেনকেও মনোপ্রোপাল্যান্ট গ্যাস হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ডিপ স্পেস মিশনের জন্য লিও অরবিটে এক তরল হাইড্রোজেনের স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা হয়েছে। সেখানে গ্যাস ভরে মহাশূন্যে পাড়ি জমাবে আগামী কালের মহাকাশযান। এ ছাড়া আছে রেজিস্টোজেট থ্রাস্টার। এতে উত্তাপ ব্যবহার করে গ্যাসের গতি বাড়ানো হয়। একে প্রোপালশনের পরিভাষায় বলে ‘ডেলটা-ভি’।
যত কম জ্বালানি খরচ করে যত বেশি ডেলটা-ভি পাওয়া যাবে, সে থ্রাস্টারের কদর তত বেশি। পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণের সময় রকেটের পিঠে চেপে মাধ্যাকর্ষণের মায়া কাটিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার প্রচুর জ্বালানি। এমনকি ফিউশন প্রক্রিয়ার মতো অতি উন্নত পদ্ধতিতেও মহাকাশে কোনও দূর গন্তব্যস্থলে উড়ে যেতে এবং সেখানে থামতে যানের ভরের ন’গুণ জ্বালানি লাগবে। দশ কেজি মহাকাশযানের জন্য নব্বই কেজি জ্বালানি। যত বেশি জ্বালানি, তত বড় ইঞ্জিন। তত বেশি শক্তিক্ষয়। তাই কেবল ডেলটা ভি নয়। বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন আরও এক পরিমাপ। নিউটন বলের একক। প্রতি সেকেন্ডে এক একক ওজনের জ্বালানি ব্যবহার করে যত নিউটন বল সৃষ্টি করা যায়, তাকে বলে স্পেসিফিক ইমপালস বা আইএসপি। রকেটের থ্রাস্ট বেশি। আইএসপি খুব কম। সে জন্য উৎক্ষেপণের সময় রকেটের বিভিন্ন অংশ ভাগ করা থাকে। আকাশপথে কিছু দূর যাওয়ার পর ধাপে ধাপে সেই অংশগুলো খসে পড়ে। যানের ওজন কমায়। মহাকাশে হাইড্রাজিনের থ্রাস্টার বেশ কয়েক নিউটন বল সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু এর আইএসপি মাত্র ২০০-২৫০ সেকেন্ড। কোল্ড গ্যাস থ্রাস্টারের আইএসপি ৭০ সেকেন্ডের কম। তুলনায় ইলেকট্রিক এবং ইলেকট্রোস্প্রে থ্রাস্টারের আইএসপি ২০০০ থেকে ৮০০০ সেকেন্ড। অর্থাৎ, সেকেন্ডে ২০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিবেগ।
বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত ইলেকট্রিক প্রোপালশনে সবচেয়ে পরিচিত ‘হল’ এফেক্ট থ্রাস্টার (বিজ্ঞানী এডউইন হলের নামানুসারে) আর আয়ন থ্রাস্টার। দুটোতেই জ্বালানি মূলত জ়েনন, ক্রিপটন ইত্যাদি গ্যাসের প্লাজমা। সত্তরের দশক থেকে মহাকাশের বহু স্যাটেলাইটে ‘হল’ এবং আয়ন থ্রাস্টার ব্যবহার করা হয়েছে। এরা কয়েক মিলি নিউটন বল তৈরি করতে সক্ষম।
ইলেকট্রোস্প্রে থ্রাস্টার তৈরি করে মাইক্রো নিউটন বল। অর্থাৎ, এক নিউটনের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। ভাবছেন, এত কম বলপ্রয়োগে কী কাজ হবে? ভূপৃষ্ঠের দেড়শো মাইল উচ্চতায় বাতাসের ঘনত্ব সমুদ্রতলের বায়ুস্তরের ঘনত্বের হাজার কোটি ভাগ। সেখানে প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে গড়ে একশো কোটি অণু। মহাশূন্যে আরও কম। এত কম অণু থাকার জন্য বাতাসের ঘর্ষণ কম। ফলে খুব স্বল্প পরিমাণ বল ব্যবহার করে ক্রমশ অনেক বেশি গতিবেগে পৌঁছনো যায়। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীতে কোনও গমের দানা আঙুলের টোকা দিয়ে সরাতে যতটা বল প্রয়োগ প্রয়োজন, সেই একই বল দীর্ঘ সময় ধরে প্রয়োগ করে মহাকাশে কয়েক হাজার মাইল গতিতে মহাকাশযান চালানো সম্ভব।
যেমন, ভয়েজার টু। ১৯৭৭ সালে পাঠানো এই মহাকাশযান সৌরজগতের মায়া কাটিয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রবেশ করল ইন্টারস্টেলার এলাকায়। তখন তার গতি ঘণ্টায় প্রায় ৩৬,০০০ মাইল। এমন অনেক মহাকাশযান সুদূর অন্তরীক্ষে পাঠানো হয়। কোনওটা বা আমাদের সৌরজগতের গণ্ডির মধ্যে গ্রহ-উপগ্রহ বা অ্যাস্টেরয়েডের পথে পাড়ি দেয়। যেমন, মঙ্গলগ্রহে সোজার্নার নামানো হল। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর পাথফাইন্ডার-এর গতি নিয়ন্ত্রণ করা হল। সবই এই থ্রাস্টারদের কল্যাণে। স্যাটেলাইটের আকার যত ছোট হবে, থ্রাস্টারের আকৃতিও তত ছোট হবে। কারিগরি বদলাবে। যেমন মাইক্রো, ন্যানো আর কিউবস্যাট। কোথাও ব্যবহার হচ্ছে ইলেকট্রোস্প্রে। জাইরোস্কোপ। পাল্সড প্লাজমা। কোথাও বা রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি থ্রাস্টার। বলা বাহুল্য, এর যে কোনও একটি বিষয় নিয়ে অনেকগুলো থিসিস ইতিমধ্যে লিখে ফেলা হয়েছে।
স্যর রিচার্ড ব্র্যানসনের ভার্জিন গ্যালাক্টিক। এলন মাস্ক-এর স্পেস এক্স স্টারশিপ। এ সব তো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে মানুষকে ঘুরিয়ে আনার জন্য তৈরি। আর একটু সবুর করলে চাঁদের কক্ষপথেও ঘুরে আসা যাবে। এই নভেম্বরে নাসার কাছে আমেরিকার বোয়িং কোম্পানি কক্ষপথ থেকে চাঁদের মাটিতে যাতায়াতের এক রিইউজ়েবল হিউম্যান ল্যান্ডার সিস্টেম বানাবার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আরটেমিস প্রকল্পে নাসা ২০২৪ সালের মধ্যে চাঁদে প্রথম মহিলা মহাকাশচারী পাঠাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৮ নাগাদ চাঁদের শিবির থেকে মহাকাশযানে চড়ে বুধ গ্রহে পাড়ি দেবে মানব-মানবী। সেটা হবে স্পেস প্রোপালশন টেকনোলজির পরবর্তী প্রজন্ম।