Science News

কলকাতার দিব্যেন্দুর ছবিই বলয়গ্রাসে মিলিয়ে দিল সূর্যের অভিসন্ধি

সূর্যের মনের কথা পড়ে ফেলতে পারলেন কলকাতার দিব্যেন্দু নন্দী আর তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। সূর্যের আচার, আচরণ কেমন, তার বায়ুমণ্ডল বা ‘করোনা’ কতটা ক্ষ্যাপাটে হতে পারে, আগেভাগে তার দু’টি ছবি এঁকেছিলেন দিব্যেন্দুরা।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৮:৩৬
Share:

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস। অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী (বাঁ দিকে), সঙ্গে সৌম্যরঞ্জন দাশ।

কলকাতার আজ আবার বড় দিন! বড়দিনের পরের দিনের সকালটাও যে ফের একটা ‘বড় দিন’ এনে দিল বাঙালির ঘরে!

Advertisement

সূর্যের মনের কথা পড়ে ফেলতে পারলেন কলকাতার দিব্যেন্দু নন্দী আর তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। সূর্যের আচার, আচরণ কেমন, তার বায়ুমণ্ডল বা ‘করোনা’ কতটা ক্ষ্যাপাটে হতে পারে, আগেভাগে তার দু’টি ছবি এঁকেছিলেন দিব্যেন্দুরা। বৃহস্পতিবারের বলয়গ্রাসে তাঁদের আঁকা সেই ছবিদু’টি একেবারে হুবুহু মিলিয়ে দিল নাসার মহাকাশযান ‘সোলার অ্যান্ড হেলিওস্ফেরিক অবজারভেটরি (সোহো)’-র ভিতরে থাকা একটি বিশেষ যন্ত্র ‘করোনাগ্রাফ’ (‘লাসকো-সি-২’)।

এ দিন সকালের বলয়গ্রাস জানিয়ে দিল, দিব্যেন্দুরা সূর্যের মনের কথা অনেকটাই জেনে ফেলতে পেরেছেন। ধরে ফেলতে পেরেছেন সূর্যের করোনার আচার, আচরণটা এই মুহূর্তে ঠিক কেমন, কী তার গোপন অভিসন্ধি!

Advertisement

কেন আগেভাগে ছবি এঁকেছিলেন দিব্যেন্দুরা?

সূর্য থেকে ছুটে আসা নানা ধরনের হানাদারদের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্যই তার মনের এই সব গোপন অভিসন্ধি জেনে, বুঝে ফেলার দরকার ছিল বিজ্ঞানীদের। না হলে যে কোনও মুহূর্তে তাদের আচমকা হামলায় বিকল, নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করা কৃত্রিম উপগ্রহগুলির গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রগুলি। তাদের হানাদারিতে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) বিভিন্ন যন্ত্রাংশের। সেখানে থাকা মহাকাশচারীদেরও ক্ষতি হতে পারে শারীরিক ভাবে। এক লহমায় সাড়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে দিতে পারে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু ও তার লাগোয়া এলাকাগুলির বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবস্থার। অচল করে দিতে পারে জিপিএস। যাবতীয় যোগাযোগব্যবস্থাও।

সূর্যের বলয়গ্রাস। তিরুচিরাপল্লিতে বৃহস্পতিবার। ছবি- আইআইটি মাদ্রাজের সৌজন্যে।

সূর্যের মনের গোপন অভিসন্ধিগুলি আগেভাগে জানা, বোঝা গেলে, যে বিপদগুলি কিছুটা এড়ানো সম্ভব। আপৎকালীন ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।

একেবারে ‘পারফেক্ট টেন’!

তাই ছবি এঁকেছিলেন মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার-কলকাতা)’-র অধ্যাপক বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দিব্যেন্দু নন্দী আর তাঁর ছাত্রছাত্রী সৌম্যরঞ্জন দাশ ও প্রান্তিকা ভৌমিকরা। দেখতে চেয়েছিলেন, সূর্যের আচার আচরণটা এই সময়ে ঠিক এমনটাই হয় কি না। করোনাগ্রাফ ‘লাসকো-সি-২’ জানিয়ে দিল, দিব্যেন্দু, সৌম্যরঞ্জনের আঁকা ছবিদু’টি আদ্যোপান্তই ঠিক। তাতে কোনও ভুলচুক নেই। তুলির টানে কোথাও বেশি আঁচড় পড়েনি। কোথাও রং বেশি, কোথাও রং কম, তেমনটাও নয়। জিমন্যাস্টিকসের পরিভাষায় যাকে বলে, ‘পারফেক্ট টেন’, ছবিদু’টি একেবারেই তাই। ছবিগুলি আঁকা হয়েছে কম্পিউটারে। যার নাম ‘কম্পিউটার সিম্যুলেশন’।

সূর্য থেকে ছুটে আসা সেই হানাদাররা!

সূর্যের মনের গোপন কথা জানতে দিব্যেন্দুরা ছবিগুলি এঁকেছিলেন তার চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির চেহারা, চরিত্র, আচার, আচরণ নিয়ে। কারণ, সূর্যের যাবতীয় ‘খেলাধুলো’, গ্রহ, উপগ্রহগুলিকে শক্তি জোগানো আর নানা ধরনের বিষাক্ত কণা ও ঝড়, বায়ুকে গোটা সৌরমণ্ডলে পাঠানোর পিছনে মূলত কলকাঠি নাড়ে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলিই।

সূর্যের বায়ুমণ্ডলের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির এই ছবিই এঁকেছিলেন দিব্যেন্দুরা

এই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির ক্ষ্যাপাটে কাণ্ডকারখানার জন্যই তৈরি হয় সৌরবায়ু (সোলার উইন্ড), সৌরঝড় (সোলার স্টর্ম)।

তৈরি হয় ‘করোনাল মাস ইজেকশন (সিএমই)’-এর মতো ঘটনাও। যখন মনে হয়, সূর্যের ভিতর থেকে যেন তার ‘মাংস’ উপড়ে নিয়ে কিছু উঠে আসছে। তা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা সৌরমণ্ডলে।

সৌরবায়ু, সৌরঝড় আর সিএমই, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। সবগুলিই পৃথিবী-সহ সৌরমণ্ডলের অন্য সব গ্রহ, উপগ্রহদের পক্ষে ভয়ঙ্কর। ক্ষতিকারক। সূর্যের ছোড়া ওই ‘বাণ’গুলির মধ্যে যে ক’টি পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে, সেগুলি এসে আছড়ে পড়ে আমাদের বায়ুমণ্ডলের একেবারে উপরের স্তরে। যাকে আমরা বলি ‘আয়নোস্ফিয়ার’।

কেন দিব্যেন্দুরা তাকিয়ে ছিলেন এই বলয়গ্রাসের দিকে?

সূর্যের একেবারে অন্দরে যেখানে পরমাণু চুল্লিটা আছে, সেখানকার তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি কেলভিন। সেখান থেকে সূর্যের পিঠ বা ফোটোস্ফিয়ারের দূরত্বটা ৭ লক্ষ কিলোমিটার। যেখানকার তাপমাত্রা ৫ হাজার ৭০০ থেকে ৬ হাজার ডিগ্রি কেলভিন বড়জোর।

সূর্যের উত্তর গোলার্ধের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির এই ছবি এঁকেছিলেন দিব্যেন্দুরা

কিন্তু তার পরেই যেন হঠাৎ ক্ষেপে উঠল সূর্য! পিঠ থেকে ২ হাজার কিলোমিটার উপরে থাকা তার বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে নীচের স্তরটিকে তাতিয়ে তুলল রীতিমতো গনগনে ১০ হাজার বা তারও কিছু বেশি ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায়। ওই স্তরের নাম ‘ক্রোমোস্ফিয়ার’।

চমকের শেষ নয় এখানেই। ক্রোমোস্ফিয়ার থেকে শুরু হল সূর্যের বায়ুমণ্ডল। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘করোনা’। ফোটোস্ফিয়ার থেকে যে করোনার শেষ প্রান্তটার দূরত্ব প্রায় ৭০ লক্ষ কিলোমিটার।

রহস্যের জন্ম হল। সূর্যের অন্দরে থাকা পরমাণু চুল্লির তুলনামূলক ভাবে কাছে থাকা সত্ত্বেও ফোটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা যেখানে মাত্র ৬ হাজার ডিগ্রি কেলভিন, সেখানে পরমাণু চুল্লি থেকে তার প্রায় ১০ গুণ দূরত্বে থাকা করোনার তাপমাত্রা কী ভাবে একলাফে বেড়ে হয়ে যায় ১০ লক্ষ ডিগ্রি কেলভিন?

সেই রহস্যের জট খুলতেই সূর্যকে আমাদের আরও গভীর ভাবে চেনা, জানার প্রয়োজন হয়। কয়েক শতাব্দী ধরে এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন তত্ত্বের জন্ম হয়েছে।

সূর্যের উত্তর গোলার্ধের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির আচার আচরণ: দিব্যেন্দুদের আঁকা আর একটি ছবি

করোনায় সূর্যের বিপরীতধর্মী (ধনাত্মক ও ঋণাত্মক) দু’ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি এক অন্যের কাছে এসে নিজেদের ধ্বংস করে ফেললে বিপুল পরিমাণে চৌম্বক শক্তি জন্ম হয়। যা পরিবর্তিত হয় তাপশক্তি ও গতিশক্তিতে। করোনার প্রচণ্ড তাপমাত্রার অন্যতম কারণ এটি, মনে করেন বিজ্ঞানীদের একাংশ।

আবার বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন, সূর্যের পিঠ বা ফোটোস্ফিয়ারে যেখানে চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি রয়েছে, সেখান থেকে এক ধরনের তরঙ্গ (অ্যালফ্‌ভেন ওয়েভ) বেরিয়ে আসে। ওই তরঙ্গের জন্ম হয় ফোটোস্ফিয়ারের নীচে ঢুকে যাওয়া চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির নীচের অংশগুলির মধ্যে সব সময় কাঁপাকাঁপি চলে বলে। একটা তারকে এক জনের হাতে ধরিয়ে তারের অন্য প্রান্তটি আপনার হাতে নিয়ে ঝাঁকালে যেমন তরঙ্গের জন্ম হয়, ঠিক তেমনই। ওই তরঙ্গ করোনায় পৌঁছে তার তাপমাত্রা কয়েক লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দেয়। সেই তরঙ্গগুলি যদি লম্বায় খুব বড় হয়, তা হলে তা সূর্যের বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে বাইরের মহাকাশেও ছড়িয়ে পড়ে। তরঙ্গ খুব শক্তিশালী হলে তা সৌরবায়ুর (সোলার উইন্ড) গতিবেগ অসম্ভব বাড়িয়ে দিতে পারে।

রয়েছে আরও তত্ত্ব। ‘নানা মত নানা মুনি’র। যদিও রহস্যের জট পুরোপুরি খোলেনি এখনও পর্যন্ত। বোঝা যায়নি করোনায় কী ভাবে তার ‘খেলাধুলো’ চালিয়ে যাচ্ছে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি।

কেন করোনাকে দেখতে হয়?

দিব্যেন্দু জানাচ্ছেন, সেই জট খুলতেই সূর্যের করোনাকে দেখতে হয়। কিন্তু সূর্যের করোনাকে কোনও দিনই খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। তার ঘনত্ব খুব কম, ফলে আলোর বিচ্ছুরণও (স্ক্যাটারিং) কমই ঘটে। তুলনায় ফোটোস্ফিয়ার অনেক বেশি ঘন। তার থেকে বিচ্ছুরণ বেশি।ফলে উজ্জ্বলতাও বেশি। সেই ঔজ্জ্বল্যেই ঢেকে যায় করোনা। আমরা সব সময়েই সূর্যের ফোটোস্ফিয়ারকে দেখি। দুই মেরুতে বিভিন্ন ‘অরোরা’ বা মেরুজ্যোতি দেখার সময়েই আমরা করোনার কিছুটা প্রভাব দেখতে পাই।

আর দেখা যায় সূর্যের পূর্ণগ্রাস হলে। সেই সময় চাঁদ যেহেতু সূর্যের ফোটোস্ফিয়ারকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়, তাই করোনা ধরা দেয় আমাদের চোখে। করোনা নিয়ে তাঁদের যাবতীয় পরীক্ষা করে নেওয়ার জন্যে বিজ্ঞানীরা যে কারণে মুখিয়ে বসে থাকেন পূর্ন গ্রাসের অপেক্ষায়। কিন্তু গবেষণার জন্য তো আর প্রকৃতির উপর ভরসা রেখে বসে থাকলে হবে না। কবে একটা সূর্যগ্রহণ হবে, তার অপেক্ষায় থাকতে হলে তো সৌরপদার্থবিজ্ঞানীদের খুব মুশকিল।

তাই বানানো হয়েছে ‘করোনাগ্রাফ’। পূর্ণ-গ্রাসের সময় চাঁদ যে ভাবে সূর্যের মাঝখানটাকে ঢেকে দেয়, অনেকটা সেই কৌশলেই কাজ করে করোনাগ্রাফ। তার ফলে, সূর্যগ্রহণ না হলেও করোনাগ্রাফ দিয়ে সূর্যের ফোটোস্ফিয়ারকে ঢেকে তার করোনার মন বোঝার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা।

এ বার ভাবা যাক বলয়গ্রাসের কথা। তখন ফোটোস্ফিয়ার পুরোপুরি ঢাকা পড়ে না। তার ৯৯ শতাংশ ঢাকা পড়ে। এবং তখনও করোনার চেয়ে সূর্যের ফোটোস্ফিয়ারের ঔজ্জ্বল্য অন্তত ১০ হাজার গুণ বেশি হয়। যদিও দেখা গিয়েছে, করোনাগ্রাফ ও বলয়গ্রাসের সমন্বয়ে করোনা থেকে যে তথ্য পাওয়া সম্ভব, শুধু করোনাগ্রাফ দিয়ে তত ভালো না-ও পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও, পূর্ণগ্রাসের সময় ব্যবহার করা হবে এমন বেশ কিছু যন্ত্র পরীক্ষা করে নেওয়া হয় বলয়গ্রাসের সময়। তাই সৌরপদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

দিব্যেন্দুদের আঁকা ছবিকে এ দিন বলয়গ্রাসের সূর্য ‘রাইট’ বলে দেওয়ায় শুধু বাঙালিরই জয় হল না কিন্তু। বিশ্বের তাবৎ সৌরপদার্থবিজ্ঞানীরা যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর ধরে, তাঁদেরও দিল আশার আলো!

ছবি সৌজন্যে: আইসার-কলকাতা

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস

ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement