গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
ইসরোর গ্রাউন্ড কন্ট্রোল রুমে একটা সুইচ টেপা হল। গেল একটা টেলিফোন বা ফ্যাক্স-বার্তা। অথবা মোবাইল মেসেজ। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অ্যালার্ম ঘড়িটা বেজে উঠল ৪ আলোকবর্ষ দূরে থাকা নক্ষত্রমণ্ডল ‘আলফা সেনটাওরি’তে! জেগে উঠল আলফা সেনটাওরির সেই অ্যালার্ম ঘড়িটা! হ্যাঁ, আলফা সেনটাওরি থেকে আমাদের দূরত্বের নিরিখে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। আলোর গতিবেগে ছোটা সম্ভব হলে সঙ্গে সঙ্গেই হত। তাৎক্ষণিক। ফলে খুব তাড়াতাড়ি হলেও আলফা সেনটাওরির সেই অ্যালার্ম ঘড়িটাকে বাজাতে সময় লাগবে চার বছরের একটু বেশি।
অথবা খুব জটিল একটা অঙ্ক। যেটা কষতে এখনকার কম্পিউটারের লেগে যেত হাজার কোটি বছর। সেটা হয়তো এ বার কষে ফেলা যাবে এক সেকেন্ড বা তারও ভগ্নাংশে! আমার-আপনার কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের দেখানো এক ‘ভুতুড়ে খেল’ এই সব আশার পালেই জোরালো বাতাস দিল। এই প্রথম। গবেষণায় সাহায্য করেছে ডেনমার্কের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি।
এই গবেষণা দেখাল, একটি কম্পিউটার চিপ থেকে অনেক দূরে থাকা অন্য একটি কম্পিউটার চিপে অত্যন্ত দ্রুত বার্তা পাঠানো যায় একটি অভিনব পদ্ধতিতে। যেখানে দূরত্বের বাধা অনেকটাই কমে যাবে। আর অতটা দূরত্ব পেরতে বার্তার তুলনামূলক ভাবে সময়ও লাগবে অনেকটাই কম।
দু’টি সিলিকন চিপ আর ফোটনেই ভুতুড়ে খেল!
এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-ফিজিক্স’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায়। ব্যবহার করা হয়েছে দু’টি সিলিকন চিপ। ১০ মিটার দীর্ঘ তার। আর আলোর কণা ‘ফোটন’। ফোটন কণাটিকে একটি সিলিকন চিপ থেকে অনেক দূরে থাকা সিলিকন চিপে পাঠানো সম্ভব হয়েছে, ১০ মিটার দীর্ঘ সংযোগকারী তারের মাধ্যমে। এর আগে এত অল্প সময়ে যা কখনও সম্ভব হয়নি।
এর আগে উপগ্রহের মাধ্যমে দু’টি শহরের মধ্যে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের যে সফল পরীক্ষা করেছিল চিন।
সহযোগী গবেষক, ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যান লেউইলিন বলেছেন, “তাঁদের পরীক্ষায় একটি কম্পিউটার চিপ থেকে ৯১ শতাংশ বার্তা দূরে থাকা অন্য একটি কম্পিউটার চিপে পাঠানো সম্ভব হয়েছে।"
এই আবিষ্কার কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে গণনাকে (কোয়ান্টাম কম্পিউটিং) সহজতর ও দ্রুততর করে তোলার সম্ভাবনা তো বাড়িয়ে দিলই, অত্যন্ত দ্রুত গতির কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের আশাকেও জোরালো করে তুলল।
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন কী জিনিস?
এই ঘটনাকে আমি, আপনি ভুতুড়ে ভাবতে পারি! কিন্তু বিজ্ঞানের পরিভাষায় এর নাম- ‘কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন’।
কোনও জিনিসকে বাক্স বা পার্সেলে পুরে আমরা অনেক দূরে পাঠাতে পারি। যাকে বলে ‘ট্রান্সপোর্টেশন’। আবার বহু ক্ষণ ধরে টেলিফোনে বহু কথা বলাবলি করেও কোনও জিনিসকে অনেক দূরে পাঠানো যায়। যাকে বলি, ‘টেলিপোর্টেশন’। তবে তার জন্য লাগে অসীম সময়। সনাতনী পদার্থবিজ্ঞানে (ক্লাসিকাল মেকানিক্স) এটাই দস্তুর। সেখানে দূরত্বের ভূমিকা থাকে।
আর এক রকম ভাবেও কাজটা করা যায়। কী ভাবে জানেন? এখানকার জিনিস সম্পর্কে অন্য জায়গায় খবর পাঠিয়ে। যাতে সেই জায়গাতেও এখানকার জিনিসটাই তৈরি করা যায়। এই পদ্ধতিকে বলা হয়, ‘কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন’। যেখানে দূরত্বটা বড় কথা নয়।
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন: ভিডিয়োয় খুব সহজে
গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?
ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণার অভিনবত্ব, তাঁরা টেলিফোনের লাইন কাটেননি। ফোনে কথা বলাবলিতেও কোনও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি। তবে টেলিফোনে যাতে কম বাক্যালাপেই কাজটা হয়ে যায়, তার ব্যবস্থা করেছেন। সঙ্গে জুড়েছেন কণা ও পদার্থদের আরও একটি অবস্থার বিশেষ একটি চরিত্রকে।
যে অবস্থাটিকে পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘কোয়ান্টাম’ অবস্থা। আর কণা ও পদার্থদের সেই বিশেষ চরিত্রটিকে বলা হয় ‘কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট’।
ইলাহাবাদের ‘হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচআরআই)’-এর পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক উজ্জ্বল সেন বলছেন, “প্রথমত, কম্পিউটারের দু’টি চিপের মধ্যে এই বার্তা পাঠানোর পরীক্ষা এর আগে সফল হয়নি। সেই অর্থে, এই আবিষ্কার যুগান্তকারী। দ্বিতীয়ত, এত অল্প সময়েও এত বেশি পরিমাণে বার্তা পাঠানো সম্ভব হয়নি। করা সম্ভব নয় ঠিকই, তবে যদি সনাতনী পদার্থবিজ্ঞানের কৌশলে সেই বার্তা পাঠানো যেত, তা হলে মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ খবর পাঠানো যেত।’’
কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট কী জিনিস?
ধরুন, আপনি দিল্লিতে রয়েছেন। আর আমি রয়েছি কলকাতায়। আমাদের মধ্যে একটা ভৌগোলিক দূরত্ব রয়েছে। আপনি ঠিক করলেন, আপনার কয়েকটি বিশেষ গুণ, আপনার আচার, আচরণ আপনি আমাকে দিয়ে দেবেন। ভাল গুণগুলিই দেবেন বলে ঠিক করেছেন। তার জন্য অবশ্য অন্তত এক বার আমাদের দু’জনের সাক্ষাৎ হতে হবে। সাক্ষাতের পর ভাল লেগেছিল বলেই তো আমাকে আপনার কয়েকটি ভাল গুণ দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাই না? সেই সাক্ষাতের পর হয় আপনি দিল্লি ফিরে গেলেন বা আমি কলকাতায় ফিরে এলাম। তার পর আপনি আপনার কয়েকটি গুণ আমাকে দিয়ে দিতে চাইলে, দিতে পারবেন।
কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট: ভিডিয়োয় খুব সহজে
দিল্লি থেকে ট্রেনে, বিমানে, পার্সেলে বা ক্যুরিয়ারে আমাকে পাঠাতে হবে না গুণগুলি। টেলিফোনে কথাও বলতে হবে খুব সামান্যই। সেগুলি খুব অল্প সময়ে দিল্লি থেকে কলকাতায় আমার মধ্যে এসে যাবে।
তবে, আপনার বিমর্ষ হওয়ারও কারণ থাকবে সে ক্ষেত্রে। আপনার বাছাই করা যে ভাল ভাল গুণগুলি আপনি আমাকে ‘শেয়ার’ করলেন, সেগুলি কিন্তু আপনার মধ্যে থেকে ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাবে। ফলে, আপনি উল্টোটাও করতে পারেন। আপনার খারাপ গুণগুলিও আমাকে শেয়ার করতে পারেন। তাতে সেগুলি আর আপনাকে জ্বালাবে না!
এই সব করতে টেলিফোনে সামান্য বাক্যালাপ ছাড়াও আমার ও আপনার মধ্যে একটা ‘কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট’ অবস্থা। একটা বিশেষ অবস্থা। যা আমার ও আপনার মধ্যে এক বারের সাক্ষাতেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মনের মিল বলতে পারেন। এক বারের সাক্ষাতে ভাল লেগেছিল বলেই তো আপনি আপনার কয়েকটি ভাল গুণ আমাকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন!
আইনস্টাইনও বিশ্বাস করতে পারেননি!
রূপকথা ভাবছেন তো? ভাবছেন কোনও কল্পকাহিনী?
ভাবতেই পারেন। আইনস্টাইনের মতো প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীও অনেক দিন আগে এই ব্যাপারটাকে মানতেই চাননি। বলেছিলেন, ‘স্পুকি অ্যাকশন’। ‘ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা’।
আলোর চেয়ে বার্তাকে জোরে ছোটানো যাবে না
ইলাহাবাদের ‘হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচআরআই)’-এর পদার্থবিজ্ঞানের ‘ভাটনগর’ পুরস্কারজয়ী অধ্যাপক অদিতি সেন দে বলছেন, “এই গবেষণা সত্যিই অভিনব। তবে গবেষণার সারমর্ম সরলীকৃত হয়ে একটা ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে। কেউ ভাবতে পারেন, একটি কম্পিউটার চিপ থেকে হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই বার্তা পাঠানো যাবে অনেক দূরে থাকা অন্য একটি কম্পিউটার চিপে। তাৎক্ষণিক। যার মানে, আলোর গতিবেগে অন্তত বা তার চেয়েও বেশি গতিবেগে। কিন্তু সেটা একেবারেই ভুল ধারণা। তবে অনেক বেশি দ্রুত গতিতে। এর আগে যে গতিবেগে পৌঁছনো কখনও সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, এই পদ্ধতিতে দুই ‘কিউবিট’ বা চারটি বার্তা পাঠানো যেতে পারে। যা ক্লাসিকাল ‘বিট’ দিয়ে কখনওই সম্ভব নয়।’’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের সফল পরীক্ষা ঘরের মধ্যে করা হয়েছে। করা হয়েছে ২৫ কিলোমিটার (সাড়ে ১৫ মাইল) এবং ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) দূরত্বে। তার পর উপগ্রহের মাধ্যমে সেই বার্তা পাঠানো সম্ভব হয়েছে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার (৭৪৬ মাইল) দূরত্বেও।
অদিতির কথায়, “এমনকী, একই কম্পিউটারের চিপের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যেও এই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে। তবে দু’টি কম্পিউটার চিপের মধ্যে এই বার্তা বিনিময়ের ঘটনা ঘটানো এই প্রথম সম্ভব হল।’’
গুগলের কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং এই আবিষ্কার
তবে এই সফল পরীক্ষার ফলে গুগলের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের গতি আরও বাড়ানো যাবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়, জানিয়েছেন উজ্জ্বল। তবে তাঁর বক্তব্য, “আগামী দিনে কোনও কোয়ান্টাম কম্পিউটারে দু’টি চিপের মধ্যে এই পরীক্ষা করা সম্ভব হলে, তার ভিত্তিতে সেই কম্পিউটারকে আরও দ্রুত গতিসম্পন্ন ও আরও বেশি পারদর্শী করে তোলা সম্ভব হতে পারে।’’