গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
না, এখনও আশা ছাড়িনি। ঘটনাটা আগামী কাল, রবিবারেও ঘটতে পারে। ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ সিগন্যাল পাঠিয়ে ‘চন্দ্রযান-২’-এর অরবিটারকে জানিয়ে দিতেই পারে, চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ঠিক কোন জায়গাটায় সে পা ছুঁইয়েছে! এও জানাতে পারে, তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সে রোভার প্রজ্ঞানের সামনে ছোট্ট দরজাটা খুলে দিয়েছিল কি না।
মনটা খারাপই হয়ে রয়েছে। যেহেতু কাল, শুক্রবার গভীর রাতে চাঁদের পিঠে নেমেছে কি না, নামলে কোথায় নেমেছে, প্রায় একটা দিন বয়ে যেতে চলল, তার কোনও সিগন্যালই যে বিক্রম এখনও অরবিটারকে পাঠায়নি। পাঠায়নি বলে অরবিটারও বেঙ্গালুরুতে ইসরোর গ্রাউন্ড কন্ট্রোল রুমকে দিতে পারেনি চাঁদের পিঠে বিক্রমের ‘পৌঁছ সংবাদ’।
যে সংবাদটা পাওয়ার আশা ইসরো কাল শুক্রবার করেছিল, আগামী ১৪ দিন সেই আশাটা ইসরো ছাড়বে বলে আমার মনে হয় না। মানে, ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কারণ, চাঁদের যেখানটায় বিক্রম নেমেছে, ওই দিন পর্যন্তই, সেখানটায় সূর্যের আলো এসে পড়বে। তার পর ১৪ দিন ধরে সেখানটায় সূর্যের আলো পড়বে না। রাত নেমে আসবে চাঁদের সেই অংশে। চাঁদের রাতে হাড়জমানো ঠান্ডায় বিক্রমের সিগন্যাল পাঠানোর ব্যবস্থা কাজ করবে, এমন আশা করাটা কিছুটা বাতুলতাই।
যে পথে নামার কথা ছিল (লাল রং), তার থেকে যে ভাবে শেষ মুহূর্তে বদলে গেল বিক্রমের অবতরণের পথ (সবুজ রং)।
২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিক্রমের সাড়া পাওয়ার চেষ্টা চালাবে ইসরো
তার মানে, শুধু আগামী কালই নয়, ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিক্রমের পাঠানো সিগন্যালের হদিশ পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে ইসরো।
অত দিন অপেক্ষা করতে না-ও হতে পারে। হয়তো কাল, রবিবারই ইসরো পেয়ে গেল বিক্রমের ‘পৌঁছ সংবাদ’। কালকের তিথিটা দশমী। চাঁদের মাটিতে বিক্রমের পা ছোঁয়ানোর জন্য ইসরো বেছেছিল যে সময়টা, ভারতীয় সময়ে গত কাল, শুক্রবার, রাত ১টা ৫২ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডে। সেই তিথিটা আদতে অষ্টমী।
আনন্দবাজারকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী, দেখুন সেই ভিডিয়ো
দিন বাছতে গিয়েই ভুল করেছিল ইসরো?
আমার মনে হয়, ইসরো এই দিনটি বাছতে গিয়েই বোধহয় ভুল করেছিল। ইসরো যদি অষ্টমীর তিথিটি না বেছে তার দিনদু’য়েক পর দশমী (আগামী কাল, রবিবার) তিথিটি বেছে নিত, তা হলে হয়তো ইসরোকে গত কাল রাত থেকে এতটা উদ্বেগে কাটাতে হত না।
আরও পড়ুন- রামানুজনের পূণ্যভূমির মাটিই কি উতরে দেবে বিক্রমকে?
কেন অষ্টমীকে বেছেছিল ইসরো?
তার কারণ, চাঁদের যে অংশে নামার কথা বিক্রমের, ওই দিনটি থেকেই সেখানে সূর্যের আলো ফোটার কথা। ইসরো ভেবেছিল, ভোরের আলো ফুটতেই চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে বিক্রমকে নামিয়ে দেওয়া যাবে। তাতে পুরো ১৪টি সূর্যালোকিত পৃথিবীর দিন ধরে চাঁদে গবেষণা চালাতে পারবে বিক্রম ও রোভার ‘প্রজ্ঞান’। তার সুবিধাটা কী? যেহেতু বিক্রম ও প্রজ্ঞান চলবে সৌরবিদ্যুৎশক্তিতে, তাই গবেষণা, অনুসন্ধান, পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য চাঁদের ওই অংশে সূর্যের আলোকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারবে ল্যান্ডার ও রোভার।
আমার মনে হয় এইখানেই হয়তো ভুল করেছিল ইসরো। বিক্রমকে চাঁদের ওই অংশে নামানোর জন্য আর দু’-একটা দিন (নবমী বা শনিবার অথবা দশমী বা রবিবার) অপেক্ষা করা যেত।
কেন বলছি কথাটা?
চাঁদের পিঠে রয়েছে আমাদের গ্রহের ধুলোর চেয়েও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ণ ধুলিকণা। যেগুলিকে বলা হয় ‘রেগোলিথ’। খুব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বলে আর চাঁদের অভিকর্ষ বল পৃথিবীর ৬ ভাগের এক ভাগ বলে সেই রেগোলিথ কোনও ভাবে চাঁদের মাটি থেকে উপরে উঠে এলে তার চাঁদের মাটিতে নামতে সময় লাগে। সেগুলি তখন অনেকটা মেঘের মতো ভেসে বেড়ায় চাঁদের মাটি থেকে কিছুটা উপরে।
বিক্রমের নামার কথা চাঁদের দক্ষিণ মেরুর যেখানটায়, সেই অংশটি গিয়েছে ‘টার্মিনেটর’-এর উপর দিয়ে। এই টার্মিনেটর আসলে একটি কাল্পনিক বিভাজন রেখা। যার এক দিকে সূর্যের আলো এসে পড়ছে, অন্য দিকে পড়ছে না। যেমনটা পৃথিবীতে হয়। যার জন্য পৃথিবীর এক জায়গায় যখন দিনের ঝকঝকে আলো, তখন সূর্য ডোবার সময় ঠিক তার পাশেই দেখা যায় ঘুটঘুটে রাত। পৃথিবীতে যেমন ঊষা ও গোধূলি যে জায়গাগুলির উপর দিয়ে যায়, সেগুলি তাৎক্ষিণক টার্মিনেটরের উপরে রয়েছে।
আরও পড়ুন- ফিল্মস্টার, ক্রিকেটার নন, এ বার নতুন হিরো ইসরো
সূর্যের করোনা বা বায়ুমণ্ডল থেকে নানা ধরনের বিষ বেরিয়ে আসে। তার মধ্যে অন্যতম এক্স-রে। সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা সেই এক্স-রে আমাদের পৃথিবীর দিকেও ধেয়ে আসে। ধেয়ে যায় সৌরমণ্ডলের প্রতিটি গ্রহের দিকে, প্রতি মুহূর্তেই। কিন্তু তাতে আমাদের ক্ষতি হয় না, কারণ, পৃথিবীর রয়েছে পুরু বায়ুমণ্ডল। সেই বায়ুমণ্ডলই কার্যত আমাদের ‘কম্বলের চাদরে’ মুড়ে রেখে সূর্য থেকে আসা এক্স-রের ঝাপটা থেকে বাঁচায়। কিন্তু চাঁদের কোনও বায়ুমণ্ডল নেই। ফলে, সেই সুবিধাটা নেই চাঁদে। তাই সূর্য থেকে আসা এক্স-রে সরাসরি এসে আছড়ে পড়ে চাঁদের বুকে। চাঁদের মাটিতে। ধাক্কা মারে চাঁদের মাটিতে থাকা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রেগোলিথগুলিকে। সেই কণাগুলি তো আদতে বহু অণু, পরমাণু দিয়ে গড়া। তার মানে, সেই পরমাণুর কেন্দ্রে যতগুলি ধনাত্মক কণা প্রোটন রয়েছে, তাদের বাইরের খোলকগুলিতে (শেল) রয়েছে ঠিক ততগুলিই ঋণাত্মক কণা ইলেকট্রন।
এক্স-রে ধাক্কা মারলেই সেই রেগোলিথের পরমাণুগুলির গা গরম হয়ে যায়। উত্তেজনা কমাতে তখন সে বাইরের খোলকে থাকা ইলেকট্রনগুলিকে বাইরে ছেড়ে দেয়। তার ফলে, সেই রেগোলিথের সবক’টি কণাই হয়ে পড়ে একটি রাক্ষুসে ধনাত্মক কণা। তখন সমধর্মী কণাগুলি একে অন্যকে বিকর্ষণ করে। তার ফলে, সেই রেগোলিথের মেঘ প্রায় এক কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত উঠে যায়।
টার্মিনেটরের যে দিকটায় সূর্যের আলো পড়ছে, সেই দিকটাতেই এটা ঘটে। যে দিকটায় তখন সূর্যের আলো পড়ছে না, সেই দিকটা অন্ধকার, অসম্ভব ঠান্ডাও। সেই দিকেও তো রেগোলিথ রয়েছে। মুক্ত হওয়া ইলেকট্রনগুলি সেই দিকটায় ছুটে এসে ধাক্কা মারে রেগোলিথের কণাগুলিকে। গা গরম করে নিতে তখন সেই কণাগুলি সেই ইলেকট্রনগুলিকে নিয়ে ঋণাত্মক কণায় বদলে যায়। টার্মিনেটরের দুই দিকের মধ্যে থাকা সেই ধনাত্মক ও ঋণাত্মক কণার স্রোত তখন একে অন্যকে আকর্ষণ করতে শুরু করে। তার ফলে, টার্মিনেটরে একটি ঝড়ের (আদতে কণার ঝড়) জন্ম হয়। চাঁদের পিঠ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উঁচুতে।
ল্যান্ডার ‘বিক্রম’কে যখন একটু একটু করে গড়া হচ্ছিল ইসরোর গবেষণাগারে
সেই ঝড় শুধুই থাকে টার্মিনেটর বরাবর, যেখানে বিক্রমের নামার কথা ছিল। কিন্তু টার্মিনেটর থেকে দূরে গেলে সেই ঝড়ের কোনও অস্তিত্বই থাকে না। কাজেই অষ্টমী ছাড়া বাকি যে কোনও দিনই বিক্রমের ওই অবতরণের জায়গায় ঝড় বইত না।
উৎক্ষেপণের আগে বিক্রমকে পরীক্ষা করা হয়েছিল তামিলনাড়ুর সালেমের কাছে নামাক্কালের যে মাটি নিয়ে, সেই মাটি অনেকটা চাঁদের মতো হলেও তাতে কিন্তু কোনও রেগোলিথ ছিল না। ফলে, রেগোলিথের ঝড় মোকাবিলার পরীক্ষাটায় পাশ করানো যায়নি বিক্রমকে। উৎক্ষেপণের আগে।
রেগোলিথের ঝড়ই কি দিকভ্রান্ত করল বিক্রমকে?
আমার মনে হয়, ওই ঝড়ই হয়তো নামার সময় বিক্রমকে দিকভ্রান্ত করেছে। সেই ঝড়ই হয়তো ল্যান্ডার বিক্রমের সঙ্গে অরবিটারের যোগাযোগকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ফলে, বিক্রমের ‘পৌঁছ সংবাদ’ অরবিটার আমাদের দিতে পারেনি। তার পাঠানো শেষ যে সিগন্যালটি আমরা পেয়েছি, সেটি এসেছিল তখনই, যখন বিক্রম ছিল চাঁদের পিঠ থেকে ঠিক ২.১ কিলোমিটার উপরে। যেখানে রেগোলিথের সেই ঝড় পৌঁছয় না।
তাই ইসরো একটু অপেক্ষা করতে পারতো। অষ্টমীর দিন বিক্রমকে না নামিয়ে চাঁদের পিঠে তাকে নামাতে পারতো আজ শনিবার (নবমী) বা কাল, রবিবারে (দশমী)। তাতে রেগোলিথের সেই ঝড়ের মুখে পড়তে হত না বিক্রমকে। ইসরোর সঙ্গে তার যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হত না।
লেখক কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সের অধিকর্তা, দেশের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইসরো