ঝোড়ো গতিতে ব্যাট করছে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’।
দারুণ ব্যাট করছে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’। রীতিমতো কঠিন পিচে! যাকে বলে, বাঘের মতো লড়ছে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’। সুদূর মহাকাশে।
মহাকাশের অতল অন্ধকারে নতুন জিনিসের খোঁজে ‘গোয়েন্দাগিরি’(সায়েন্স অপারেশন) চালাতে এপ্রিলের গোড়ার দিক থেকে শুরু হয়েছিল তার পয়লা দফার ‘অপারেশন’। সেই ‘অপারেশন’-এ বেশ শক্ত পিচে খেলতে হলেও, ইসরো সূত্রের খবর, গোড়া থেকেই চালিয়ে খেলে চলেছে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’। অসম্ভব দ্রুত গতিতে পাঠিয়ে চলেছে ছবি। হরেক রকমের নতুন নতুন তথ্য। যার অনেক কিছুই এত দিন আমাদের জানা ছিল না। মহাকাশে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর এই ‘ঝোড়ো ব্যাটিং’ এতটাই নজর কেড়েছে গোটা বিশ্বের যে, পৃথিবী থেকে সাড়ে ৬শো কিলোমিটার ওপরে রীতিমতো কঠিন পিচে খেলতে নামা ভারতীয় উপগ্রহটির ওপর ভরসাটা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে উন্নত দেশগুলির। ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর কাজটা কঠিন ছিল, কারণ, পশ্চিমি দুনিয়ার বুকের ছাতি বাড়িয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) যতটা ওপরে রয়েছে, ভারতের এই উপগ্রহটি ‘গোয়েন্দাগিরি’ চালাচ্ছে চার দ্বিগুণ উচ্চতায়।
মহাকাশে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর ‘সায়েন্স অপারেশন’-এর চেয়ারম্যান, পুণের ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এর (আই-ইউকা) সিনিয়র প্রফেসর দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এই খবর দিয়ে বলছেন, ‘‘আমরা যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়েও অনেক বেশি সফল হয়েছে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’, সামান্য কয়েক মাসেই। দারুণ দারুণ ছবি আর নতুন নতুন তথ্য পাঠাচ্ছে ভারতের গর্বের এই উপগ্রহটি। আমরা ওর (অ্যাস্ট্রোস্যাট) পারফরম্যান্সে রীতিমতো চমকে গিয়েছি। এখনই সবটা খোলসা করে বলতে পারছি না। কারণ, সেই সব ছবি আর তথ্যাদি এখন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে খতিয়ে দেখা (পিয়ার-রিভিউ) হচ্ছে। সেই সব নজরকাড়া ফলাফল প্রকাশ্যে আসবে শীঘ্রই।’’
‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর মহাকাশ-যুদ্ধের ‘সেনাপতি’ অধ্যাপক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
দীপঙ্কর জানাচ্ছেন, কানাডা ও ব্রিটেন ছাড়াও উৎসাহীদের তালিকায় রয়েছে আমেরিকা, জাপান, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, জার্মানি, পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন ও ফ্রান্সের নাম। চিন ও রাশিয়াও এ ব্যাপারে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকেই। তারা চাইছে, ‘অ্যাস্ট্রোস্যাটে’র তথ্যগুলি তাদের দেওয়া হোক, যাতে সেটা তাদের গবেষণায় সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। তা ছাড়াও, তারা চাইছে মহাকাশে তাদের ‘ফেভারিট টার্গেট’গুলোর ওপরেও নজর রাখুক আর গোয়েন্দাগিরি চালাক ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’। স্বাধীনতার ৭০ বছরের মাথায়, মহাকাশে যে বড় ‘যুদ্ধে’ নেমেছে ভারত, সেই যুদ্ধের সেনাপতি এক বাঙালি। যাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এই ‘মহাকাশ যুদ্ধে’র কন্ট্রোল রুমের ‘চাবি’!
‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ কী করছে মহাকাশে? দেখুন ভিডিও।
ভারতের ১৫০০ কেজি ওজনের এই গর্বের উপগ্রহটিকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল ছ’মাস আগে, গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর। তার পর তার যন্ত্র-টন্ত্রগুলো ঠিক ভাবে কাজ করছে কি না, তা দেখে-বুঝে নেওয়ার জন্য একের পর এক ‘প্র্যাকটিস ম্যাচ’ খেলে চলছিল ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’। চলছিল তার ‘শরীর’কে পুরোপুরি ফিট রাখার কায়দা-কসরৎ। দেরি হয়নি তার ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট’ হাতে পেতেও! বিষুব রেখার দিকে ছয় ডিগ্রি হেলে থেকে সেকেন্ডে সাড়ে সাত কিলোমিটার গতিবেগে আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহটিকে বৃত্তাকার কক্ষপথে চক্কর মারতে মারতে এই ব্রহ্মাণ্ডে একেবারেই নতুন একটি পদ্ধতিতে পয়লা দফার ‘গোয়েন্দাগিরি’ চালানো শুরু করেছিল ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’, এপ্রিলের গোড়ার দিক থেকে। যে ভাবে এত দিন নাসা বা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) কেন, বিশ্বের কোনও মহাকাশ গবেষণা সংস্থাই চালাতে পারেনি অনুসন্ধান।
অ্যাস্ট্রোস্যাটের ‘সায়েন্স অপারেশন’ চালাচ্ছে যে যন্ত্রগুলি।
‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর জন্য মহাকাশে পিচটা বেশ কঠিন ছিল। কারণ, আলোক-তরঙ্গের একটি অজানা প্রান্ত আলট্রা-ভায়োলেট থেকে এক্স-রে, এমনকী, সফ্ট গামা-রে পর্যন্ত বিশাল একটা এলাকা জুড়ে তন্নতন্ন তল্লাশির দায়িত্ব বর্তেছিল এই ভারতীয় উপগ্রহটির কাঁধে। এলাকাটা এক অ্যাংস্ট্রমের দশ ভাগের এক ভাগ থেকে ৫ হাজার অ্যাংস্ট্রম পর্যন্ত জুড়ে রয়েছে। মানে, একটা সুবিশাল এলাকার অচেনা দেশে, অজানার সন্ধানে মেতে রয়েছে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’।
‘অ্যাস্ট্রোস্যাটে’র ‘সায়েন্স অপারেশনে’র টার্গেট কী কী ছিল?
পুণে থেকে ভারতের ‘ফ্ল্যাগশিপ স্পেস প্রজেক্ট’-এর যাবতীয় ‘সায়েন্স অপারেশনে’র চেয়ারপার্সন দীপঙ্কর আনন্দবাজারকে বলছেন, ‘‘আপাতত ঠিক হয়েছে পাঁচ বছর ধরে চালানো হবে ওই গবেষণা। তাতে আমরা আলোক-তরঙ্গের এত বড় যে একটা এলাকা জুড়ে এই ব্রহ্মাণ্ডে গোয়েন্দাগিরি চালানোর সুযোগটা পাচ্ছি, বিশ্বের আর কোনও মহাকাশ গবেষণা সংস্থাই এর আগে এই সুযোগটা পায়নি। কোনও তারাকে যখন কোনও ব্ল্যাক হোল গিলে খেতে শুরু করে, তখন তার ‘অ্যাক্রিশন ডিস্কে’ তারার শরারের যে অংশগুলো ছিটকে ছিটকে এসে পড়ে, তা থেকে তৈরি হয় জোরালো আলোক-তরঙ্গের। তৈরি হয় আলট্রা-ভায়োলেট আর এক্স-রে।
অ্যাস্ট্রোস্যাটের ‘সায়েন্স অপারেশন’ চালানোর আরও কিছু যন্ত্র।
যে কোনও আলোই আমাদের পথ দেখায় অন্ধকারে। তাই ওই আলোও আমাদের সামনে তুলে ধরবে অনেক অজানা, অচেনা ব্ল্যাক হোলকে। জানাবে, তারা আদতে সত্যি-সত্যি কতটা ভারী। জানাবে, তারা আসলে কতটা গতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর কতটা জোরে টেনে নিচ্ছে, গিলে খাচ্ছে কোন কোন তারাদের। যার থেকে হদিশ পাওয়া যাবে অজানা, অচেনা শ্বেত বামন নক্ষত্র আর নিউট্রন নক্ষত্রদেরও। এই আলট্রা-ফাস্ট ব্রাইটনেসে গোটা ব্রহ্মাণ্ডের ওপর গোয়েন্দাগিরি চালানোর সুযোগ এত দিন নাসা বা ইএসএ-র মতো সংস্থার উপগ্রহগুলোও পায়নি। আমাদের এই গর্বের প্রকল্পে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর), বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইআইএ), ইসরো, আরআরআই, পুণের আই-ইউকা ও আমদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির (পিআরএল) মতো গবেষণা সংস্থাগুলো ছাড়াও কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ) ও লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা প্রথম ছয় মাসে নজর রাখার জন্য মহাকাশে ৬০টি টার্গেট বেছেছি, প্রাথমিক ভাবে।’’
‘লাস্ট ফ্রন্টিয়ারে’র এত কঠিন পিচে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর এই ‘ঝোড়ো ব্যাটিং’-এর প্রথম ইনিংসটা অবশ্য শেষ হচ্ছে আর দু’মাস পরেই, সেপ্টেম্বরে।
এই ফর্মে থাকলে দ্বিতীয় ইনিংসেও ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ বড় ‘রান’ পাবে বলেই বিশ্বাস দীপঙ্করের।
আরও পড়ুন- অন্ধকার পথে এ বার আলো দেবে গাছ!
ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: ইসরো।