তিন হাজার বছর আগের ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ’-এ প্রথম আমের উল্লেখ পাওয়া যায়। ছবি: শাটারস্টক
আম পেলে বাঙালির আর কিছুই চাই না। গরমের মরসুম যদি কারও প্রিয় হয়, তার পিছনে কারণ কিন্তু ওই একটাই, আম। বাংলার আম আর বাঙালির আমপ্রীতি একে অপরকে টেক্কা দিতে পারে। বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ— আম খাওয়া ও খাওয়ানো নিয়ে তাঁদের শৌখিনতার গল্প অনেক। শোনা যায়, বাজার থেকে নিজের হাতে বাছাই করা ভাল জাতের আম এনে পাতার বিছানায় সেগুলি সযত্নে রেখে, দিনদুয়েক ওলটপালট করে সেই আম পাকাতেন বিদ্যাসাগর মশাই। শুধু তা-ই নয়, বঁটি দিয়ে নিজের হাতে সেই আম কাটতেনও তিনি। ঠাকুরবাড়ির রান্নাতেও কাঁচা, পাকা সব রকম আমের ব্যবহার ছিল ভালই। রবি ঠাকুর নাকি পাতলা বালদোর ছুরি দিয়ে নিজের হাতে আমের খোসা ছাড়িয়ে অতিথিকে পরিবেশন করতেন, সেই গল্পও শোনা যায়।
তিন হাজার বছর আগের ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ’-এ প্রথম আমের উল্লেখ পাওয়া যায়। যত দিন কেটেছে এই আম কেবল বাঙালির রসনাকেই তৃপ্ত করেনি, বরং ফলের রাজা হয়ে বাঙালির শাস্ত্রাচার, লোকাচার, শিল্পেও প্রভাব ফেলেছে। নারায়ণ পুজো হোক কিংবা দুর্গাপুজো— ঘটে আমের পল্লব না হলে কোনওটাই সম্পূর্ণ হয় না। টাঙাইল শাড়ি হোক কিংবা বাংলাদেশি ঢাকাই— আমকল্কার নকশা কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। কেবল ফল হিসাবেই নয়, রন্ধনশিল্পেও আমের বেশ রমরমা। আমসত্ত্ব কিংবা আমের আচার, আমের পায়েস হোক কিংবা পুডিং— রান্নার উপকরণ হিসাবে আমের ব্যবহার যুগ যুগ ধরে।
আমসত্ত্ব কিংবা আমের আচার— রান্নার উপকরণ হিসাবে আমের ব্যবহার যুগ যুগ ধরে। ছবি: ফ্লেভারড টক।
বাঙালি রান্নায় কাঁচা আমের প্রভাব বেশি থাকলেও ভারতের আর পাঁচটা রাজ্যে কিন্তু রান্নার স্বাদবৃদ্ধির জন্য পাকা আমের প্রচলন বহু দিন ধরেই। যে সব আম স্বাদে ততটাও মিষ্টি নয়, সেই সব আমের সঙ্গে বিভিন্ন রকমের মশলাপাতি মিশিয়ে বিবিধ পদ রান্না করা হত। মূলত মহারাষ্ট্রের কোঙ্কন অঞ্চল, গোয়ায় আর দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের রান্নায় গাছপাকা বুনো আম ব্যবহারের চল ছিল। এখন অবশ্য ফিউশন রান্নার যুগে সেই চল আরও বেড়েছে। বাঙালি রান্নায় আগে কাঁচা আমেরই প্রাধান্য ছিল। বাঙালি হেঁশেলে পাকা রসালো আমের চল বেড়েছে চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকে। ভক্তি আন্দোলনের সময় যখন নিরামিষ রান্নার অনেক বেশি প্রসার ঘটল, সেই সময় ঝাল খাবারেও মিঠে আমের ব্যবহার শুরু হয়। চৈতন্যচরিতামৃতে আম দিয়ে তৈরি নানা পদের উল্লেখ পাওয়া যায়। খনার বচনে যেখানে কোন মাসে কী খাবেন বলা হয়েছে, সেখানেও কিন্তু জৈষ্ঠ্যে অমৃতফলের উল্লেখ আছে। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রান্নায় আমের বিবর্তনও স্পষ্ট।
মোগলরা এ দেশে রাজত্ব না করলে যেমন তাজমহল, কুতুব মিনার, লালকেল্লার দেখা মিলত না, তেমনই ভারতের আমজনতার আম নিয়ে এত আদিখ্যেতা করারও সুযোগ থাকত না। আমের আগমন এ দেশে অনেক আগে হলেও মোগল যুগেই আম নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়। দ্বারভাঙার কাছে লাখবাগে এক লক্ষ আমগাছের বাগান তৈরি করেছিলেন বাবর। বাবর-আকবর-জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে কেবল রাজা-বাদশাদের বাগানেই আমের ফলন হত, আমজনতার সেই আম চেখে দেখার সুযোগ হত না বললেই চলে। শাহজাহানের সময় থেকে আমজনতাও আমের স্বাদ উপভোগ করার অধিকার পেলেন। শাহজাহানের ঘোষণায় সাধারণের বাগানেও শুরু হল আমের ফলন। ব্যাস! শুরু হয়ে গেল ভারতে আমের ‘দাদাগিরি’!
বাঙালি হেঁশেলে পাকা রসালো আমের চল বেড়েছে চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকে। — ফাইল চিত্র।
বাংলায় মুর্শিদাবাদ জেলায় আমের ফলন ভাল হয়। সেখানকার আমের চাহিদাও বাজারে অনেক বেশি। আকবরের সময় মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন আমবাগানে দুষ্প্রাপ্য ২০০ রকমের আমের প্রজাতির ফলন হত। পরবর্তী কালে নবাব সিরাজদৌল্লা এবং মুর্শিদ কুলি খাঁ— দু’জনেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির চারা আনিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সুবিশাল সব আমবাগান। হোমশেফ এবং ফুড ব্লগার সায়ন্তনী মহাপাত্রের সঙ্গে কথোপকথনে জানা গেল, রাজস্থানের শহরওয়ালি সম্প্রদায়ও নাকি বাংলায় এসে আম নিয়ে চর্চা শুরু করে। নবাবদের দেখানো পথ ধরেই বিভিন্ন সুগন্ধি ফুল ও ফলের সঙ্গে আমের শংকর ঘটিয়ে স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় আমের অনেক নতুন প্রজাতির ফলন শুরু করে। বিমলি, রানিপসন্দ, কোহিতুর, শাহদুল্লা, সারাঙ্গা আরও কত কী!
মোলামজাম, আনানাস, চম্পা, চন্দনকোসা, গোলাপভোগ, গৌড়মতি, আশ্বিনা, সুবর্ণরেখা বাংলার মতো এত প্রজাতির আমের ফলন ভারতের অন্যান্য প্রান্তে হত না। এদের নাম যত বাহারি, প্রত্যেক প্রজাতির গন্ধ ও স্বাদও একে অপরকে টেক্কা দিতে পারে।
বাঙালি রান্নায় কাঁচা আমের প্রভাব বেশি থাকলেও ভারতের আর পাঁচটা রাজ্যে কিন্তু রান্নার স্বাদবৃদ্ধির জন্য পাকা আমের প্রচলন বহু দিন ধরেই। — ফাইল চিত্র।
গরমের মরসুমে বাজারে গেলেই মিঠে আমের গন্ধে মন ভরে যায়। যে দিকেই তাকাবেন সেই দিকেই ঝুড়ি ঝুড়ি আম আর আম। তবে আম নিয়ে মাতামাতি করার সুযোগ কম। কোথায় গেল বাংলার বাহারি আমের সেই অভিজাত্য? কলকাতার বড় বড় বাজারে ঢুঁ মারলে আমের অভাব নেই বটে, তবে শহর জুড়ে রাজত্ব করছে কেবলই হিমসাগর। মানিকতলা বাজারে আমের গোটা দশেক দোকান, কয়েক জন সব্জি বিক্রেতাও আম নিয়ে বসেছেন। সবাই বসেছেন হিমসাগর নিয়ে, কেবল এক জনের কাছেই দেখা মিলল ল্যাংড়ার। ১ কেজি হিমসাগরের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে আর ল্যাংড়ার দাম ৬০ টাকা। গড়িয়া বাজারেও চোখে পড়ল সেই হিমসাগরের রাজত্ব। সেখানেও প্রতি কেজি ৫০ টাকা থেকে ৮০ টাকা দরেই হিমসাগর বিক্রি হচ্ছে। সোদপুর বাজারে গেলে সেই দাম আরও কমে যায়। ২০ টাকা কেজি দরে হিমসাগর বিক্রি হচ্ছে সেখানে। হিমসাগর ছাড়া চৌসা, ল্যাংড়াও রয়েছে, তবে খুব কম দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি কেজি ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ল্যাংড়া-চৌসা। কাঁকুড়গাছির ভিআইপি মার্কেটে আবার আমের দাম বেশ চড়া! ভাল হিমসাগর চাইলে প্রতি কেজিতে খরচ করতে হবে ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকা। হিমসাগর ছাড়া ওই বাজারে রয়েছে ল্যাংড়া, চৌসা, গোলাপখাসও। সেগুলির দাম আরও বেশি। চোখে পড়বে অ্যালফান্সোও। দোকানদারের এক কেজির দাম জিজ্ঞেস করায় একটু ভুরু কুঁচকে দোকানদার বললেন, ‘‘পেটি নিতে হবে ম্যাডাম, ৭৫০ টাকা পেটি।’’ শুনেই যেন পকেটে ছ্যাঁকা লাগল। ‘‘ক’টা থাকে এক পেটিতে?’’ প্রশ্নের জবাব এল, ‘‘১০ থেকে ১২টা।’’ এক পেটি কেনার পর দেখা গেল এক ধরনের মিঠে গন্ধ থাকলেও হিমসাগরের স্বাদ এর থেকে অনেক ভাল! নিউটাউনের বাজারে হিমসাগর বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজি। হিমসাগর ছাড়া সেখানে গাছপাকা কিছু আম বিক্রি হচ্ছে বটে, তবে দোকানদার ঠিক নামটা বলতে পারলেন না।
কলকাতার বড় বড় বাজারে ঢুঁ মারলে আমের অভাব নেই বটে, তবে গোলাপখাস পরিমাণে কম, শুধুই হিমসাগরের দাপট। ছবি: শাটারস্টক
রান্নাবান্না নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন সায়ন্তনী মহাপাত্র। সাবেকি রান্না হোক কিংবা ফিউশন পদ— গরমের মরসুমে তিনি রান্নায় আমের ব্যবহার বেশ ভালই করেন। কী কী বানানো হয় আম দিয়ে? প্রশ্নের উত্তরে সায়ন্তনী বলেন, ‘‘খাঁটি বাঙালি রান্নায় খুব একটা পাকা আমের ব্যবহার হয় না। তবে অন্নদামঙ্গল কাব্য পড়ে এক বার হিমসাগর আম আর কামিনি চাল দিয়ে বানিয়েছিলাম বিষ্ণুভোগ। তা ছাড়া খুব গরমে নারকেলের দুধে মোটা দানা সাবু, পাকা আম, লিচু দিয়ে মালয়শিয়ান সাগু মেলাকাও খুব ভালবাসেন আমার বাড়ির সবাই। বাজার থেকে খুঁজে খুঁজে মাঝেমধ্যে একটু টক পাকা আমও কিনে আনি। সেই আম দিয়ে বানিয়ে ফেলি কেরল স্টাইল মাম্বাজহা পুলিসেরির মতো পদ।’’
মাম্বাজহা পুলিসেরি। ছবি: অলিশা ডায়েরি।
কেবল বাড়ির হেঁশেলেই নয়, শহরের বিভিন্ন রেস্তরাঁ ও ক্যাফেতেও আম দিয়ে বাহারি পদ বানানো হচ্ছে। ৬ বালিগঞ্জ প্লেসের মেনুতে প্রতি বছরই আমের মরসুমে খাদ্য উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ বছরও ১৬ জুন থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত এই উৎসব চলবে। শেফ সুশান্ত সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘পাকা আম দিয়ে সাধারণত মিষ্টি রান্নাটাই বেশি হয়, তবে আমাদের খাদ্য উৎসবে কিন্তু ঝাল-নোনতা রান্নাতেও আমের ব্যবহার করা হচ্ছে। আম ছানার কাটলেট, হিমসাগর পটলের চপ, আম এঁচোড়ের পাতুরি, চিকেন-ম্যাঙ্গো সারপ্রাইজ়, আম মাংসের কালিয়া, আম কাঁকড়ার ঝাল, আম আচারি পমফ্রেট পাতুরি— বাঙালি রান্নায় দেওয়া হয়েছে কাঁচা-পাকা আমের টুইস্ট।’’ এত পদ বানাতে তো অনেক আম লাগবে! কোন আম ব্যবহার করেন? কোথা থেকে আম কেনা হয়? সুশান্ত বললেন, ‘‘এখন শহরে হিমসাগর আমেরই জোগান বেশি। তাই ওই আমটাই ব্যবহার করি আমরা। নিউমার্কেটের একটি নির্দিষ্ট দোকান থেকেই আম আসে আমাদের রেস্তরাঁয়।’’
অওধ ১৯৫০-এর অন্যতম কর্ণধার দেবাদিত্য চৌধুরির সঙ্গেও কথা বলে জানা গেল আমের মরসুমে তাঁরাও তাঁদের মেনুতে আমের রকমারি পদ নিয়ে আসার কথা ভাবছেন। দেবাদিত্য বলেন, সারা বছর ধরেই আমপোড়া শরবত থাকে আমাদের মেনুতে। অন্য সময় বাজার থেকে কিনে আনা ম্যাঙ্গো সিরাপ ব্যবহার করলেও আমের মরসুমে কিন্তু আম কিনে রেস্তরাঁতেই সেই শরবত বানানো হয়। এ ছাড়া কবাবের সঙ্গে আমরা টক-ঝাল-মিষ্টি আমের চাটনি ব্যবহার করি। আমের মরসুমে মেনুতে ম্যাঙ্গো কুলফি তো থাকছেই। পাকা আমের ক্ষেত্রে আমরা হিমসাগর ও ল্যাংড়া দুটোই ব্যবহার করি। নিউমার্কেট থেকেই সেই সব আম আনানো হয়।’’
শহরের রেস্তরাঁগুলিতে নিউ মার্কেট থেকে আম আনানো হয়। ছবি: শাটারস্টক
কেবল মিষ্টিতেই নয়, পাকা আম এখন ঝাল-নোনতা খাবারেও ব্যবহার করা হচ্ছে। রান্নায় আম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন শহরের রন্ধনশিল্পীরা। সে ক্ষেত্রে রান্নার জন্য হিমসাগরই থাকছে তাঁদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। আম নিয়ে এখন বাঙালির আর বিলাসিতা করার সুযোগ নেই। আমের হাতে গোনা প্রজাতিই এখন মিলছে শহরের বাজারে। দক্ষিণের ইমাম পসন্দ, উত্তর প্রদেশের দশেরি, মহারাষ্ট্রের রত্নগিরির জোগান কলকাতায় নেই, তাই যত পরীক্ষা ওই হিমসাগর ঘিরেই!