রবীন্দ্রনাথ যেন এক পাঁচমাথার মোড়। যে মোড়ে এসে জমা হচ্ছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান। এই ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ থেকেই সামনে চলার রাস্তা খুঁজে নিতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। পঁচিশে বৈশাখের সকালে এ ভাবেই রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিতে চায় সঙ্গীতমহল। ফেসবুকের দেওয়াল ভরে গিয়েছে রবীন্দ্র অনুষ্ঠানের তালিকায়। নামী হোন বা অনামী, কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০টি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান না গাইলে বাঙালির ‘কবিগুরু স্মরণ’ যেন অসমাপ্ত থেকে যায়।
শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় রবীন্দ্রনাথ।
হাইরাইজের রুফটপ থেকে রেস্তোরাঁর নীলবাতিতে পঁচিশে বৈশাখ তাই ঝকমক করে রবীন্দ্রনাথের দাড়িমুখের হাসি-ছবি। ‘আসলে তো জন্মদিনের সেলিব্রেশন। সব সময় যে তানপুরা আর এস্রাজ নিয়ে বন্ধ হলে বা কোনও ঘরে রজনীগন্ধার ধূপের গন্ধে রবীন্দ্রনাথকে মনে করতে হবে, এই মাথার দিব্যি কে দিয়েছে?’ বেশ ঝাঁঝালো সুরেই বলে উঠলেন বাসবদত্তা। রবীন্দ্রনাথের গান শেখাও শান্তিনিকেতনে। হলে কি হবে! শান্তিনিকেতনে বিনোদন বলতে তখন আমরা বুঝতাম রবীন্দ্রনাথের গান। এফএম বা টিভির অত রমরমা ছিল না। পিকনিকে, ক্যান্টিনে, খোয়াইয়ের আড্ডায়, হস্টেলের পথে সক্কলে মজা করে একসঙ্গে গান গাইতাম। ওই সকলে গাওয়ার মধ্যে সুর হয়তো খানিক পাল্টেও যেত। কিন্তু আনন্দ কিছু কম পড়ত না। হাসতে হাসতে স্মৃতি হাতড়ালেন শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক বাসবদত্তা।
রবীন্দ্রনাথের গানে খোলা রাস্তায় সুর এ দিক ও দিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেটাই বারে বারে বলতে চাইছেন সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র। তিনি বললেন, ‘‘কুড়ি বছর আগে রবীন্দ্রনাথকে তেমন জরুরি কখনও মনে হয়নি। কিন্তু, আজ যত বয়স বাড়ছে তিনি আমার সুরের কাছ থেকে, আমার মনের ছন্দ থেকে কিছুতেই যেন সরে যাচ্ছেন না। রবীন্দ্রনাথের এই ‘পাওয়ার অফ মিউজিক’টাই আমার কাছে এনার্জির মতো কাজ করে। তবে এটাও ঠিক, এস্রাজ, তানপুরা, তবলা আর গম্ভীর পরিবেশ থেকে রবীন্দ্রনাথকে টেনে বার করার দায়িত্ব আমাদের। আমরা জানি, আজকের প্রজন্ম দুধ খেতে ভালবাসে না। আমরা তাই দরকারে দুধের সঙ্গে বোর্নভিটা মেশাই। এখানেও ঠিক তাই। গানকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে গানরীতিকেই বদলে ফেলতে হবে আমাদের।’’ দেবজ্যোতি বলতে থাকেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গান ভারী পর্দার মতো। ওই পর্দা সরিয়ে সুরের আলো আনতে হবে। এমন সুর, যাতে মিশে আছে বিশ্বের সকল সুর...গ্রেগরিয়ান চান্ট, মোৎজার্ট, বাখ, বিঠোভেন।’’
বিদেশে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের গানের উপস্থাপনা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত তাবত সঙ্গীতমহল। এখন সবাই গিটার বাজায়। গিটার বাজিয়ে দাঁড়িয়ে যদি রবীন্দ্রনাথের গান লোকে শুনতে বেশি পছন্দ করে তা হলে সেটাই হোক। জানালেন স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত। ‘একলা গীতবিতান’-এর মধ্য দিয়ে তিনি নতুন করে রবীন্দ্রনাথকে চিনছিলেন। সেই চেনার কাজ এখনও চলছে। কথায় কথায় বললেন, ‘‘গল্পের জন্য সিনেমায়, সিরিয়ালে রবীন্দ্রনাথের প্রচুর গান ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বার উল্টো রাস্তায় রবীন্দ্রনাথের গানকে বসাতে চাইছি আমি। আগে কোথাও বলিনি। পঁচিশে বৈশাখের জন্য প্রথম বলা হয়ে গেল। এ বার গানের জন্য গল্প বলছি আমি।’’ তেইশ বছরে কাদম্বরীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এ পরবাসে রবে কে।’ আজও সেই গান কোনও এক প্রেমহারা নারীকণ্ঠে রাতের অন্ধকারে ধ্বনিত হয়— স্রষ্টা চলে গেলেও তিনি থেকে যান এ কালের মাঝে, তাঁর গতির সুরে।
রবীন্দ্রনাথ নিজে হয়তো গানের এই বদল চাইতেন না। বলেছিলেন, ‘আমার গান যাতে আমার মনে হয় সেইটা তোমরা কোরো।’ দেবজ্যোতি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন, ‘‘তাতে কী! শেক্সপিয়র বেঁচে থাকলে কি ‘মকবুল’ করতে দিতেন? দিতেন না। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার রাস্তায় এই কাজগুলো না হলে সঙ্গীতই পথ হারাবে।’’
পাঁচমাথার মোড়ে এসে দিকনির্দেশটা যে খুবই জরুরি!
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী মৃনালিনী দেবী