গত বছরের কথা এখনও মনে আছে আমার। দিনটা ছিল ৭মে, তখন সন্ধ্যা। বসন্তের এই সময়টা যে আমেরিকায় কী মনোরম, বর্ণনাতীত। পাহাড়ের উঁচু-নিচু ঢাল বেয়ে উপত্যকার আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ি চালিয়ে অফিস থেকে ফিরছি। কনে দেখা আলোয় চারিদিকের সবুজে অপার্থিব ঝিলিক। গাড়ির অডিও সিস্টেমে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতার বাজছে। মনটা রোমান্টিক হয়ে আছে। বাড়ি ঢুকেই শুনি আমার বউ আর মেয়ে মিলে ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ চালিয়েছে। কলকাতায় এখন ৮ মে, পঁচিশে বৈশাখের সকাল। মন বলল, ঠিক এই সময়ে সৌরভকে ফোন করা দরকার। ওর গলায় রবিঠাকুরের গানে মেতে থেকেছি সারাটা যৌবন। সেল ফোনে ডায়াল করলাম। শুনতে পেলাম রিং টোন: ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’। নো রিপ্লাই। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমার ফোনে রিং বাজল। ‘হ্যালো’ বলতেই সাত সাগর তেরো নদীর ওপার হতে তীব্র শ্লেষ: কী রে, এখন নিশ্চয়ই তেতো কফি খেতে খেতে টিভি দেখছিস, ‘স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে বোকা বাক্সতে বন্দি’। আরে, কলকাতায় এখন পঁচিশে বৈশাখের সকাল। আমি রবীন্দ্র সদনের সামনে মাটির গ্লাসে চা খেতে খেতে চুটিয়ে রবিঠাকুরের গান শুনছি। এই শোন...বলেই নীরব হল সৌরভ, আর আমি ইথারের আবহে মুগ্ধ হয়ে শুনলাম: ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’। ফোনে ফিরল সৌরভ: কী, রবিঠাকুর-টাকুর তো ভুলে মেরেছিস নিশ্চয়ই!
একটি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ।
এ বার আমি মুখ খুললাম: শোন সৌরভ, প্রথমত, আমিও চা খাচ্ছি এবং রীতিমতো দার্জিলিং। আর সঙ্গে অবিরাম রবীন্দ্রসঙ্গীত। কারণ আজ পঁচিশে বৈশাখ, এবং সে জন্যই তোকে মনে পড়ল আমার। দ্বিতীয়ত, কামিং উইকেন্ডেই আমাদের এখানে রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে, বেশ ঘটা করে। আর ফর ইওর বেটার ইনফরমেশন, এক মাত্র পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষে মার্কিন প্রবাসী ‘দুই ধরনের’ বাঙালি মিলিত হয়। এখানে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের বাঙালিদের আলাদা সংগঠন। কিছু বাঙালি অবশ্য দু’টোরই মেম্বার, কিছু ক্রুশ মেম্বারশিপও আছে। কিন্তু দু’টি সংগঠনের কর্মসূচি আলাদা। একমাত্র যৌথ অনুষ্ঠান রবীন্দ্রজয়ন্তী। আরে, রবীন্দ্রনাথ কি শুধু তোদের একার নাকি, তিনি আমাদের সবার। সৌরভ বলল: সাধু সাধু। তোদের অনুষ্ঠান কেমন হল বিস্তারিত লিখে চিঠি দিস।
আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তীটা সত্যিই ভাল হয়। শহরের কেন্দ্রস্থলে ইউনাটিরিয়ান চার্চের একটা ভাল অডিটোরিয়াম আছে। পঁচিশে বৈশাখের নিকটতম শনিবারের বিকেলে সেখানেই বসে আমাদের এপার ওপার দুই বাংলার সেই সাংস্কৃতিক আসর। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে। খ্রিস্টানও বাদ যায় না। কিন্তু, সে গপ্পো পরে বলছি। অনুষ্ঠানের আগে এক মাস ধরে উইকেন্ডে চলে রিহার্সাল। অবশ্য মহড়া ছাড়া কিছু এক্সটেম্পোরও হয়। মঞ্চে পুরো রাবীন্দ্রিক ডেকরেশন। কবির ঢাউস ছবি, প্রদীপ, ধূপকাঠি। ফুলে ফুলে ছয়লাপ। সাজগোজে অবশ্য শুধু কবি নন, তাঁর ‘মানসকন্যা’রাও বাদ যায় না। ফুলশয্যা তাঁদেরও। এবং কঠোর ভাবে শাড়ি সে দিন। কাঁথাস্টিচ, তাঁত, অ্যাপ্লিক আঁচল জুড়ে কবিতা বা গানের কলি। ‘পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর’-ও আছে। সেই সঙ্গে লোকশিল্প ঘরানার অলঙ্কার। সব মিলিয়ে তাঁরা কবির একনিষ্ঠ পূজারিণী যেন। পূজারীদের দৌড় অবশ্য ধুতি-পাঞ্জাবি-চোস্ত-চাপকানেই শেষ! দু’-এক জন ‘যত্নে পাট করা চুল’ কান্তবাবুও আছে, অবশ্য কর্নেট ছাড়া। বাচ্চাকাচ্চাগুলোর রূপশয্যা একে বারে দেখার মতো। ছেলেরা পাঞ্জাবি-চোস্ত-চাপকান, এমনকী ইলাস্টিকের বেল্ট দেওয়া ধুতি। মেয়েরা রংবেরঙের ঘাগড়া-চুড়িদার, কয়েকটার আবার শাড়ি। নাচের জন্য তৈরি।
শুরুতেই ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’-র সঙ্গে দল বেঁধে নাচল ওই পুঁচকিগুলো। হারমোনিয়াম-বেহালা-বাঁশি-তবলা সহযোগে লাইভ গান। তার পরে সিন্থেসাইজার বাজিয়ে টিনএজাররা কোরাস গাইল: ‘আমরা নতুন যৌবনেরই দূত, আমরা অদ্ভুত...’। সত্যিই অদ্ভুত, কারণ এদের কারও বাংলা উচ্চারণই বাঙালিদের মতো নয়। ওদের মা-বাবা কিন্তু নিপাট বাঙালি, দেশে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে তবে না তারা আমেরিকায় চাকরি বা গবেষণা করতে এসেছে। আর তাঁদের ছেলেমেয়েরা, হয়ত জন্মেছে বা বড় হয়েছে এখানে, অনেক কষ্ট করে বলবে ‘র্যাবিনড্রোন্যাট’, কিংবা অত ঝামেলায় না গিয়ে স্রেফ ‘টেগোর’ বলে চালিয়ে দেবে। আর ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’ বলতে গিয়ে তোতলে-টোতলে একশেষ হয়ে যাবে। ওই যে গানটা তারা গাইল, রবীন্দ্রনাথের ওইটুকুই তারা জানে, আর বেশি কিছু না। তা-ও গানটা ইংরেজি হরফে লিখে এক মাস মহড়া দিয়ে কোনওমতে রপ্ত করেছে, সেটাও খুব ভালবেসে নয়, মা-বাবার জোরাজুরিতে। প্রশ্ন করলেই বলবে: ও, আই নো ড্যাডস টোল্ড মি, টেগোর গট নোবেল ইন লিটারেচর। মম সামটাইমস সিংস হিজ সংস, দ্যাটস ইট! এন আর আই বাঙালির নতুন জেনারেশন। বাবা-মায়ের দিন যেই ফুরোবে, তেমনি এই প্রজন্ম থেকে হারিয়ে যাবেন রবীন্দ্রনাথ, যিনি ছিলেন আদ্যোপান্ত আন্তর্জাতিক, মনুষ্যত্বের বিশ্বরূপ। বাঙালির শিকড় হলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনিই যদি না থাকেন, তা হলে তো আমরা ছিন্নমূল। যতই ঘটা করে রবীন্দ্রজয়ন্তী হোক এখানে, আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের নয়া প্রজন্ম যেন একটা ঝুলে থাকা নিরালম্ব সময়ের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে।
১৯৩৭-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ।
তবু রবীন্দ্রনাথ আছেন, আমাদের, আমরা যাঁরা প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী বাঙালি, তাঁদের হৃদয় জুড়ে। তাই আমরা যত দিন বাঁচব, তত দিন এই দূর প্রবাসে ‘পঁচিশে বৈশাখ’ করব। ছেলেমেয়েদের দিকে সঙ্কুচিত হাতে এগিয়ে দেব ‘সংস অফ অফারিং’, ওদের আই পডে ঢুকিয়ে দেব রবীন্দ্র গানের ইনস্ট্রুমেন্টাল ভার্সন। আমরা সব বাঙালের পোলা বা ঘটির পো, আমাদের ছেলেমেয়েদের ঠেলে পাঠিয়ে দেব রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে। ওরা ‘ইউ আর বদারিং মি’ বলে গজগজ করতে করতে কাঁপা হাতে তুলে নেবে মাইক্রোফোন। নেহাত অবহেলায় উচ্চারণ করবে: অ্যামাঢের ছোটো ন্যাধি চোলে এঁকেবেঁকে, বাইশেখ মাসে তার হ্যাটু জোল থাকে...! তাতেই আমরা সজোরে হাততালি দিয়ে বলব: এই দেখ, রবীন্দ্রনাথ এখনও আছেন। তাই এখনও প্রাণ আছে, বাঙালির মান আছে। ওই ‘অ্যামাঢের ছোটো ন্যাধি’-ই তো এখন আত্মঘাতী বাঙালির একমাত্র সান্ত্বনা! আমি বসে বসে এই সব সাত-পাঁচ ভাবছি, আর মঞ্চে তখন একে একে হয়ে চলেছে ‘শ্যামা’ বা ‘চিত্রাঙ্গদা’র টুকরো টুকরো নৃত্যাংশ। বাংলাদেশি এক ডাক্তার মহিলা অসাধারণ গাইলেন ‘বধু, কোন আলো লাগল চোখে’। আমাদের এক ইঞ্জিনিয়র ও তাঁর এক অধ্যাপক বন্ধু, দু’জনেই কলকাতার, আবৃত্তি করল ‘দুঃসময়’ আর ‘কিনু গোয়ালার গলি’। আমার মেয়ে গিটারে ‘তোমার হল শুরু আমার হল সারা’ বাজাল। গান শেষ হতেই চার্চের কেয়ারটেকার ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের ছবিটা দেখিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন: হি ইজ আর এন টেগোর? আমি ‘হ্যাঁ’ বলতেই তিনি গির্জার প্রার্থনা সঙ্গীতের বইয়ের একটা পাতা আমার সামনে খুলে ধরলেন। আমি গর্বের সঙ্গে দেখলাম, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’, ইংরেজি বর্ণমালায় লেখা। নীচে পাদটিকা: আর এন টেগোর, অ্যান ইন্ডিয়ান নোবেল, গট নোবেলপ্রাইজ (১৯১৩) ইন লিটারেচর। সেই সাহেব বললেন: আমরা প্রতি রবিবার সকালে চার্চের প্রেয়ারে এই গানটা করি। আমরা ঠেলেঠুলে সেই সাহেবকে উঠিয়ে দিলাম মঞ্চে। আমাদের এক বন্ধুর মেয়ে পিয়ানোতে সুর তুলল। সাহেব অবলীলায় গাইলেন ‘অ্যাগুনের পারশমানি চোয়াও প্র্যানে’। আমি মনে মনে বললাম: আমার রবীন্দ্রনাথ, ‘আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া তোমারি বীণা হতে আসিল নাবিয়া’।
অবশেষে ‘বিনি পয়সার ভোজ’ দুইবার। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের ওই কৌতুকনাটিকার একক অভিনয় করলেন বাংলাদেশি এক অধ্যাপক। তার পরে রাতের খাওয়াদাওয়া। ব্যাপক আয়োজন। সবাই কিছু না কিছু রান্না করেছে। কিছু আইটেম এসেছে ইন্ডিয়ান বা বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ থেকে। ডিনার সেরে পার্কিং লটে গিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে দরজাটা খুলে বসে অপেক্ষা করছি বৌ-মেয়ের জন্য। মনটা তখনও ‘রবি রবি’ করছে। পরের দিন রবিবার, ছুটি। গাড়ির অডিও সিস্টেমে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ চালিয়েছি। পাশের মর্গান হাউজ থেকে বেরিয়ে এসে এক মেমসাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন: টেগোরস সং? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম: হাউ ইউ নো? মেমসাহেব বললেন: আমি শিকাগোর একটা ইউনিভার্সিটিতে এশিয়ান স্টাডি পড়াই। আমার এক ছাত্রী ইন্ডিয়ান মিউজিক নিয়ে রিসার্চ করছে। ও আমাকে একশোটা টেগোরস সংস শুনিয়েছে। ‘টুমি র্যাবে নির্যাবে রিডয়ে মাম’, আই লাইক দ্যাট সং। আমার হৃদয়ে যেন বেজে উঠল ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’। তাড়া আছে। এক বন্ধুর বাড়িতে আমরা আজ ‘স্লিপ ওভার’ করব। একটা ডকুমেন্টারি দেখব সবাই মিলে। এখানের পাবলিক লাইব্রেরি থেকে অর্ডার দিয়ে আনানো হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। ‘তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভরে’।
শান্তিনিকেতনে একটি অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ।
পঁচিশে বৈশাখের সকালে আমি এ বারও সৌরভকে ফোন করব, সেই ডায়াল টোনের লোভে, ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’। আমি ‘যাব না ওই মাতাল সমীরণে’। যাওয়া হবে না আমার। আমার মা-বাবা একদা জন্মভূমির ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ইন্ডিয়ার শরণার্থী শিবিরে। আমিও আমার মাতৃভূমি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে আছড়ে পড়েছি মার্কিন মুলুকে। আমেরিকা যন্ত্র, যৌনতা, বিত্ত, বৈভব, মজা আর মাদকের দেশ। এখানে আমার রবীন্দ্রনাথ বলতে শুধু আলমারি বন্দি দুটো পুরনো বই, ‘সঞ্চয়িতা’ আর ‘গীতবিতান’। পঁচিশে বৈশাখের সকালে আমি আর কী করব? অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে বড়জোর গাড়িতে লাগানো ‘প্রবাসী বাঙালি’ বোস-সাহেবের তৈরি অডিও সিস্টেমে গান শুনবো, ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি’।
সৌরভ, পঁচিশে বৈশাখের সকালে আমার ফোন পেলে, এক বার তোর দোতলা বাড়িটার দক্ষিণের বারান্দায় এসে দাঁড়াস। দূর আকাশের পানে চেয়ে গেয়ে উঠিস সেই গানটা, ‘হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি, আমি কোন সুরে ডাকি তোমারে’।
পূর্বের সেই গান আমি ঠিক শুনতে পাব এই দূরতম পশ্চিমে বসে!