রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share:

মনে পড়ে, মা খুব ধর্মভীরু ছিলেন। বাবার কী হবে, আমরা ছোট দু’ভাই, সংসার, চাষবাস। মা’র মুখে সব সময় ছুঁয়ে থাকত হালকা একটা বিষাদের মেঘ। আর অনেক রকম দেবতার নাম। পুলিশ মাঝেমধ্যে অতর্কিতে হানা দিত। রাত্রে লণ্ঠনের আলোয় দেখেছি, মায়ের চোখে জল।

Advertisement

এক বর্ষার বিকেলে মা কালিন্দীকে দুইছেন। বাছুর ধরে আমি দাঁড়িয়ে আছি দূরে। বাবা এলেন। ময়লা পোশাকে, উসকো চুল, মলিন হাসি জোর ফুটিয়ে গোয়ালঘরে মাকে ডাকলেন। বাবা এ ভাবেই আসতেন, যেতেনও। বড় জোর আধ ঘণ্টা। তার বেশি নাকি থাকা চলে না। সে বারও মিনিট কুড়ি পরেই বাবা চলে গেলেন। মা ভিতর হতে বুকের কাপড় গুছিয়ে এসে ফের কালিন্দীর পায়ের কাছে বসলেন। সেই শেষ বার, বাবা আর কখনও ফেরেননি। মায়ের চোখে বিষাদ দেখলেই আমার বাবার কথা মনে পড়ত। কালিন্দীর বাছুর ধরে আমি গোয়ালঘরের সেই আঁধারে চেয়ে থাকতাম।

তখন বড় অশান্ত সময়। অত্যাচারী জোতদারদের কবল থেকে বাঁচতে নকশালদের হাত ধরে রুখে দাঁড়িয়েছে সমস্ত গ্রামের গরিব চাষিরা। তাঁদের আক্রমণের মুখে পড়ে মারা গেছে বীরভূমের দু’চার জন জোতদার-জমিদার। জেলা জুড়ে ব্যাপক ধরপাকড়। দেওয়ালে দেওয়ালে বিপ্লবের আহ্বান। চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। সন্ধে গড়াতেই চার দিকে বোমার আওয়াজ। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ। পাড়ার ছেলেবুড়ো সব্বাই ভয় পেত। প্রায় সকালে উঠে দেখা যেত নতুন লেখা। কারা যেন রাতের অন্ধকারে দেওয়াল জুড়ে রেখে গেছে মৃত্যুর ঘোষণা। বেলা বাড়তেই চলে আসত থানার জিপ। অফিসাররা ঝটপট ডায়রিতে লিখেই ওপরওয়ালাকে জানাত ওয়্যারলেসে। ‘স্যর, ক্ষমতার উৎস-টুৎস তো আছেই। আর লিখেছে, নলিনাক্ষ সরকারের মুন্ডু চাই। হ্যাঁ স্যর, সাহাপুরের জোতদার স্যর...’

Advertisement

মাঝেমধ্যে বাবার সঙ্গে দেখেছি কলকাতা থেকে আসা কিছু নতুন মুখের আনাগোনা। তাঁদের দু’চোখে কত স্বপ্নের ভিড়। পাণ্ডবেশ্বর থেকে অজয় নদ পেরিয়ে আসত বর্ধমানের কমরেডরা। ধরপাকড় বাড়তেই সব্বাই চলে গেল আন্ডারগ্রাউন্ডে। তার আগে যে পাওয়া গেল অজয় নদের চরে কিছু তরুণ ছেলের লাশ! সবার মুখে ঘুরতে লাগল কাশেম দারোগার ‘এনকাউন্টারে মৃত’র সংখ্যা। কেউ বলত, একশো দশ। কোনও বয়োজ্যেষ্ঠ বলতেন, না হে, ভীমগড়ের ওই তিনটে নকশাল ছোঁড়াকে ধরলে দাঁড়াচ্ছে একশো তেরো...। বাবারা জেলা ছেড়ে পালালেন।

এক জন ফেরার বিপ্লবী, নকশাল। অন্য জন সংসারে নির্বাসিতা। মৃণাল সেন

পরিচালিত ‘পদাতিক’ ছবির একটি দৃশ্যে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় ও সিমি গ্রেবাল

স্কুলের পথে যেতে আমরা ছোটরা থমকে যেতাম কলেজের কাছে। ক্যাম্পাস দখল করে বসে গেছে সিআরপিএফ ক্যাম্প। দিনে পুলিশ আর সিআরপিএফ মিলে যৌথ ‘এরিয়া ডমিনেশন’। আর রাত জুড়ে খানাতল্লাশি। তখন একটা সহজ সূত্র ছিল। বাইরের কোনও লোক মানেই সন্দেহভাজন। প্রথম প্যাঁদানি হয়ে যেত কলেজ ক্যাম্পাসেই, রাখঢাকহীন। অতঃপর, সিআরপি-র হাতের সুখ মিটলে চালান যেত থানায়। কাশেম দারোগার থার্ড ডিগ্রির চেম্বারে। নির্দোষ লোক স্বেচ্ছায় হয়ে যেত আসামি। ‘জান কবুল স্যর, মরে গেলাম, মরে গেলাম স্যর, যা যা বলছেন কোর্টে গিয়ে কাল তা-ই বলব।’ আমি তখন ক্লাস সেভেন। ভাই ফাইভ। এক দিন সিআরপি-র মার দেখতে দেখতে স্কুলফেরত ছোট ভাই খিমচে ধরে আমার হাত, ‘দাদা, ওরা বাবাকেও মারবে, না?’ টানতে টানতে ওকে সে দিন বাড়ি নিয়ে চলে আসি। বাবার জন্য খুব ভয় হত।

এক দিন স্কুলের পথে আমাদের দু’ভাইকে দেখে থমকে দাঁড়ায় থানার জিপ। ছোট ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, আমি ভাইকে। বুকের ভিতরে হাতুড়ি পিটছে। জিপ থেকে নেমে আসেন থানার ছোটবাবু। মুখে হাসি দেখে হাতুড়িপেটা একটু কমে। এঁকে আগে দেখেছি। এক রাত্রে কাশেম দারোগা যখন আমাদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে স্বাধীন ভারতের পুলিশের শেখা সমস্ত কুৎসিত শব্দগুলো আমার মায়ের সামনে উচ্চারণ করছিলেন, ইনি ঈষৎ অসহিষ্ণু ভাবে বলেছিলেন, স্যর, এরা তো বলছে, জানে না। ধমকে উঠেছিলেন কাশেম দারোগা, ‘দাস, ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বি আ গুড অফিসার, দেন লার্ন টু ডিসবিলিভ অল দিজ বোগাস থিংস।’ সেই দাসবাবু আমার হাত ধরেন, আড়ালে টানেন। ‘তোমরা রফিকুল হাসানের ছেলে না? শোনো, বাড়ি গিয়ে মাকে বলবে, বাবা যেন এখন কিছুতেই বাড়ি না আসে।’ ধুলো উড়িয়ে চলে যায় জিপ। আমি ভাইয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিই। আমার চোখেও জল। পুলিশ নামক প্রতিপক্ষের মধ্যেও কেউ এক জন আমাদের কথা ভাবেন জেনে সেই জল গাল বেয়ে গড়িয়ে আসে। বুঝি, ছোট ছোট মানুষদের জন্য ছোট ছোট ঈশ্বররা এখনও আছেন। কোথাও না কোথাও।

মা পর দিন ছোট্ট চিরকুটে লেখা ফোন নম্বরটি বুকের ভিতর নিয়ে তিন কিলোমিটার হেঁটে পোস্ট অফিস গেলেন। ফলে সেই বর্ষার বিকেলের পর বাবা আর ফেরেননি। পলাতক জেনে পুলিশ আসাও একটু কমে গেল।

অনেক দিন পর, আবার পুলিশ। কাঁটামারা জুতোর মশমশ আওয়াজ যেন বুঝিয়ে দেয় তাদের সফলতা। শুরুটা অবশ্য হয়েছিল প্রত্যেক বারের মতো জেরা দিয়ে। ‘কী রে শালি, রসা-র পোস্টমাস্টারের বাড়ি কী জন্য যাস? চিঠি দিতে, না ফোন করতে?’ তার পর অন্য দিনের মতো ‘তল্লাশি’ না করে বড়বাবু বাঁকা হাসি আর দু’অক্ষরের একটা হালকা গালি দিয়ে মাকে খবরটা দিয়ে যান।

মর্গে গিয়ে দেখি, বিকৃত মুখ নিয়ে পড়ে আছে কত বেওয়ারিশ লাশ। বাবার কপালে শুধু ছোট্ট একটা গুলির দাগ। মা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। শনাক্তকরণ শেষে লাশ চলে যায় শিক্ষানবিশ সার্জেনের টেবিলে। আমি মর্গ থেকে বেরিয়ে আসি। ডোম বাবার পকেট থেকে পাওয়া একটা চিঠি ধরিয়ে দেয় হাতে। মাকে লুকিয়ে আমি মোমিনপুর মর্গের পিছনে চলে যাই। ঝাপসা চোখে দেখি রক্তমাখা একটা নীল খাম। মাকে লেখা বাবার চিঠি। কয়েকটা লাইন। ‘সুচেতনা, ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে তোমার অভিমান, জানি। চিঠি তো আজকাল আর লেখোই না। ফোনেও বড় কম কথা বলো রাগ পুষে রেখে। কাল বিহারের একটা অজ গ্রামে চলে যাচ্ছি। বুঝি, ভালবেসে এত দূরে থাকতে নেই, একা।

কিন্তু, কিছু দিন লুকিয়ে থাকা খুব জরুরি...

হাসান হাবিব, বীরভূম

hasanhabib1000@gmail.com

সত্তরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?

লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

জেন-জেড’রা তাদের মা-বাবার কাছে জানতে চেয়েছে, কেন তাদের ছেলেবেলার সব ক্যানডিড ছবিই ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন। এতে তাদের চোখের, চুলের, দাঁতের, এমনকী গায়ের রঙের বিন্দুবিসর্গও বোঝা যাচ্ছে না। সবই ঘন কালো। তা ছাড়া ৮০% ছবিই হয় ঝাপসা, না হয় হাত কেঁপে যাওয়া, হেজি। পিকচার কোয়ালিটিও এমন কিছু আহামরি নয় যে সেটা দিয়ে জেন-জেড ব্ল্যাংকেট বা ওয়ালপেপার বানাবে। উত্তরে মা-বাবারা জানিয়েছেন, সে সময় সব ছবিই ক্যামেরা-ফোনে তোলার চল ছিল। আসল ক্যামেরা তাঁরা বড় একটা বের করতেন না। জেন-জেড-এর আনা গুরুতর অভিযোগগুলির মধ্যে আরও একটি হল, ফ্যামিলি-গ্রুপ ছবিগুলির সবই কেন গলা পর্যন্ত। ফুল-বডি শট না তোলার জন্য আজ তাদের সেই সময়ের ড্রেস সেন্স, ফ্যাশন ট্রেন্ড বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। এ ছাড়া আউটডোর ছবিগুলিতে ফোটো বম্ব-এর উপস্থিতিও বেশ বিরক্তিকর। মা-বাবারা সবিনয়ে জানিয়েছেন তাদের এতে কোনও হাত নেই। যুগটাই ছিল সেল্ফি-র। আদ্যিকালের ক্যামেরা-ফোন জনিত ভুলত্রুটির ফল যাতে আর একটা প্রজন্মকে ভুগতে না হয়, তার জন্য আপেল, আঙুর, আম সহ সমস্ত কোম্পানি এখন থেকে ফোনে ফ্ল্যাশের ফাংশনকে বাধ্যতামূলক করেছে। প্রতিটি ইশারা-ফোন (টাচ ফোনের আঙুলের যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিতে যে নতুন ফোন বাজারে এসেছে, যা হাত ও চোখের ইশারায় অপারেট করা হয়) ও ট্যাবলেটের সঙ্গে তারা একটি অ্যাটাচ্ড ফোল্ডিং স্ট্যান্ড (যার ওজন প্রায় শূন্য এবং ফোনের মধ্যেই ফিট করা। নির্দিষ্ট জায়গা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলে, ফোন থেকে বেরিয়ে এসে, নিজে থেকে সেট হয়ে যায়) বিনামূল্যে ক্রেতাদের বিলি করছে। ওই স্ট্যান্ডের ওপর ট্যাব বা ফোন আটকে, শরীর থেকে অন্তত পাঁচ ফুট দূরত্ব রেখে, টাইমার সেট করে, আঙুল হেলিয়েই ফুল-বডি সেলফি তোলা যাচ্ছে। নতুন ব্যবস্থায় দারুণ খুশি আমজনতা।

সংহিতা হাজরা চক্রবর্তী, নিউ অর্লিয়েন্স

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা: টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement