রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

....

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৪ ০১:২৮
Share:

পিনাকী ভট্টাচার্য

Advertisement

সব সংস্থায় পদোন্নতি আর ঠাঁই-বদলের ফলাফল বেরিয়ে গিয়েছে এত দিনে। এই সময় কিছু লোক গেলাসে উল্লাস তুলছে আর কিছু লোক প্রোমোশন না পাওয়া আর দ্বীপান্তরে পোস্টিং-এর হতাশা ভুলতে গেলাস আঁকড়াচ্ছে। এই পালাবদলের পালায় একটু জলপথে বিচরণ করা যাক।

ঠিক কবে থেকে ‘ডিস্টিলেশন’ পদ্ধতি ব্যবহার করে বা বিভিন্ন খাদ্য আর শস্য গেঁজিয়ে মদ ও পানীয় বানানো শুরু হয়েছিল, তা বলা মুশকিল। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার যুগে মিশরীয়রা যে ‘ডিস্টিলেশন’ পদ্ধতি নিয়ে ওয়াকিবহাল ছিল, তার বিস্তর প্রমাণ মিলেছে পরবর্তী যুগে। আর চিন দেশের প্রাচীন পুঁথিতে খ্রিস্টের জন্মের ১০০০ বছর আগেও ভাত পচিয়ে কড়া আরক বা মদ বানানোর কথা লেখা আছে। তরল পদার্থকে তার স্ফুটনাঙ্কের চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় ফুটিয়ে তার থেকে নির্যাস বার করার রেওয়াজ গ্রিস আর রোমে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই ছিল। অ্যারিস্টটল এই পদ্ধতিকে মদিরা থেকে আরক তৈরির উপায় বলে উল্লেখ করেছেন। হিপক্রিতিস আর গ্যালেন শরীরে ক্ষতস্থান সারাতে বা জল পরিশুদ্ধ করতে ফুটিয়ে ঘন করা মদিরা ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ল্যাটিন ভাষায় আরককে যার জন্য ‘অ্যাকুয়া ভিটা’ বা ‘জীবনদায়ী জল’ বলা হয়।

Advertisement

অষ্টম শতাব্দীর আরব দেশে জেবার নামে এক অপরসায়নবিদ (অ্যালকেমিস্ট), মদিরা থেকে আরক (স্পিরিট) তৈরির এক বিশদ পরীক্ষা করেন অ্যালেম্বিক নামে এক বিশেষ ভাবে বানানো এক ধাতব পাত্রে, আর সেই সফল পরীক্ষার এক পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা লেখেন। জেবারের মুর-দেশি বেরাদররা স্পেন বিজয়ের সময় ‘অ্যালেম্বিক’-এর রহস্য ইউরোপীয়দের শিখিয়ে দেয়। মোটামুটি সেই পদ্ধতি ধরেই আজও মদিরা থেকে আরক বার করা হয়ে চলেছে। ডিস্টিলেশন পদ্ধতির গোপন রহস্য আর কলাকৌশল খুব কম দিনেই পৌঁছে গেল খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের মনাস্ট্রিগুলোতে। আর এই বিদ্যা তাঁরা কাজে লাগালেন বিভিন্ন ধর্মীয় উপচারের জন্যে মদ বানানোর সময়। দ্বাদশ শতাব্দীতে এই খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের সঙ্গেই এই কলাকৌশল আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডে পৌঁছায়, যেখানে প্রাচীন কেল্টরা ইতিমধ্যেই আঙুরের অভাবে শস্য ব্যবহার করে তৈরি করছিল তাদের ‘ইশ্গা বাহা’, যার অর্থ কেল্ট ভাষায় ‘জীবনদায়ী জল’! এই ‘ইশ্গা বাহা’ ধর্মযাজকদের আনা বিশেষ ডিস্টিলেশন পদ্ধতিতে ফেলে প্রথম হুইস্কি তৈরি হল। ১৪৯৪ সালে প্রথম যখন কোনও নথিতে হুইস্কিকে পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে উল্লেখ করা হচ্ছে যে ফ্রায়ার জন ক্যর শস্যদানা পেয়েছিলেন হুইস্কি তৈরির জন্যে, যা দিয়ে তিনি অনায়াসে বর্তমান মাপের ১৫০০ বোতল হুইস্কি তৈরি করতে পারেন। কিন্তু এই নথি প্রকাশের অনেক আগেই হুইস্কি স্কটল্যান্ডে জনসাধারণের কাছে শীতকালে চাঙ্গা থাকার জন্যে অব্যর্থ দাওয়াই হিসেবে আর সারা বছরের মৌতাতের সঙ্গী হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

হুইস্কি যখন স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে এই জনপ্রিয়তা লাভ করছে, খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা কিন্তু তখনও হুইস্কি বানানোর কৌশল নিজেদের আস্তিনে লুকিয়ে রেখেছিলেন। ১৫৪১ সালে রাজা অষ্টম হেনরি স্কটল্যান্ডের মনাস্ট্রি বন্ধ করে দিলেন যখন, ধর্মযাজকরা আতান্তরে পড়ে বেকারত্ব ঘোচাতে ব্যক্তিগত মালিকানায় হুইস্কি তৈরি করতে শুরু করলেন, আর ভাল মানের হুইস্কি বানানোর রহস্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। স্কটল্যান্ডের মানুষ তাঁদের হুইস্কি নিয়ে এতটাই স্পর্শকাতর হয়ে উঠল যে তারা হুইস্কি বানান করে WHISKY যেখানে বাকি বিশ্ব হুইস্কি বানান করে WHISKEY।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের কার্তিক চন্দ্র গাইন আমাদের ছোট লঞ্চ এবং গাইড দিয়ে সাহায্য করেছিলেন বলেই সুন্দরবনের গভীরে ঢুকে মধুসংগ্রহকারী ‘মৌলে’দের রেডিয়ো ডকুমেন্টারি করতে পেরেছিলাম। নাম ছিল ‘মধু’। ২০০১/২০০২ সাল নাগাদ কাজটা হয়েছিল, এই কাজের সুবাদেই ফকির আলির সঙ্গে পরিচয়।

ফকির আলি হল এক জন পোকাচালাক। মৌলেদের দলে এক জন বহরদার থাকে, সে হল গুণিন। বাঘের মুখ বন্ধ করে দেওয়া, বাঘকে আলসে করে দেওয়া ওদের কাজ। নানা রকম মন্ত্র আছে। একটি হল ‘বাঘ তোর জন্ম ফতেমার ঘরে/ ধামাচাপা দিয়ি রাখি তোরে/ বাঘ তোর ধর্ম করিস কুকর্ম/ যদি নাড়িস হাত/ যদি নাড়িস পা/ দোহাই মা ফতেমা,

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

দোহাই মা ফতেমা।’ দলে এক জন থাকে পোকাচালাক, সে মৌমাছির চাক কোথায় আছে, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। একটি চাকের মৌমাছিরা একটা নির্দিষ্ট স্থানে মলত্যাগ করে। সেই মৌ-মলের সন্ধান পেলে মৌমাছিদের বাহ্যগমনাগমন ফলো করে চাকের সন্ধান পায়। মৌমাছিকে লৌকিক ভাষায় বলে ‘পোকা’। এক জন থাকে তাড়ানি। সে চাক থেকে মৌমাছি তাড়াতে বিশেষজ্ঞ। ফকির আলি ছিল পোকাচালাক। ফকির আলির কাছে শুনতাম শুধু মৌ-মল নয়। বাঁদরও কী ভাবে চাক চিনিয়ে দেয়। এর বদলে ওদের একটু একটু করে চাক ভেঙে দিতে হয়।

এক দিনের কথা মনে পড়ে, নৌকায় ফকির গান গাইছে— রুনা লায়লার ‘তিন দিন তোর বাড়িতে গেলাম’-এর সুরে— বন্ধু, তিন দিন তো হইয়া গেল চাক পাইলাম না...আইতে যাইতে একশো/ লাইসেন পাইতে দুইশ/ এত খরচ তবু বুঝি মধু মিলে না... গ্রীষ্ম কাল, মাতলা নদীতে দখিন পবন, ফকির খালি গায়ে, ফকিরের ছেলেটা ওর বাবার বুকে আর পাঁজরে আঙুল চালিয়ে এক-এ চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিন-এ নেত্র চার-এ বেদ...বলছে। লক্ষ করলাম ফকির আলির গায়ে লম্বা লম্বা দাগ, চামড়া কুঁচকে রয়েছে। অপারেশনের সেলাইয়ের মতো। জিজ্ঞাসা করলাম, এই দাগগুলো কীসের ফকির ভাই? ফকির খুব নির্বিকার ভঙ্গিতেই বলল, বাঘে থাবা মেরিছিল, এগুলো বাঘের থাবার চিন্ন।

কী ভাবে ধরেছিল? গল্প শুনতে চাই, হরর স্টোরি।

ও নির্বিকার ভাবে বলে, কু’দে কু’দে এগুচ্ছিলাম, চোখ তো পোকার দিকে, পোকা ঝিদিক পানে যাচ্ছে, আমিও সে দিক পানে, সেই মওকায় বাঘে ধরল, পরে স্যাঙাতরা এসে পটকা মেরে বাঘ তাড়াল।

কু’দে কু’দে মানে পরে জেনেছিলাম। গভীর জঙ্গলে গাছেরা আড়াল করে দেয় মানুষদের, তখন কোকিল-চ্যাঁচানি দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানাতে হয়, এটাই কু দেওয়া।

তার পর? গল্প শুনব তো, নৌকোয়, দখিনা পবন।

আল্লাতালা সব ব্যবস্থাই করি রাখিচেন। পারুই লতা ঝুলছিল কাছেই, দাঁতে চিবিয়ে গায়ে থুপে দিল, ক্যানিং-এর হাসপাতাল দুই জোয়ারের পথ। সিলাই ফোড়াই হল, আল্লা বাঁচায়ে দেলেন।

ছেলেটা বলল, পিঠ ফেরো বাপ, গুনি, পাঁচে পঞ্চবাণ, ছয়ে ঋতু, সাতে সমুদ্দর...।

ফকির আলি আবার নির্বিকার ভাবে অনন্ত আকাশের দিকে কথা ছুড়ে দেয়— দুই ছাওয়াল আমার। বড় ছাওয়ালটাও এরম ভাবেই থাবার দাগ দে এক-দুই শিখেছে...।

বিদ্যাসাগর মাইল-ফলক গুনে, আর এই ছেলেটা বাঘের থাবায়।

দক্ষিণরায়-বনবিবি বন্দনা বন্দনা, খিলেন মন্ত্র, আলসে মন্ত্র, কোকিল চ্যাঁচানি, সব রেকর্ডিং করে ফিরে আসি, কিন্তু ফকির আলি আমাকে ছাড়ে না। যখন বিউটিশিয়ানরা টেলিভিশনে মধু-ময়দার প্যাক-এর কথা বলে, ডায়েটিশিয়ানরা লেবু-মধুর কথা বলে, এমনকী ইন্ডিয়াশিয়ানরা ‘মধুবাতা ঋতায়তে’ বলে, তখন ফকির আলি মেহের আলি হয়ে ‘জিলে লে-জিলে লে’র সুরে চেঁচিয়ে গান গায় ‘গুনে নে-গুনে নে আয়ো আয়ো গুনে নে...’

কিছু দিন আগে আবার ফকির আলি’কে দেখলাম, এ অন্য এক ফকির আলি। সারা গা থেকে রক্ত ঝরছে। ফকির আলির ছেলেটাকেও দেখলাম, খবর কাগজে, টেলিভিশনে।

আমার সঙ্গে আপনারাও অনেকে দেখেছেন ছেলেটিকে। ফকির আলির সেই ছেলেটির মতোই বয়স, ও রকমই চোখ।

ভোটের আগে হাড়োয়ার এক গ্রামের ঘরছাড়া মানুষেরা এসেছিল গণতন্ত্রের পবিত্র কর্মটি করতে, মানে ভোট দিতে। গুলি চলেছিল।

ছেলেটি নির্বিকার, মানুষের গায়ে লাগা গুলির দাগ গুনতে গুনতে সংখ্যা শিক্ষা করছিল। এক-এ চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিন-এ নেত্র, চার-এ বেদ... নব্য বাল্য শিক্ষা।

swapnoc@rediffmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement