হিটলার, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে।
প্রতিবেদক: ‘ডায়রি অব অ্যানি ফ্র্যাঙ্ক’ পড়েছেন?
হিটলার: না। তবে জানি। বেস্টসেলার। আমার ‘মাইন কাম্ফ’-এর মতোই। তবে আমার বইয়ের বিক্রি বাইবেলকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। কোথায় লাগে তোদের হ্যারি পটার, ফিফটি শেড্স অব গ্রে?
প্রতি: একটা ছোট্ট ইহুদি মেয়ে, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে...
হিটলার: সেন্টিমেন্টাল তাস খেলছিস? সোজাসুজি বললেই হয়! আমার জমানায় লক্ষ লক্ষ মানুষ মরেছে বলে আমার গিল্টি ফিলিং হয় না। কারণ, যা করেছি, তার পেছনে একটা প্রিন্সিপ্ল ছিল। যে প্রিন্সিপ্ল বলে, আমার দেশ পৃথিবীর সেরা দেশ। আমার জাতটা সেরা জাত। আর সব— ইহুদি, স্লাভ, সার্ব, ক্রোট, পোলিশ, রাশিয়ান— সব অশিক্ষিত, থার্ড ক্লাস, ছোটলোক। তো আমার দেশকে সেরার সেরা করতে হলে যা যা করা দরকার ছিল, করেছি। প্লেন অ্যান্ড সিম্পল।
প্রতি: বাঃ, প্রিন্সিপ্লটা আদৌ ঠিক কি না, ভাবব না?
হিটলার: তুমি এক জন ডিক্টেটরের সঙ্গে কথা বলছ, ছোকরা। দুধুভাতু গণতান্ত্রিক নেতার সঙ্গে নয়। আলেকজান্ডারকে কেউ বলতে পেরেছিল, পারস্যতে কী মরতে হামলা করছেন? নেপোলিয়নের রাশিয়া-আক্রমণ নিয়ে কেউ আঙুল তুলেছিল? ডিক্টেটররা যখন যা ভাবে, সর্বস্ব দিয়ে ভাবে। বিশ্বাস করে কলজে দিয়ে। আর ওই বিশ্বাসটাকে সত্যি করে তুলতে একরোখা একবগ্গা অ্যাকশন যা যা করা দরকার, করে তবে ছাড়ে।
প্রতি: একটা জাতের রক্ত সব চেয়ে ভাল, এটা বিশ্বাসযোগ্য? সায়েন্স বলে কিছু নেই?
হিটলার: বিশ্বাসযোগ্য কী বলছিস রে, আমি সিনে আসার ঢের আগে থেকেই লাখ লাখ জার্মানের ওটাই বিশ্বাস ছিল। শুধু পাবলিক না, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পপতি, যাজক, মায় কবিও ভাবত, এই ইহুদিগুলো, স্লাভগুলো জিনা হারাম করে দিল! নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরির জার্মান হিস্ট্রি পড়! হিটলার ভুঁইফোঁড় স্বয়ম্ভূ না। ঠিকঠাক জল-হাওয়া-সার পেয়েছে বলেই তরতর বেড়েছে! থার্ড রাইখ বিশ শতকের জার্মানির ভবিতব্য ছিল।
প্রতি: আপনি তবে স্রেফ ক্যাটালিস্ট?
হিটলার: না। আমি গমগমে লাউডস্পিকার। সবাই যেটা মনে মনে ভেবে হদ্দ হয়ে গুমরেছে, আমি সেটা সপাটে বলেছি। তোরা বাঙালিরা মনে মনে ভাবিস না, রাজ্যটা পুরো বিহার হয়ে গেল? আবার একটা সম্প্রদায়ের মানুষ মনে মনে বলিস না, সব রেপ-এর নিউজে শুধু ওই ব্যাটাদের নাম? ওই সাইলেন্ট তড়পানিগুলো আমি মুখের ওপর বলে দিয়েছি। আমার সাফ কথা, আমার এরিয়ায় তো নয়ই, এই দুনিয়াতেই তুমি থাকতে পারবে না বস। কাজেও করে দেখিয়েছি।
প্রতি: ‘কাজ’? ৬০ লক্ষ ইহুদি মরেছে। ২০ লাখ পোলিশ। সোভিয়েত যুদ্ধবন্দি আর কমিউনিস্ট মিলে ৩০ লাখেরও বেশি।
হিটলার: স্ট্যাটিসটিক্স দেখাচ্ছিস? আমিও দেখাতে পারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শুরু করে আজ অবধি গোটা বিশ্বে কোথায় কত লোককে কারা সাল্টে দিল, তার স্ট্যাটিসটিক্স? এক ভিয়েতনাম আর দুটো ইরাক যুদ্ধেই আমেরিকা দেড় কোটি নিকেশ করেছে। আফগানিস্তান, কোরিয়া, সিরিয়া, লিবিয়া, মিশর, ইউক্রেন, গাজা... আফ্রিকার কেলেকুষ্টি দেশগুলোর কথা তো বাদই দিলাম। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়, আর আমি একা কিনা ইতিহাসের পাতায় অনন্ত খুনি, ছাপ্পামারা গণহত্যাকারী!
প্রতি: এখন কী হচ্ছে না হচ্ছে, তাতে তো আপনার দোষ কমে না।
হিটলার: দোষ আবার কী রে হতভাগা? আমি বলছি এটা একটা গুণ। এটা একটা সত্য, যাকে সেমিনারবাজি দিয়ে রোখা যাবে না। আমাকে গ্রেটেস্ট ভিলেন বানানো হয়েছে, কারণ লোকে স্তালিনের কেচ্ছা জানে না, পল পট-এর নাম শোনেনি, জেনারেল ফ্রাঙ্কোর চ্যাপ্টার পড়েনি, মুগাবের নাম বললেও হাঁ করে তাকায়। আসলে, আমি সবচেয়ে শার্প আর ডায়নামিক ছিলাম তো! কথা দিয়ে, আদর্শ দিয়ে একটা গোটা দেশের লোককে চুম্বকের মতো কাছে টেনেছিলাম! আমার ম্যানিফেস্টোটা খুব সিম্পল। বিশ্বটাকে আমার কলোনি বানাতে হবে, কারণ ঠিকঠাক খেয়েপরে বেঁচেবর্তে থাকতে হলে আমার য়াব্বড় জায়গা চাই। নইলে জাতটা বাড়বে কী করে? তোর ঘরের বহর সাড়ে পাঁচ হাত, পাশ ফিরে শুতে দেওয়াল গায়ে ঠেকে, তুই তো অষ্টপ্রহর খিটখিটে হয়ে থাকবি। ওর মধ্যেই বউ বাচ্চা বিয়োবে, মা-বাপ হাঁপ টানবে, আপাদমাথা অসুখ পিনপিন করবে, আর তুই পথে বেরিয়ে আলুর দাম আর বাসভাড়া নিয়ে ইউনিয়নবাজি করবি, সোশালিস্ট স্টেটাস পোয়াবি!
প্রতি: আপনারও পার্টির নামেও কিন্তু ‘সোশালিস্ট’ শব্দটা ছিল।
হিটলার: ছিল। তবে অন্য সংজ্ঞায়। আমারই দেওয়া। দেশকে যে সর্বস্ব দেবে, ‘দেশের কাজ’-এর উর্ধ্বে যে আর কোনও কিছুকেই রাখবে না, যার চোখে দেশোয়ালি ভাইবেরাদরের চেয়ে আর কিচ্ছু, কোনও দিন, কোনও ভাবে বড় নয়, সে-ই সোশালিস্ট।
প্রতি: সুইসাইড বম্বারকেও ওই বলেই ব্রেনওয়াশ করে।
হিটলার: বোগাস! আমার কথা একটা গোটা দেশ নিয়েছিল, আধখেঁচড়া গুটিকয় না। খেয়োখেয়ির রাজনীতির একটা দেশকে আমি এক করেছিলাম। পাবলিকের মজ্জায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম এই অস্মিতা: আমি সব্বার চেয়ে বড়, দুনিয়ার প্রভু। মোটে ১২ বছরে দেশটাকে এমন হাইটে তুলেছিলাম, যা আগের হাজার বচ্ছরে হয়নি। অ্যাডল্ফ হিটলার একটা মানুষ না, একটা মানসিকতা। আর, বাপ আমার, সেই মানসিকতাই কি এখনও জিতছে না? রমরম করছে না? তোরা এই ১৫ অগস্ট কপচালি না, তোদের দেশই পৃথিবীর সেরা?
প্রতি: কী মুশকিল, আমরা তো তা বলে অন্য দেশকে মারতে যাইনি! দেশপ্রেম আর মেগালোম্যানিয়া এক?
হিটলার: সব এক। শুধু ইংরিজি আর বাংলা। শাক দিয়ে ঢাকা, আর খুল্লমখুল্লা। তোরা মারতে যাসনি, কারণ তোদের মুরোদ নেই। যদি পাকিস্তানকে পেটাস, তোদের পাবলিক কী করবে? ‘ছিঃ, কী হিটলারি!’ বলে নিন্দে করবে? না, ‘জয় জয় বীরশ্রেষ্ঠ’ বলে মালা পরাতে উঠতেপড়তে ছুটবে? যদি একটা ‘জয় বাঙালি’ নামে হিংস্র সংগঠন হঠাৎ গজিয়ে বলে, কলকাতা থেকে ধনী আবাঙালি সম্প্রদায়কে তাড়াব, বাঙালিকে চাকরিতে প্রেফারেন্স দেওয়া বাধ্যতামূলক করব— তা হলে পোস্ট-এডিটে যতই কুমির-কাঁদুনি হোক, সত্যি সত্যি সব বাঙালি কি তাকে ছ’কোটি ছাপ্পা ভোট দিতে রাত থাকতে লাইন দেবে না? শুধু বাঙালি কেন, সবাই, সবাই। সব্বাই ডিক্টেটর চায়। তাই আমার এত ক্যারিশ্মা। এখনও আমাকে নিয়ে নাটক, ফিল্ম। কিম জং-আন সৈন্যদের মাইন কাম্ফ বিলিয়ে বলেছে, আমিই পরম ইন্সপিরেশন। খোদ জার্মানিতে এগজিবিশন হচ্ছে নাৎসি জমানার চিঠিচাপাটি-ফাইলপত্তর নিয়ে, লোক উপচে হাঁ করে গিলছে। তোদের দেশের এক মুখ্যমন্ত্রী এই সে দিন বিবৃতি দিয়েছে, দুনর্ীর্তি হঠাতে আমি হিটলারও হতে পারি! তোদের রিসেন্ট ভোটেও কি জাত্যভিমানকে কাজে লাগিয়ে সমষ্টি-ইগো চাগিয়ে তোলার ব্লুপ্রিন্ট কাজ করেনি? আমি আসলে তোদের ভেতরে ডেলি গার্ড অব অনার নিচ্ছি। কোথাও এক তিল, কোথাও এক তাল। দুনিয়ার সব লোকের রাত্তিরের ফ্যান্টাসি তালে তালে বলছে, ‘হেইল হিটলার!’
iwritemyright@gmail.com