ঘুড়ি ওড়ানো কোনও আন্তর্জাতিক খেলা নয় ঠিকই, তবে সারা বিশ্বে বিনোদনের এক মেজাজি উপকরণ। একরাশ আনন্দ লাভের জন্য আট থেকে আশি প্রত্যেকেই মেতে ওঠেন এই ঘুড়ি ওড়ানোর চিত্তজয়ী খেলায় আর ভো-কাট্টার নির্বার নেশায়। নিছক ‘মনোরঞ্জন’ই বা বলব কেন, পৃথিবীর অনেক দেশই ঘুড়িকে আকাশে উড়িয়ে বিভিন্ন রকমের কাজ করার কৌশলে সফল হয়েছে।
প্রাচীনকালে ঘুড়িকে ব্যবহার করা হত সামরিক কাজে। নৌবাহিনীর গোলন্দাজরা লক্ষ্যভেদের অনুশীলনের জন্য ঘুড়ি ব্যবহার করতেন। সে সময় চিনে তৈরি হত ‘মু ইয়ুয়ান’ অর্থাৎ কাঠের ঘুড়ি। পরে কাগজ আবিষ্কার হলে তৈরি হয় ‘ঝি ইয়ুয়ান’ অর্থাৎ কাগজের ঘুড়ি। চিনে ঘুড়িকে বলে ফেং ঝিং। আফগানিস্তানে আবার এর নাম ‘গুড়িপারান বাজি’।
হাজার বছর আগে চিন দেশে শত্রুর যুদ্ধ-জাহাজ ধ্বংস করার উদ্দেশে ঘুড়িতে বিস্ফোরক বেঁধে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পাঠানো হত, বিস্ফোরণ ঘটাতে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও প্লাস্টিক-ঘুড়ির সঙ্গে ‘এরিয়াল’ লাগিয়ে শূন্যে ভাসিয়ে পাঠানো হত রেডিয়ো-সংকেত। আবার কখনও কখনও অকূল সমুদ্রে জাহাজ বিকল হয়ে পড়লে ঘুড়ির সাহায্য নিয়ে সংকেত জানানো হত। ১৮৯৮-এ আমেরিকা-স্পেনের যুদ্ধে ঘুড়ি-ফোটগ্রাফারের কথা নিশ্চয় অনেকেই জানো।
ঘুড়িকে ‘গুপ্তচর’ হিসেবেও ব্যবহার করতে দেখা গেছে প্রাচীনকালে। জাপানে এক দুর্গ থেকে আর এক দুর্গে দুর্গবাসীরা গুপ্তসংকেত এবং চোরা চিঠি পাঠাতেন ঘুড়ির গায়ে ক্যালিগ্রাফি করে।
পাখির ধাক্কায় বিমান দুর্ঘটনার খবর আমরা হররোজই কাগজে পড়ি। পাখি তো উড়োজাহাজের শত্রুই, বিমানের আর এক শত্রু হল ঘুড়ি। বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের বিমান হানার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মিত্রপক্ষের রণতরীতে অসংখ্য ঘুড়ি বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ওই ঘুড়িতে চারটি জার্মান বিমান নষ্টও হয়ে গিয়েছিল। রণতরীর ওই ঘুড়ির নকশা তৈরি করেছিলেন হ্যারি সি চাউলস।
ঘুড়ির ব্যবহার দেখা গেছে গবেষণার কাজেও। ১৭৫২-তে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন খুবই বিপজ্জনক কাজে ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন আকাশে। তাঁর ঘুড়ি ওড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল বজ্রপাতের পেছনে যে বিদ্যুৎ কাজ করে, তা প্রমাণ করা। স্কটল্যান্ডের দুই বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার উইলসন ও টমাস মেলভিন ১৭৪৯-এ ঘুড়ির গায়ে থার্মোমিটার লাগিয়ে তাকে আকাশে ভাসিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন পৃথিবীর উপর স্তরের তাপমাত্রার। আর ইংল্যান্ডের এক বিজ্ঞানী ডগলাস আর্কিবল্ড বিভিন্ন উচ্চতায় বাতাসের গতিবেগ মাপার জন্য ঘুড়িতে বেঁধে দিয়েছিলেন অ্যানিমোমিটার। ঘুড়িতে বাঁধা যন্ত্রটি প্রায় ১২০০ ফুট উচ্চতায় বাতাসের সঠিক গতিবেগ জানিয়ে দিতে এতটুকু ভুলচুক করেনি কিন্তু!
১৮০৯-এ অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী হারগ্রাভস যে ত্রিমাত্রিক ঘুড়ি তৈরি করেছিলেন, তার সঙ্গে রাইট-ভাইদের এরোপ্লেনের মডেলের আবার অদ্ভুত মিল দেখা যায়। প্রসঙ্গত, এরোপ্লেন আবিষ্কারের আগে ঘুড়ি অনেকটাই এরোপ্লেনের কাজ করত। ঘুড়ির সঙ্গে মানুষকে বেঁধে তাকে অনেক উপরের দিকে তোলা হত শত্রুপক্ষের নানান তথ্য এবং তাদের ঠিক অবস্থান জানতে।
প্রযুক্তির কাজেও ঘুড়ির ব্যবহার হয়েছে। ১৮৪৭-এ নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উপর যে ঝুলন্ত সেতু তৈরির কাজ হয়েছিল, সে কাজে দড়ির মইকে এপার থেকে ওপারে নিয়ে যেতে কিন্তু এই ঘুড়িরই সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। আবহাওয়ার পূর্বাভাস নির্ণয়ের জন্য আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস’ সংস্থাটি ১৮৯৩-১৯৩৩ পর্যন্ত সাহায্য নিয়েছিল ঘুড়ির।
ভারতে ঘুড়ির ব্যবহার হয় মূলত বিনোদন ও খেলাধূলার কাজেই। ভারতে সর্বপ্রথম ঘুড়ি ওড়ানো হয় মোঘল আমলে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে, দিল্লিতে। তার পর দিল্লি থেকে আগ্রা, লখনউ, কানপুর, গাজিয়াবাদ, বেরিলি, আমদাবাদ, লুধিয়ানা হয়ে অনেক পরে কলকাতায় এসে পৌঁছেছিল এই খানদানি শখটি। বাবু কালচারের হিড়িকের কলকাতায় বাবুদের আগ্রহে ঝিলিক তুলেছিল ঘুড়ি। আভিজাত্যের অহংকারে হিরে, চুনি, পান্না গুঁড়ো করে মাঞ্জা দেওয়া হত ঘুড়ির সুতোয়। নোট বেঁধে ওড়ানো হত ঘুড়ি। এখন রীতিমত গবেষকদের দখলে কলকাতার ঘুড়ির জগত। ‘কাইট ক্লাব’ও হয়েছে অনেক। মেটিয়াবরুজ, খিদিরপুর, তালতলা, এন্টালির হালকা ও মজবুত ঘুড়ি যথেষ্ট জনপ্রিয় এখন।
এক সময় বল্লারপুর কাগজের চাহিদা থাকলেও এখন বাদামজি, অজন্তা, এম এফ টিসু, ত্রিবেণীর কাগজের চাহিদাই বেশি। গুজরাতের উত্তরণ উৎসবে, জাপানের ৫ মে-র শিশুদিবসে, চিনের লণ্ঠন উৎসবে, কোরিয়াতে নববর্ষে, তাইল্যান্ডে মার্চ মাসে, মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন শহরে প্রত্যেক বসন্তে ঘুড়ি নিয়ে শুরু হয় হইহুল্লোড় আর ঘুড়ির নানান প্রতিযোগিতা। আকাশ তখন শুধুই ঘুড়ির আকাশ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক ঘুড়ি-উৎসবটি হয় ভারতের ঘুড়ির শহর আমদাবাদের পতঙ্গনগরে। ১৯৮৬-র ফেব্রুয়ারিতে এখানে খোলা হয় শুধুমাত্র পতঙ্গেরই একটি মিউজিয়াম।
ঘুড়ি মনের খোরাক শুধু নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারের কাজেও আজ লাগানো হচ্ছে এই ঘুড়িকে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুড়ির কাগজে বিভিন্ন সব ধর্মের প্রতীকের ছবি এঁকে ওড়ানো হচ্ছে ঘুড়ি!