তিনিই বিশ্বের একমাত্র নাট্যকার যিনি শেষ পর্যন্ত একটি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। না, ভুল হল, সেই রাষ্ট্রটি পরে দু’ভাগ হওয়ার পর, নতুন একটি রাষ্ট্রেরও তিনিই নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। আবার তিনি সেই লেখক, যিনি সারা পৃথিবীতে প্রচুর খ্যাতি পেয়ে, সেই খ্যাতিকে আরও বাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগকে সংযত করে, নিজের দেশে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাই বার বার তাঁর ওপর নেমে এসেছে শাসকের কোপ। এই চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার এবং সিভিল সোসাইটির নেতাকে দেশের কমিউনিস্টরা শত্রু ভেবেছে, আবার দেশের জটিল পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছে।
তিনি ভাচলভ হাভেল। অবিভক্ত চেকোস্লোভাকিয়ার শেষ রাষ্ট্রপতি, নবীন চেক রিপাবলিক-এর প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান। এই সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আগেই অবশ্য দুনিয়া জুড়ে ‘দ্য গার্ডেন পার্টি’ (১৯৬৩), ‘দ্য মেমোরেন্ডাম’ (১৯৬৫)— এই দুটি অ্যাবসার্ড নাটকের জন্য তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ‘অ্যান ওপ্ন লেটার টু ডক্টর হুসাক’ আর ‘দ্য পাওয়ার অব দ্য পাওয়ারলেস’-এর মতো বিস্ফোরক নিবন্ধ সংকলনও তাঁকে খুব বিখ্যাত করেছে। তাঁকে স্যামুয়েল বেকেট-এর ভাবশিষ্য বলা হয়। বেকেটও তাঁকে খুবই ভালবাসতেন, নোবেল পাওয়ার তেরো বছর পর লেখা নাটক ‘ক্যাটাসট্রফি’ বেকেট উৎসর্গ করেন তাঁর প্রিয় হাভেলকেই।
চেকোস্লোভাকিয়ায় তখন চরম সংকট। প্রায় পাঁচ বছর জেল-এ আছেন হাভেল। তাঁর নেতৃত্বে তিন বছর আগেই, অন্যায় ভাবে জেলবন্দি মানুষের মুক্তির সমর্থনে, গড়ে উঠেছে প্রতিবাদী নাগরিক কমিটি (কমিটি ফর দ্য ডিফেন্স অব দি আনজাস্টলি প্রসিকিউটেড)। আর তার দু’বছর আগে, ১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে, হাভেলের নেতৃত্বে ‘চার্টার ৭৭’-এর গণদাবিগুলোকে সামনে রেখে মানুষের নিঃশব্দ প্রতিবাদ সাড়া জাগিয়েছে দেশে তো বটেই, দেশের বাইরেও। ‘চার্টার-৭৭’এর ‘কয়েকটি বাক্য’ (আ ফিউ সেনটেন্সেস)-এর স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা কয়েকশো থেকে তখন অজস্র, অসংখ্যের দিকে। আলোচনার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-কলাকুশলীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছাত্রছাত্রীরাও প্রবল আন্দোলন চালাচ্ছে, আর সকলের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসছে। প্রাগ শহরে ‘ম্যাজিক ল্যান্টার্ন থিয়েটার’-এ, আর স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্লাতিস্লাভার ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’-এ সমবেত হচ্ছে প্রতিবাদীরা। নাট্যকার হাভেলের নেতৃত্বে এই ভাবে থিয়েটার তখন বিনোদনকেন্দ্রের বদলে শেকলভাঙা আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠছে। ১৯৮৯-এর ডিসেম্বরে চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রিত সংসদ নিরুপায় হয়েই ‘সিভিক ফোরাম’-এর নেতা ভাচলভ হাভেলকে সর্বসম্মত ভাবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নির্বাচন করে।
চেকোস্লোভাকিয়ায় চার দশকের বেশি টিকে থাকা কমিউনিস্ট শাসন প্রথম থেকেই দেশের থিয়েটারকে, থিয়েটার হলগুলিকে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনতে উঠেপড়ে লেগেছিল। সেই জন্যই, হাভেলের কলম সরাসরি বাস্তবের কথা না লিখে, স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল দুঃসহ বাস্তবের প্রতীকে, রহস্যময়তায়। বাকিরা তখন সমকালকে এড়িয়ে শেক্সপিয়র থেকে চ্যাপেকের অনুসরণে, অথবা গীতি-ব্যালাডে, কিংবা দূর-ইতিহাসের ছায়াপথে নিরাপদ ঘোরাঘুরি করছে। আর হাভেলের ‘দ্য গার্ডেন পার্টি’, ‘দ্য মেমোরেন্ডাম’ থেকে ‘দি ইনক্রিজ্ড ডিফিকাল্টি অব কনসেনট্রেশন’ কিংবা ‘লারগো ডিসোলেটো’, ‘টেম্পটেশন’ সহ প্রায় সব নাটকেই তিক্ত সমকালের ‘অ্যাবসার্ড’ আখ্যান। ফলে দেশের ভিতরে এই নাটকগুলি করতে যতটা বাধা এসেছে (নাটকগুলি তখন দেশে প্রকাশিত হতে পারেনি), দেশের বাইরে হাভেলের সাহসী আর ব্যতিক্রমী কলম আর কণ্ঠস্বর ততটাই আলোড়ন তুলেছে (তাঁর নাটকগুলি প্রকাশিত হয়েছে জার্মানিতে)।
এই সাহস আর ব্যতিক্রমী মানসিকতা অবশ্য হাভেলের রক্তে আছে। তিনি প্রাগ-এ যে পরিবারে জন্মেছিলেন, সেই পরিবার জ্ঞানে, মননে, মুক্তচিন্তায় দীর্ঘ কাল চেকোস্লোভাকিয়ার এনলাইটেন্ড সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছে। ফলে কমিউনিস্ট শাসকেরা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পরিবারটি সরকারি সন্দেহের তালিকায় ছিল। হাভেল তখন ছাত্র। তাঁকে তাঁর পছন্দমত পড়াশোনা করতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই চার বছরের শিক্ষানবিশিতে (এক কেমিকাল ল্যাবরেটরির নগণ্য এক সহায়ক হিসেবে) ঢুকতে হয় তাঁকে। নাছোড়বান্দা হাভেল সারা দিনের কাজের পর সন্ধ্যায় ক্লাস করে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন। রাজনৈতিক কারণেই পছন্দমত উচ্চতর শিক্ষালাভের দরজা তাঁর সামনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে স্টেজ টেকনিশিয়ানের কাজ করতে করতেই ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত ‘ফ্যাকাল্টি অব থিয়েটার অব দি অ্যাকাডেমি অব মিউজিকাল আর্টস’ থেকে পছন্দের নাট্যকলার ডিগ্রি অর্জন করেন। আসলে, পরিবার আর কৈশোর-যৌবনের এই যন্ত্রণাময় সময়টা তাঁকে একটু একটু করে তৈরি করেছে, এক লড়াকু ও শুদ্ধ চেতনার মানুষ হিসেবে। এই শুদ্ধ চেতনার তাড়নাতেই তিনি চেকোস্লোভাকিয়ায় দু’বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েও, নতুন চেক রিপাবলিকের প্রধান হয়েও, কোনও দিনই তৃপ্তি পাননি। তাঁর হয়তো বার বার মনে হয়েছে, তথাকথিত ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রেও শুদ্ধ গণতান্ত্রিক বোধ প্রায়ই আক্রান্ত হতে বাধ্য। যাঁরা একটু-আধটু আপস করে টিকে থাকেন, তাঁরাই হাস্যমুখে বলতে পারেন, যো জিতা ও হি সিকান্দর। তাই হাভেল গড়েন, আবার সব গড়াপেটা থেকে বেরিয়ে এসে হাঁপও ছাড়েন। সব পদ ছেড়ে দিয়ে বর্মা থেকে লাতিন আমেরিকায় মানবাধিকারের দাবিতে ঘুরে বেড়ান।
হাভেলের তিনটি একাঙ্ক— ‘অডিয়েন্স’, ‘প্রাইভেট ভিউ’ আর ‘প্রোটেস্ট’ আসলে কোথাও কোথাও নিজের সঙ্গে নিজের একান্ত কথোপকথন। অন্তত ‘প্রোটেস্ট’ নাটকের পাঠক অনুভব করবেন, নাটকের দুটি মাত্র চরিত্র (স্টানেক ও ভানেক) আসলে দুটি স্বতন্ত্র দ্বান্দ্বিক মানুষ নয়, দুজনে মিলেই এক জন হাভেল। গণতন্ত্রের জন্য লড়াইটা আসলে কোনও দিনই শেষ হওয়ার নয়, অন্তত যত দিন ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ নামক এক রহস্যময় অ্যানোম্যালি বেঁচে থাকবে।
জেলে বসে সুখদুঃখের বিশ্বস্ত সঙ্গিনী স্ত্রী ওলগাকে লেখা ‘লেটার্স টু ওলগা’র চিঠিগুলো (১৯৮৮-তে প্রকাশিত) পড়লে অনুভব করা যায়, জেলের বাইরে যাঁর এত জনপ্রিয়তা, জেলের মধ্যে তিনি ততটাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত! নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণায় জেলবন্দি ভাচলভ হাভেল ভাবছেন, স্বপ্নের স্বাধীনতা হয়তো এ বার অনিবার্য, কিন্তু সেই মুক্তিও তাঁর অর্জনকে কতটা শুদ্ধ রাখতে পারবে? ২০১১-র ১৮ ডিসেম্বর প্রয়াণের মুহূর্তেও হয়তো তাঁর প্রিয়তম স্যামুয়েল বেকেটের নাটকের কথাই মনে পড়ছিল! হয়তো মৃত্যুর অদূরে দাঁড়ানো হাভেল তখন নিরুচ্চার অনুভবে বলছিলেন, শুদ্ধ গণতন্ত্রের জন্য প্রতীক্ষাও তো আসলে ‘গোডো’র জন্যই এক অনন্ত প্রতীক্ষা!
sen_chandan@rediffmail.com