‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ ছবির দৃশ্য।
নেশাফিম বা নেশাস্কচ নয়— নেশাভাং। ‘নেশা’-র গায়ে গা ঠেকিয়ে বসার সুযোগ আর কারও জোটেনি। এই ভাং-এর নেশা যখন-তখনই করা যায়, তবে কে না জানে, সব নেশাই বেশি জমে হোলি-তে। অলিতে-গলিতে, টলোমলো পায়ে চলিতে, এ ঘোর কলিতে ওই দিন যেন নেশা করার ঢালাও লাইসেন্স। ভাংকে লোকমুখে কলকে দিয়েছে গাঁজার চিরসবুজ পাতাটি। অজিত বাঁড়ুজ্জে ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনিতে লিখছেন, ‘দধি গোলমরিচ শসার বীচি এবং আরও বহুবিধ বকাল সহযোগে প্রস্তুত উৎকৃষ্ট ভাঙের সরবৎ; এমন সরবৎ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ছাড়া আর কোথাও প্রস্তুত হয় না।’ মনে হয়, আমাদের দোলে ভাঙের এই আমদানি ভিনরাজ্যের হোলি থেকেই হয়েছে। নইলে এ বাংলায় ভাং বা সিদ্ধি ব্যোমকেশেরই প্রসাদ, কেষ্ট ঠাকুরের নয়।
ভাঙের ওভারডোজ হয়ে গেলেই বিপত্তি! দু’দলের কাছ থেকে তখন প্রশ্ন আসতে থাকে দু’রকম; আশাবাদীদের জিজ্ঞাসা— ‘কাজ হবে তো?’ আর, অতিআশাবাদীদের কৌতূহল— ‘নেশা হয়ে যাবে না তো?’ পিনু আমার কলেজবেলার বন্ধু। এলাকার দাদা, হাফ-ডন গোছের। এক বার দোলের দিন তুমুল দাদাগিরির পর স্নান করতে গিয়ে যখন ক্রমাগত রং উঠছে গা-মাথা থেকে, হঠাৎই তার মনে হয়, রং-টং নয়, এ হল নিখাদ রক্ত! আঁতকে ওঠে সে। তার পর সাবান ছেড়ে বাকি স্নানটি সারে ডেটল সহযোগে।
আমার বাবা নাকি এক বার দোলের পর দিন অফিসে গিয়ে কোনও কথা-টথা বলেননি, কেবল হেসে যাচ্ছিলেন। কখনও মুচকি, কখনও অট্টহাসি। বেয়ারা, সহকর্মী, মায় আগুনে বস’কেও রেয়াত করেননি।
কী বিচিত্র এক জাদু-গাছেরই না পেটেন্ট নিলেন শিব ঠাকুর! সিদ্ধি, গাঁজা, চরস, হাশিশে গোটা দুনিয়াকে ঘোল খাইয়ে ছাড়লেন! এই উদ্ভিজ্জ পরিবারটির ফ্যামিলি ট্রি বন্দিত হয়েছে উনিশ শতকে লেখা মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘চার্ ইয়ারে তীর্থযাত্রা’য়— ‘গাঁজার রাজার মতো এক পুত্র আছে।/ সর্ব্বদা ফেরেন তিনি বাবুদের পাছে।।/ চরস তাহার নাম অতি চমৎকার।/ যাহা খেলে রগ ধরে রূপ অন্ধকার।।/ গুলির ছেলের নাম জটাধারী সিদ্ধি।/ যাহারে খাইলে হয় হত বুদ্ধি বৃদ্ধি।।’
এহেন প্রসাদবৈচিত্রে ভরা পুণ্য তীর্থক্ষেত্রে পুনর্জন্মের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন নকল ডন বিজয়ও। ‘ভাঙ্গ কা রঙ্গ জমা হো চকাচক!’ পান করা ও পান খাওয়ার সেই গঙ্গাকিনারেওয়ালি দেশটি পবিত্র বারাণসী। শিবঠাকুরের আপন দেশে আজও সরকারি রেজিস্টার্ড দোকানে তিন রকমের ভাং মেলে। কাঁচা সিদ্ধি বেটে সবুজ কাঁচাগোল্লার মতো করে বিক্রি হয়, এগুলি টাটকা মেরে দেওয়াই দস্তুর। দ্বিতীয় রকমটি হল, ভাঙের মিঠাই বা ‘মাজুম’। স্থানীয়রা বলে, ভাঙের চকোলেট। আর হল ‘চুরন’— বিবিধ সুগন্ধি মশলা মেশানো শুকনো ও গুঁড়ো সিদ্ধি।
এই বাংলায় বিজয়া দশমীর দিন সিদ্ধির নেশাও খুব চালু। বাঙালির ভাং খাওয়ার সেরা আসর। ‘ভাং’ বা সংস্কৃত ‘ভঙ্গা’-র জন্ম যে ‘ভঙ্গ’ শব্দটি থেকে, তার এক অর্থ যে মত্ততাকারক, তা বোঝাই যায়। কিন্তু, আর এক অর্থে তাকেই বলা হয় বিজয়া। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ বিষয়টি সাঁটে খোলসা করেছে। তান্ত্রিকদের মতে, শ্রবণানক্ষত্রের উদয়ের সময় গাঁজাগাছে কচি পাতা বেরয়, যে হেতু ওই নক্ষত্রের উদয়কালই হল শ্রাবণ মাসের উদয়কাল এবং তন্ত্রমতে ওই পাতার রস সেবনে প্রতিকূল বাসনার বিজয় করা যায়, তাই ভাঙের শ্রেষ্ঠ নাম ‘বিজয়া’। তা ছাড়া এই বিজয়ার রসে দেহকে আস্বাদনসিক্ত করাই দুর্গাপুজোর অন্তিম পুণ্য কাজ। যাঁরা গৃহী ও যাঁরা সংসারের মায়া-মুক্ত, উভয়ের কাছেই এ কারণে দশমীর নাম ‘বিজয়া দশমী’।
কাজেই, দশমী পেরিয়ে বাঙালির ধুনকি যে বিজয়া একাদশী, বিজয়া দ্বাদশীতেও জিইয়ে থাকে। আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া একাদশীর দিন বিছানার উপর গুম হয়ে বসে। মুখ হাঁ, জিভ বেরিয়ে। মাঝে-মাঝে হাতে করে জিভটি টেনে ধরছেন। ঘণ্টাখানেক কাটার পরও সিন একই দেখে সবাই ঘিরে ধরে তাঁকে। শাড়ি, বেড কভার লালায় জবজবে। দুর্গাপুজো শেষ হতে না হতেই এ কি কালীপুজোর জ্যান্ত ঠাকুরের রিহার্সাল নাকি! প্রাথমিক জিজ্ঞাসা, অনুনয়-বিনয়ে যখন কাজ হল না, ধমক-ধামক দিয়ে হাত টেনে ধরতেই তাঁর তীব্র আর্তনাদ – ‘ঢুকে গেল, ঢুকে গেল!’ মাথায় জল ঢেলে, পিঠে ধাক্কা মেরে-মেরে কিছুটা স্বাভাবিক করা গেল অবশেষে। তার পর জানালেন, সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই তাঁর খালি মনে হচ্ছিল জিভটা পেটের ভেতর ঢুকে যাবে। কাজেই সেই রিস্ক আর নেননি, বাইরে বের করে টেনে ধরে রেখেছিলেন। বলা বাহুল্য, গোটাটাই বিজয়া দশমীর আফটার এফেক্ট।
আর এক মহিলার কীর্তি, এক বন্ধুর বউদি স্থানীয়া। গাঁয়ের বাড়িতে থাকেন। সেখানে লক্ষ্মীপুজো হয় খুব ঘটা করে। একাদশী থেকেই প্রস্তুতি শুরু। সে দিন একাদশীর বিকেল। শ্বশুরমশাই ফল খাবেন, তিনি গিয়েছেন ফল কাটতে। তাঁর ঘরেই রয়েছে সব ফলমূল। দোর এঁটে ফল কাটছেন তিনি। আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। সেই বউদির আর দেখা নেই। আমার বন্ধু গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী বউদি, কদ্দূর?’ উত্তর আসে, ‘এই যাচ্ছি, হয়ে এল বলে।’ আবার সময় যায়, বউদি আসেন না। ‘কী গো, কী করছ?’ জবাব আসে, ‘এই তো, ফল কাটছি, হয়ে এসেছে।’ কথা বলছেন, কিন্তু বেরোচ্ছেন না দোর খুলে। ঘণ্টা দু-আড়াই যখন কেটেছে, অনেক দরজা ধাক্কাধাক্কির পর খিল খোলেন বউদি। ফের বঁটির সামনে বসে পড়েন। দেখা যায়, সামনে ফলের তাগাড়, কুঁচি-কুঁচি করে কাটা শসা, শাঁকালুর পাহাড়। লক্ষ্মীপুজোর জন্য নিয়ে আসা চাষের যাবতীয় ফল কেটে শেষ। একটি-দুটি শসা অনাথ পড়ে রয়েছে। নড়া ধরে যখন বউদিকে তোলা হচ্ছে, তখনও প্রাণপণে সেই শসাগুলির দিকে হাত বাড়াচ্ছেন— ‘আর একটু বাকি আছে আমার, আর একটু বাকি আছে!’
এ গল্পটি শোনা এলাকারই সিনিয়র সোমনাথদার কাছে। সোমনাথদা গপ্পে-মানুষ। এক দিন সকালে সোমনাথদার সঙ্গে দেখা বন্ধু শংকরের। তিনি অফিস যাচ্ছেন। দেখা হতেই শংকরদা বলেন, ‘আর বলিস না ভাই, কাল আড্ডায় সবাই জোর করে সিদ্ধি খাইয়ে দিল, তার পর রাত্তিরে কী অবস্থা! সে দেখি, বিছানা ছেড়ে ভাসছি, তারপর ছাদে বুক ঠেকে যায়, শ্বাস নিতে পারি না! সকালে চান-টান করে একটু ফ্রেশ লাগছে। তবে, অফিস বেরতে পারলাম।’ দু-চারটে কথার পর সোমনাথদা বাড়ি ফিরে আসেন, শংকরদা অফিস যাওয়ার জন্য স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগান। ঘণ্টা দুয়েক পর ফের সেই একই জায়গায় সোমনাথদার সঙ্গে ফের শংকরদার দেখা। ‘কী রে শংকর, তখন অফিস যাচ্ছিস বললি যে!’ ‘হ্যাঁ, সে পরে বলব। এই এখন যাচ্ছি।’ সোমনাথদা অবাক হয়ে ফিরে আসেন। আরও ঘণ্টা দুয়েক পর, তখন প্রায় দুপুর দেড়টা হবে, ফের ওই একই জায়গায় সোমনাথদার সঙ্গে শংকরদার দেখা। সোমনাথদা এ বার চেপে ধরেন। ‘ব্যাপার কী বল তো?’ ‘এই তো অফিস যাচ্ছি।’ শংকরদা কিছুতেই আসল কথা খুলে বলতে চান না। অনেক চাপানউতোরের পর তিনি বলেন, ‘আরে কী বলব, সকাল থেকে বার বার স্টেশন যাচ্ছি, প্রতি বার দেখি লাইনটা প্ল্যাটফর্ম থেকে কত্তটা দূরে সরে গিয়েছে! ট্রেন এসে দাঁড়াচ্ছে প্ল্যাটফর্ম থেকে তিন-চার হাত ফাঁক রেখে। একে ভাঙের নেশা পুরোটা কাটেনি, তার ওপর ওই ভাবে লাফিয়ে ট্রেনে ওঠা যায়, বল! এখন আবার যাচ্ছি, দেখি এ বার যদি প্ল্যাটফর্মের একটু কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় ট্রেনটা...’
এ কাহিনি গাঁজাখুরি নয়, ভাং বিষয়ক। সোমনাথদার মুখে গোটাটা শোনার পর একটাই প্রশ্ন ছিল আমার, শংকরদা নয় ঘোরে ছিলেন, কিন্তু বার বার রাস্তার একই জায়গায় তাঁর সঙ্গে দেখা হচ্ছিল কী করে সোমনাথদার! ভাং-টা তা হলে কে খেয়েছিলেন?