Words of Election

ভোটের মরসুমে শব্দের রুটমার্চ

বিশেষ কিছু শব্দই যেন জমিয়ে দেয় ভোটের লড়াই। রাস্তার দেওয়াল থেকে সমাজমাধ্যমে, পোস্টার থেকে পোস্ট, সর্বত্রই শব্দের ফুলঝুরি।

Advertisement

বিধান রায়

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৩৫
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

ভোট প্রায় দোরগোড়ায়। দেওয়ালে দেওয়ালে রঙের মেলা। দলীয় চিহ্ন, কার্টুন, চার্ট, ছড়া থেকে স্লোগান, কী নেই! ছোট সভা থেকে জনসভা সর্বত্রই রাজনৈতিক শব্দের ফুলঝুরি। ‘ভোট মেশিনারি’ থেকে ‘বাইনারি’ যা-ই বলুন না কেন, বিশেষ কিছু শব্দ বাদ দিয়ে কোনও বারের ভোটপ্রচার জমে না। এ বার যেমন ‘সিএএ’ থেকে ‘সেটিং’, ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ থেকে ‘বঞ্চিত বাংলা’, ‘কাটমানি’ থেকে ‘ওয়াশিং মেশিন’, ‘ইডি-সিবিআই’ থেকে ‘দুর্নীতি’, এই শব্দগুলো দাপটের সঙ্গে অলিতে গলিতে রুটমার্চ করবে।

Advertisement

রাজনীতির কিছু শব্দ থাকে যা সমসময়ের রাজনীতিকে বুঝতে সাহায্য করে। ‘শহিদ’ রাজনৈতিক শব্দ, কিন্তু ‘গ্যাস খেয়ে শহিদ ক্ষুদিরাম’ ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে ‘ক্ষুদিরাম’ শব্দটার অর্থ হয়ে যায় ‘নির্বোধ আবেগ’। বিশ শতকের বিশ-তিরিশের দশক পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতিতে অন্যতম জনপ্রিয় শব্দ ছিল ‘গান্ধীজি’। কোনও সমস্যাকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করাকে আজকে ‘গান্ধীগিরি’ বলা হয়। ‘ক্ষুদিরাম’ শব্দের অপকর্ষ ঘটলেও ‘গান্ধী’ শব্দটির উৎকর্ষ অনেক ক্ষেত্রে বজায় আছে। ‘ঘেরাও’ শব্দটি ষাটের দশকের মধ্যপর্বে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এখনও অফিস, কল-কারখানা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির দাবিতে রাজপথে এই ‘ঘেরাও’ ‘ধর্না’ কর্মসূচি মাঝেমধ্যেই লেগে থাকে।

জওহরলালের মৃত্যুর পর কংগ্রেসের প্রবীণ অংশে ইন্দিরা গান্ধীর চালু নাম ছিল ‘গুঙ্গি গুড়িয়া’ অর্থাৎ ‘বোবা পুতুল’। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতৃত্বের বোঝাবুঝিটা ছিল এই রকম যে, ইন্দিরা কাঠপুতুলের মতো সিংহাসনে বসে থাকবেন আর পর্দার আড়ালে থেকে তাঁরা দেশ চালাবেন। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৯-এর ২১ জুলাই ১৪টি প্রধান ব্যাঙ্কের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ এবং রাজন্যভাতা বিলোপ করার অঙ্গীকার করেন। এর ফলে কংগ্রেস বিভাজিত হয়। এই সব পদক্ষেপের জন্য ইন্দিরা গান্ধী বামপন্থীদের কাছে ‘প্রগতিশীল’, নেহরুবাদের এক ‘র‌্যাডিক্যাল’ উত্তরসূরি হিসাবে বিবেচিত হন। অন্য দিকে কংগ্রেসেরই অভ্যন্তরে এই সব কাজের বিরোধীরা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হিসেবে চিহ্নিত হন। জরুরি অবস্থার সময় এই ইন্দিরা গান্ধী অনেকের কাছে ‘স্বৈরাচারী’। আবার একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্বে ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’।

Advertisement

রাজনৈতিক শিক্ষা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত, তাই ব্যক্তি আক্রমণ সামনে এসে যায়। ‘কানা অতুল্য’, ‘চিনের দালাল’, ‘রক্তচোষা হায়না’, ‘বাস্তুঘুঘু’, ‘কুমড়োপটাশ’ ‘হোঁদল কুতকুত’ ইত্যাদি।

‘তরমুজ’ একটি গ্রীষ্মকালীন ফল। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে এক সময় অনেকে মনে করতেন, কংগ্রেসে থেকে অনেক কংগ্রেসি বামেদের কাছে কিছু বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে বামেদের স্বার্থে কাজ করছেন, এঁরাই ‘তরমুজ’। বাইরে সবুজ, ভিতরে লাল। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট হলে ‘তরমুজ’ তত্ত্ব আরও জোরালো হয়। অনুরূপ ভাবে ‘কুমড়ো’ও তার রঙের গুণে বাংলার রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। বর্তমান শাসক দল তৃণমূল তার দলের অভ্যন্তরে অনেককে বিজেপির প্রতি অনুরক্ত ভেবে ‘কুমড়ো’ বলেছে। অর্থাৎ, বাইরে সবুজ, ভিতরে কমলা।

রাজনীতি ক্ষেত্রে ‘চাণক্য’ শব্দটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সরাসরি রাজশক্তিতে আসীন না হয়ে নেপথ্যে থেকে রাজশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করা বোঝাতেই ‘চাণক্য’ শব্দের ব্যবহার। কংগ্রেসের অতুল্য ঘোষ, সিপিএম-এর হরকিষেন সিংহ সুরজিৎ, অনিল বিশ্বাস, অনেক সময় প্রণব মুখোপাধ্যায়, তৃণমূলের মুকুল রায় প্রমুখকে এই শব্দে ভূষিত করা হয়েছে। একই ভাবে ‘সুযোগসন্ধানী’, ‘পাল্টিবাজ’ কিংবা ‘দলবদলু’ শব্দগুলিও বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির নামের আগে বসে যায়।

‘রিগিং’ শব্দটি সত্তরের দশকে রাজনীতিতে প্রবেশ করে। তার পর আসে ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’, তার অনেক পরে ‘বুথ জ্যাম’। ‘৭২-এর সন্ত্রাস’ শব্দটি আজও বামপন্থীরা কথায় কথায় ব্যবহার করেন। বাম-বিরোধীরা ‘সাঁইবাড়ি’, ‘মরিচ ঝাঁপি’, ‘আনন্দমার্গী হত্যাকাণ্ড’ ইত্যাদি শব্দ দিয়ে বামেদের আক্রমণ করেন।

সত্তর-আশির দশকে রাজনীতিতে ‘সমাজবিরোধী’ শব্দটির স্বাভাবিক অন্তর্ভুক্তি ঘটে যায়। বর্তমানে যেমন এই ধরনের একটি শব্দ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে— ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’। ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন’ শব্দটি সাম্প্রতিক কালের শব্দ। অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির কিছু শব্দ অনিবার্য ভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করে, যার সূত্রপাত আশির দশক থেকেই। ‘বোফর্স’, ‘শেয়ার’, ‘সঞ্চয়িতা’, ‘বেঙ্গল ল্যাম্প’, তারও পরবর্তী সময়ে ‘হাওলা,’ ‘কফিন’, সাম্প্রতিক সময়ে ‘সারদা’, ‘নারদা’, ‘নিয়োগ-দুর্নীতি’, ‘পাচার-দুর্নীতি’ ইত্যাদি কেলেঙ্কারির শব্দ রাজনীতিকে তোলপাড় করেছে।

‘ভোটার’ শব্দটাই ভোট-ময়দানের একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। ‘জীবিত ভোটার’, ‘মৃত ভোটার’, ‘ভূতুড়ে ভোটার’, ‘ডামি ভোটার’, তার সঙ্গে সঙ্গে ‘ভোটভিক্ষা’, ‘ভোটবৈতরণি’ ইত্যাদি শব্দ বিশেষ অর্থ-সহ ভোটের বাজারে হাজির হয়। ‘ব্যালট’ শব্দটাও উপেক্ষার নয়। ‘বুলেটে নয়, ব্যালটে জবাব’ কথাটাও বেশ জনপ্রিয়।

‘জোট’ আর ‘জোটনিরপেক্ষ’ শব্দগুলি রাজনীতিতে অপরিহার্য। পরাধীনতার কাল থেকেই এই বাংলা জোট শব্দটি শুনে আসছে। পরে ষাটের দশকে বাংলা কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের ‘জোট’, সত্তরের দশকে ইন্দিরা কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআই-এর জোট, ‘তৃতীয় বিকল্প’, ‘ইউপিএ’, ‘এনডিএ’ এ রকম সব ‘জোট’ গড়ে উঠতে ভাঙতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়েও এই শব্দটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। এখন ‘জোট’-এর সঙ্গে ‘জট’ শব্দটিও এসে যায়। স্বার্থে ঘা লাগলেই জোটে জট পড়ে। জোট ভেঙে যায়।

শব্দগুলি জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করে সংবাদমাধ্যম। ‘আমরা ওরা’, ‘এসইজ়েড’, ‘শিল্পতালুক’, ‘জ্ঞানভিত্তিক শিল্প’ ‘দোফসলি’, ‘তিন ফসলি’, ‘ক্ষতিপূরণ’, ‘অনুসারী শিল্প’, ‘চারশো একর’, ‘পাওয়ার গ্রিড’, ‘মাওবাদী’, ‘যৌথ-বাহিনী’, ‘কেন্দ্রীয় বাহিনী’, ‘সিবিআই তদন্ত’, ‘আরবান নকশাল’ ইত্যাদি শব্দ রাজনীতি-ক্ষেত্রে একটা সময় জনপ্রিয় হয়। এক সময় গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ছিল ‘ইচ্ছুক অনিচ্ছুক’, অর্থাৎ সিঙ্গুরে টাটার গাড়ির কারখানার জন্য জমি প্রদানে সম্মত ও অসম্মত কৃষক। এই নিয়ে তৎকালের বাম সরকার ও বিরোধী পক্ষে বিস্তর টানাপড়েন চলে। শেষ পর্যন্ত টাটার ‘ন্যানো’ কারখানার চিমনি ধোঁয়া ওড়ায়নি। কিন্তু ২০১১ সালের নির্বাচনে শব্দটা এ রাজ্যে সবুজ আবির উড়িয়েছিল।

অতি সাম্প্রতিক কালে কিছু শব্দ যেমন ‘পালাবদল’, ‘পরিবর্তন’, ‘পরিবর্তনের পরিবর্তন’, ‘ল্যান্ডব্যাঙ্ক’, ‘সিন্ডিকেট রাজ’, ‘কাটমানি’ ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’, ‘মিডিয়া সন্ত্রাস’, ‘ঘরছাড়া’, ‘বিজেমূল’, ‘পরিযায়ী শ্রমিক’, ‘লক-ডাউন’, ‘রেড ভলান্টিয়ার’, ‘পলিটিক্যাল উইশলিস্ট’ ইত্যাদি রাজনৈতিক আলোচনায় চলে আসছে। আসন্ন নির্বাচনেও এই শব্দগুলোর প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।

গলি থেকে রাজপথের দেওয়াল ছাড়াও আরও একটা ‘ওয়াল’ আছে। সমাজমাধ্যমের ওয়াল বা দেওয়াল। সেখানে পোস্টার নয়, পোস্ট করা হয়। সেখানকার বেশ কিছু শব্দ বর্তমানে রাজনৈতিক চর্চার বিষয়। ‘সেকু’, ‘মাকু’, ‘ভাম, ’‘চাড্ডি’, ‘চটি’ ইত্যাদি শব্দ যথাক্রমে তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ‘মার্ক্সবাদী’, ‘বাম’, ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’ ও এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের স্যান্ডেলকে উদ্দেশ্য করে প্রযুক্ত হচ্ছে। সন্দেহ নেই, সবগুলিই রাজনৈতিক অপশব্দ। রাজনীতি তার নিজস্ব ক্যানভাসে কখন যে কোন শব্দকে ‘সেটিং’ করে নেবে তা আগাম বলাও যায় না। আসলে ‘রাজনীতি’ শব্দটাই যে বড় বেশি রাজনৈতিক!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement