এ দেশের এগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটি তাঁরই তৈরি
Horticulture

কেরি সাহেবের বাগান

বাংলা ব্যাকরণ ও ছাপাখানা বিষয়ে এই ধর্মপ্রচারক বিখ্যাত। উইলিয়াম কেরি। কিন্তু এ দেশে নৈনিতাল আলু থেকে বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটোর বীজও যে তাঁর আমদানি, মানুষ ভুলে গিয়েছে।

Advertisement

সত্যরঞ্জন দাস

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২১ ০০:১৭
Share:

ছবি: কুনাল বর্মণ।

জাহাজে চেপে ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনশায়ার থেকে ভারতে আসছেন মাথায় পরচুলা পরা এক খ্রিস্টান মিশনারি। সালটা ১৭৯৩। আঠারো শতকে তাঁর দেশে ফ্যাশন হিসেবে পরচুলা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই মিশনারির খুব কম বয়সে মাথার চুল উঠে যাওয়ায় তিনি পরতে শুরু করেছিলেন পরচুলা, ফ্যাশন হিসেবে নয়। পরচুলায় ঢাকা ছিল তাঁর মাথাজোড়া টাক। হঠাৎ কী মনে হল, মাথার পরচুলা এক টানে খুলে ছুড়ে ফেলে দিলেন সমুদ্রের জলে। বোধ হয় ভেবেছিলেন ঈশ্বরের বাণী প্রচার করবেন যিনি, তাঁর মাথায় চুল থাকল কি থাকল না, তাতে কী এসে যায়! তবে এ দেশের মানুষের কাছে মিশনারি হিসেবে তিনি যত না খ্যাতি পেয়েছেন, অন্যান্য কীর্তির জন্য খ্যাতি পেয়েছেন অনেক বেশি। সে সব কীর্তির অদৃশ্য মুকুট শোভা পেয়েছে সেই মিশনারি উইলিয়াম কেরির পরচুলাহীন ফাঁকা মাথায়।

Advertisement

কেরি বিখ্যাত তাঁর লেখা বাংলা ব্যাকরণ আর তাঁর ছাপাখানার জন্য। সেখানে ব্যাকরণ বই-ই শুধু ছাপা হয়নি, ছাপা হয়েছিল বাংলায় প্রথম সংবাদপত্রও। সতীদাহ প্রথা, শিশুবলি বা কুষ্ঠরোগীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যার মতো নানা কুপ্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে উনিশ শতকের বাংলা থেকে অন্ধকার দূর করতে কেরির প্রয়াস স্মরণীয়। শিক্ষা প্রসারে বিদ্যালয় স্থাপন, নারীশিক্ষার সূচনায় এই মিশনারির অসামান্য অবদানের কথা কে না জানে? তবে কেরির কর্মকাণ্ডের একটি দিক অনেকের কাছে অনালোকিত, তা হল এ দেশের কৃষির উন্নতির জন্য তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং উদ্ভিদবিদ হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব। হাতে কলমে বাগান গড়ে তোলার কাজ ও চাষবাসের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ।

মিশনারি হয়ে ভারতে এলেও এ দেশের মানুষের দুর্দশা কেরিকে খুবই বিচলিত করেছিল। তিনি দেখেছিলেন, ভারতীয়রা মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে। বীজ, যন্ত্রপাতি সবেরই অবস্থা করুণ। ফলন খুব কম। দারিদ্রের অতলে তলিয়ে যাওয়া চাষিদের জন্য তিনি যে কতখানি চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন, তা বোঝা যায় ১৮১১ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত তাঁর একটি নিবন্ধ থেকে। তিনি বুঝেছিলেন, কৃষির উন্নতি হলে তবেই মানুষের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব। প্রথমে নীলকুঠির ম্যানেজার হিসেবে মালদা জেলার মদনাবতীতে থাকার সময় ও পরে শ্রীরামপুরে তাঁর নিজের দীর্ঘ চাষবাসের অভিজ্ঞতা থেকে মাটির কাছাকাছি থাকা এই মানুষটি পেয়েছিলেন উত্তরণের পথ।

Advertisement

১৮২০ সালে কলকাতায় তিনি স্থাপন করেন এগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটি। এই প্রতিষ্ঠা কৃষির উন্নতির লক্ষ্যে কেরির এক স্মরণীয় পদক্ষেপ। অতিমারির বছরে নিঃশব্দে পেরিয়ে গেল এই সংস্থার দুশো বছর। এই প্রতিষ্ঠানে আছে তাঁর একটি মর্মর মূর্তি। মূর্তিটি তাঁর মৃত্যুর এগারো বছর পর ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়। রানি ভিক্টোরিয়া, রোমান্টিক কবি সাদি-র মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন যে শিল্পী, এটিও তাঁরই তৈরি।

কেরির উদ্দেশ্য ছিল, ভাল জাতের নতুন শস্যবীজ এনে আধুনিক উন্নত পদ্ধতিতে চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া। সেই লক্ষ্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন বর্তমান আলিপুরের বিরাট জায়গা জুড়ে থাকা, ফুলে ফলে ঘেরা এই সংস্থাটি। কেরি মত প্রকাশ করেছিলেন, কৃষির উন্নতিতে সরকার, বিভিন্ন আধিকারিক এবং যাঁরা ইউরোপ থেকে এখানে এসেছেন, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ইউরোপীয়দের সঙ্গে দেশীয় মানুষদের যোগদানের ব্যাপারেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ভারতীয়দের বাদ দিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য সফল হতে পারত না।

তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পর্তুগিজদের হাত ধরে এ দেশে আসা আলুকে খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় করতে চেষ্টা করছিল। সোসাইটির উদ্যোগে বিদেশ থেকে উন্নত আলু বীজ এল। এখানকার মানুষের মধ্যে আলু চাষকে জনপ্রিয় করতে চাষিদের মধ্যে নানা প্রতিযোগিতা শুরু হল। সেরা চাষির জন্য নগদ পুরস্কার ও রুপোর মেডেলের ব্যবস্থা করা হল। আজকের নৈনিতাল আলু আসলে বিদেশ থেকে সোসাইটির হাত ধরে এ দেশে এসেছিল। সোসাইটি শসা, লাউ, বেগুনের মতো সবজির যাতে ভাল ফলন হয়, তার জন্য যেমন চেষ্টা করেছিল, তেমনই আমদানি করেছিল বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, বিন, গাজর, মটরশুঁটির মতো নানা আনাজপাতিও। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল উন্নত জাতের ধানও।

১৮২০ সালে ‘এগ্রিকালচারাল সোসাইটি অব ক্যালকাটা’ হিসেবে সংস্থার আত্মপ্রকাশ হলেও ১৮২৪ সালের পর ‘হর্টিকালচারাল’ কথাটি যোগ করা হয় এর নামের সঙ্গে। নানা ধরনের ফুল, বাগানের শোভা বাড়ানোর জন্য বহু বিচিত্র গাছগাছালিরও যত্ন কী ভাবে নিতে হয়, সে বিদ্যা শেখার একটা সুযোগ করে দেওয়াও ছিল এর উদ্দেশ্য। পরে সংস্থার নাম হয়ে যায় ‘এগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’।

অর্থকরী ফসল চাষের লক্ষ্যে কেরি সাহেব ভুট্টা, তুলো, চা, আখ, সিঙ্কোনা এ সবের ভাল মানের বীজ বা চারা নিয়ে আসেন বিভিন্ন দেশ থেকে। ধর্মপ্রচার, অনুবাদ, অধ্যাপনা, নিজের বাগানের দেখভাল-সহ নানা কাজে সদাব্যস্ত মানুষটির উন্নত মানের চাষবাসে উৎসাহ দিতে কখনও ক্লান্তি ছিল না। এক সময় বিদেশ থেকে পিচ, চেরির মতো ফল বা ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, বোগেনভিলিয়ার মতো ফুলের চাষ আমদানি করেছে তাঁর এই সোসাইটি।

কেরির এই সোসাইটির কাজে প্রথম থেকে গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস এবং তাঁর স্ত্রীর কাছে দারুণ উৎসাহ পেয়েছিলেন। হেস্টিংস এবং পরবর্তী গভর্নর জেনারেল বা ভাইসরয়রা মুখ্য পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এই সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণনের সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপতিদের পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছে এই সোসাইটি। এর অনুকরণে ১৮৩৮ সালে ইংল্যান্ডে গড়ে ওঠে ‘রয়্যাল এগ্রিকালচারাল সোসাইটি’।

১৮১১ সালে লেখা কেরির নিবন্ধে শুধু চাষবাসের কথা নয়, ছিল বনানী সংরক্ষণের কথাও। তিনি সোসাইটির বাগানে বিলুপ্তপ্রায় অনেক গাছ এনে লাগিয়েছিলেন। উদ্ভিদ সংরক্ষণের কাজ তিনি নিজের শ্রীরামপুরের বাগানে, শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে বরাবরই করে যাচ্ছিলেন।

আসলে শৈশব থেকেই দেখা গিয়েছিল কেরির গাছপালা, প্রাণিকুল নিয়ে অদম্য আগ্রহ। কাকা ছিলেন মালি, তাঁর কাছে বাগানে গাছপালার যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে ওস্তাদ হয়ে উঠেছিল ছোট্ট কেরি। পরে অসুস্থতার জন্য রোদে বেরনো যখন বন্ধ হল, তখন ঘরের ভেতরেই তৈরি করেছিলেন হরেক উদ্ভিদ আর প্রাণী নিয়ে ছোট্ট মিউজ়িয়াম।

আঠারো শতকের ইংল্যান্ডে অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার যে নেশা বহু দুঃসাহসী অভিযাত্রীকে ঘরছাড়া করেছিল, সেই নেশা কেরিকেও বোধহয় তাড়া করেছিল। নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে সে সব দেশের অদ্ভুত সব মানুষের কথা, উদ্ভিদ ও প্রাণিসম্পদের হাজারও নমুনা এসে পৌঁছেছিল ইংল্যান্ডে। ভারতে আসার প্রেরণা কেরি শুধুমাত্র মিশনারিদের কথা শুনেই পেয়েছিলেন তা নয়, তার খানিকটা পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন কুকের বিস্ময় জাগানো অভিযান থেকেও। ছোটবেলায় ধর্মগ্রন্থের চেয়ে অভিযান কাহিনির বই যে তাঁকে বেশি টানত! সে সময় পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল মুচির কাজও। কী এক মারাত্মক চর্মরোগ হওয়ায় স্কুল যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছিল। দারিদ্র তো ছিলই, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া দেখে বাবা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এক মুচির কাছে শিক্ষানবিশি করতে। স্কুল ছাড়তে হলেও পড়ার বহরটা নেহাত কম ছিল না। বিজ্ঞান ছিল কেরির আর এক পছন্দের বিষয়। তা ছাড়াও গ্রিক, ল্যাটিন, আরও নানা ভাষা চর্চাও করতেন। ভাষা শেখার সহজাত ক্ষমতা ছিল কেরির। ভারতে আসার সময় জাহাজে বাংলা শিখতে শুরু করেছিলেন সঙ্গীর সাহায্য নিয়ে। সেই সঙ্গী ভারতে আগে কয়েক বছর কাটিয়ে গিয়েছিলেন। ভাষাপ্রেমী কেরি ছ’টি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। এ ছাড়াও বাইবেলের কিছু কিছু অংশ আরও উনত্রিশটি আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ছাড়াও এক সময় সংস্কৃত ও মরাঠি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। এই তিনটি ছাড়া আরও কিছু ভাষার ব্যাকরণ বইও তিনি লিখেছিলেন। তবে ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে বাংলাই কেরিকে মুগ্ধ করেছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি নাকি মনে করতেন, যে সব ভাষায় ভারতীয়রা কথা বলে, তাদের মধ্যে বাংলাই সেরা। তিনি একটি বাংলা অভিধানও লিখে ফেলেছিলেন।

এ দেশে এসে প্রথম দিকটা চালচুলোহীন কেরির মোটেই ভাল কাটেনি। এখানে ওখানে কোনও মতে কিছু দিন কাটানোর পর শুনলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাগানে কাজের সুযোগ হতে পারে। কিন্তু সেখানে গেলেও কাজের সুরাহা হল না। কেরির দেখা হল উদ্ভিদবিদ উইলিয়াম রক্সবার্গের সঙ্গে, যিনি বাগানের সুপারিনটেনডেন্ট পদে সদ্য নিযুক্ত হয়েছেন। দু’জনের উদ্ভিদপ্রেম ছিল গভীর। রক্সবার্গের সঙ্গে সারা জীবনের সখ্য গড়ে উঠেছিল কেরির। ঋণ করে সুন্দরবনে কিছু দিন কাটানোর পর কেরি নীলকুঠির ম্যানেজারের চাকরি পেলেন। চলে যেতে হল মালদার প্রত্যন্ত এলাকায়। তবে এক বার রুজি-রোজগারের চিন্তা যেতেই দেখা গেল গাছগাছালির সঙ্গে তাঁর আত্মার আত্মীয়তা। ওখান থেকে ইংল্যান্ডে গসপেল প্রচারসমিতিকে লেখা প্রথম চিঠিতেই কোদাল, কাস্তের মতো সব যন্ত্রপাতি আর ফুল-ফলের নানা গাছের বীজ চেয়ে পাঠালেন এই উদ্যানপ্রেমী। নীলকুঠিতে থাকতে থাকতে আর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন বাংলার চাষিদের দুর্দশা। সে অভিজ্ঞতা থেকেই তো ১৮১১-তে লিখেছিলেন এখানকার কৃষির অবস্থা নিয়ে তাঁর নিবন্ধ। ১৭৯৯-এর অক্টোবরে ইংল্যান্ড থেকে শ্রীরামপুরে এসে পৌঁছলেন ব্যাপটিস্ট মিশনের চার জন মিশনারি। শ্রীরামপুরে তাঁদের সঙ্গে একযোগে ধর্মপ্রচার এবং বাইবেলের অনুবাদ ছেপে বিলি করার জন্য নীলকুঠি ছেড়ে চলে এলেন কেরি।

১৮০০ সালের জানুয়ারিতে শ্রীরামপুরে ঘাঁটি গাড়লেন কেরি। সেখানে নবাগত মিশনারিদের মধ্যে তাঁর সঙ্গী হন ওয়ার্ড আর মার্শম্যান। নিরলস পরিশ্রমের জোরে বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে জায়গা করে নেন এই ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’।

শ্রীরামপুর মিশন থেকে নানা ভারতীয় ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ প্রকাশিত হল। কেরি ধর্মপ্রচারের সঙ্গে অনুবাদ ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনার কাজ চালাতে লাগলেন। প্রতি সোমবার নদীপথে পৌছতেন কলকাতা, শুক্রবার ফিরতেন শ্রীরামপুরে। কলকাতায় থাকার সময় অনুবাদ বা ধর্মপ্রচারের কাজ থেমে থাকত না। আবার মিশনের মধ্যে নিজের বাড়ির কাছে কয়েক একর জমিতে বড়সড় বাগানও গড়ে তুললেন। তিনি গাছ লাগিয়েছিলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াসের বিজ্ঞানসম্মত বিন্যাসের পদ্ধতি অনুসরণ করে। চারশো সাতাশটির বেশি প্রজাতির উদ্ভিদ তাঁর এই বাগানে ছিল। ভারতের বিভিন্ন অংশ শুধু নয়, সারা বিশ্ব থেকে তিনি রকমারি উদ্ভিদের বীজ বা চারা আনিয়েছিলেন। ১৮২৩ সালে লন্ডনের লিনিয়ান সোসাইটির ফেলো হিসেবে স্বীকৃতি পান কেরি।

আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অভিযান আর আবিষ্কারের সেই সময়ে ক্যাপ্টেন কুক যখন তাঁর প্রথম অভিযানে যান, তাঁর দলে ছিলেন উদ্ভিদবিদ জোসেফ বাঙ্কস। কুকের অভিযাত্রী দলের নিয়ে আসা প্রায় তিরিশ হাজার উদ্ভিদের মধ্যে ইনি একাই চোদ্দোশো নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। বাঙ্কস যখন ইংল্যান্ডে রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি হলেন, বাঙ্কস-এর সেনানীরা তখন বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে খুঁজে আনতে শুরু করলেন উদ্ভিদকুলের নিত্যনতুন নমুনা। তিলোত্তমার মতো সেজে উঠেছিল লন্ডনের কিউ রয়্যাল বোটানিক গার্ডেন। কিন্তু কেরি বুঝেছিলেন, সমস্ত উদ্ভিদ প্রজাতির নমুনা লন্ডনে মজুত করা সম্ভব নয়। ভারতীয় গাছপালার ক্ষেত্রেও যেগুলো বাংলার জল-হাওয়ায় টিকে থাকতে পারবে না, সেগুলোর সংরক্ষণে উপযুক্ত জায়গা দিতে হবে ভারতের অন্যত্র। তাঁর ইচ্ছে পূরণ হয়, যখন সরকারি উদ্যোগে সাহারানপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেন গড়ে ওঠে।

দুঃখের বিষয়, যে বছর লিনিয়ান সোসাইটি কেরিকে স্বীকৃতি দিল, সেই বছরই ভয়ঙ্কর এক বন্যায় ভেসে গিয়েছিল তাঁর সাধের বাগান। বাড়িও গিয়েছিল ভেঙে। তাঁর তখন ধুমজ্বর। ক’দিন আগে ঊরুসন্ধির হাড় সরে গিয়েছিল নৌকো থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে। ক’দিন অসহ্য যন্ত্রণার পর জ্বর। সেই অবস্থায় ভাঙতে থাকা ঘর থেকে পাঁজাকোলা করে যখন তাঁকে বার করে আনা হল, তখন বাড়ির জন্য নয়, হা-হুতাশ করেছিলেন বাগানের জন্য। আস্তে আস্তে জ্বর ছেড়েছিল, কিন্তু মাটিতে পা ফেলতে পারতেন না। বাগান বলতে তখন শূন্যতার এক দৃশ্যপট। তবু সেখানেই যেতে চাইতেন। নিয়ে যেতে হত কাউকে না কাউকে। হার মানার পাত্র ছিলেন না কেরি। এর আগে ১৮১২ সালে যখন লেলিহান আগুনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল প্রেসে রাখা তাঁর অমূল্য সব অনুবাদ, অভিধান, ব্যাকরণের পাণ্ডুলিপি, তখনও নতুন করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অনেক কাজই দ্বিতীয় বার করে ফেলেছিলেন কিছু দিনের মধ্যেই। এ বার বীজ বা চারার জন্য অনুরোধের চিঠি পৌঁছে গেল নানা দেশে। কয়েক বছরের মধ্যে আবার সেজে উঠল বাগান।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বাগান ছিল তাঁর নয়নের মণি। মারা যাওয়ার আগে কিছু দিন শয্যাশায়ী ছিলেন কেরি। বন্ধু সহকর্মী মার্শম্যান আসতেন রোজ দেখা করতে। এক দিন উপস্থিত সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে কেরি বলে উঠলেন, “আমি যখন থাকব না, মার্শম্যান আমার বাগানে গরু ছেড়ে দেবে।”

মার্শম্যান হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “ছিঃ ছিঃ! এমন কথা আমার মনেও যেন না আসে কোনও দিন।”

তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, বাগানের যথাযথ দেখভাল হবে। ১৮৭৫ সালে অবশ্য পুরো জমিটিই বিক্রি হয়ে যায় ইন্ডিয়া জুট কোম্পানির কাছে। মার্শম্যান তার আটত্রিশ বছর আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে কুড়ি বছরের পরিশ্রমে রক্সবার্গ যে তিন হাজার দুশো প্রজাতির উদ্ভিদ সংগ্রহ করেন, তার একটি বড় অংশ কেরিই পাঠিয়েছিলেন। রক্সবার্গ কেরির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একটি উদ্ভিদ প্রজাতির নাম তাঁর নামে রাখেন ‘কেরিয়া’। রক্সবার্গ যখন অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে গেলেন, বোটানিক্যাল গার্ডেনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন কেরি। এ দেশের গাছপালার ওপর লেখা রক্সবার্গের অসমাপ্ত দু’টি বইও যত্ন নিয়ে প্রকাশ করেন। নিজের হাতে গড়া শ্রীরামপুর কলেজে কেরি ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি উদ্ভিদবিদ্যার ক্লাস নিতেন। আমেরিকা গিয়ে যখন তাঁর সহযোগী ওয়ার্ড এই কলেজের জন্য অর্থ সাহায্য সংগ্রহ করছিলেন, তখন এই কলেজে যাতে শুধু ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হয় এমনটা নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়েছিল। সে কথা জেনে অসন্তুষ্ট কেরি বলেছিলেন, “আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, আমি কখনও এমন নীচ মানসিকতার কথা শুনিনি।”

ঠিক যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে এক রকম লুটতরাজ চালাচ্ছে, সে সময় কেরি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে। কল্যাণব্রতের যে সুমহান নমুনাগুলি তিনি রেখে চলেছিলেন, সেগুলো অন্ধকারে ডুবে থাকা অনেক মানুষের কাছে ভরসার আলো হয়ে দেখা দিয়েছিল। স্কুল-কলেজ, হাসপাতালের মতো আলোকবিন্দুগুলি এক এক করে ফুটে উঠেছিল কেরির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। এখানকার উদ্ভিদ-সম্পদ অনুসন্ধান ও সংরক্ষণ করার লক্ষ্যেও তিনি ব্যয় করেছিলেন অগাধ সময় ও শ্রম। এ দেশের ভাষা, সাহিত্যকে যেমন আলোর বৃত্তে এনেছিলেন তিনি, তেমনই কৃষি ও উদ্যানচর্চায় তাঁর কর্মকাণ্ড ছিল এক আলোর দিশা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement