উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী।
একটা সময় বাংলার বুকে কালাজ্বর শব্দটির সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় উচ্চারিত হত ‘ইউরিয়া স্টিবামাইন’ অথবা ‘ব্রহ্মচারী’। এই ‘ব্রহ্মচারী’র পুরো নাম স্যর উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। গত ১৯ ডিসেম্বর পূর্ণ হয়েছে তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ। সারা পৃথিবীর কাছে তিনি স্মরণীয় মারণ-রোগ কালাজ্বরের নিরাময়ের আবিষ্কারের জন্য। এক শতক আগে এই ভয়ঙ্কর কালাজ্বর অকালে কেড়ে নিয়েছিল সুকুমার রায়কে। অথচ তাঁর মৃত্যুর আগেই, ১৯২০ সালে এ রোগের প্রতিষেধক উপেন্দ্রনাথ আবিষ্কার করে ফেলেছেন। চা-বাগানের বস্তির অজস্র কুলির শরীরে ওষুধ প্রয়োগ করে তাদের সুস্থ করেছেন। আসলে কোনও ওষুধের প্রথম প্রয়োগ সমাজের নিচুতলার মানুষদের উপরই হয়। তাই পরাধীন দেশের চিকিৎসক-বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কৃত ওষুধটি কেউই পরখ না করে ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন জার্মানির ওষুধ ‘নিওস্টিবোসান’। অথচ সুকুমার রায়ের মৃত্যুর মাত্র দশ দিন পরে, বিখ্যাত ডাক্তার নীলরতন সরকার ক্যালকাটা মেডিক্যাল ক্লাবে উপেন্দ্রনাথের এই আবিষ্কারের বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন।
জন্ম ১৮৭৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর, বিহারের মুঙ্গেরের জামালপুরে। বাবা নীলমণি ব্রহ্মচারী ছিলেন চিকিৎসক। উপেন্দ্রনাথ শৈশব থেকেই মেধাবী। বিজ্ঞান ও সাহিত্যে ছিল সমান দখল, সঙ্গে প্রখর স্মৃতিশক্তি। জামালপুর বয়েজ় স্কুলের পড়াশোনা শেষে হুগলি মহসীন কলেজে এক সঙ্গে অঙ্ক আর কেমিস্ট্রি নিয়ে অনার্স পড়ে স্নাতক হলেন ১৮৯৩ সালে। বাবার ইচ্ছে ছেলে ডাক্তার হোক, ছেলের প্রাণের বিষয় কেমিস্ট্রি। সমঝোতা করতে কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি ও প্রেসিডেন্সি কলেজে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়া চলতে লাগল। ১৮৯৪ সালে কেমিস্ট্রিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এম এসসি পাশ করলেন। ১৮৯৯ সালে পাশ করলেন চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রাথমিক পর্বের পরীক্ষা। যোগ দিলেন প্রভিনশিয়াল মেডিক্যাল সার্ভিসে। পরের বছর পাশ করলেন এম বি। মেডিসিন ও সার্জারিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে অর্জন করলেন গুডিভ পদক ও ম্যাক্লিয়ড পদক। ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলে শিক্ষকতা করতে করতেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম ডি ও শারীরবিদ্যায় পিএইচ ডি করলেন।
একই সময়ে গবেষণা শুরু করেছেন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলের (আজকের নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ) সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যর নিল ক্যাম্পবেল-এর সঙ্গে। ম্যালেরিয়া আর কোয়ার্টন ফিভার নিয়ে গবেষণা করে দেখালেন, প্রাচীন বর্ধমান ফিভার আসলে ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরের মিশ্রিত ব্যাধি।
১৯০৫ থেকে ১৯২৩, দীর্ঘ আঠারো বছর ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে শিক্ষক ও চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন, অবসর সময় কাটিয়েছেন গবেষণায়। ১৯০৫ সালে কলকাতায় বদলি হয়ে এসেও তিনি মগ্ন থেকেছেন নিরক্ষীয় উষ্ণ দেশগুলির মহামারি সৃষ্টিকারী অসুখের প্রাদুর্ভাব নিয়ে। কালাজ্বর তখন বাংলা, অসম, বিহার, ওড়িশা, মাদ্রাজের অন্যতম ব্যাধি। রোগের লক্ষণ ছিল অনেকটা ম্যালেরিয়ার মতো: জ্বর, দুর্বলতা, শরীরের ওজন কমে যাওয়া, যকৃত আর প্লীহার বাড়বৃদ্ধি আর চামড়ার রং কালো হয়ে যাওয়া। আক্রান্ত রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় থাকতই না।
১৯০৩ সালে এই রোগের কারণ হিসেবে আবিষ্কৃত হয় পরজীবী এককোষী ‘লিশম্যানিয়া ডোনোভ্যানি’। দীর্ঘ দেড় দশক পরিশ্রমের পর উপেন্দ্রনাথ ১৯২১ সালের শুরুতেই আবিষ্কার করলেন এক বিশেষ রাসায়নিক, যার নাম দেওয়া হয় ‘ইউরিয়া স্টিবামাইন’। ১৯২৪ সালে জানা গিয়েছিল এই রোগের জন্য দায়ী পরজীবীটির বাহক স্যান্ড ফ্লাই। ম্যালেরিয়ায় রক্তের লোহিত কণিকারা আক্রান্ত হয়, আর এরা আক্রমণ করে যকৃত, প্লীহা, অস্থিমজ্জা আর রোগ-প্রতিরোধকারী কোষদের। পরাধীন দেশের নাগরিক উপেন্দ্রনাথ ইন্ডিয়ান রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বদান্যতায় সামান্য আর্থিক অনুদান পেলেন। লোকবল বলতে সদ্য এম এসসি পাশ করা তিন ছাত্র আর দু’জন কম্পাউন্ডার। অনেক পরীক্ষার পর তৈরি করলেন নতুন যৌগ ইউরিয়া স্টিবামাইন। ১৯২২ সালে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চ-এ প্রকাশিত হল তথ্য, ওষুধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এর সাহেব কর্তাব্যক্তিরা কালা-আদমির গবেষণাকে ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও, উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কৃত ওষুধের ব্যবহার শুরু হল চিন, গ্রিস, ফ্রান্স, ইটালিতে। কালাজ্বর ছাড়াও ম্যালেরিয়া, ডায়াবেটিস নিয়েও তাঁর গবেষণা ছিল। কালাজ্বর বিষয়ে লিখেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ বই, ‘আ ট্রিটিস অন কালাজ্বর’।
১৯২৭ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগেই কলকাতায় কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে বাড়ির এক অংশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট’। আবিষ্কৃত ওষুধের ফর্মুলা পারিবারিক গণ্ডির বাইরে প্রকাশ করেননি। ওষুধটি বাজারে ছাড়তেন বাথগেট কোম্পানির মাধ্যমে। পেটেন্ট না নিলেও বাজারি সংস্থাগুলো একই নামে ওষুধ বিক্রি শুরু করলে মামলা করেছেন। বিভিন্ন হাসপাতালে ওষুধ দান করে তার পূর্ণ হিসাব রেডক্রস সোসাইটির মাধ্যমে বাংলার গভর্নরের কাছে পাঠিয়েছেন। ওষুধের ব্যবসায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও দানধ্যানে ছিলেন অকৃপণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস, ফিজ়িয়োলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা ব্লাড ব্যাঙ্কে নিয়মিত অনুদান পাঠাতেন। বিজ্ঞান-পত্রিকা ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ তাঁরই দানে প্রকাশিত হত।
এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য এক বার নোবেল কমিটির কাছে সুপারিশ গেলেও নোবেল-প্রাইজ় পাওয়া হয়নি উপেন্দ্রনাথের। তা না পেলেও পরাধীন ভারতের এই বিজ্ঞানী সারা জীবন আর্থিক উপার্জন, সম্মান, পুরস্কার, প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন অনেক। ফেলো হয়েছেন একাধিক সংস্থার, সে তালিকায় রয়েছে রয়্যাল কলেজ অব মেডিসিন (লন্ডন), রয়্যাল কলেজ অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন (লন্ডন)।
১৯৩৫ সালে ভারতের ভাইসরয় উপেন্দ্রনাথকে নাইটহুড প্রদান করেন। ১৯৩৬ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ২৩তম অধিবেশনে, ফিজ়িয়োলজি ও মেডিসিন বিভাগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। ভাষণের নির্যাসে ছিল দীর্ঘজীবনে, জাতি গঠনে সুস্বাস্থ্য, পুষ্টি, আহার্যের প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু কালাজ্বর বা ইউরিয়া স্টিবামাইনের প্রসঙ্গ এক বারও তোলেননি।
বই কেনা ছিল উপেন্দ্রনাথের নেশা, ভালবাসতেন নানা ফ্যাশনের গাড়ি। নিজের বাড়িতে বিশাল লাইব্রেরি করেছিলেন। লাউডন স্ট্রিটের বাড়িতে নানা জাতের ফার্ন, অর্কিড, ক্যাকটাসের বাগান করেছিলেন। ডায়াবেটিসে ভুগেছিলেন জীবনের শেষ ষোলো বছর। ১৯৪৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি উপেন্দ্রনাথের প্রয়াণ ঘটে।