Nababarsha

বাঙালির হালখাতায় হারানো-প্রাপ্তি

বাঙালিয়ানা মানে কি এখন শুধুই নস্টালজিয়া? আর কিছু নেই? বাঙালি সংস্কৃতি বিক্রি হয় এই বচ্ছরকার দিনগুলোয়? কারা বিক্রি করে? কারাই বা কেনে?

Advertisement

প্রচেত গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:০৬
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।

Advertisement

বাড়ির নাম ‘‌চক্রবর্তী নিবাস’‌। কলকাতা থেকে ঘণ্টা দেড়েক দূরে, গঙ্গার ধারে, অনেকটা জমি জুড়ে জমিদারি ঢঙের বাড়ি। উচ্চতা কম, দু’‌পাশে ছড়ানো। সামনে সবুজ লন। পিছনে পাখি-ডাকা গাছপালা।

এখন‌ সকাল সাতটা দশ। ছিয়াত্তর বছরের পতিতপাবন চক্রবর্তী বাড়ির দোতলার বারান্দায়। ইজ়িচেয়ারে আধশোয়া।‌ ইজ়িচেয়ার তাঁর প্রপিতামহের। সেগুন কাঠের গায়ে বেতের বুনট, চওড়া হাতল। সাদা-কালো পাথর-পাতা লম্বা বারান্দায় মানানসই। জাফরির নকশা দিয়ে সকালের রোদ তেরচা হয়ে পড়ায় বারান্দার সৌন্দর্য বেড়েছে। ইজ়িচেয়ারের হাতলে কাপ-ডিশ রেখে চা খাচ্ছেন পতিতপাবন। পাশে একটা খোলা বই উল্টে রাখা।

Advertisement

শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা নির্বিশেষে সকালের চা বারান্দায় বসে খাওয়ার অভ্যাস করিয়েছিলেন স্ত্রী। সাত বছর হল তিনি দুই পুত্র, এক কন্যা, তিন নাতি নাতনি এবং স্বামীকে রেখে মারা গিয়েছেন। বলতেন, দিনের প্রথম চা বাঙালি খাবে আলো-বাতাসে বসে। বাগান, লন বা বারান্দায়। সকালের নির্মল আকাশ দেখতে দেখতে। স্ত্রী নেই, কিন্তু পতিতপাবন আজও সকালের চা নিয়ে বারান্দাতেই বসেন। আজও বসেছেন এবং অপেক্ষা করছেন।

দুই পুত্র অমিত, সুমিত এবং কন্যা দীধিতী খানিক পরে এখানে আসবে। অমিত ইনদওরে ব্যবসা করে, সুমিত মুম্বইয়ে কলেজে পড়ায়, কন্যা দীধিতী বিয়ের পর থাকে দিল্লিতে। আই টি সেক্টরে বড় পদে চাকুরে। বাবার জরুরি ডাকে তারা দু’‌দিনের জন্য এসেছে। নাতি-নাতনিরা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্কুল-কলেজে পড়ছে। বড় নাতি দেবাদিত্য বাবার সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছে।

তিন ছেলেমেয়ের সঙ্গে পতিতপাবন আজ জরুরি কথা বলবেন। ঠিক বলবেন না, শুনবেন। কাল ব্রেকফাস্টের টেবিলে তাদের কাছে একটি প্রস্তাব তিনি রেখেছেন। আজ সকালে তারা সিদ্ধান্ত জানাবে। পতিতপাবন জানেন, ছেলেমেয়েরা তাঁর প্রস্তাব আনন্দের সঙ্গে মেনে নেবে। সেটাই স্বাভাবিক। গত তিন-চার দশক ধরে, কলকাতা এবং আশপাশের বাঙালি পরিবারের জন্য এটি সর্বশ্রেষ্ঠ লোভনীয় প্রস্তাব, অবধারিতও বটে। এই প্রস্তাব শুনলে সবাই একটার বদলে দুটো হাত তোলে।

এক মাস আগে বিষয়টি পতিতপাবনবাবুর মাথায় আসে। সে দিন সকালে খবরের কাগজের একটি সংবাদ তাঁকে চমকে দেয়, চোখও খুলে দেয়। খবরটি অপরাধের। সেটি পড়ে সারা সকাল চিন্তামগ্ন ছিলেন পতিতপাবন। বেলা বাড়লে বুঝতে পারেন, তিনি ভুল করেছেন। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাঙালি যে পথে ‘‌করিছে গমন’‌ সেই পথে তিনি হাঁটেননি। হাঁটা উচিত ছিল। স্ত্রী জীবিত থাকা পর্যন্ত তা-ও একটা যুক্তি থাকে। কিন্ত স্ত্রীবিয়োগের সাত বছর পরও হাত গুটিয়ে বসে থাকাটা ‘‌অপরাধ’ ছাড়া আর কী?‌‌ ছেলেমেয়েরা নিশ্চয় ভিতরে ভিতরে অধৈর্য, অস্থির, বিরক্ত। মুখ ফুটে বলতে পারছে না, এই যা। এর পর ধৈর্য হারিয়ে তারা যদি কোনও ‘‌অপরাধ’‌ করে বসে?‌ তার চেয়ে নিজে উদ্যোগ নেওয়াই ভাল নয় কি? তাই তাদের ডেকে পাঠানো।‌‌

অমিত, সুমিত, দীধিতী এসে চেয়ার, মোড়া টেনে বাবাকে ঘিরে বসল।

পতিতপাবন বললেন, “‌‌তোমরা আমার প্রস্তাবে নিশ্চয়ই রাজি।‌”‌

অমিত বলল, “‌না বাবা, আমি রাজি নই।”

সুমিত বলল, “‌আমিও নই।”

দীধিতী বলল, “‌আমারও মন চাইছে না বাবা।”

পতিতপাবন এতটাই অবাক হলেন যে, ইজ়িচেয়ারে পিঠ সোজা করে উঠে বসলেন।

এরা বলছে কী!‌

“সে কী! কেন? আমার প্রস্তাবে রাজি হলে কত টাকা তোমরা তিন জনে পাবে ভাবতে পারছ?”‌

অমিত বলল, “‌বাবা, আমরা সব হিসাব করেছি। তবু এই বাড়ি আমরা বিক্রি করব না, ঠিক করেছি।”

পতিতপাবন বললেন, “‌এত বড় বাড়ি রেখে কী করবে?‌ এই পুরনো বাড়ি ভেঙে প্রোমোটার ফ্ল্যাটবাড়ি তুলবে। টাকাও পাবে, আবার ফ্ল্যাটও পাবে। সেই ফ্ল্যাটে মাঝেমধ্যে এসে থাকবে। গঙ্গার হাওয়া খাবে। বড় প্রোমোটার কাজ করতে চাইছে। অনেক টাকা ইনভেস্ট করবে। কমপ্লেক্সের নামও ঠিক করে ফেলেছে। ‘সোনার তরী’। তোমরা যদি আমার মরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো, তা হলে এত ভাল অফার আর না-ও আসতে পারে।”

অমিত বলল‌‌, “তুমি থাকো না থাকো, বাড়ি আমরা বেচতে চাই না। এটা আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য। আমরা ভাগ্যবান যে, উত্তরাধিকার সূত্রে গর্ব করার মতো একটা সম্পত্তি পেয়েছি।”‌

সুমিত বলল, “‌এমন পোক্ত ইট-পাথরের বড় বড় ঘর, খিলান দেওয়া দরজা, কাঠের পাল্লার জানলা, কড়ি-বরগা, রঙিন কাচ‌.‌.‌.‌”‌

দীধিতী বলল, “পাথর-বসানো বারান্দা, তিন ধাপের ছাদ ভেঙে ফেলতে দেওয়া যায় না।”

অমিত বলল, “‌এক তলায় অত বড় বসবার ঘর, দেওয়ালে টাঙানো যামিনী রায়, অবনীন্দ্রনাথের পেন্টিংস ছেড়ে দেব?‌ ইমপসিবল।”‌

দীধিতী বলল, “আর একশো বছর আগের পাল্লা-টানা আলমারির বইগুলো?”‌

বড় ছেলে নিচু গলায় বলল, “বাবা, এ বাড়ির সঙ্গে আমাদের অনেক স্মৃতি। ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, মাকে জড়িয়ে কত গল্প! বিয়ে, অন্নপ্রাশন, দুর্গাপুজোয় শাড়ি, ধুতি.‌.‌.‌ ভিয়েনের পেল্লায় কড়াইয়ে ঠাকুর-বামুনের বানানো পান্তুয়া, রসগোল্লা.‌.‌.‌”‌

পতিতপাবন খানিক ক্ষণ চুপ করে থাকলেন। বললেন, “তোমরা এ সব রক্ষা করবে কী করে?‌”‌

অমিত বলল, “কেন? যে ভাবে এখন করছি। তোমার ছেলেমেয়েরা কেউ বেকার নয়।”

পতিতপাবন চিন্তিত গলায় বললেন, “‌আমার নাতি-নাতনিরা কী বলছে?‌ তারাও তো বড় হচ্ছে।”

দীধিতী বলল, “আমরা কথা বলেছি। তারাও এই বাড়ি রেখে দেওয়ার পক্ষে।‌ তোমার নাতনি শুনে তো শিকাগো থেকে হোয়াটসঅ্যাপ কলে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। বলছে, দেশে ফিরলে থাকবে কোথায়!”‌

অমিত হেসে বলল, “তোমার নাতিও মজার কথা বলেছে। বলল, একমাত্র এই বাড়িতে এসে প্রাণ খুলে বাংলায় বকবক করি।”

দীধিতীও হাসল। বলল, “‌তোর ছেলে ঠিক বলেছে দাদা।‌ প্রবাসে বাংলা বলার জন্য শরীর আইঢাই করে। এখানে এলে ক’টা দিন বাঁচি।”

সুমিত হেসে বলল, “শুধু প্রাণ ভরে বাংলা বলি?‌ পেট পুরে যে বাঙালি খাবার খাই?‌ সেটা বলবি না?‌‌”

দীধিতী বলল, “‌‌আর ড্রেসের কথা? সেটা বাদ যায় কেন?‌‌ তোর জামাইবাবু তো বলে, তোমাদের বাড়ি গেলে কোঁচানো ধুতিগুলো বাঁচে, নইলে এত দিনে সব পোকায় কেটে দিত। আমি তো বাপু এখানে এসে শাড়ি পরে হাঁপ ছাড়ি।”

অমিত বলল, “‌এ বাড়ি কাউকে দেব না বাবা, আমরাই থাকব। এটা আমাদের আইডেন্টিটি ‌সেন্টার। হাতছাড়া করা যাবে না।”

পতিতপাবন অস্ফুটে বললেন, “‌অফার কিন্তু কয়েক কোটির... গঙ্গার ধারে এতটা জমি.‌.‌.‌”

অমিত বলল, “হোকগে। এ বাড়ি টাকার বাড়ি নয় বাবা, পয়লা বৈশাখ, দুর্গাপুজোর বাড়ি।”

সুমিত বলল, “‌নারকোল নাড়ু, মালপোয়া, পাটিসাপটার বাড়ি।”‌

দীধিতী বলল, “তোদের জামাইবাবু যতই কোঁচানো ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবির বাড়ি বলুক, ‌আমার বাপু এই বাড়ি তাঁতের শাড়ির বাড়ি।”

ছেলেমেয়েরা চলে যাওয়ার পর থম মেরে বসে রইলেন পতিতপাবন চক্রবর্তী। তিনি জানতেন, ছেলেমেয়েরা খুশিমনেই মিটিং শেষ করবে। সেই হাসি হবে ‌টাকা প্রাপ্তির‌। কিন্তু এখন যে হাসি‌ তিনি দেখলেন তা অন্য। তবে?‌‌ খবরের কাগজে যে অপরাধের সংবাদ পড়ে তিনি চিন্তিত হয়েছিলেন, তা কি সবার জন্য নয়? সংবাদটি ছিল এ রকম—

‘‌কলকাতার উপকণ্ঠে বসতবাড়ি লিখে না দেওয়ার জন্য ছেলের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে বৃদ্ধ বাবা হাসপাতালে। পুলিশ জানিয়েছে, ছেলে শিক্ষিত, বড় চাকুরে। বাবা সংস্কৃতি ও গানবাজনার চর্চা করেন। এক প্রোমোটারের কাছে বসতবাড়িটি বিক্রি করার জন্য বাবাকে অনেক দিন ধরে ছেলে চাপ দিচ্ছিল। বাবা রাজি না হওয়ায় এই গোলমাল। হাসপাতাল সূত্রের খবর, বৃদ্ধের দু’টি হাড় ভেঙেছে।’‌

পতিতপাবন ইজ়িচেয়ারে ফের হেলান দিলেন। ভুরু কোঁচকানোই রইল। তিনি ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের ভালবাসেন। পরিবারকে ভালবাসার সঙ্গে, বাংলার অনেক কিছু যে তাদের অতি পছন্দের, শুনে ভাল লাগছে। তবু তাঁর ভুরুতে ভাঁজ কেন?‌ ‌

দেড় বছর পরের কথা। পতিতপাবন চক্রবর্তী আর নেই। ‘‌চক্রবর্তী নিবাস’‌ এখন রিসর্ট। নাম ‘‌‌গঙ্গা কী নাও। আ বেঙ্গলি হেরিটেজ ডেস্টিনেশন।’ সুইমিং পুল এবং বার নিয়ে এখানে পাঁচ‌তারা সুবিধা পান পর্যটকরা। রেস্তরাঁয় ভাত, মুগডাল, পোস্ত, বেগুনভাজা, আলুভাজা, সঙ্গে এগারো রকমের শাক, তেরো রকমের বড়া, সতেরো রকমের মাছ। বারান্দার ইন্টিরিয়র হয়েছে ধুতি পাঞ্জাবি, তাঁত, ধনেখালির শাড়ি দিয়ে।

পতিতপাবনের ছেলেমেয়েরা কথা রেখেছে। বাড়ি থেকে তারা বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু বাড়ি হাতছাড়া করেনি। রিসর্টের ব্যবসা তাদের তিন জনের। ‘‌চক্রবর্তী নিবাস’‌ এর জামাই, অর্থাৎ দীধিতীর বর সরাসরি দেখাশোনা করছে।

‘‌চক্রবর্তী নিবাস’‌-এর এই ঘটনা বাঙালির পক্ষে ভাল না মন্দ, সে তর্ক পরে হবে, এটি বাঙালি-‌উদ্যোগের একটি দৃষ্টান্ত। বাঙালি নতুন ব্যবসায় নেমেছে—‘‌বাঙালিয়ানা’‌‌র ব্যবসা।‌ অলিগলিতে এখন পোস্তর বড়া, ভেটকি পাতুরির রেস্তরাঁ, শাড়ি-ধুতির বুটিক, তিন তারা চায়ের ঠেক। ‘‌ভুলি ভেদাভেদ জ্ঞান’, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কাস্টমার ভিড় করে ‘বাঙালিয়ানা’‌র স্বাদ নিচ্ছে, ‘‌আহা উহু’‌ করছে আর বলছে, ‘‌বঙ্গালি অ্যায়সা থা!‌’‌ হয়তো কিছু দিন পরে কলকাতায় কিছু ‘‌দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা কেন্দ্র’ও‌ তৈরি হবে। এই সব কেন্দ্রে ভাত, মাছের ঝোল, টক দই খেয়ে খানিক ক্ষণ ঘুমোনোর সুবিধে থাকবে। বাঙালির অলস ঘুম। সঙ্গে ফুড়ুত ফুড়ুত‌ নাক ডাকা। ইচ্ছে করলেই এই ঘুমের অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে। খরচ একটু বেশির দিকে। কারণ ‘‌ঘুমন্ত বাঙালি’‌র আয়েসের স্বাদ পেতে গেলে খরচ তো একটু হবেই। ‌

একান্নবর্তী বাঙালি

বাঙালি একা বাঁচতে শিখেছে। একটা সময় ছিল, বাঙালি বাড়িতে এক বেলায় উনিশ, কুড়ি বা বাইশটা করে পাত পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। রান্নার ঠাকুর, পার্টটাইম বা ফুলটাইম কাজের লোক, গাড়ির চালক, দারোয়ান, হুট করে এসে পড়া কোনও আত্মীয়, এক-আধ জন প্রতিবেশীও বিনা নেমন্তন্নেই আসন টেনে বসে যেত। কেউ কিছু মনে করত না। বাবা, কাকা, ফুলকাকা, ন’‌কাকা, বড়জেঠু, মেজজেঠু, ফুলপিসি, সোনাপিসি, বড়দা, মেজদা, রাঙাদা, ছোড়দিতে গিজগিজ করত বাড়ি। ছোটদের মধ্যে খুড়তুতো, জেঠতুতো, পিসতুতো, ফুলতুতোয় ভাগাভাগি ছিল না। এক থলিতে বাজার, এক হাঁড়িতে রান্না, এক ছাদের নীচে ঘুম। আপদে-বিপদে কাউকে না কাউকে পাশে পাওয়া যাবেই যাবে।

এক সময়ে বাঙালির অহঙ্কার ছিল এই যৌথ পরিবার। ভাঙতে ভাঙতে সেই যৌথ পরিবার এখন ধ্বংসস্তূপ। ধ্বংসস্তূপে আগাছা, সাপখোপ। বাঙালি গুঁড়ি মেরে ফ্ল্যাটে ঢুকেছে। সেখানে শুধু স্বামী-‌স্ত্রী, দু’টি বা একটি সন্তান। ‘‌অতিরিক্ত’‌ হিসেবে তাদের বৃদ্ধ বাবা বা মা থাকলেও থাকতে পারেন, তবে তিনি ভাসমান। তিন মাসের মেয়াদে ভাগাভাগি করে ছেলেমেয়েদের বাড়ি ঘুরে অস্থায়ী সংসার পাতেন। গত কয়েক দশকের কিছু বেশি সময় ধরে যৌথ পরিবারের এই ধ্বংসস্তূপের ইটেও ফাটল ধরেছে।

ছেলেমেয়েরা ফ্ল্যাট খালি করে পাড়ি দিয়েছে বিদেশে। উচ্চশিক্ষা, চাকরি বা বৈবাহিক কারণে গৃহত্যাগ। আগে মধ্যবিত্ত বাঙালি পাড়ায় দু’-একটি পরিবারে সাগরপাড়ির ঘটনা দেখা যেত। এখন প্রায় সব পরিবারেই তাই। ফলে ঘুলঘুলিসম ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রী কবুতর দম্পতির মতো ‘দোকা’‌। এদের এক জন ‘‌টা টা’‌ করলে ব্যস, রইল পড়ে ‘‌এক’‌। দূর দেশ থেকে ছেলেমেয়ে আসবে, শেষ দেখা হবে, তাই বরফঘরের ট্রাঙ্কে শুয়ে অপেক্ষা। যে রইল, তার একা দিবস, একা রাত্রি। এক সময় যে বাঙালি ছাব্বিশ জনের সঙ্গে জমিয়ে বসে ডাঁটা-চচ্চড়ি চিবোত, এখন একা বসে টেবিলের কোণে। ডোরবেল টিপে হোম ডেলিভারি থেকে ভাত দিয়ে যায়।

এই অবধারিত ‘‌একা ‌জীবন’‌ বাঙালি মেনে নিয়েছে খুশি, যুক্তি এবং বাধ্যবাধকতায়। শুধু যে বয়স্ক মানুষটি একা হয়েছে তা নয়, যে বাঙালি তরুণ বা তরুণী অন্য শহরে বাসা বেঁধেছে, তাকেও একা হওয়া মানিয়ে নিতে হয়েছে। আধ-রান্না চিজ়-‌চিকেনের উপর টমেটোকুচি ছড়িয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠাতে শিখেছে। এতে বাঙালির মন যেমন গর্বিত হয়েছে, তেমন হয়েছে মনকেমনও। ঘরে ঘরে বাঙালি একাকিত্বে আরও অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

বাজারু বাঙালি

কুইজ়ে যদি কখনও প্রশ্ন ওঠে, যুগযুগান্ত ধরে বাঙালির সেরা নেশাটি কী?

উত্তর নিশ্চিত হবে, বাঙালির সেরা নেশা নিঃসন্দেহে বাজার করা। কত সময় নিয়ে, কত যত্ন করে যে বাজার করা যায়, তা বাঙালিই কেবল জানে। শিল্পী ক্যানভাসে যেমন তুলি চালান, বাঙালিও একই কায়দায় বাজারে ঢুকে ঢেঁড়সের বোঁটা ভেঙে পরীক্ষা করে, নধর কুমড়োর পেটে উঁকি দেয়, চকচকে পটলের গা ঘষে দেখে রং আছে কি না!‌ একদা বাবু ধুতির কোঁচা লুটিয়ে বাজারে যেতেন। পিছনে, হাতে থলি নিয়ে বাড়ির গাঁট্টাগোঁট্টা পরিচারক। বাড়ি ফেরার পথে শোভাযাত্রায় যোগ দিত বাজার থেকে ভাড়া করা ঝাঁকামুটেরা। তাদের মাথার ঝুড়িতে উপচে পড়ত শাকপাতা, আনাজ, আম‌-কাঁঠাল। পরিচারকের ‌দু’‌হাতের থলি থেকে উঁকি দিত রুই মাছের ল্যাজা, গলদা চিংড়ির লম্বা দাঁড়া। পথচারীর ঈর্ষাভরা চোখের সামনে দিয়ে ‘‌বাজারু‌ বাঙালি‌বাবু’‌ হেঁটে যেতেন সদর্পে।

বাবু কালচার চলে গেলেও বাজার কালচার ছাড়তে পারেনি বাঙালি। পকেটে পয়সা থাকুক বা না থাকুক, সেখানে এক বার ঢুঁ না দিলে বাঙালির শরীর-মন আনচান করে। শুধু কুমড়ো-বেগুন, পটল-‌মুলো, ট্রে-তে শোওয়া মাগুর মাছের ধড়ফড়ানি নয়, বাজার বাঙালির মিলনক্ষেত্রও। পাড়ার ‘ঘোষদা’, ‘‌মিত্রবাবু’‌, ‘‌মিসেস রায়’‌, ‘‌বুলুমাসিমা’দের সঙ্গে দেখা হওয়া। সংসার, রাজনীতি, বিশ্ব অর্থনীতি বিষয়ে ‘‌বিগ টক’‌, পাড়ার পলিটিক্স, হালকা কেচ্ছার খবরাখবর।

তবে আজ ‘‌বাজারু বাঙালি’‌ খেয়েছে ধাক্কা। অনলাইনে বাজার এখন সংসারে ‘‌গল্প হলেও সত্যি’‌। ড্রইংরুমের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে মোবাইলের কি-বোর্ড টিপে হুকুম পাঠালেই কেল্লা ফতে। মোটরবাইক বাড়ির সামনে চলে আসছে। কোনও কোম্পানি সাত মিনিটে ধনেপাতা দেয়, কোনও কোম্পানি এগারো মিনিটে পালং শাক পাঠায়, কেউ আবার তেরো মিনিটে চাটনির জন্য কাঁচা আম নিয়ে হাজির। মহামারির সময় ঘরে বসে কেনাকাটার যে আয়োজন এসেছিল, সে নিজেই এখন মহামারি। বাজার অর্থনীতির হাত থেকে বাজার বাঁচাতে বাঙালি প্রতিরোধের চেষ্টা করছে না, এমন নয়। জলকাদার বাজার ঢুকে, ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে, ঘামে মাখামাখি হয়ে বাজার করার রোমাঞ্চ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে ঠিকই। খেতে বসে কাঁচালঙ্কায় কামড় দিয়ে বলছে, “‌ধুত্তোরি! অনলাইনের লঙ্কার ঝাল‌লাইন ঠিক নেই। কাল থেকে বাজারেই যাব।”

যাওয়া হচ্ছে না। ঘুম ভাঙতে দেরি, অফিসের তাড়া। গিন্নি নিজেই মোবাইল নিয়ে বসে পড়ছে— “হ্যাঁ গো, পুঁইশাকের ইংরেজি কী গো?”‌

প্রেমিক বাঙালি

বাজারে অভ্যাস না হয় ছাড়া গেল, কিন্তু প্রেম?‌ গত কয়েক দশক ধরে বাঙালির প্রেমের অবস্থা কোন পথে? সেখানে কি ভাটা?

একেবারেই নয়। বরং উল্টো। নব নব ধারায় প্রেমিক বাঙালি‌ আরও‌‌ পল্লবিত। বাঙালির যে প্রেম একদা কাঁচা হাতের লেখা চিঠিতে পায়রার পায়ে ওড়াউড়ি করত, সে এখন‌ স্যাটেলাইটে ওড়ে। ‘‌দুরু দুরু বক্ষে’র‌ প্রেম এখন ‘‌ডিজিটাল চক্ষে’‌র‌ হয়ে উঠেছে। ডিজিটালেই চোখাচোখি হয়। এখন ‌ভিক্টোরিয়া বা গঙ্গাতীরে না গেলেও প্রেমে সমস্যা নেই। হাতের মুঠোয় ভিডিয়ো কল। বাঙালি একই সঙ্গে হাফ ডজন প্রেম চালাতে শিখেছে। চাঁদ, চুমু কিংবা চাউমিনের ছবি দিতেও খরচ নেই। মন দিলে না তো কী হয়েছে,‌ ফোন তো দিলে!

শুধু কমবয়সিরা নয়, গত কয়েক দশকে মাঝবয়সি বাঙালিকেও সাহস জুগিয়েছে ডিজিটাল প্রেম। অফিসের বসের কাছে ‘‌গুড ফর নাথিং’‌, সন্তানদের কাছে ‘বোকা’‌, স্ত্রীর কাছে ‘মেনিমুখো’‌ মিত্রমশাই‌ বুঝতে শিখেছেন, তাঁকে দু’‌দণ্ড শান্তি দিতে হাতের মোবাইল লতাবন থেকে এনে দিতে পারে ‘‌মিস সেন’‌কে। নিঝুম দুপুরে, গভীর রাতে মোবাইল ফিসফিসিয়ে বলে, “ভেতো বাঙালি ‌মিত্রদা, ভয় কিসের, প্রেম বয়স মানে না‌।”‌ মিত্রমশাই অম্বলের ওষুধ গালে ফেলে মোবাইল ঘাঁটেন।

এই হল প্রযুক্তি, প্রেমের কুযুক্তি। ভার্চুয়াল ভাব-ভালবাসা। রিয়েল প্রেমেরই বা খবর কী?‌ রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দের বাঙালি এখন প্রেমের কোন কিনারে ‌এসে দাঁড়িয়েছে?‌

গত কয়েক দশকে বাঙালির প্রেম ‘‌মুক্তমনা’‌ হয়েছে। নারী-পুরুষ সম্পর্কে এখন খোলামন। এক বার প্রেমে পড়া মানেই যে পরস্পরকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে, এ ধারণা মুছেছে। পোষালে হাসিমুখে থাকল, না পোষালে হাসিমুখেই বিদায়। ‘ব্রেকাপ’ এখন কফিশপে বসে কফি এক কাপ। খাওয়া শেষ হলে ‘কেটে পড়ো’‌। পাশ্চাত্যের এই বিশ্বাসে বাঙালি এখন প্রেমকে গ্রহণ করেছে। তা হলে বাঙালির প্রেম কি গভীরতা হারাচ্ছে?‌ ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের ফড়িং হয়ে প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেমের উপরে উপরে উড়ে বেড়ায় এখন?‌ জল ছোঁয় না?‌

একেবারেই নয়। বরং নিজেদের চেনাজানায় ছেলেমেয়েরা আরও গভীরে গিয়েছে। বাঙালির প্রেম তার নেয়াপাতি ভুঁড়িটি সরাতে জিমে যাতায়াত করছে নিয়মিত। সে বুঝেছে, শুধু মন দেওয়া-নেওয়ায় তৃপ্তি নেই, শরীরও লাগে। ‘কুসুম’-এর কাছ থেকে সে নির্দ্বিধায় মনের সঙ্গে শরীরও চায়।

প্রতিবাদী বাঙালি

আপস এবং প্রতিবাদ— দুইয়ে‌ই বাঙালির ইতিহাস উজ্জ্বল। সে ব্রিটিশ শাসককে মেরে প্রতিবাদ করেছে, আবার তৈলমর্দন করে আপস করেছে। গত কয়েক দশক ধরে কোনটায় বাঙালি এগোচ্ছে?‌ বলা কঠিন। কারণ বাঙালি নিজের মনের কথা লুকোতে শিখেছে। আলাদা আলাদা ফোল্ডার বানাতে পারে। যা ভাবে তা বলতে চায় না, আবার যা বলছে, তা ভাবতে চায় না। অনেক সময় আপসের মধ্যে যেমন প্রতিবাদ লুকিয়ে রাখে, তেমন প্রতিবাদের মধ্যে রাখে আপস। বাঙালি আজকাল চট করে এমন কিছু করতে চায় না, যা তার আখের অগোছালো করে দেয়। সে ‘‌অর্থ’ চিনেছে। পকেটের অর্থই যে ‘‌‌ভাল থাকা’‌র অর্থ, ‌এই সহজ সমীকরণটি আত্মস্থ করেছে। একটা সময় যে বাঙালি ছিল ‘রে রে বাঙালি’‌, সমাজে পান থেকে চুন খসলেই হইহই করে তেড়ে যেত। এখন সেই বাঙালি হয়েছে অনেকটাই ‘ছেড়ে দে বাঙালি’‌। ভাবটা হচ্ছে, ‘‌‌সব কিছু নিয়ে মাথা ঘামালে নিজেরই ক্ষতি।’‌ আর তেমন রাগ হলে ‘‌ফসফসানি’ তো রয়েছেই। মানে, ফেসবুক প্লাস বকবকানি। বিপ্লবের আগুন জ্বালানো হল, আবার হাতও পুড়ল না।

তবে সবই কি মেকি?‌ সবাই স্বার্থপর? মোটেও নয়। বাঙালির প্রতিবাদ আজও রয়েছে। পকেটের অর্থ খরচ করে মিছিলে, নাটকে, সিনেমায়, লিটল ম্যাগাজ়িনে সে চিৎকার করতে পারে আজও। করছেও। অনীতি, কু‌নীতি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ন্যায়ের পক্ষে তুফান তোলে। এতে কিছু টনক‌ নড়ে, কিছু ধমক‌ টলে। ‌টিটকিরি আর ছেঁদো রসিকতা নয়, কিছু তরুণ বাঙালি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে অসহায়কে সহায় দিতে শিখেছে। মহামারির সময় বাঙালি দেখিয়েছিল কাকে বলে ‘‌লড়কে লেঙ্গে’‌। শুধু নিজেকে বাঁচায়নি, বাঁচাতে চেয়েছে অন্যকেও।

আড্ডাবাজ বাঙালি

এর পর বাঙালির আড্ডা। যা ছিল গৌরবের, তার হাল এখন কতটা বেহাল, কতটা ডিজিটাল?‌

যত দিন যাচ্ছে, সশরীরের আড্ডা গোঁত্তা খেয়ে পড়ছে। যাকে বলে ‌আড্ডার অধঃপতন। মুখোমুখি বসে সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতি, পরনিন্দা-পরচর্চার কথা না হলে যে বাঙালির এক সময় ভাত হজম হত না, সেই বাঙালি এখন মনে করে মুখোমুখি বকে লাভ নেই, ওতে মুখ ব্যথা, তেমন কিছু শুনতে হলে বুকেও ব্যথা লাগতে পারে। তার থেকে মোবাইলের ‘ফেসে-ফেসে’‌ কথা হোক লিখে। নিজের বুকের থেকে ফেসের ‘‌বুক’‌ অনেক নিরাপদ। সেখানে অ্যাটাক হলে বড় কোম্পানিরা সামলে নেবে। একটা সময় ছিল যখন সকালে বাজার ফেরত, বিকেলে অফিস ফেরত, সন্ধ্যায় ক্লাব ফেরতও আড্ডা চাই-‌ই। দ্বিপ্রহরে ছিল ‘‌মহিলা-‌মহল’‌। রবিবার বা ছুটির দিনের সকাল-বিকেলে মান্যিগণ্যিদের বাড়ির আড্ডা বাঙালির ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা। চিন্তকেরা জড়ো হতেন। আলোচনা, তর্কে বেলা গড়াত। সেই সব আড্ডা ছিল ‘‌ডিসকোর্স’‌। গভীর বিষয়ে নিয়ে গভীর মতের আদানপ্রদান। সঙ্গে গান, কবিতা, ছবি আঁকা। ঠাকুর পরিবারের আড্ডা থেকে সুকুমার রায়ের মন্ডা ক্লাবের আড্ডা শুধু বাঙালির গর্ব নয়, দুনিয়ার যে কোনও মননচর্চার কাছে উদাহরণ।

সেই সব আড্ডার ছটা কিছু দিন আগে পর্যন্তও বাংলার অতি বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকারদের বাড়ির বসার ঘরে এসে পড়ত। এখন কোথায়?‌ বাঙালির সময় হুড়মুড়িয়ে কমছে। কোথাও থিতু হয়ে দু’‌কথা বলার বা শোনার সময় এবং ধৈর্য কমেছে। তার থেকে চলতে চলতে মুখে নয়, হাতে কথা (‌মোবাইলে)‌‌ বাঙালি অভ্যস্ত।

তাও বলি, হারাইনি পুরো। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির টিচার্স রুমে, ক্যান্টিনে আজও আড্ডা চলে। চায়ের দোকানে, পার্টি অফিসে, পাড়ার ক্লাবে এখনও বাঙালি রাজা-উজির‌‌কে বিচারে তোলে এবং ফাঁসি দেয়। কফি হাউসে, কফি শপে, বইমেলা, নন্দন, অ্যাকাডেমি চত্বরে আজও ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে বসে। কোথাও সঙ্গে মুড়ি-‌তেলেভাজা, কোথাও বার্গার-পাস্তা, কোথাও গিটার, কোথাও কৃশকায় কবিতার বই। তবে বাঙালি আড্ডার সেই মেধা হারিয়েছে, যে মেধায় সে এক দিন ভাবত, রাত গড়িয়ে গেলে যাবে, আড্ডা থামবে না। ফুটপাত যদি মধ্যরাতে বদল হয়, তা-ই হোক।

খাদ্যরসিক ও ভ্রমণপিপাসু বাঙালি

বাঙালি চিরকালই খেতে আর ঘুরতে ভালবাসে। খাওয়ার মেনু এবং বেড়ানোর ভেনুতে সে এখন বিশেযজ্ঞ। তার জীবনে ফুড ব্লগ, ট্রাভেল ব্লগের রমরমা। লোকাল ট্রেনের ভিড়ের চাপাচাপিতেও হাতে ধরা মোবাইল। স্ক্রিনে ‘‌তানজানিয়ায় তিন দিন’‌ অথবা ‘‌কাঁকড়াঝোড়ের কাঁকড়ার ঝোল’‌ চলছে। বেড়ানোয় বাঙালি নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে, মাঝেমধ্যে ভয় লাগে— এর পর চাঁদে বা মঙ্গলে যাওয়ার জন্য ব্যাগ না গোছায়।

‘‌মুডি বাঙালি’‌ এখন ‘‌ফুডি বাঙালি’‌। পকেটে একটু রেস্ত থাকলেই রেস্তরাঁয়। আগে রেস্তরাঁয় খাওয়া মানে বছরে দু’দিন কি তিন দিন। সাহেবপাড়ায় ছুটতে হত। কালো-‌হলুদ ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরতে হিমশিম অবস্থা। খাবার ছিল হয় চিনা, নয় কন্টিনেন্টাল। এখন বাড়ির পাশের গলিতেই ফুড স্টেশন, ফুড কোর্ট। গ্যারেজ, বারান্দায় এক চিলতে জায়গা পেলেই তাই, জাপানি, কোরিয়ান, ইরানি, চিলির খাদ্য সম্ভার সেজেগুজে অপেক্ষা করছে। বাঙালি ‘‌থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, চাখব এবার জগৎটাকে’ বলে হাতা গুটিয়ে বসে পড়ছে। আবার ফাইভ-স্টারে টেবিল বুক করে ‘‌ফুলকো লুচি দিয়ে ন্যাজে বেগুন’‌ ভোজনেও কমতি নেই।

লেখার শেষ পাতে একটু মিষ্টি থাকবে কি?‌

না, সেটি চলবে না। শেষ পাতের মিষ্টি বাঙালি বাদ দিয়েছে। নিজের প্রতি নিষ্ঠুর হয়েছে। অথচ ক’দিন আগেও খাওয়ার মেনু যা-ই হোক‌ না কেন, শেষে মিষ্টি ছিল মাস্ট‌। এক হাতা দই, একটা রসগোল্লা, একটা সন্দেশ পেলে তবেই খাওয়াটি হত বেশ। নইলে পেট ভরত না। তবে এখন উপায় নেই। এক সময়ের মননসর্বস্ব বাঙালি এখন অনেকটা চলনসর্বস্বও— স্বাস্থ্যরক্ষায় নিয়ম করে তেড়ে হাঁটে। কুস্তির আখড়া ‘‌জিম’ হয়ে‌ ফিরে এসেছে। বাঙালি সেখানে ঘাম ঝরিয়ে আয় করা পয়সা ঘাম ঝরিয়ে ব্যয় করতে যায়। তা যাক। তবে শুগার, প্রেশার, কোলেস্টেরল, ভুঁড়ি-সচেতন বাঙালি মিষ্টির সঙ্গে চোখের জলে, থুড়ি জিবের জলে বিচ্ছেদ করেছে। মাঝে মাঝে ‘‌তব’‌ দেখা পেলেও, রোজ নয়।

তবে মিষ্টি হারালেও বাঙালি তার মিষ্টত্ব হারায়নি। আজও সে রসবোধে দুনিয়ায় সেরা। না হলে চার পাশের ‘‌রংতামাশা’‌ দেখে, এমন মুচকি হাসতে পারত?‌

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement