রসস্রষ্টা: মিন্টু দাশগুপ্ত
তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে মঞ্চ ফাঁকা। সবে শেষ হয়েছে ‘ম্যাগনোলিয়া ক্যামেলিয়া’, ‘তোলপাড় তোলপাড় মনের কথা’ আর ‘চলো রিনা ক্যাসুরিনা’-র জাদু। সুরে, আমোদে ভরে আছে রাতজাগা জলসার মাঠ। এখন স্টেজে উঠে শ্রোতার মন ফেরানো কঠিন কাজ। পরবর্তী শিল্পীরা দ্বিধাগ্রস্ত। ডাকো মিন্টু দাশগুপ্তকে। বলামাত্র হাজির তিনি। অকুতোভয়, হাস্যমুখ, মঞ্চে সটান দণ্ডায়মান। শুরু হতেই কথা আর গানে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন শ্রোতা। আজ নয়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেন গতকাল গেয়ে গেছেন। সকলে শুনছেন কান খাড়া করে। শুনতেই হত সুরের পিঠে কথার সেই প্যাঁচ-পয়জার। বিধানচন্দ্র রায় থেকে সলিল চৌধুরী, কে না ছিলেন এই স্পষ্টভাষী গায়কের অনুরাগী!
কী এমন ছিল মিন্টু দাশগুপ্তর প্যারোডি গানে? এক কথায় বলা যায়, সময়ের সরস ধারাবিবরণী সে গান। স্বয়ং রাহুল দেব বর্মণও একদা রাগ দেখাতে গিয়ে হেসে কুটোপাটি হয়েছেন, কারণ ওঁকে দেখেই মঞ্চে মিন্টু শুরু করেছেন, ‘সংসারে পড়ে কলির কৃষ্ণ কাঁদে/ রাধা তার রান্নাঘরে শুক্তো রাঁধে।’ জনপ্রিয় সুরে বাঙালিয়ানার এই অম্লমধু মিন্টু দাশগুপ্তর জাত চেনায়। এমনই জনপ্রিয় হয়েছিল সে গান যে, দোকানে দোকানে আশা ভোঁসলের বেসিক আর মিন্টুবাবুর প্যারোডির অর্ডার পড়ত পাশাপাশি।
পোক্ত কণ্ঠ। গায়নশৈলী নড়বড়ে দায়সারা নয়। জহুরি রাইচাঁদ বড়াল শ্রোতাদের চমকে দিয়েছিলেন ‘নতুন ফসল’ ছবিতে মিন্টু দাশগুপ্তর গলায় লোকজ আগমনী ‘আহা রে হৈমবতী শিবসোহাগী রাজার নন্দিনী’ শুনিয়ে। রবীন্দ্রশতবর্ষে যখন গাইলেন ‘কাঁটাবনবিহারিণী সুর-কানাদেবী’, শ্রোতাকুলের অভিনন্দন আরও চওড়া হল যেন। হাসির মোড়কে রূঢ় বাস্তব পরিবেশনে অদ্বিতীয় ছিলেন মিন্টু।
১৯৫২। দলে দলে শরণার্থী আসছেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। পথে, প্রান্তরে আশ্রয় নিতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের। মিন্টু বেছে নিলেন জনপ্রিয়তার শিখরচুম্বী ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’ গানটিকে। কথা বসালেন সেখানে, ‘না হলাম হিন্দুস্থানি, না হলাম পাকিস্তানি/ হায় রে দুয়ের মাঝে পড়ে খাইরে নাকানি-চোবানি’। হাসির আড়ালে বাস্তবের এমন সব কশাঘাত মিন্টুর গলায় আর হাতে এসেছে অনর্গল। সংখ্যায় তা হাজারের কম নয়। চেনা সুর, কথার অন্যতর ট্রিটমেন্টে গোত্র পাল্টে ফেলেছে গানগুলি। ‘আমি এক যাযাবর’-এর সুরে মিন্টু যখন মঞ্চে গাইছেন, ‘আমি হাতকড়া পরে অবশেষে হায় জেলেতে দিলাম পাড়ি/ ফিরে গেরুয়া বসনে ঢেকেছি নিজেকে, রেখেছি লম্বা দাড়ি’, তখন হাসতে গিয়েও ঢোক গিলতে হয়েছে। যাযাবর মিন্টু দাশগুপ্ত নিজেই তখন যেন দৈনিক সংবাদপত্র।
যাযাবরেরই জীবন প্রায়। ছেলেবেলায় মাতৃহারা মিন্টু বাবাকেও বেশি দিন কাছে পাননি। দার্জিলিং, পটনায় শুরু হওয়া স্কুলজীবনের শেষ অঙ্ক কলকাতার তীর্থপতি স্কুলে। সঙ্গীতগুরুরা সকলেই নামী। অনুপম ঘটক, সুধীরলাল চক্রবর্তী, দ্বিজেন চৌধুরী। গান শেখার পাশাপাশি চাকরি। প্রায় তখনই জনপ্রিয় সুরে কথা বসানোর এই অচেনা বিষয়টি বিধানচন্দ্র রায়ের নজরে এল। পিঠ চাপড়ে বললেন, “বিনা পয়সায় গেয়ো না কিন্তু। মান পাবে না।”
মান পেলেন স্বয়ং সলিল চৌধুরীর কাছেই। ওঁর ‘বাঁশি কেন গায়’-এর প্যারোডিতে মিন্টু লিখেছেন লটারি-অভিলাষী মধ্যবিত্তের স্বপ্ন, ‘তখন কিনব গাড়ি বাড়ি শাড়ি, চলব নতুন ছন্দে/ গিন্নির মন ভরিয়ে তুলব তেল সাবানের গন্ধে/ চাকর ডাইনে বাঁয়, গায়ে হাত বোলায়/ আরামে দিন যায়...’। নিজের গানের সমাজমনস্ক প্যারোডিকারকে সমাদরে বুকে টেনে গাড়িতে তুলে নিতে ভুল হয়নি সলিল চৌধুরীর।
মিন্টুবাবু নিজেই লিখেছেন, লেকের পাশের রাস্তা ধরে সাউথ এন্ড পার্কের বাড়িতে ফিরছেন শচীন দেব বর্মণ। পথে দেখা। শচীনকর্তা জিজ্ঞেস করেন, “কেমন আছো, মিন্টু?” তৎক্ষণাৎ শুনিয়ে দিয়েছেন ওঁরই গানের প্যারোডি, ‘আমি আর নেই সে আমি’। মিন্টুর জীবনের এক কালের কঠিন সংগ্রামের কথা জানতেন শচীনবাবু। সহাস্যে মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে বলেন, “জানি ভায়া, তুমি আর নেই সে তুমি।” এই সৌহার্দ বিনিময় আর শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের টুকরোটাকরাও কি খুঁজে পাওয়া যাবে আজকের কর্পোরেট গানের দুনিয়ায়?
এক সময় অসমে প্রচুর অনুষ্ঠান করতেন মিন্টু, জনপ্রিয় সব প্যারোডি অহমিয়াতে অনুবাদ করিয়ে শোনাতেন শ্রোতাদের। প্যারোডির কথাই যে আসল। হাসির আড়ালে জনশিক্ষার সেই দ্বিভাষিক গান কম জনপ্রিয় হয়নি। যেমন, কালজয়ী ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ মিন্টুর কলমে হল, ‘যদি গ্রহের মিলনে সব পেত লয়, তবে কেমন হত তুমি বলো তো/ যদি সব লোক মরে হত নয়ছয়, তবে কেমন হত তুমি বলো তো?’ কথার মারপ্যাঁচে শ্রোতা যখন সংশয়ে, তখন আসত রিলিফের মজা। কু-সংস্কারের বিরুদ্ধে অনেক কিছু বলা সেখানে। যেমন, শ্যামল মিত্রর ‘পুতুল নেবে গো পুতুল’-এ পুতুলের জায়গায় নিল দৈব পাথর। সোয়া পাঁচ আনার সেই পাথর পরলেই নাকি সব মুশকিলের অবসান। ‘সংসারে লাগিয়ে দ্বন্দ্ব, যে জন যায় রেসের মাঠে/ জিতবে সে নিত্য সেথায়, কভু উঠবে না লাটে/ এ সুযোগ পাবে না আর/ বলো ভাই কী দাম দেবে, পাথর নেবে গো...’। এই বিদ্রুপ আরও খোলতাই লতা মঙ্গেশকরের ‘মেরা দিল ইয়ে পুকারে আ জা’-র আদলের গানটিতে। সেখানে রেসুড়ে গাইছে, ‘প্রভু শনিবারে কোরো মোরে রাজা/ আছে ঘোড়ার খবর কিছু তাজা/ দিয়ো দিয়ো ভগবান, কেটো নাকো নাক কান’। ফি-শনিবার কলকাতা রেসকোর্সে উত্তেজনার পারদ কোন পর্যায়ে পৌঁছত, এই প্যারোডি তার আভাস দেয়। ‘শোন শোন গেরোবাজ’-এর প্যারোডিতেও সেই ঘোড়া স্ব-মহিমায়। সংসারের জাঁতাকলে পিষ্ট মধ্যবিত্তর ছবি এঁকেছেন মিন্টু এ ভাবে, ‘খায় চরকি, দেয় ভড়কি, যেন গর্কি দেখে যা’। রণক্লান্ত সে মানুষটির ভরসাস্থল তবে কী? মিন্টু গাইছেন, ‘ভরসা তাদের ঘোড়ার চরণ/ হায়রে ভাবে সদাই ট্রিবল টোটে/ অভাব তারা করবে হরণ/ হরিবোল’। স্বপ্না চক্রবর্তী বা গোষ্ঠগোপাল দাসের লোকগানের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার সাক্ষী যে বাংলার শহর ও গ্রামাঞ্চল, সে জনপ্রিয়তার ব্যাটন মিন্টুও একদা বহন করেছেন। তামাশা আর লোকশিক্ষার সেখানে অভূতপূর্ব সহাবস্থান।
ভালবাসার চিমটি কাটাতেও অদ্বিতীয় তিনি। মহম্মদ রফির ‘গাতা রহে মেরা দিল’ অনুকরণে ‘তুমি যেন সেই চিল/ কাছে পাওয়া মুশকিল/ থাকো তিন তলার ছাদে/ আমি দেখি রাত দিন’ পুজোর প্যান্ডেলে রাত-দিনের ‘রিপিট’। ছাদের কন্যেকে বশে আনা গেলেও, পরিণতিতে ছিল দংশনও। ‘হয়তো তোমার জন্য/ করেছি প্ৰেম জঘন্য/ বাবার পকেট শূন্য/ তোমার ব্যাগ ভরাই’-এর মূল গান কী, সুররসিকদের বলে দিতে হবে না। সত্তরের দশক, সন্ধে হতেই শহর অন্ধকারে। জনমানবশূন্য ব্ল্যাক আউটের কলকাতা। এই বুঝি বোম পড়ল। মিন্টুর ব্যঙ্গে উঠে এসেছে সেই সময়ও, ছদ্মবেশী ছবির ‘আমি কোন পথে যে চলি’ গানের আদলে— ‘ব্ল্যাক আউটের কথা বলি/ সে তো ঠিকানা আমার গলি/ সেথা আবছা আঁধারে টেঁপাটেঁপিদের জমেছিল ঢলাঢলি’। টিভির এক সাক্ষাৎকারে মান্না দে বলেছিলেন, “নতুন গান হিট করলেই জানতাম নির্ঘাত মিন্টু গুটি সাজাচ্ছে।”
এই গুটি সাজানোয় দক্ষতা প্রয়োজন। শুধু তবলা-হারমোনিয়ামে সাদা জামা সাদা প্যান্ট মিন্টু যে ভাবে মঞ্চ থেকে সরাসরি শ্রোতার অন্তরে প্রবেশ করতেন, তা কি কম কৃতিত্বের? অবিস্মরণীয় ‘সপ্তপদী’ ছবির সেই গানের রেষারেষির দৃশ্যটি মনে আনুন। সবান্ধব রিনা ব্রাউনের ইংরেজি পপ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কৃষ্ণেন্দুর ‘এবার কালী তোমায় খাব’-র দাপটে। সেখানে সারা ক্ষণ মহানায়কের পাশে জুড়িগায়ক মিন্টু। বিপরীত স্রোতে সাহসী ভেলা চালিয়েছেন সারা জীবন। দমে যাননি। এই নভেম্বরের পঁচিশ আর তেইশ তারিখে ওঁর আসা আর যাওয়া, যথাক্রমে। পুত্র-কন্যারা প্রতিষ্ঠিত। কন্যা মুনমুন বসু বাবার গান নিয়ে গবেষণা করেছেন। মিন্টুবাবুর স্ত্রী জীবনের শেষ অঙ্কে দেখে যেতে পেরেছেন স্বামীর কালজয়ী গানের সঙ্কলন সিডি হয়ে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই ‘আউট অব মার্কেট’ হয়ে যেতে। কারণ হাসির যে সংস্কার হয় না— তা যুগান্তরের হাজার দুর্বিপাকেও অমলিন থেকে যায়।