সকৌতুক: জহর রায়। ‘দিনান্তের আলো’ (১৯৬৫) ছবির দৃশ্যে
ঠিক দু’দিন পরে বিশ্বকর্মা পুজো। কুমোরটুলি থেকে একটার পর একটা ঠাকুর যাচ্ছে। কারখানার এক দল কর্মচারী ঠাকুর নিয়ে যাচ্ছে লরি করে। তাদের হুল্লোড়-ভরা নাচ দেখতে গিয়ে জহর রায়ের চোখ পড়ে গেল একটা মজার দৃশ্যে। লরির উপর যারা নাচছে তাদের হাতে হাতির শুঁড়! বুঝতে পারলেন, আসলে বিশ্বকর্মা-বাহনের শুঁড়টি ভেঙে গেছে। সেটাই মাথার উপর ঘোরাতে ঘোরাতে চলছে সকলের উদ্দাম নাচ। কৌতুক-অভিনেতার মাথায় ঘুরতে লাগল দৃশ্যটা।
আইডিয়াটা এল সন্ধ্যাবেলায়। গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে ‘নিউ ক্যাথে’ রেস্তরাঁয় বসে ঠোঁটে পানপাত্র ছোঁয়ানোর খানিক পরেই ভাবনাটা ডানা মেলল। সামনেই তো দুর্গাপূজা। দুর্গাপ্রতিমাকে কেন্দ্র করে এ রকম একটা কৌতুক-নকশা করলে কেমন হয়! বাড়ি ফিরে জহর রাতারাতি লিখে ফেললেন ‘ন্যাপাসুর বধ’। গণেশ বাবাজির শুঁড় একটা ছিল ঠিকই, তবে এই গল্পে দুর্গাপ্রতিমা আনতে গিয়ে ভেঙে গেল আস্ত অসুরটাই। এখন অসুর পাওয়া যাবে কোথায়? কেন, পাড়ার ন্যাপা থাকতে চিন্তা কী! ফলে মাটির মহিষাসুরের জায়গায় প্রক্সি দিতে হয় কাঠবেকার নেপালচন্দ্র ওরফে ন্যাপাকে। তারই প্রাণান্তকর নানান বিপত্তি নিয়ে সপ্তমী থেকে দশমীর বিসর্জন পর্যন্ত হাস্যরোলের ঘনঘটা।
পুজোর আগেই রেকর্ডিং হল। বিক্রিও রেকর্ড-ছোঁয়া। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সে বার জহর রায়ের ‘ন্যাপাসুর বধ’। অনু দত্তের মতো এক দল তরুণ কৌতুক-শিল্পী ছোটখাটো জলসাতে এই নকশা শুনিয়ে প্রচুর হাততালি পেতেন তখন। ফিল্মি পত্রিকা ‘উল্টোরথ’-এর পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের মঞ্চে ‘ন্যাপাসুর বধ’ শোনাচ্ছেন জহর রায়, দর্শকাসনে সত্যজিৎ রায়। জহরবাবুর অভিনয় দেখে আকাশ-ফাটানো হাসি হেসেছিলেন সত্যজিৎ। উপস্থিত জনৈক আলোকচিত্রী হাতছাড়া করেননি সে সুযোগ। সেই হাঁ-হাস্যমুখ ছবিটিতে সত্যজিতের আলজিভ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল! পরে এই ছবি প্রসঙ্গে জহর রায় মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘গ্রেটম্যানরাই এ রকম প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারে।’’
সমরেশ বসুকে এক বার জহর জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আপনি কালকূট না পানকূট! এত পান করেন কেন?’’ যিনি নিজে ‘পানাসক্ত’, নিউ ক্যাথে-তে যাঁর নিত্য যাতায়াত, যাঁর পানাহারের আড্ডা নিয়ে সিনেমা-পত্রিকায় গসিপ বেরোয়, তিনিই নাকি এমন কথা বলছেন! তবে শব্দ নিয়ে ‘পানিং’ করার অসাধারণ দক্ষতা ছিল জহরের। তা প্রায় শিবরাম-সদৃশ। হয়তো সেই লোভেই এই কালকূটোক্তি। সত্যজিৎকে বলেছিলেন, ‘‘আমি এজ-এ বড়, আপনি ইমেজ-এ বড়,’’ কিংবা উত্তমকুমারকে: ‘‘হনুমান ছিলেন সীতারাম ভক্ত, আমি হনু-ম্যান Rosa Rum ভক্ত’’— এ সব Puning তো বিখ্যাত হয়ে আছে। নিজের কারণ-পানের কারণ নিয়ে করুণ কৈফিয়ত দিয়েছেন জহর রায় নিজেই: ‘‘মানুষ মরার জন্য বিষ পান করে, আর আমাকে বিষ পান করতে হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য। এই তরল কালনাগিনীর ছোবল থেকে আমার মুক্তি নেই।’’
দারিদ্রকে ভয় পেতেন। বলতেন, ‘‘জীবনে অনেক দারিদ্র ভোগ করেছি, এখন আমি তাকে ভয় পাই।’’ আসলে সংসারের চাপে, বাবার পাশে দাঁড়ানোর কর্তব্যবোধে প্রথম জীবনে নানান কাজ করেছেন তিনি। কলেজে পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে ঢুকলেন পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রুফ রিডারের চাকরি। সেটা ছেড়ে হয়ে গেলেন মেডিকেল রিপ্রেজ়েন্টেটিভ। চাকরি-জীবন পোষাচ্ছিল না বলে ঢুকলেন স্বাধীন ব্যবসায়। দিলেন দর্জির দোকান। এক মুসলমান কারিগর তাঁকে শিখিয়েছিলেন শার্ট-প্যান্ট কাটা বা সেলাই-ফোড়াইয়ের কারিকুরি। দোকান জমে গেল। অর্থাগম হচ্ছিল ভালই। কিন্তু মনের টান যে অন্যত্র! অভিনেতা-পিতা সতু (সত্য) রায়ের সৌজন্যে রক্তে অভিনয়ের নেশা ছিলই, সেটাই আরও বাড়িয়ে দিলেন চার্লি চ্যাপলিন। ‘‘এক দিন দোকান-টোকান তুলে সামান্য কিছু পয়সা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কলকাতার উদ্দেশে। আমার পরিচিত এক জন কলকাতায় বিয়ে করতে আসছিল। তাদেরই বরযাত্রীর দলে ভিড়ে গেলাম। পাটনা টু ক্যালকাটা রেলভাড়াটা বেঁচে গেল,’’ বলেছেন জহর রায়।
মহানগরে এসেই কিন্তু কাজ জোটেনি। পূর্বপরিচিত অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে সুযোগ মিলল ঠিকই, তার পরেও বহু দিন এক বেলা উপোস থেকেছেন, ভেবেছেন পটনাতেই ফিরে যেতে হবে আবার। অদম্য জেদ তাঁর, হাল ছাড়েননি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭— দীর্ঘ তিন দশকে জহর রায় অভিনীত ছবির সংখ্যা প্রায় তিনশো। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল থেকে শুরু করে তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার— প্রায় সব খ্যাতিমান পরিচালকের ছবিতেই তিনি অভিনয় করেছেন। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘পরশপাথর’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘পলাতক’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘ঠগিনী’-র পাশাপাশি মনে রাখতে হবে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ বা ‘ধন্যি মেয়ে’র মতো সিনেমাকেও। আবার আজীবন সুহৃদ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুড়ে গেছে তাঁর নাম— ‘ভানু-জহর’ যেন একটাই শব্দ। দুজনের মধ্যে ছিল গভীরতম বন্ধুত্ব। দুজনেই কমেডি অভিনয় করতেন, অথচ পারস্পরিক ঈর্ষার লেশমাত্র ছিল না। এই সম্পর্কের জোরে এবং জেরে তৈরি হয়েছে ‘এ জহর সে জহর নয়’ বা ‘ভানু গোয়েন্দা জহর এ্যাসিস্ট্যান্ট’-এর মতো ছবি। বাজারে গুজব ছিল, দুজন নাকি পরস্পরকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে জহর রায় উত্তর দিতেন, ‘‘যারা ওই সব কথা রটাচ্ছে তাদের মুখের মতো জবাব দেবার জন্য এক বার বাথরুমে যাবার দরকার।’’ বাংলা ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা রোম্যান্টিক যুগের সূচনা করেছিলেন, সমান্তরাল সময়ে ভানু-জহর কমেডি যুগের সূচনাকার— এটাই ইতিহাসের লিখন।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি নাটকের ক্ষেত্রেও জহর রায়ের অভিনয়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতীত। প্রায় দুই দশক জুড়ে তিনি ছিলেন ‘রঙমহল’ মঞ্চের প্রধান আকর্ষণ। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নাটক চলছে। হাজারি ঠাকুরের চরিত্রে সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায় হয়েছেন মতি চাকর। এক দিন সত্যবাবু মঞ্চে ‘মতি মতি’ করে ডেকে চলেছেন। এটাই সংলাপ। কিন্তু ‘মতি’ জহরের পাত্তা নেই। হঠাৎ মতির আগমন ঘটল, তবে সারা মুখে ময়দা মাখা। এ সব তো নাটকের স্ক্রিপ্টে ছিল না! সত্যবাবু বিস্মিত। তবু বিষয়টাকে ম্যানেজ করে নিয়ে তিনি সংলাপ তৈরি করলেন: ‘‘এ কী চেহারা হয়েছে তোর?’’ মতির উত্তর: ‘‘আমি সবে গামলায় ময়দাটা ঢেইলেছি মাখব বলে, এমন সময় তুমি এমন জোরে ‘মতি’ বলে ডাইকলে যে আমি ওই এক গামলা ময়দার উপর মুখ থুইবড়ে পইড়ে গেলুম।’’ দর্শককে এক টুকরো হাসি উপহার দেওয়ার জন্য এই সব মুহূর্ত অহরহ তৈরি করে ফেলতেন জহর রায়। দু’মিনিটের সংলাপকে ‘এক্সটেম্পো’ দিয়ে কুড়ি মিনিটে নিয়ে যেতেন মাঝেমধ্যেই। দর্শক বিনোদন-রসে ডুবে যেত ঠিকই, নাটকটিরও ভরাডুবি ঘটত সেখানেই। ‘দেশ’ পত্রিকায় সমালোচনা করে লেখাও হয়েছিল, ‘কী বিরাট প্রতিভার কী শোচনীয় অপব্যয়।’
‘এক্সটেম্পো’ দেবার এই অভ্যাসটা যে অতিরিক্ত ‘ফাংশন’ করার কুফল, তা নিজেই স্বীকার করতেন জহর, ‘‘ফাংশনের সময় স্টেজে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক নানা ঘটনা নিয়ে এক্সটেম্পো বলে বলে এমন বদ অভ্যাস হয়ে গেছে যে নাটক করার সময়েও সেই জাতীয় কথা মুখ থেকে হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসে।’’ পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে জহর রায়কে ছাড়া ফাংশনের কথা কল্পনাও করতে পারতেন না উদ্যোক্তারা। ছোট-বড় বাছবিচার ছিল না তাঁর। দিনে চারটে করেও করেছেন। ‘মঞ্চে কৌতুক-নকশা পরিবেশনের সময় কত রকম ভঙ্গিতে যে নিজেকে মূর্ত করে তুলতেন! কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে কখনও তিনি বৃদ্ধ, কখনও বৃদ্ধা। কখনও রকবাজ, কখনও ধড়িবাজ। কখনও প্রেমিক, কখনও প্রেমিকা। সেই সঙ্গে মুখে মুখে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজ়িক, গান, নাচ।’
শহর থেকে যত দূরেই অনুষ্ঠানে যেতে হোক, বাড়ি ফেরার জন্য মন ছটফট করত। তমলুকে গেছেন নাটক করতে। রাত বারোটা নাগাদ অভিনয় শেষ হল। মেক-আপ তুলে রাত দুটোর ট্রেন ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে বসলেন। আয়োজক-বন্ধুটিকে সরল মনে কৈফিয়ত, ‘‘আসলে কী জানিস, তোর বৌদি আর ছেলেমেয়েদের জন্য বড্ড মন কেমন করছে।’’ এক বার পটনার বেঙ্গলি ক্লাব-এর পক্ষে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন হল। তিনি তো সেই শহরেরই ছেলে। যে দিন রওনা দেবেন, এক মেয়ের ধুম জ্বর। কিছুতেই কমছে না। পটনা যাওয়া বাতিল করলেন। আয়োজকদের প্রতিনিধি খুব পীড়াপীড়ি করায় তাঁকে বললেন, ‘‘বাবা তো হওনি। হলে বুঝবে সন্তান কী জিনিস!’’
বাংলা ছাড়াও ওড়িয়া আর হিন্দিতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন তিনি। এত ভাল হিন্দি জেনেও বোম্বে যাননি পরিবারকে ছেড়ে থাকতে হবে বলে। জীবনে একটিমাত্র হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন, বিমল রায়ের ‘পহেলা আদমি’। নেতাজি সুভাষচন্দ্র ও আইএনএ-র ওপর ভিত্তি করে তৈরি এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৮-এ। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নচিকেতা ঘোষের আত্মপ্রকাশ এই ছবিতে। জহর রায় এখানে এক বাঙালি সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তিনিই লিপ দিয়েছিলেন ডাক্তারি-পড়ুয়া নচিকেতার গানটিতে।
পটুয়াটোলা লেনের ‘অমিয় নিবাস’ বাড়িটিতে জহর নিজের অফিস করেছিলেন। অফিস না বলে লাইব্রেরি বলাই ভাল। দুটো ঘর জুড়ে শুধু বই আর বই। নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরীর থেকে পেয়েছিলেন বই পড়ার নেশা। শুধু পড়ার নয়, কেনারও। ‘অহীনবাবা’র উপদেশ শিরোধার্য জহরের কাছে: ‘‘বই কেনাটা জরুরি। দরকার হলে নিজে আধপেটা খেয়ে থাকবে, কিন্তু বই কেনা চাই-ই। এমন বই আছে যা তোমার খিদে-তেষ্টা মিটিয়ে দেবে।’’ নতুন বইয়ের গন্ধ প্রাণভরে নিতেন। লিখছেন, ‘সারা বুকটা তৃপ্তিতে ভরে যেত। কত কষ্ট করে, সংসারকে বঞ্চিত করে টাকা দিয়ে বই কিনতে হয়েছে, সে কথাটা আমাকে ভুলিয়ে দিত বইয়ের গন্ধ।’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এক বার কেউ এসে বললেন, ‘‘জহরের বাড়িতে অনেক বই দেখলাম। আসলে ও সব বুজরুকি, ও সব পড়ে-টড়ে না কি!’’ শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি কিন্তু আমার সব বইতে মলাট দিয়ে রেখেছি, পাছে জহরের কাছে গিয়ে আবার বলেন, ভানুটা কিসসু পড়াশুনো করে না!’’
১৯১৯-এর ১৯ সেপ্টেম্বর জহর রায়ের জন্মদিন। তাঁর শতবর্ষ নীরবেই কেটে যাবে হয়তো! ৪২ বছর আগে, ১৯৭৭-র ১১ অগস্ট, মেডিকেল কলেজ থেকে একটা শোকমিছিল এগোচ্ছিল বিধান সরণি ধরে। বেথুন কলেজের সামনে এসে থেমে গেল মিছিলটা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ি থেকে নামলেন সুচিত্রা সেন। ধীর পায়ে লরিতে উঠলেন। সেখানে তখন নিথর শুয়ে জহর রায়। সুচিত্রা কিছু ক্ষণ তাকিয়ে রইলেন প্রিয় সতীর্থের দিকে। অস্ফুটে বললেন: ‘‘তুমি চলে গেলে চার্লি!’’ তার পর নিচু হয়ে ছোট্ট একটা চুম্বন এঁকে দিলেন জহর রায়ের কপালে।
কৃতজ্ঞতা: স্নেহাশিস পাত্র, সোহম দাস
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে নিবন্ধ পাঠান। শব্দসংখ্যা ৬০০-১২০০। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। পিডিএফ-এ নয়, ওয়ার্ড ফাইল ইমেল করুন।
ইমেল: rabi.article@abp.in
সাবজেক্ট: Rabibasariya Nibandha
পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর ও সম্পূর্ণ ঠিকানা দেবেন।