শারদোৎসব: সেলিমপুর পল্লির দুর্গোৎসব, ২০০২
দুর্গাপূজা শুরু হতে সাকুল্যে এক মাস বাকি, শহর মেতে উঠবে অনাবিল আনন্দে। শহরের অন্য প্রান্তের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিয়ে থিম-ভিত্তিক পুজোর আয়োজনে সেলিমপুরের পুজোও শহরবাসীর নজর কেড়েছে। পুজোর ক’টা দিন এই এলাকায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম হবে। চারিদিকে আলোর ছটা। পূজামণ্ডপের অদূরে সেলিমপুর রোডে প্রায় একশো বছরের পুরনো কবরস্থানের কাছের আদি বাসিন্দাদের উৎসব-আবহ হয়তো মনে করিয়ে দেবে ফেলে আসা কোনও এক ‘শবে বরাত’-এর কথা। হিজরি বর্ষপঞ্জির শাবান মাসের চোদ্দো তারিখ রাতটি শবে বরাত হিসেবে পালিত হয়। বিশ্বাসীরা মনে করেন, এই রাত সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার রাত, সঙ্গে নতুন বছর ভাল কাটানোর জন্য প্রার্থনার রাত। এই রাতেই বাসিন্দারা কবরস্থানে জমায়েত হন চিরতরে বিদায় নেওয়া বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনের মঙ্গল প্রার্থনা করতে। আছে কবরস্থানে মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালানোর রেওয়াজ। কবরের উপর ফুল দিয়েও মৃতের প্রতি ভালবাসা নিবেদন করেন মানুষ। আশেপাশের বাড়ি থেকে হরেক রকমের হালুয়ার সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। আজ থেকে সত্তর–আশি বছর আগেও সেলিমপুরের কবরস্থানে শবে বরাতের মোমবাতির আলোয় এলাকা জেগে উঠত। দেশভাগের কয়েক বছর আগে থেকেই কবরস্থানের স্বাভাবিক নীরবতার সঙ্গে যুক্ত হল এই এলাকায় চিরদিনই সংখ্যাগুরু মুসলমানদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নীরব যাত্রা। শবে বরাতের দেড় মাস পরের সবচেয়ে বড় উৎসব ইদও সাদামাটা ভাবে পালিত হওয়া শুরু হল। ইদের দিন মনে হল গ্রীষ্মের এক অলস নিঝুম দুপুর। ভাষা এক, কেবল ধর্ম আলাদা বলে, প্রতিবেশীকে কেমন অচেনা লাগল।
অবিভক্ত চব্বিশ পরগনার ঢাকুরিয়া গ্রামের সেলিমপুরে তৎকালীন সংখ্যাগুরু বাসিন্দারা আজ সংখ্যালঘু। একটা জনপদের জনবিন্যাস কী করে বদলে গেল, এখানকার পুরনো বাসিন্দাদের কাছে সেটা অতীতের নিষ্প্রভ স্মৃতিকথা। এ দেশে থেকে যাওয়া মুসলমানরা সংখ্যালঘু হিসাবে নিজেদের যেন গুটিয়ে নিলেন। শহরের এক কোণে টিকে আছে ছোট হতে হতে ন্যানো সাইজের এক কবরস্থান, দুটো মসজিদ আর দুই পিরের মাজার।
এই জনপদের নাম কী ভাবে সেলিমপুর হল এ নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায় না, তবে নাম থেকে মুসলমান জনগোষ্ঠীর গুরুত্বের কথা আন্দাজ করা যায়। খানিক পিছিয়ে গিয়ে দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলার খাসপুর মৌজার ঢাকুরিয়া সেলিমপুর গ্রামের একদা জমিদার ছিলেন ‘শহর কলিকাতা পাথুরিঘাটা নিবাসী শ্রীযুক্ত মহারাজ বাহাদুর স্যার প্রদ্যোত কুমার ঠাকুর KT’ মহাশয়। এই জমিদারের খাজনা আদায় করে, কখনও ভোগদখল সূত্রে বা মধ্যস্বত্বাধিকারী চিরস্থায়ী, বা পিরের সেবার সূত্রে এলাকার অবস্থাপন্ন মুসলমানরা জমির মালিক হন।
অবস্থানগত ভাবে সেলিমপুরের গুরুত্ব বরাবরই বেশি। সেলিমপুর ক্রমে তৎকালীন টালিগঞ্জ পুরসভার অধীনে আসে এবং তারও অনেক পরে কলকাতা পুরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়। কলকাতা শহরে শুরু থেকেই মুসলমানদের প্রভাব সুবিদিত। জনসংখ্যার হিসাবে ও জনপরিসরে তাঁদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব থেকে অনেকে মনে করেন, ইংরেজদের কাছে সিরাজউদ্দৌল্লার শোচনীয় পরাজয় না হলে হয়তো শহরের নাম পাকাপাকি ভাবে ‘আলিনগর’ই থেকে যেত। স্ব-নিযুক্ত পেশায় মুসলমানদের দক্ষতার কারণে তাঁরা আর্থিক ভাবে সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। প্রশাসনিক কাজেও তাঁদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয় ছিল, সেলিমপুরের অনেক বাসিন্দাই সরকারি কাজে নিযুক্ত ছিলেন। শিক্ষার কারণে এ অঞ্চলে মুসলমানদের আর্থিক সচ্ছলতারও আভাস পাওয়া যায়। সেলিমপুরের যে কবরস্থানের কথা শুরুতেই বলা হয়েছে, তা আসলে এলাকার এক সম্পন্ন ও বনেদি মুসলমান পরিবারের পারিবারিক কবরখানা, যা পরে সম্প্রদায়ের অন্য পরিবারদের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই কবরস্থানের এক প্রান্তে মানিক পির ও বড় পিরের মাজার আছে, এখানে ১৯৪১ সালে মসজিদ গড়ে তোলা হয়। তবে এই দুই পির সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না।
আর্থিক সমৃদ্ধির আর এক প্রকাশ দেখা যায় যখন ১৮৯৮ সালে এলাকায় আর একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এটি ছিল কলকাতার প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম। জনাব ইয়াসিন মিস্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেলিমপুর রোডে এই মসজিদ স্থাপিত হয়। তিনি মসজিদের এই সম্পত্তি ওয়াক্ফ বোর্ডের হাতে তুলে দিতে আবেদন করলেন। ওয়াক্ফনামায় তিনি লিখলেন “এক্ষণে আমি অবসরপ্রাপ্ত হইয়াছি। জীবনের কিছু আশা ভরসা নাই অতএব পরকালে যাহাতে মুক্তি হয়, পাপের কিছু মুক্তি হয় সে কারণে ধর্ম কার্য্য করা আমার পক্ষে বিশেষ কর্তব্য।” এই ধর্মাচরণে তিনি কোনও বাধা প্রাপ্ত হচ্ছেন না, বরং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সহাবস্থানের নিদর্শন হিসেবে অজস্র গল্প শোনা যায়। প্রতিবেশীদের মধ্যে প্রাত্যহিক যোগাযোগের নজিরও ছিল।
এই মসজিদকে আবার অনেকে হাজিপাড়ার মসজিদও বলেন। এই পাড়ার পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে কয়েকজন ‘হাজি সাহেব’ ছিলেন, সে হদিস পাওয়া যায়। ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায় হজযাত্রায় আদতে কয়েক হাজারে এক জন সক্ষম হতেন সেই সময়। ‘হাজিপাড়া’ আসলে এখানকার বাসিন্দাদের আর্থিক সমৃদ্ধির ইঙ্গিত।
ছবিটা দ্রুত বদলাতে থাকে দেশভাগের ঘোষণার সঙ্গে। দেশভাগের আগেই বেশ কিছু পরিবার আপাত-নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাড়া ছাড়ল। চারিদিকে তখন ঘোর অবিশ্বাসের বাতাবরণ। ১৯৫০ সালে হাওড়ার সাম্প্রদায়িক হানাহানির ফলে মুসলমান মননে মানসিক অশান্তি ত্বরান্বিত হতে থাকে। বেশির ভাগ পরিবারই এক রাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কোথায় পাড়ি দিলেন সেলিমপুরের মুসলমান বাসিন্দারা? এর কোনও লিপিবদ্ধ ইতিহাস নেই, যে যেখানে পারেন বেঁচে থাকার জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতে চাইলেন। দেশভাগের শিকার, পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষের জনস্রোতে এলাকার মুসলমানরা খানিক দিশেহারা। যারা সরকারি চাকরিতে ছিলেন তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু মানুষ নিশ্চয়তার সন্ধানে দুরুদুরু বুকে পাকিস্তানের পথে পা বাড়ালেন। কিন্তু সবাই যেতে পারেননি। সেলিমপুরের মুসলমান জনগোষ্ঠীর পদবি থেকে খানিক আন্দাজ করা যায় যে বেশির ভাগই ছিলেন বাংলাভাষী। এলাকার জমির কাগজপত্র থেকে মিস্ত্রি, মুন্সি, ওস্তাগর ইত্যাদি পদবির পরিচয় পাওয়া যায়। সম্পত্তির দলিল থেকে জানা যাচ্ছে, কলকাতার পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলা, যেমন ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি ও মুর্শিদাবাদের সঙ্গে এই পরিবারগুলোর যোগ ছিল। মনে করা হয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে বাঁচতে বেশ কিছু পরিবার এই জেলাগুলোতে ফেরত চলে যায়। এর পরে সেলিমপুরের চিত্রপট দ্রুত বদলাতে থাকে।
সেলিমপুরের ঘটনা উল্লেখ করেই প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জয়া চট্টোপাধ্যায় দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে লিখেছেন তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ ‘অব গ্রেভইয়ার্ড অ্যান্ড ঘেটোস: মুসলিমস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এ। অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্ট ব্যবহার করে জয়া দেখাচ্ছেন, ১৯৫০-এর পর থেকে মুসলমানরা পায়ের নীচের মাটি হারাতে থাকে। এই সুযোগে কবরস্থানের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের উদ্বাস্তু কলোনির কিছু মানুষ কবরস্থানের জমি দখল শুরু করে বলে মনে করা হয়। কবরস্থানের উপর দখল বাড়াতে জনস্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে এখানে কবর বন্ধ করা হোক, এই দাবি করা হয়। জিন্দা মানুষ মুর্দা মানুষের আড়াই হাত কবরেরও দখল নিতে চায়। ১৯৫৫ সালে কবরস্থানে দাফনকে কেন্দ্র করে মুসলমান ও স্থানীয় উদ্বাস্তু মানুষের মধ্যে বচসা হয়, প্রতিবাদকারীরা টালিগঞ্জের কবরস্থানে মৃতকে দাফন করতে বাধ্য করেন। এর দু’মাস পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এক মুসলমান ভিখারির মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়, কিন্তু সেটাই শেষ। ১৯৫৬ সালে শবে বরাতের রাতেই কবরস্থানকে কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে মৌলবি সবে কবরস্থানের এক কোণে সবে প্রার্থনা শুরু করছেন, কবরস্থানের দক্ষিণ–পূর্ব দিকে থেকে এক দল মানুষ এসে মৌলবিকে হুমকি দিতে থাকে এবং দাবি করতে থাকে, তাদের কেনা সম্পত্তিতে কোনও প্রার্থনা চলবে না। মৌলবি মাঝপথে প্রার্থনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। শেষ রাতে পুলিশের উপস্থিতিতে শবে বরাতের প্রার্থনা শেষ হয়, শুরু হয় একে অপরের প্রতি অভিযোগ, প্রতি-অভিযোগ। যে পুলিশকে ঘটনার তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছিল, তারা কবরস্থানে উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলেদের ফুটবল খেলা, এমনকি ‘হোলি’ খেলার অভিযোগ পত্রপাঠ খারিজ করে দেয়।
সম্প্রতি ‘প্রতিবেশীকে চিনুন’ এই নামে এক উদ্যোগের অংশ হিসাবে সেলিমপুর ঘুরে জানতে পারলাম, এখনও চল্লিশ–পঞ্চাশ ঘর মুসলমান সেলিমপুর রোড, সেলিমপুর লেন এবং ঝিল রোডে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেঁচে আছেন। মসজিদ, কবরস্থান ও পিরের মাজার ছাড়া আলাদা করে এদের অস্তিত্ব খুঁজে বার করা কঠিন। বেশির ভাগ মানুষ স্ব-নিযুক্ত কাজে যুক্ত, সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় আগ্রহ বাড়লেও, সামনে অস্বচ্ছ দিশা। এখানকার বাসিন্দারা এলাকার অতীত নিয়ে কথা বলতে অনাগ্রহী। তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। কবরস্থানে নিকট-আত্মীয়দের কবর দেওয়া শুরু হয়েছে দীর্ঘ বিরতির পর। অচিরেই হয়তো শবে বরাতে কবরস্থানে আলো জ্বলবে, আগরবাতি ও ফুলের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়বে। অথবা দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে আয়োজন করবেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য মহোৎসব।