বছর পঁচিশ আগে এক দীপাবলির সময় তাইওয়ানের রাজধানী তাইপে শহরে গিয়েছিলাম এক ভারতীয় রেস্তরাঁয়। দীপাবলির আলোকমণ্ডিত সেই রেস্তরাঁর তাইওয়ানিজ় কর্মীদের মুখে ‘হ্যাপি দিওয়ালি’ শুনতে ভারী ভাল লেগেছিল। খানিকটা অবাকও হয়েছিলাম। কারণ সেখানে ভারতীয়দের সংখ্যা বড্ড কম। আজ হলে হয়তো বিস্ময়টা থাকত কম। কারণ দিওয়ালি ইতিমধ্যে অনেকটাই আন্তর্জাতিক।
চিনা বংশোদ্ভূত আমার এক মালয়েশীয় সহ-গবেষক প্রতি বছর দিওয়ালির দিন নিয়ম করে আমাকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান। ইনি কলকাতাতেও এসেছেন কয়েক বার। পুজোর সময় দস্তুরমতো ঘুরে ঘুরে দুর্গোৎসব দেখার অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। তিনি ভালই জানেন যে, ভারতের এ প্রান্তের জনগণের প্রধান উৎসব দুর্গাপুজো। তবু তিনি শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান দিওয়ালির সময়েই। কারণ তিনি যে দেশের মানুষ, তার ৮ শতাংশ জনগণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত, এবং তাঁদের সবচেয়ে বড় উৎসব দিওয়ালিটাই।
ঐতিহ্যগত ভাবে যে সব দেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা সংখ্যায় ভারী, সেখানে বহুবর্ণে দিওয়ালির আলোর বিচ্ছুরণ স্বাভাবিক। যেমন, মালয়েশিয়া ছাড়াও সিঙ্গাপুর, ফিজি, মরিশাস, গায়ানা, মায়ানমার, সুরিনাম বা ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো-তে দিওয়ালি অনুষ্ঠিত হয় রমরমিয়ে। হিন্দুপ্রধান নেপালেও দিওয়ালির উচ্ছ্বাসের উদ্ভাস থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, গত কয়েক দশক ধরে দিওয়ালির আলো যেন ভাসিয়ে দিচ্ছে আরও বিস্তীর্ণ এক দুনিয়াকে।
আমেরিকায় দিওয়ালির উপর প্রথম স্পটলাইট পড়ে ২০০৬ সালে। জনপ্রিয় টেলিভিশন কমেডি সিরিজ ‘দি অফিস’ চলছিল সে সময়। ২০০৬-তে ‘দি অফিস’ একটা এপিসোড প্রচার করে ‘দিওয়ালি’ নামে। সেটা নভেম্বর, দিওয়ালির দিনকয়েক পরের সময়। এপিসোডটি সরাসরি দেখেন প্রায় ৮৮ লক্ষ মানুষ। সেখানে কেলি কপূর নামক চরিত্রটি অফিসের সমস্ত কর্মীকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে দিওয়ালির উৎসবে। একটা কমেডি সিরিজ়ের একটি এপিসোড যেন সে দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এক নিছক ভারতীয় উৎসবকে হঠাৎই নিয়ে আসে আমেরিকান জনতার দু’হাতের গণ্ডির মধ্যে। তারা আকৃষ্ট হয় এর প্রতি। যদিও স্টিভ ক্যারেল অভিনীত চরিত্রটি সেখানে দিওয়ালিকে বলে বসে ‘হিন্দু হ্যালোউইন’! মোটামুটি একই সময়ে অনুষ্ঠিত হলেও সে দেশের হ্যালোউইন উৎসবের সঙ্গে অন্ধকারের বুক চিরে দিওয়ালির আলোর বিজয়রথের পার্থক্য আমেরিকানদের বোঝানো হয়তো কঠিন।
‘দি অফিস’-এর বছর পনেরো পর আবার জমিয়ে দিওয়ালি দেখতে পাই হালের আর একটি আমেরিকান কমেডি-ড্রামা টেলিভিশন সিরিজ়ের এক এপিসোডে। এই সিরিজ়টি কাল্ট ক্লাসিক ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’-র ২০২১-এর পুনর্জাগরিত রূপায়ণ, ‘অ্যান্ড জাস্ট লাইক দ্যাট’। এখানে দেখা যায়, ভারতীয় আলোর উৎসব দিওয়ালি কী ভাবে ইতিমধ্যেই আলোকিত করে তুলেছে আমেরিকাকে। সারা জেসিকা পার্কার অভিনীত চরিত্রটি দিওয়ালির শপিংয়ে যায় লেহেঙ্গা পরে। অবশ্য সে যে ভুল করে লেহেঙ্গাকে শাড়ি বলে ফেলে, সেটাকে আমাদের ততটা গুরুত্ব না দিলেও চলবে। তবে ৫৫ বছর বয়সি সারা জেসিকা পার্কারের চরিত্রটি যে শিকাগোর মতো শহরে— যেখানে দক্ষিণ এশীয়দের ঘনত্ব বেশ বেশি— বাস করেও দিওয়ালি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না, তাতে অবাক হন বেশ কিছু সমালোচক।
দিওয়ালিকে বিনোদনের দুনিয়ায় এনে ফেলার আরও উদাহরণ আছে। যেমন, ২০১০-এর এনবিসি-র টিভি সিরিজ় ‘আউটসোর্সড’-এর পটভূমি মুম্বইয়ের এক কল সেন্টার। টড সেখানে একমাত্র আমেরিকান। তার ভারতীয় কর্মীরা স্বাভাবিক ভাবেই দিওয়ালির ছুটিকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নেয়। টড ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়; সে ছুটি দিতে চায় না তাদের। ফলে সে অপ্রিয় হয়ে পড়ে কর্মীদের মধ্যে। আবার ডিজ়নির ২০২০-র অ্যানিমেটেড সিরিজ় ‘মীরা, রয়্যাল ডিটেকটিভ’-এ রয়েছে দিওয়ালির চমৎকার চিত্রণ।
হলিউড ছবিতে দিওয়ালির প্রবেশ এ সবের অনেক আগে। ডাকসাইটে ফরাসি পরিচালক জঁ রেনোয়ার হাত ধরে। রেনোয়া পরিচালিত ১৯৫১-র ছবি ‘দ্য রিভার’ (ফরাসিতে ‘লে ফ্লিউভ’)-এর শুটিং হয় কলকাতায়। এ ছবির একটি দৃশ্যে দেখানো হয়েছে দিওয়ালির উৎসবের চিত্রায়ণ। দেখানো হয়েছে তুবড়ির মতো বাজি পোড়ানো। এই ছবিতে কিন্তু জড়িয়ে ছিলেন তরুণ সত্যজিৎ রায়ও। এখানে রেনোয়ার কাজের ইউরোপ-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখেন সত্যজিৎ। ছবিটি যে আমেরিকান দর্শকের জন্য তৈরি এবং এতে কেবলমাত্র এক জনই ভারতীয় চরিত্র, সেটা জেনে অবশ্য হতাশ হয়েছিলেন তিনি। তবে সার্বিক ভাবে এই চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞতা তাঁর ‘পথের পাঁচালী’তে কাজে দিয়েছিল।
ফিরে আসা যাক দিওয়ালির বিশ্বায়নের গল্পে। মোটের উপর দিওয়ালি যেন ইতিমধ্যে অনেকটাই দুনিয়াজোড়া উৎসব হয়ে উঠতে পেরেছে। এর অন্যতম কারণ অবশ্যই বিশ্বময় ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের বিপুল উপস্থিতি। তবে শুধুমাত্র উপস্থিতিই নয়, ধারে ও ভারে সংশ্লিষ্ট দেশে তাদের গুরুত্ব বৃদ্ধিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন দেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা উল্কার মতো বৃদ্ধি পেয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন, ইতিমধ্যেই এক জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক এসেছেন ব্রিটেনে। এসেছেন পর পর দু’জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত হোম সেক্রেটারি, প্রীতি পটেল এবং সুয়েলা ব্রেভারম্যান। এই মুহূর্তে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্টেরও শিকড় রয়েছে ভারতে, এবং তিনি হয়তো আমেরিকান প্রেসিডেন্টও হতে পারেন ৫ নভেম্বরের নির্বাচনের ফল বেরোলে। আমেরিকার সার্জেন জেনারেল ডা. বিবেক মূর্তি, হোয়াইট হাউসের প্রাক্তন স্টাফ সেক্রেটারি নীরা ট্যান্ডেম-সহ সে দেশে এবং পৃথিবীর অন্যত্রও রাজনীতির অলিন্দে অতি-ক্ষমতাবান ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা বড় কম নয়। আবার এই মুহূর্তে ব্রিটেনের ধনীতম মানুষটির নাম গোপী হিন্দুজা। ২০১৩-র আগে বহু দিন সে দেশে সম্পদের তালিকায় শীর্ষে ছিলেন লক্ষ্মী মিত্তল। তাই দীপাবলির দীপবর্তিকা প্রজ্জ্বলনের সূত্র ধরে এ সব দেশের রাজনীতিবিদদের হয়তো রাজনৈতিক ভাবে এই অতি-ধনী প্রবাসী ভারতীয়দের ঘনিষ্ঠ হওয়ার একটা প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টাও থাকে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের মধ্যে প্রথম দিওয়ালি উদ্যাপন শুরু করেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। ২০০৩ সালে। যদিও দিওয়ালির ম্যাজিককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম আমেরিকায় ছড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব বারাক ওবামার। প্রথম বার প্রেসিডেন্ট হয়েই ২০০৯ সালে হোয়াইট হাউসে সাড়ম্বরে দিওয়ালির দীপশিখা জ্বালানোর প্রথা চালু করেন তিনি, ২০১৬-তে দিওয়ালি পালন করেন ওভাল অফিসেও। সেই থেকে ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প, জো বাইডেন-সহ সমস্ত প্রেসিডেন্টই সে দেশের ৪৪ লক্ষ ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সমর্থনের আঁচে আমেরিকার রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দকে সেঁকে নেওয়ার প্রচেষ্টা জারি রেখেছেন। দিওয়ালিকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করার জন্য একটা বিলও আনা হয়েছিল আমেরিকান কংগ্রেসে, যা অবশ্য বাস্তবায়িত হয়নি।
২০১০-এর দিওয়ালির দিন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওবামা ছিলেন মুম্বইয়ে। সস্ত্রীক। তাঁর সে দিনের সুখকর অভিজ্ঞতার কথা তিনি পরবর্তী কালে বলেছেন বারংবার। ২০১৬-র দিওয়ালিতে ওভাল অফিসে প্রথম প্রদীপ জ্বালিয়ে তিনি বলেছিলেন, “মিশেল আর আমি কখনওই ভুলব না, ভারতের জনগণ কী ভাবে সহৃদয়তার সঙ্গে দু’হাত বাড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানিয়েছিল। কী ভাবে মুম্বইয়ে আমাদের সঙ্গে তারা নেচেছিল দিওয়ালির দিন।”
২০১৩ থেকে নিউ ইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে হয়ে চলেছে প্রাণবন্ত দিওয়ালির আয়োজন। ২০২৩ থেকে নিউ ইয়র্ক শহরে চালু হল দিওয়ালিতে স্কুল ছুটির নিয়ম। এ নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন শহরের মেয়র এরিক অ্যাডামস। আবার ২০২৩-এর এপ্রিলে পেনসিলভ্যানিয়ার সেনেট সর্বসম্মত ভাবে বিল পাশ করে দিওয়ালিকে ছুটির দিন ঘোষণা করেছে সেই রাজ্যে। ও দিকে আটলান্টিকের অপর পারে, লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে আয়োজিত হয়ে চলেছে বচ্ছরকার প্রাণখোলা দিওয়ালি উৎসবের। এমনই এক দিওয়ালির অনুষ্ঠানে লন্ডনের পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মেয়র সাদিক খান সরাসরি বলিউডের উদ্দেশে অনুরোধ রাখেন ব্রিটেনের পটভূমিতে ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’র একটা রিমেক করার জন্য। সাদিকের কল্পনায় সে সময়কার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক যেন অমর, সাদিক নিজে আকবর, আর রাজা তৃতীয় চার্লস যেন অ্যান্টনি!
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে প্রথম দীপাবলির প্রদীপ কিন্তু জ্বলে ঋষি সুনক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে, ২০০৯-এ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের হাত ধরে। ওই যে বছর ওবামা হোয়াইট হাউসে উদ্যাপন করলেন দিওয়ালি, সেই বছরই। তার পর ব্রিটেনের ৩.১ শতাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দিওয়ালিকে ব্রিটেনের ‘জাতীয় জীবন’-এর অঙ্গ বলে ২০১৬-তে বর্ণনা করলেন সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে।
কানাডার মতো দেশে আবার প্রায় ৫ শতাংশ জনতা ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তাই সে দেশের পটভূমিতেও দিওয়ালি গুরুত্বপূর্ণ হতে বাধ্য। ২০১৫-তে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তরুণ জাস্টিন ট্রুডো অটোয়ার হিন্দু মন্দির আর গুরুদ্বারায় যান, ইন্দো-কানাডিয়ান জনতার সঙ্গে দিওয়ালি কাটাতে। ভোটের বাজারে এই ৪-৫ শতাংশ জনতা অবশ্যই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এবং কোনও কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এ ধরনের পদক্ষেপ সেই প্রথম। কিন্তু ট্রুডো সম্ভবত ভারতীয় সংস্কৃতিকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেননি। ২০১৭-র দিওয়ালিতে কালো শেরওয়ানি পরে প্রদীপ জ্বালানোর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলেন তিনি। সঙ্গে লিখলেন, ‘দিওয়ালি মুবারক’। নেট-নাগরিকরা প্রবল ভাবে ট্রোল করলেন তাঁকে, তিনি ‘হ্যাপি দিওয়ালি’ বলেননি বলে।
আবার ২০২২ থেকে জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফুর্টের পার্লামেন্ট হাউসে উদ্যাপিত হচ্ছে দিওয়ালি, প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাংসদ রাহুল কুমারের উদ্যোগে। ‘সিটি অব লাইট’ প্যারিসেও হয় ‘ফেস্টিভ্যাল অব লাইট’, ঘটা করে যার বর্ণনা দেয় ফরাসি সংবাদপত্রগুলি। দিওয়ালি উপলক্ষে বড় মাপের সরকার-নিয়ন্ত্রিত সঙ্গীত, নৃত্য, ফ্যাশন, খাবারদাবার, হস্তশিল্প এবং বাজির উৎসব অনুষ্ঠিত হয় টরেন্টো, সিডনি কিংবা এডিনবরা সহ পৃথিবীর আরও নানা শহরে। এর পিছনে থাকে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ইচ্ছা, আর থাকে পর্যটনকে উস্কে দেওয়া এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য।
সাধারণ ভাবে অর্থনীতি অবশ্যই যে কোনও উৎসবের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলায় দুর্গাপুজোর অর্থনীতি যেমন সুবিশাল এবং তা বহু মানুষের রুটিরুজির জায়গা আর একই সঙ্গে বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ফুলেফেঁপে ওঠার সুযোগ, সার্বিক ভাবে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দিওয়ালিও ঠিক তা-ই। দিওয়ালির আলোকবর্তিকার সঙ্গে তার এই অর্থনীতির সোনার কাঠির ছোঁয়াও কিন্তু প্রবাহিত হয় দুনিয়া জুড়ে। আমেরিকা বা ব্রিটেনে দিওয়ালির সময়ের খরচ তাই রকেটের মতো বেড়েছে সাম্প্রতিক অতীতে। সে সব দেশে দিওয়ালির উৎসব ক্রমশ জনগণের জীবনযাত্রার মূলধারায় সম্পৃক্ত হয়েছে। ফলে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিও উৎসব উদ্যাপনকারীদের ছুটির খরচের জন্য বরাদ্দ ডলার-পাউন্ড দখলের অভীপ্সায় ঘুঁটি সাজায়। ঠিক যেমন দেখা যায় সে সব দেশের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী উৎসব, যেমন থ্যাঙ্কসগিভিং, হ্যালোউইন কিংবা ক্রিসমাসের ক্ষেত্রে।
উৎসবের ছুটি উদ্যাপন করতে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী বিপুল খরচ করে। উপভোক্তারা ব্যয় করেন উপহার, খাবারদাবার, উৎসব-সজ্জা এবং ফুলের আয়োজনে। নতুন পোশাক কেনা, গৃহস্থালির নতুন সামগ্রী ক্রয় এবং গৃহসজ্জার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয়দের জন্য দিওয়ালি যেন বড়দিনের সমতুল্য। এর সুযোগ নিতে আমেরিকায় প্রধান ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলি দিওয়ালি-কেন্দ্রিক পণ্য— যেমন ঘর সাজানোর সামগ্রী, খাবার, উপহার, গ্রিটিংস কার্ড, মাটির প্রদীপ, মোমবাতি, লন্ঠন, রঙ্গোলি, এমনকি হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিতে ভরিয়ে দেয় তাদের ভান্ডার। সেই সঙ্গে আজকের দিনে দিওয়ালির সময় এ দেশের মতো আমেরিকাতেও ফুলেফেঁপে ওঠে ই-কমার্সের বাজার। এমনিতেই ইন্ডিয়ান-আমেরিকানদের গড় পারিবারিক আয় সে দেশের মানুষদের গড় আয়ের চেয়ে বেশি। তাই উৎসবের সময় তাঁদের খরচ করার ক্ষমতাও থাকে বেশি। একই ভাবে ব্রিটেনেও হাই স্ট্রিটের মতো ব্যবসার প্রধান কেন্দ্রগুলিতে চলে প্রধানত দক্ষিণ এশীয়দের রমরমা। সে দেশের স্টোরগুলিও দিওয়ালির ব্যবসা-উপযোগী সামগ্রীর পসরা সাজায়। খাবারদাবার, পোশাক, ফ্যাশন-সামগ্রী এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের বিক্রি ফুলেফেঁপে ওঠে। আবার বিদেশে শুধু ভারতীয় বংশোদ্ভূতরাই যে দিওয়ালির জন্য কেনাকাটা করেন তাও নয়, এঁদের সঙ্গে নানা ভাবে সম্পর্কিত অন্যরাও তা করেন বইকি। ওই ‘অ্যান্ড জাস্ট লাইক দ্যাট’ টিভি সিরিজ়ের দিওয়ালির এপিসোডে চিত্রিত সারা জেসিকা পার্কার-এর চরিত্রটির মতো অনেকেই দিওয়ালির শপিংয়ে যান, যান আমন্ত্রিত হিসেবে নিজে উৎসবে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি সারতে, সেই সঙ্গে অন্যদের দিওয়ালির উপহার দিতে। দিওয়ালির বাণিজ্যের ক্ষেত্র তাই বিস্তৃত হয় আরও।
সব মিলিয়ে তাই ঘটে যায় দীপাবলির বিশ্বায়ন। রাজনৈতিক প্রয়োজনে এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে আরও দ্রুতলয়ে তাকে করে তোলা হয় বিশ্বজনীন।