জোর যার জাজমেন্ট তার

আমরা সবাই এক-একটি আস্ত সুপ্রিম কোর্ট। রণে-বনে-টেলিভিশনে সর্বত্র পুচ্ছ তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর যত্রতত্র জাজমেন্ট ঝাড়ছি। রায়দান আমাদের জন্মগত অধিকার, সব কাজের পিছনে মারকাটারি যুক্তিজাল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছ্যারছ্যার করে হিসি? সে হল মধ্যবিত্ততার মুখে এক লাথি। ঝকঝকে প্ল্যাটফর্মের উপর থ্যাক করে এক দলা থুতু? কর্পোরেটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

Advertisement

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share:

আমরা সবাই এক-একটি আস্ত সুপ্রিম কোর্ট। রণে-বনে-টেলিভিশনে সর্বত্র পুচ্ছ তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর যত্রতত্র জাজমেন্ট ঝাড়ছি। রায়দান আমাদের জন্মগত অধিকার, সব কাজের পিছনে মারকাটারি যুক্তিজাল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছ্যারছ্যার করে হিসি? সে হল মধ্যবিত্ততার মুখে এক লাথি। ঝকঝকে প্ল্যাটফর্মের উপর থ্যাক করে এক দলা থুতু? কর্পোরেটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বাড়ির দরজায় মধ্যরাতে দলবল নিয়ে কুকর্ম করে এলাম? ব্যাটা দেশবিরোধীর উচিত শিক্ষা হয়েছে। সবই ফাইনাল জাজমেন্ট, এর পরে আর কথা হবে না। দলে যত ভারী, তত জাজমেন্টের জোর। কানহাইয়া কুমারকে কোর্টের গেটে একলা পেলাম, বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটু জাজমেন্ট প্র্যাকটিস করে হাতের সুখ করে ফেললাম। দেশপ্রেমের রেডিমেড যুক্তি হাতের কাছেই। রাজনীতির প্রতিপক্ষ? নেঃ, ছেলেধরা বলে ব্রিজের উপর পিটিয়ে মেরে দিলাম, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ তকমা বাঁ পকেটে হাজির। সবই জাজমেন্টের মহিমা।

Advertisement

তবে এ সব রাজনীতি-ফাজনীতি ফালতু কথা। ও সব তকমা বানানো আমাদের বাঁ হাঁতের খেল। যখন তখন অর্ডার মাফিক বানাইয়া থাকি। ‘দেশবিরোধী’ কিংবা ‘ভণ্ড দেশপ্রেমী’। ‘বাজে মেয়ে’ অথবা ‘বজ্জাত রিগ্রেসিভ’। ঠ্যাঙানোর জন্য যখন যেটা কাজে লাগে আর কী। এ ছাড়াও ‘মানুষের ভাবাবেগে আঘাত’-এর যুক্তি আছে। তাতেও না আঁটলে ‘জনরোষ’।

তবে সবাই জানে ও সব ব্যাক-ক্যালকুলেশন, আসল কথা হল, আমি যাকে বদ মনে করব, তারই হালুয়া টাইট করব। জোর যার জাজমেন্ট তার। কোনও মেয়ে হাপ্প্যান্ট পরে বয়ফ্রেন্ড বাগিয়ে ঘুরছে? আমার মনে হচ্ছে অসভ্যতা, ধরে এনে দুটোকেই লাগাও দুই থাপ্পড়। পকেটমার ধরেছি? আমার মনে হচ্ছে ব্যাটা গণশত্রু, দে শালার হাত-পা পটপট করে ভেঙে। আমার সাধের মোষ চুরি গেছে? ওই ব্যাটা মোবাইল ধরে গপ্পো করছে, চোর-চোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওটাই ক্রিমিনাল, মেরে মুখটা ভেঙে দে তো। সবই ‘জনরোষ’ এর অ্যাকাউন্টে।

Advertisement

হাবভাব দেখলে কোনওটাই ঠিক জনরোষ মনে হয় না? ঠিকই মনে হয়। ‘পাড়ার মোড়ে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? চ, এগরোলটা শেষ করে একটু ড্রাইভার পিটিয়ে আসি, যে লোকটা ধাক্কা খেয়েছে তত ক্ষণ একটু খাবি খেয়ে নিক’, আমরা এ রকম ক্যাজুয়াল মোডেই চলি। নইলে যত রোষই হোক, এ যে কাপালিকদের জমানা নয়, আমার মোষ চুরি গেছে বলে অন্য এক জনকে ধরে নরবলি দেওয়া যায় না, আমরা জানি না নাকি? নাকি এ জানি না, যে, কেউ কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে শুনলেই দঙ্গল বেঁধে তাদের ঘরদোর জ্বালিয়ে দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়?

তবু কেন করি? আরে দাদা, অত ভাবার তো টাইম নেই। সবই অবক্ষয়। এই ইঁদুর দৌড়ে, বেঁচে থাকার সংগ্রামে, ক্ষোভ এ ভাবেই ফুটে বেরোবে। দোষ দিতে হলে সমাজকে দিন, আমাদের নয়, কারণ আমরা হলাম সুপ্রিম কোর্ট, যুক্তি সব সময়েই আমাদের জিভের ডগায়।

bsaikat@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement