Bengalis of Varanasi

ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন বারাণসীর বাঙালিরা

বাবা বিশ্বনাথ, মা অন্নপূর্ণা, দশাশ্বমেধ বা মণিকর্ণিকা থেকে শুরু করে শাড়ি, পেয়ারা, চিনিসহ বারাণসীর বহু কিছু মুগ্ধ করেছিল বাঙালিকে।

Advertisement

অরিন্দম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৪ ০৭:২৩
Share:

ন্য বারাণসী, তুমি মানুষের আত্মার আরাম, সকল অশুভ চিহ্ন লোকের হৃদয় থেকে মুছে দিতে পারো তুমি, সব বিপর্যয়ও রুখে দিতে পার...” ফারসি ভাষায় বারাণসী-বন্দনা করতে গিয়ে ১৮২৬-২৭’এ মির্জা গালিব এই কথাই লিখেছিলেন ‘চিরাগ-এ দ্যয়র’ (দেবালয়ের চিরাগ)-এ। আর আঠারো শতকে রায়গুণাকর লিখলেন— “কাশীতে মরিলে জীব/ রামনাম দিয়া শিব/ কত কষ্টে মোক্ষ দেন শেষে।/ এখানে মরিলে যেই/ সদ্য মুক্ত হবে সেই/ না ঠেকিতে আর কোন ক্লেশে।” পৃথক প্রান্তর, পৃথক ভাষার, পৃথক ধর্মের দুটি মানুষ। কিন্তু লেখার নির্যাসে কত সাদৃশ্য!

Advertisement

আঠারো শতকে হালিশহরের সাধক কবি রামপ্রসাদও তো লিখলেন একই কথা— “কাশীতে মোলেই মুক্তি, এ বটে শিবের উক্তি।” বা বিজয়রাম সেন লিখলেন ‘তীর্থ-মঙ্গল’-এ— “কাশী মৈলে মুক্তিপদ অবশ্য হইবে॥/ পথে ঘাটে হাটে মাঠে জেখানে সেখানে।” কাশী মানেই মুক্তি, এ কথা চাউর হয়েছে অনেক কাল। ‘মহাস্থবির জাতক’-এ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী লিখেছিলেন, “প্রতি সকালে বিধবা বঙ্গবালারা গঙ্গাতীরে কপালে হাত ঠেকিয়ে কী চান? তাঁরা তো কাশী এসেইছিলেন মরবেন বলে। কারণ এখানে মলে আর জন্মাতে হয় না, ওই নরকের জীবনে বিতৃষ্ণ হয়ে আর জন্মাতে চান না। তার জন্যও কাশীবাস। আসলে কাশী যেন এক কালে বাঙালির শেষ আশ্রয়।”

গালিব থেকে রামপ্রসাদ— সবাই একই বার্তা দিচ্ছেন। গালিব তো এ কথাও লিখেছিলেন, যে বান্দা কাশীতে দেহত্যাগ করে, বিশ্বাসীরা মানে, মোক্ষলাভও হয় তাঁর, আত্মা মুক্তি পায় দেহ থেকে, জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে ছুটি মেলে কাশী-মহিমায়। উনিশ শতকের গোড়ায় খবরের কাগজেও কাশীর মাহাত্ম্য, “কাশীতে ত্রিলোকের তাবৎ তীর্থ সম্পূর্ণরূপে বিরাজমান অতএব কাশীর সদৃশ স্থান স্বর্গ, মর্ত্ত্য, পাতালে নাই— তথায় সৎকর্ম্ম করিলে কীদৃশ ফল জন্মে তাহা ভগবান শিবই কহিতে পারেন নচেৎ সাধ্য কার।” এই আকর্ষণেই তো আবহমান কাল ধরে বাঙালির কাশীযাত্রা আর কাশীবাস।

Advertisement

আঠারো শতকেই আস্ত এক বাঙালিটোলার অস্তিত্ব সেখানে। বিজয়রাম সেন, ভূকৈলাসের রাজা জয়নারায়ণ ঘোষালের পিতৃদেব কৃষ্ণচন্দ্রের সফরসঙ্গী হয়ে তীর্থযাত্রায় গিয়েছিলেন। তাঁরই আদেশে লেখা ‘তীর্থ-মঙ্গল’-এ সেন মহাশয় কাশীর বিবরণ দিতে গিয়ে লিখছেন, “যাত্রী লয়্যা গেল ঘোষাল বাঙ্গালীটোলারে॥/ অপূর্ব্ব বাঙ্গালী স্থান দেখি মহাশয়।” রচনাকাল ১১৭৭ বঙ্গাব্দ, মানে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ। কৃষ্ণচন্দ্র-তনয় জয়নারায়ণ ঘোষালের ‘কাশী-পরিক্রমা’তেও আঠারো শতকের শেষে বাঙালিটোলায় জাঁকজমক করে দুর্গোৎসব, কালীপুজোর বর্ণনা আছে— “বাঙ্গালী-টোলাতে দুর্গোৎসবের শোভন।/ বাঙ্গালী দেশস্থ মত সর্ব্ব প্রকরণ॥” বা “বাঙালী-টোলাতে হয় শ্যামাপূজামাত্র।”

আসলে ছাপাখানা আসার আগে ওই পুঁথিপত্তর দেখে নাটমন্দিরে বসে কথকঠাকুর যখন কাশীমাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করতেন, তখন মুগ্ধ হয়ে মানুষ বাবা বিশ্বনাথ, মা অন্নপূর্ণা, দশাশ্বমেধ বা মণিকর্ণিকা ঘাটের কথা শুনতেন। কাশীর অনেক কিছু বাঙালির মনে জায়গা করে নিয়েছিল। আঠারো শতকে রামপ্রসাদ না হলে কেন আর কাশীর চিনির কথা বলতে যাবেন— “মন যদি মোর ভিয়ান করিস/ ওরে কালীনাম কাশীর চিনি।” উনিশ শতকের শেষে হালকা মজলিশি চালে লেখা কাল্পনিক ভ্রমণকাহিনি, যাকে ইতিহাসের আকর বললেও কম বলা হবে, সেই ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ দুর্গাচরণ রায় কাশীর বিখ্যাত জিনিসের তালিকায় রাখলেন চিনি, পেয়ারা, বেনারসি শাড়ি। খোদ বিদ্যাসাগর মশাই এক রাতে কাশীতে থাকাকালীন বায়না জুড়েছিলেন, “কাশীতে এসে চুড়ী না নিয়ে ফিরে যাব কি করে?” ‘রসরাজের রসকথন’-এ অমৃতলাল বসু শুনিয়েছেন সে গল্প।

ফি-বছর নিয়ম করে অনেকেই বেরোতেন কাশীর উদ্দেশে। বিশেষত রেল চালু হওয়ার পরে। ‘হারানো খাতা’-তে রমাপদ চৌধুরীর লেখায় সে কথা আছে। অনেকে কাশীতে বাড়ি কিনে রাখতেন। ফি-বছর গিয়ে থাকার জন্য ‘বড়োবাড়ির ছোটো স্মৃতি’-তে স্মৃতি মিত্র কাশী, পুরীতে তাঁদের বাসভবন থাকার উল্লেখ করেছেন। কাশীকে ঘিরে বাঙালির কত আবেগ! বসবাস তো অনেক কাল আগেই শুরু। বিজয়রাম সেন কাশীতে ৭০০ বাঙালি ব্রাহ্মণের উল্লেখ করেছেন। এঁরা সব ‘ন্যায়লঙ্কার’ বা ‘তর্কালঙ্কার’। ১৮৩০-এ কাশীতে ৩০০০ বাঙালি ব্রাহ্মণের বসবাসের উল্লেখ আছে। অন্যরাও ছিলেন।

সরকারি ভাবে জনগণনা তখনও চালু হয়নি। ডিরোজিয়োর শিষ্য ভোলানাথ চন্দ্র ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন সে সময়ে। কাশীনিবাসী বঙ্গসন্তানের সংখ্যা লিখেছিলেন ১০,০০০। হয়তো প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়েও বেশি হত। আসলে প্রাক্‌-চৈতন্যযুগ থেকেই সূচনা। ‘বঙ্গের বাহিরে বাঙ্গালী’ রচয়িতা জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস লিখেছেন, নবদ্বীপের রাজনৈতিক গোলযোগে, সুপ্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক বাসুদেব সার্বভৌমের পিতৃদেব মহেশ্বর কাশী চলে যান, সে কথা জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ আছে।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বহু কাশীবাসী বাঙালির নাম করেছেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার ২৬ খণ্ডে যে ‘বংশ-পরিচয়’ লিখেছিলেন তা ঘাঁটলে কত জমিদার, বিশিষ্ট মানুষ যে শেষ জীবনে কাশীকে স্থায়ী নিবাস করেছিলেন, তা স্পষ্ট হয়। লক্ষ্য ছিল সেই ‘কাশীলাভ’ বা ‘কাশীপ্রাপ্তি’। অনেকে গিয়ে রীতিমতো ডাক্তারি-ওকালতিও শুরু করেছিলেন। মনোমোহন বসু কাশী গেলে, তাঁর ঠিকানা ছিল হোমিয়োপ্যাথ চিকিৎসক, ভগিনীপতি শ্রীকৃষ্ণ দত্তের দেবনাথপুরার বাড়ি। অমৃতলাল বসুও কাশী গেলে থাকতেন আর এক হোমিয়োপ্যাথ চিকিৎসক লোকনাথ মিত্রের বাড়ি। লোকনাথবাবুই কাশীর প্রথম হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসক। কাশীর তৎকালীন জেলা জজ ব্যাক্স আয়রনসাইড তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। তাঁর স্ত্রী লোকনাথের চিকিৎসায় আরোগ্যলাভ করেন। রসরাজ লিখছেন: “ইংরাজ জজের জায়া/ ছাড়িতে ছাড়িতে কায়া/ তব চিকিৎসায় পায় প্রাণ পুনরায়/ পুরস্কার দিতে এর/ আয়রণ্‌-সাইডের/ কোমল কৃতজ্ঞ মন পুলকেতে চায়/ মহাপ্রাণ লোকনাথ/ নিজে না পাতিয়া হাত/ দীন দুঃখী তরে চায় চিকিৎসা-আলয়/ হানিমান্‌ জয় জয়/ ভারতে কাশীতে হয়/ হোমিওপ্যাথি হস্পিটাল্‌ প্রথমে উদয়॥”

মনোমোহন বসুর ডায়েরিতে আছে চিকিৎসক উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আশ্রমবাসী মুর্শিদাবাদের উকিল শ্যামচরণবাবু বা সীতানাথ পালধীর নাম। যে সীতানাথের বাড়িতে ১৮৫০-৫১’তে তাঁর সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মোলাকাত হয়। আর নবীন সেনের সঙ্গে মোলাকাত হয় রসরাজের। লিখছেন, “কলকাতার বর্তমান রঙ্গভূমির রসিক চূড়ামণি এবং প্রহসনের খনি শ্রীযুক্ত অমৃতলাল বসুর সঙ্গে সেইবার কাশীতে সাক্ষাৎ হয়।” অর্থাৎ বাঙালির যেন আড্ডার জায়গা হয়ে গেল কাশী। বিশ শতকের সূচনায় এ সব দেখেই বোধহয় নন্দী শর্ম্মা লিখেছিলেন, “ভারতের সকল জাতই কাশীধামে আসে/ সবাই কিন্তু হার মেনেছে বাঙ্গালীর পাশে।”

কাশীবাসী প্রবাসী বাঙালি অমিতাভ ভট্টাচার্যের (স্থানীয়দের বলাইমামা) মতে কাশীতে বাঙালি আসেনি কখনও, এসেছিল একটা দর্শন। হয় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার, আর না-হয় সংঘর্ষ করার জন্য। দুটোই হয়েছে। বাঙালিরা কবে থেকে কাশীতে আসা শুরু করেন, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট সন-তারিখ বলা সম্ভব নয়। পলাশির পর যাঁরা এলেন, তাঁদের আগমন প্রধানত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে। এর পরে দলে দলে বাঙালিরা এসেছিলেন। সে তো অনেকটাই কর্মসূত্রে, মুখ্যত স্কুল-কলেজে। সে আবার বাঙালির ভারতজয়ের গল্পের অংশ। তবে এঁরা এলেন বলেই ১৮৯৮-তে বাঙালি ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য তৈরি হল ‘অ্যাংলো বেঙ্গলি স্কুল’। আর একটু পরে ‘বাঙ্গালীটোলা ইন্টার কলেজ’। ‘কাশীবার্ত্তা প্রকাশিকা’, ‘উত্তরা’-র মতো বাংলা খবরের কাগজ, সাময়িকপত্রও বেরোতে দেরি হয়নি। যদুনাথ সর্বাধিকারীর লেখাতেও কাশীবাসী বেশ কয়েক জন বাঙালির কথা আছে: খালেশপুরাতে তারাচাঁদ দে-র বাড়ি, শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। এই বাঙালিটোলাতেই বসে ১৩০৩ বঙ্গাব্দে ‘কাশী দর্শন’ লিখেছিলেন শিবপ্রসন্ন মৈত্রেয় বিদ্যাভূষণ। বাংলায় গীতার শঙ্করভাষ্যের লেখক প্রমথনাথ তর্কভূষণ থাকতেন এই বাঙালিটোলাতেই। থাকতেন ন্যায়শাস্ত্রের পণ্ডিত পঞ্চানন তর্করত্ন, ফণীভূষণ তর্কবাগীশ। জয়নারায়ণ ঘোষালের বাড়ি ছিল গোধূলিয়া চৌমাথার দক্ষিণে জঙ্গমবাড়ি রোডে। কোচবিহারের মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণের আশ্রয়স্থল ছিল সোনাপুরাতে। বেনারসের গলির কথা লিখতে গিয়ে সম্প্রতি শান্তা শ্রীমানী এমন অনেকের সন্ধান দিয়েছেন।

এ তো কাশীবাসী বাঙালি পুরুষের গল্প। মহিলাদের সংখ্যা তাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। বৈধব্যজীবনের শেষ দিনগুলো বাবা বিশ্বনাথের কাছেই কাটাতে গিয়েছিলেন। লিখিত সূত্রে বড় ঘরের মেয়েদের যা একটু-আধটু খবর পাওয়া যায়। ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’-এ সৌরীন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী লিখেছেন, “নারায়ণী দেবী ১২৪৬ সনের ২৪শে বৈশাখ কাশীধামে ৮৬ বৎসর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করিয়া পরমপদ লাভ করেন। কাশীধামে তিনি নয় বৎসরকাল জীবিতা ছিলেন।” ওই পরমপদ লাভের আশায় এক কাঁড়ি পাপ করে কাশী গিয়ে কিছু ভাল কাজ করে বিখ্যাত হন রানি শ্যামাসুন্দরী। স্বদেশে বিষয়সম্পত্তি দখলের বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন, মামলা চলে দীর্ঘকাল। শেষে ঠিক হয় শ্যামাসুন্দরী বছরে ১৪,০০০ টাকা পাবেন। সে টাকাতেই তিনি দীর্ঘকাল কাশীতে বাস করে কিছু দান-খয়রাতও করেন। যে কারণে তিনি সেখানে ‘গোবরডাঙার রাণী’ নামে বিখ্যাত হন। ও দিকে চন্দননগরের সুপ্রসিদ্ধ নৃত্যগোপাল শেঠের দ্বিতীয়া স্ত্রী কৃষ্ণভাবিণী দেবী স্বামী গত হলে জীবনের শেষ দশ-বারো বছর সামান্য বেশে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ান। মনের সাধ ছিল কাশীলাভ। ছেলেরা বাড়িও কিনে দেন। ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের ৬ ফাল্গুন সামান্য রোগভোগের পর সেখানেই তাঁর কাশীলাভ। কাশী যে আঠারো-উনিশ শতকের বাংলাদেশের কত জমিদারগিন্নির শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার হিসাব নেই।

তবে সব মহিলাই যে কাশীতে প্রাণের আরাম খুঁজে পেয়েছিলেন, তেমনটা নয়। সুপ্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম শিবচন্দ্র দেবের মেয়ে রমাসুন্দরী ঘোষ যে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-য় ১৮৬৪ তে ‘কাশী-দর্শন’ লিখলেন, সেখানে তো উল্টো ছবি: “দুর্গন্ধ আইল যবে, নাসিকা ভিতর/ তখন হইল মম, যে রূপ অন্তর/ লিখিব কি তাহা ওহে, করি সবিস্তার/ তৎপর যাইনু যবে, বাসার ভিতর/ গ্রীষ্মতে হইল মম, দেহ জর-জর/ ভালো বায়ু যাইবারে, নাহি আছে দ্বার/ সে সকল গৃহ যেন, হয় কারাগার।” এখানেই শেষ নয়। বিশ্বেশ্বর শিব দেখে তাঁর মনে হল ‘কেবল প্রস্তর’, কেবল ‘তাহাতে আছে কাপট্য আচার।’ ব্রাহ্ম শিবচন্দ্রের মেয়ের কাছে এ হয়তো প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু এ ভাবনাকে চাপা দিয়ে ফেলেছিল আম-বাঙালির কাশী দর্শনের অভিলাষ।

ধর্মে বিশ্বাসী হোন বা অবিশ্বাসী, বড় ঘরের মহিলাদের ছাপিয়ে গেলেন কিন্তু আর এক দল। জরাসন্ধের ‘মানসকন্যা’র পুসী-র মতো মেয়েরা। সংসারে তার মতো ‘ফালতু’দের তো একটাই ঠিকানা— কাশী। তথাকথিত ভদ্র পরিবারের বিধবাও তো বহু সময়ে এই উটকোদের দলে পড়েছিলেন। ‘পিঞ্জরে বসিয়া’তে কল্যাণী দত্ত তাঁর মেজপিসিমা শিবকালীর ছোট জা ইন্দুমতীর কথা লিখেছেন। ভাশুর চাইতেন না তিনি শ্বশুরবাড়ি থাকুন। সবাই একজোট হয়ে কাশী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আর তাঁর জন্য মাসোহারা ঠিক হল একশো টাকা। ছ’মাস যেতে না যেতেই মাসোহারা কমতে থাকে। একশো টাকা কমে দশ টাকায় দাঁড়াল। বড় ঘর ছেড়ে এক টাকার ভাড়ার বাড়িতে ঠাঁই হল। চব্বিশ ঘণ্টা তসরের কাপড় পরে, কমণ্ডলু হাতে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে ঘোরা সেই ইন্দুমতী কাশীর ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে মরলেন শেষকালে। কল্যাণী দত্ত লিখছেন, আট ভাশুরপো মিলে পিসিমাকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। শেষে পাগল হয়ে ঠাঁই হয় মিশনের সেবাশ্রমে। পিসিমার খবর পেয়ে এক দিন গিয়ে দেখলেন, সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ইন্দুমতী ‘মুখপোড়া ভগবান’কে গালমন্দ করছেন। দেশ থেকে পাঠানো মাসোহারা কমে এলে অনেকে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করত, কেউ বা আত্মঘাতী হত। নিমাই ভট্টাচার্যর ‘গোধুলিয়া’ মনে পড়ে? গল্পের নায়ক প্রদীপ কাশীতে বিধবা পিসির বাড়িতে থাকার সময় মণিপিসি, সুধাপিসি, সারদাপিসির কথা শুনতে গিয়ে জানল, দু’পাঁচ-দশ টাকা মানি অর্ডারে কোনও রকমে এই বিধবারা বেঁচে আছেন। বিধবারা অনেক কাল ধরে এ ভাবেই বাবা বিশ্বনাথ আর মা অন্নপূর্ণার ভরসায় দিন গুজরান করতেন।

রেল হওয়ার পরে কাশীবাসী বাঙালি বিধবাদের সংখ্যা বেড়েছিল। ঐশিকা চক্রবর্তী ‘উইডোজ় অব কলোনিয়াল বেঙ্গল’-এ বলছেন, কলকাতা থেকে ট্রেনে করে পৌঁছোনো সব বয়সের পরিবার-পরিত্যক্ত বাঙালি হিন্দু বিধবাদের আশ্রয় দিল কাশী। ১৮৯১-তে জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ হিন্দু বিধবা। বাঙালি পরিবারের বিধবারা যখন অক্ষমতার কারণে আর কঠোর পরিশ্রম করতে পারতেন না, বা কামানলের বলি হতেন, তখন তাঁদের ঠাঁই হত বেনারস বা বৃন্দাবনে। বেনারসে কুড়ি থেকে ষাট বছর বয়সি বিধবাদের সংখ্যা ইউনাইটেড প্রভিন্সেস-এর (তখনকার উত্তরপ্রদেশ) ২৩টি প্রধান শহরকে ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে বিধবা বঙ্গবালার সংখ্যা অনেকটাই ছিল সন্দেহ নেই। ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ দুর্গাচরণ রায় লিখেছেন, দেবতারা এক দিন ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছলেন কাশীতে। দেখছেন, কয়েকটা বাচ্চা বাবার কথা জিজ্ঞেস করছে, মা-কে। পরিচয় জানতে চাইলে ইন্দ্রদেব বরুণদেবকে উত্তর দিচ্ছেন, এদের এই অবস্থার কারণ— এরা বিয়ের দু’-এক বছরের মধ্যেই বিধবা হয়। বঙ্গদেশে যে হেতু তখনও বিধবাবিবাহ চালু হয়নি, তাই এরা স্বামী-সহবাসের সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে “সংযম-শিক্ষার অভাবে রিপুদমনে অসমর্থতা হেতু পরপুরুষ সহবাসে গর্ভবতী হয়।” এদের মা-বাবা লোক সমাজের ভয়ে এবং ভ্রূণহত্যা মহাপাপ মনে করে তীর্থযাত্রার নামে তাদের বারাণসী তীর্থে ‘বনবাস দিয়া গিয়াছেন’। কারও বাড়ি থেকে কখন কখনও কিছু খরচ আসে, অনেকের তাও জোটে না। আস্তে আস্তে এই কাশী সব ‘পাপীদের’ আখড়াতে পরিণত হতে লাগল। অনেকেই পাপ করলেন। প্রায়শ্চিত্ত করবেন কোথায়? জায়গা একটাই— কাশী।

কেমন ছিল সেই পাপের ধরন! বরুণদেবের মুখে শোনা একটি ঘটনা শোনা যাক। এক যুবতী অল্পবয়সে বিধবা হয়ে ভাশুরের যত্নে শ্বশুরবাড়িতে বাস করত। ভাশুরটি দুশ্চরিত্র। “পাপাত্মার ভাদ্রবধূর উপর নজর পড়ে ও উভয়ে পাপ-পঙ্কে নিমগ্ন হয়।” এই কথা গ্রামে রাষ্ট্র হল। আত্মীয়-পরিজনের কাছে মুখ দেখাতে না পেরে তারা দু’জনে ঠিক করল, “আমরা যে পাপে লিপ্ত হইয়াছি ইহার প্রায়শ্চিত্ত নাই। এক মাত্র উপায় আছে, কাশী গিয়ে বাস করা।” কারণ শিবের প্রতিজ্ঞা আছে যে, কোনও পাপীও যদি কাশীতে বাস করে প্রাণ ত্যাগ করে, ‘তাহার আর শমনভয়’ থাকে না। ভাশুর-ভাদ্রবৌ তাদের নিজেদের বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করে কাশীতে এসে বাস করছে।

এই ভাশুর-শ্বশুরদের হাতে সব খুইয়ে কলঙ্কের দায়ে কাশীবাসী হওয়া মেয়েদের উদাহরণ কম ছিল না। ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’-য় এই কাশীবাসী বাঙালিনিদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, “জাতিতে জাতিতে, জাতিতে বিজাতিতে, সম্পর্কে সম্পর্কে, সম্পর্কে নিঃসম্পর্কে, বাঙ্গালী নর-নারী পাপলিপ্ত হোলেই নিরাপদের আশাতে কাশীতে পালিয়ে আসে; মাতুলের ঔরসে ভগিনী-পুত্রী, পিতৃব্যের ঔরসে ভ্রাতৃকুমারী, ভ্রাতার ঔরসে বিমাতৃকুমারী, ভাগিনেয়ের ঔরসে মাতুলানী, জামাতার ঔরসে শ্বশ্রূঠাকরাণী, শ্বশুরের ঔরসে যুবতী পুত্রবধূ গর্ভবতী হোলেই কাশীধামে পালিয়ে আসে!” বিধবাদের এই আসার হিড়িক দেখে ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ নারায়ণ তো সদাশিবকে বলেই বসলেন, “কাশীতেই তুলসীদাসের আশ্রম এবং রামানন্দের মঠ ছিল। এখন সেই কাশীতে আছে কি না কতকগুলো বেশ্যা এবং লম্পট। এখন সেই কাশী কিনা বাঙ্গালী বালবিধবাদিগের আণ্ডামান।”

আস্তে আস্তে এ ভাবেই যেন কাশী ‘খারাপ মেয়েদের’ও আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করল। কাশী বা বারাণসী সম্পর্কে তো প্রবাদও তৈরি হয়েছিল, “রাঁড়, ষাঁড়, সিঁড়ি, সন্ন্যাসী/ ইনহে লে কর বারাণসী।” ৩০ অক্টোবর ১৮২২-এর ‘সমাচার দর্পণ’ কাশীর তিন আশ্চর্য বিষয় বলে চিহ্নিত করেছিল, রাঁড়, ষাঁড়, সিঁড়ি-কে। উনিশ শতকের অন্যতম বিখ্যাত পত্রিকা ‘সোমপ্রকাশ’ (২৮ অক্টোবর ১৮৬৭) লিখছে, “কাশীতে যে সকল অর্ধবয়স্কা বিধবা অন্নপূর্ণার বাটীতে তদ্গতচিত্ত হইয়া বিল্বপত্রের অঞ্জলি প্রদান করেন, যে স্ত্রীলোকেরা মণিকর্ণিকার ঘাট হইতে কুম্ভ পূর্ণ করিয়া বারি আনয়ন করেন, এবং যে প্রফুল্লনয়না সধবাগুলি হাস্যমুখে ভোজনার্থিনী হইয়া দণ্ডায়মান থাকেন, তাঁহারা প্রায় সকলেই কামদেবের প্রধান ভক্ত। এই ললনাগণ প্রায় কোন পুরুষেরই প্রার্থনা অগ্রাহ্য করেন না।”

এঁদের দূরে রাখতেই বোধ হয় কাশীর বীরেশ্বর পাঁড়ে ধর্মশালার নিয়মাবলিতে বড় বড় করে লেখা হয়েছিল, “পতিতা, ভ্রষ্ট ও রক্ষিতা জাতীয়া অবাঞ্ছিত মহিলাসহ ধর্মশালায় প্রবেশ নিষিদ্ধ।” কাগজের প্রচারে সত্যি তো কিছু ছিলই।

সোনাগাছির গোলকমণি তাঁর পালিতা কন্যা শিবসুন্দরীকে নিয়ে গয়া-কাশী-বৃন্দাবন গেলেন রীতিমতো উইল করে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘সেই সময়’-এ বিধবা বিন্দুবাসিনীর কথা বলতে গিয়ে মনসারামকে দিয়ে কি বলালেন?— কাশীতে মেয়ে বিক্রির ব্যবসার ধুম চলছে। আপনারা বাঙালিরা বিধবাদের এই কাশীধামে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন, ব্যস। তার মধ্যে কতজন যে রেন্ডিপাড়ায় যায় আর কতজন বিক্রি হয়ে চালান হয়ে যায় তার খবর কে রাখে।

‘মনোমোহন বসুর অপ্রকাশিত ডায়েরি’-তে কাশীবাসী পিসিশাশুড়ির কথা বলতে গিয়ে লেখক বলছেন, পাতালেশ্বর শিব দেখে রাণামহলে গেলেন। সেখানে তাঁর পিসিশাশুড়ি বাস করতেন। বামুন কায়েত মিলেমিশে এক। প্রত্যেকে নিজেদের খরচ নিজেরা করেন, নিজেরা রান্না করেন, তবে তাঁর “পিস্‌শাশুড়ীর ন্যায় অসমর্থা স্থবিরারা ব্রাহ্মণ কন্যার পাকে ভোজন ও সমর্থাদিগের শ্রমসাহায্য গ্রহণে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে সক্ষম হন।” এই পাতালেশ্বর পাড়ায় এত বিধবা থাকতেন যে, কল্যাণী দত্ত একটা বাড়ির নামই দেন ‘বিধবা মহল’। কল্যাণী দত্তের বন্ধু, সিটি কলেজের উমা মৈত্রের কাকিমা সুশীলা দেবী ছিলেন কাশীবাসিনী। থাকতেন পাতালেশ্বর পাড়াতেই তিনতলা এক বাড়িতে। যার ঠিকানা ৩২/৮৮ পাতালেশ্বর। ওই বাড়িতেই নানা দেশ থেকে আসা বিধবা থাকায় বাড়ির নাম দেন ‘বিধবা মহল।’

সহায় সম্বলহীন কাশীবাসিনী বিধবাদের কথা তো ‘তীর্থ-মঙ্গল’-এই আছে: “কাশীর মধ্যেতে আছেন বিধবা জতেক/ সবাকারে দিলা কর্ত্তা তঙ্কা এক এক/ শূদ্রের বিধবা পাইল একৈক আধুলী/ দিগম্বরে কিছু দিলা প্রিয়বাক্য বলি।” আর যারা হয়তো সধবা হয়েও বাঁচবার জন্য কাশী পালিয়েছিলেন, কাশীতে সেই সব বঙ্গললনার ভিড় থেকে নন্দী শর্মা তো বুঝতেই পারেননি তিনি কোথায় আছেন। ‘কাশীর কিঞ্চিৎ’-এ লিখলেন, “বাংলা কি বিদেশে আছি— কিছু বুঝ্‌তে নারি/ যে দিকে চাই—বাংলা দেশের মেয়েমদ্দের সারি।/ দোকানে চাই— নেড়ির মা ভেন্‌খোলা খুলচে, / পাশেতেই পুঁটির পিসী—চরকা নে ব’সেছে; / পাট কাট্‌চে মেনির মাসী—পান বেচ্‌চে পাঁচি, / চুণ বেচ্‌চে চাঁপাদাসী, কামার গিন্নী-কাঁচি; / হোটেল খুলে বসে আছে হরিশেঠের শালী,/ উল্টোডিঙ্গির ডোমের মেয়ে সাজায় পূজোর ডালি; ... মনোরমা মুড়্‌কির মোয়া ব্যাচে বোসে হাটে! / বিলিসী, সারদা, ক্ষ্যান্তো, কাঞ্চন, গোলাপী— / বড় বাড়ির দাসী এরা –বড়ই আলাপী।/ নীরদা, ক্ষীরদা, শ্যামা—লক্ষী, হরিমতী— / বারাণসীর গেজেট এরা—সর্ব্বত্রই গতি।”

আলোকপ্রাপ্ত, নবজাগরণে উদ্ভাসিত বাংলায় হয়তো এঁদের ঠাঁই হয়নি। ‘নিষ্ঠায় অভাব’ ঘটা বিধবা বা বড় ঘরেও উটকো বলে গণ্য বিধবা আর এই সব ‘মেনির মাসী’ বা ‘পুঁটির পিসী’দের আশ্রয় দিলেন বাবা বিশ্বনাথ, মা অন্নপূর্ণা। অথচ সম্মানের সঙ্গে কত মহিলা যে কাশী আলো করে ছিলেন, সে খবর তো সামনে আসেনি। রাজনারায়ণ বসু হটী বিদ্যালঙ্কার নামে যে বাঙালিনির কথা লিখেছিলেন, বর্ধমানের সেই মেয়ে তো বিধবা অবস্থায় বৃদ্ধ বয়সে কাশী এসে টোল স্থাপন করে সভায় ন্যায়শাস্ত্রের বিচার করতেন এবং ‘পুরুষ ভট্টাচার্যদিগের ন্যায় বিদায় লইতেন’। পুটিয়ার রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়ের স্ত্রী রানি শরৎসুন্দরী ধর্মীয় ক্ষেত্রে কিছু দান করেছিলেন। যখন তাঁর বয়স চোদ্দো, জীবনে নেমে আসে বৈধব্যের যন্ত্রণা। পারিবারিক ঝড়ে ক্লান্ত রানি শেষ জীবনে চলে যান কাশী। কাশী, বৃন্দাবনের মন্দিরে ও অন্নসত্রের উন্নতির জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। তাঁর জীবনীকার গিরিশচন্দ্র লাহিড়ী লিখেছেন, “তাঁহাকে মণিকর্ণিকার ঘাটে লইবার সময়ে দুই ধারে ‘দয়াময়ী মাই যাতা হ্যায়, দরিদ্রকা কা গতি হোগা’ বলিয়া সহস্র নরনারী রোদন করিতে করিতে শবানুগমন করিয়াছিল।” অন্য দিকে স্বর্ণময়ীর দান ছিল স্কুলগুলোয়। বাঙালিটোলা বালক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিটিতে ২০ টাকা করে দানও করেছিলেন। আর এক বাঙালি রানি, দিনাজপুরের শ্যামমোহিনী বাঙালিটোলা বালক বিদ্যালয়ে ৫০ টাকা দিয়েছিলেন। এঁদের আমরা আর খুঁজলাম কোথায়!

তবে বিরূপ প্রচার মানুষকে সামান্য পরিমাণেও ‘কাশীবিমুখ’ করতে পারেনি। বা এক শ্রেণির ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালির কাছে নোংরা, জঘন্য শহর বলে চিহ্নিত হলেও মানুষের আসায় ভাটা পড়েনি। অনেকেই এসেছিলেন, আবার ফিরে আসবেন বলে ঠিকও করে নিয়েছিলেন। হয়তো এক অদ্ভুত আকর্ষণের জন্য তাঁরা ফিরে আসতে চাইতেন। ঠিক নিমাই ভট্টাচার্যের নায়ক ‘গোধুলিয়া’র প্রদীপের মতো। কেমন ছিল সে ইচ্ছে? এক দিন কাশী শহর সম্পর্কে এক আলোচনায় ভানুদা প্রদীপকে বলেছিলেন, “ভায়া তবু এই নোংরা জঘন্য শহরটায় এমন কিছু আছে যা চট করে ছেড়ে যাওয়া যায় না। ...। সত্যি এ এক বিচিত্র শহর। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে নিত্য আসছে। কেউ বাবা বিশ্বনাথের চরণে মাথা রাখার জন্য, আবার কেউ বা আসছেন সারা জীবনের সমস্ত সঞ্চয় বাঈজীকে বিলিয়ে দিতে। বাবা বিশ্বনাথ বা বাঈজীদের জন্য আমি আসব না। কিসের জন্য আসব আমি জানি না, তবে আসতেই হবে। না এসে পারব না। যে মৃত্যুকে আমরা সবাই ভয় পাই, সেই মৃত্যুকে বরণ করার জন্য পৃথিবীর আর কোন্‌শহরে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে যায় বলতে পারো?”

সে বাঙালিটোলা আর নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী বাঙালি জানান, আগে ছিল বাঙালিটোলা। তার পর হল আহিরটোলা আর ‘এখন’ হয়ে গেছে ‘ম্যাড্রাসিটোলা’। ‘মাদ্রাজি’রা চড়া দামে বাঙালিটোলার পুরনো বাড়িগুলো সব কিনে নিচ্ছেন, যেগুলো দেখাশোনার কেউ নেই। এগুলো কিনে নিজেদের মতো করে রিমডেলিং করে হোটেল বা গেস্ট হাউস বানিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। আর এই গেস্ট হাউসের সংখ্যাটা বাড়তে দেখা যাচ্ছে ২০১৪-র পর। এ ভাবেই আস্তে আস্তে ‘বিকাশ’ ঘটছে, ঠিক যেমন বিশ্বনাথ মন্দিরের হল। চিন্তামণি মুখোপাধ্যায়, সারদাচরণ চক্রবর্তী প্রমুখ ছিলেন প্রাতঃস্মরণীয়। বাঙালিটোলা অ্যাংলো-বেঙ্গলি স্কুলের প্রাণপুরুষ ছিলেন প্রথম জন। ১৯১১-র নভেম্বরে তাঁদের সমিতির নিবন্ধীকরণই হয়ে গিয়েছিল। ১৯২২-এর সরকারি দস্তাবেজে বাঙালিটোলা অ্যাসোসিয়েশন এর নাম দেখেছি। কাশীনরেশ ভেলুপুরা মহল্লাতে ৭.৮৫ একর জমির স্বত্ব ছেড়ে দেন স্কুলের কাজে। ১৯১৯-এর রেল, বারাণসী স্টেশনে আগত তীর্থযাত্রীদের ওপর ‘ভিজিটর’স ট্যাক্স’ চাপালে জোরালো প্রতিবাদ করেছিল সমিতি। তাদের সে দাপট আজ ইতিহাস। তবু বাঙালিটোলা ইন্টার কলেজে ফি-বছর পুজোর আগে থিয়েটারের মহড়া হয়। আজও দেবনাথপুরা, পাণ্ডে হাভেলির বাঙালিদের বাড়িগুলো ছুটির দিন আড্ডায় মাতে। তবে সে রমরমা নেই। জঙ্গমবাড়ির বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনীর দফতরে নিয়ম করে মাসিক বৈঠক, সাহিত্যবাসর আর বসে না। ওই একটাই হয় নিয়ম করে— গোপীনাথ কবিরাজের জন্মদিবস পালন। নতুনদের ঠিক আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। দেবাশিসবাবু বা সুব্রতবাবুর মতো প্রবীণ সদস্যরা একা হয়ে পড়ছেন। বাঙালিটোলায় সুধীরের ল্যাংচা সেবা করতে করতে কথা হচ্ছিল উদ্যমী কাশীপ্রেমিক জয়দেব দাসের সঙ্গে। সবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। তবু ওই টোলাতেই বাঙালি নামটা বেঁচে আছে। দীর্ঘদিনের বিধায়ক ছিলেন শ্যামদেব রায়চৌধুরী। তিনিও আজ অশক্ত। কত পত্রিকা বেরোত, ‘কাশীবার্ত্তা প্রকাশিকা’ বা ‘উত্তরা’র মতো। তার এক কপিও আজ পাবেন না। পাঁড়ে ধর্মশালাতেও বাঙালি গিজগিজ করে না। থাক সে সব পুরনোদের মনেই— ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায়’—কাশীর পেয়ারা, চিনি আর মাটির মতোই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement