চিত্রভাষ: ‘ফুলেশ্বরী’ (১৯৭৪) ছবির দৃশ্য।
এ বার আমাকে উপসংহার টানতে হবে। কিন্তু তার আগে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে দু’একটা কথা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার লোভ আমি সামলাতে পারছি না।
এতে বোঝা যাবে মানুষটা কেমন, আর পরবর্তী প্রজন্মের পরিচালকদের পথ দেখাবার জন্য উনি কতটা শ্রম আর উদ্যোগ ব্যয় করতেন।
অনেক দিন আগের কথা। এক দিন স্টুডিয়ো অফিসে বসে কাজ করছি, এমন সময় আমারই কিছু বন্ধু-পরিচালক এসে হাজির। এক জনের বগলে কিছু ফাইলপত্র, রেজিস্টার খাতা। কী ব্যাপার? জানতে পারলাম, ওঁরা এসেছেন একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। কী উদ্দেশ্য? না, আমাদের এই বাংলা ছায়াছবির ক্ষেত্রে যেমন আর সবার একটা করে গিল্ড বা ইউনিয়ন আছে, পরিচালকদের সে রকম কোনও সংগঠন নেই। ফলে, এখানকার রাজ্য সরকার আর বিশেষ করে কেন্দ্রের সরকারের কাছে নানা রকম দাবিদাওয়া উপস্থিত করা আর সেই বাবদ কিছু আর্থিক সহায়তা আদায় করে আনার মতো কোনও সংস্থা নেই। যেহেতু পরিচালকরাই বলতে গেলে ‘ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ’, তাঁরা যদি একসঙ্গে গিয়ে বলেন, তা হলে কোনও সরকারেরই সাধ্য নেই সেটাকে অগ্রাহ্য করার। এই সব আলোচনার জন্য দু’দিন পরে ওঁরা ক্যালকাটা মুভিটোন স্টুডিয়োতে পরিচালকদের একটা সভা ডেকেছেন। আমিও যদি উপস্থিত থাকি।
গেলাম। গিয়ে দেখি, লম্বা একটা টেবিল। চার পাশে অনেক চেয়ার। যিনি আমাকে অনুরোধ করতে এসেছিলেন, তিনি নিজেই সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করে বসে আছেন। আমার মতো কিছু পরিচালক জড়ো হয়েছেন, আবার অনেকেই নেই।
সভার প্রথমেই আগামী বছরের জন্য কার্যকরী সমিতির সভ্যদের নাম ঘোষণা। সাড়ম্বরে সেটি পাঠ করে শোনানো হল। প্রস্তাবটি যখন পাশ হব-হব করছে তখন আমি বললাম, ‘‘দাঁড়ান দাঁড়ান, যদিও অনেকেই আছেন এখানে, তবু যাঁরা ছাড়া বাংলা ছবিকে কেউ পাত্তাই দেবে না, কোনও পরিচয়ই নেই, বিশেষ করে দিল্লিতে, তাঁদের কাউকে এখানে দেখা যাচ্ছে না কেন? ওঁদের কি যোগাযোগ করা হয়েছে? যেমন সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার, অজয় কর— এঁদের কি ডাকা হয়েছে আজকের সভায়?’’
শুনে সভাপতি মশাই, যিনি এত ক্ষণ দিব্য হাস্যমুখ ছিলেন, হঠাৎ যেন কেমন গম্ভীর আর অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।
‘‘এঁদের ছাড়া হবে কী করে?’’ আমি বললাম, ‘‘এঁদের বাদ দিয়ে আমাদের চেনে কে যে আমাদের কথা মন দিয়ে শুনবে? আগে বলুন আদৌ এঁদের বলা হয়েছে কি না?’’
উপস্থিত কয়েক জন আমায় সমর্থন করলেন, কিন্তু সভাপতিমশাই আর তাঁর কাছে বসা সকলেরই গাম্ভীর্য আরও বেড়ে গেল। বোঝা গেল, এঁদের কাউকেই বলা হয়নি। প্রশ্ন করলাম, ‘‘সমস্যাটা কী?’’
খানিক ক্ষণ তা-না-না-না করে অদ্ভুত সব জবাব আসতে লাগল। উদ্যোক্তারা যুক্তি দিলেন, অনুপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে যাওয়া হয়নি এই কারণেই যে, এঁদের কেউ কেউ নাকি ভীষণ গম্ভীর, কেউ কেউ মহা দেমাকি, কেউ কেউ আবার মহাব্যস্ত।
আমি তখন ভার নিলাম, সত্যজিৎবাবুর কাছে আমি নিজেই যাব। শর্ত একটাই— উনি যদি এই উদ্যোগে রাজি হন তা হলে ওঁকেই সংগঠনের মাথায় বসাতে হবে। কারণ, সারা দেশ ওঁকে চেনে আর শ্রদ্ধা করে। তার পর নাহয় একে একে বাকি সবার কাছে যাওয়া যাবে।
অত্যন্ত বিরসবদনে উদ্যোক্তারা জবাব দিলেন, ‘‘ঠিক আছে, তা-ই যান।’’
আমার কাছে সমস্ত প্রস্তাবটি শুনে সত্যজিৎবাবু খুবই খুশি হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘‘এ রকম একটা সংগঠন খুবই দরকার ছিল। ঠিক আছে, তোমরা এগোও। কিন্তু পরের মিটিং তোমরা যে তারিখে রেখেছ, সে দিন তো আমি কলকাতায় থাকছি না। আমার সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আমি এখনই একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি।’’
সেই চিঠি এনে আমি যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার পর লক্ষ করলাম, উদ্যোক্তারা কেমন যেন মিইয়ে পড়েছেন। শেষ পর্যন্ত সংগঠনটা দাঁড়ায়নি। সত্যজিৎবাবুর সেই চিঠিটা কোথায় গেল, আমার জানা নেই।
বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা পুরস্কার ‘গোল্ডেন বেয়ার’ হাতে সত্যজিৎ রায়।
পরে উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কী? কী হল তোমাদের সেই ডিরেক্টর্স গিল্ডের?’’ লজ্জায় জবাব দিতে পারিনি। উনি শুধু বললেন, ‘‘ও রকম একটা body থাকার খুবই দরকার ছিল।’’
যাকগে, এ বার আমার দ্বিতীয় গল্পে আসি।
একটা ছবি বানিয়েছিলাম— ১৯৭৪ সালে। নাম ‘ফুলেশ্বরী’। তার গোড়ায় একটা পাঁচালি গোছের গান ছিল:
‘শুন শুন মহাশয়, শুন দিয়া মন—
বিচিত্র কাহিনি এক করিব বর্ণন।।
যদিও জানি গো ইহা চুয়াত্তর সন—
দিকে দিকে প্রগতির কত না লক্ষণ।।
জলেতে জাহাজ ওড়ে, আকাশে বিমান—
কলে-মিলে ধর্মঘট, মিছিল-স্লোগান।।
‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ আর ‘গরিবি হাটাও’—
ইন্দিরা-নিক্সন-ভুট্টো-কোসিজিন-মাও।।
ফেলিনি-গোদার-ত্রুফো-সত্যজিৎ রায়—
ইহাদের সকলেরে রাখি গো মাথায়।।
এর পরেই স্মৃতি-মেদুরতার গন্ধ মেখে
পরের লাইন:
‘তবু মাঝে মাঝে মন যেতে চায় ফিরে ফিরে’—
একটা সবুজ-সবুজ গ্রাম। মাটির পথ ধরে এগিয়ে চলেছে একটি মেয়ে। কাঁখে কলসি— ইত্যাদি ইত্যাদি।
চিত্রনাট্য লেখার সময় থেকেই মনে মনে ভাবা ছিল যে, গানে যাঁদের যাঁদের নাম বলা আছে— ছবির সেই অংশে তাঁদের স্টিল ফোটোগ্রাফ ব্যবহার করা হবে। যেমন ইন্দিরা-নিক্সন থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত সবার। সত্যজিৎবাবুকে অবশ্য এ ব্যাপারে জানানো হয়নি কিছুই। কারণ, ওঁর ফোটোগ্রাফ জোগাড় করা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। গোদারের ছবিও পাওয়া গেল। কিন্তু মুশকিল বাধল ফেলিনির ছবি নিয়ে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। কী করা যায়? হঠাৎ মনে হল এ ব্যাপারে সত্যজিৎবাবুর সাহায্য নিলে কেমন হয়? ফোনে ওঁর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে পর দিন সকাল হাজির হলাম ওঁর ফ্ল্যাটে। সব শুনে উনি বললেন, ‘‘ফেলিনির ছবি? আমাকে দিন সাতেক সময় দিতে পারবে?’’
রাজি হয়ে গেলাম।
ঠিক সাত দিন পরে সকাল ন’টায় ওঁর ফ্ল্যাটে গিয়ে বেল বাজালাম। উনি নিজেই দরজা খুললেন। চেয়ে দেখি অদূরে, মেঝের ওপর, রাশি রাশি বিদেশি ফিল্ম ম্যাগাজিন আধখোলা অবস্থায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’, ‘ফিল্ম অ্যান্ড ফিল্মিং’ জাতীয় পত্রিকাও উঁকি দিচ্ছে। আমাকে দেখেই সত্যজিৎবাবু বলে উঠলেন, ‘‘পেয়েছি একটা, বুঝলে। ছবিতে একটু গ্রেন আছে, তবে মনে হয় তোমার কাজ চলে যাবে।’’ এই বলে বিশেষ একটা ম্যাগাজিনের সারা পাতা-জোড়া একটা ছবি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে জানতে চাইলেন, ‘‘কিন্তু হঠাৎ ফেলিনির ছবি নিয়ে কী করবে বলো তো?’’ তখন আমি খুলে বললাম, আর এ-ও বললাম যে ‘‘আপনার ছবিও দরকার, কিন্তু তার জন্য আর আপনাকে কষ্ট দেব না। ও আমি ঠিক জোগাড় করে নেব।’’
শুনে দরাজ গলায় হোহো করে হেসে উঠলেন উনি। সেই হাসি এখনও আমার কানে লেগে আছে। আমার জন্য এক সপ্তাহ ধরে একটা ছবি খুঁজে দিয়েছেন তিনি, এই ঋণ আমি কেমন করে মেটাব?
পরের গল্পটা আরও চমকপ্রদ।
‘সংসার সীমান্তে’ নামে আমার একটা ছবি মুক্তি পেয়েছে। প্রথম দিন এসেই ছবিটা দেখে গিয়েছেন উনি।
দিন সাতেকও পেরোয়নি। এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক, যিনি সত্যজিৎবাবুর পরিচিত, আবার আমারও— হঠাৎ এসে বললেন, ‘‘শোনো, ওই লম্বা লোকটা তোমায় বলতে বলেছেন, এখনই তোমার ছবির একটা shorter version বানিয়ে ফেলতে। ঝট করে।’’
আমি শুনে খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। সত্যজিৎবাবুর মতো ব্যস্ত মানুষ সব কাজ ফেলে আমাকে ও রকম একটা উপদেশ দিতে যাবেন, — কেন? কী দায় পড়েছে ওঁর? তাই গা করলাম না।
কয়েক দিন পরে আবার সেই ভদ্রলোক এসে হাজির। ‘‘কী? বানিয়ে ফেলেছ তো তোমার shorter version?’’
আমি বললাম, ‘‘দেখি ভেবে।’’
‘দেখি ভেবে’ মানে? ওই লম্বা লোকটা কী রকম তাড়া দিচ্ছে, জানো? এর মধ্যে এখানে ওখানে চিঠি লিখে ছবিটার পাবলিসিটি শুরু করে দিয়েছে। বিশ্বাস না হয় তো এক বার কথা বলে দেখো।’’
অগত্যা তা-ই ঠিক হল। টেলিফোন করলাম। উনি বললেন, ‘‘কাল সকাল ন’টায় চলে এস।’’
ঘরে ঢুকে সোফায় মুখোমুখি বসলাম আমরা। একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘‘আপনি কি আমার ছবির একটা shorter version বানাতে বলেছেন?’’
‘‘হ্যাঁ তো। এখনও শুরু করোনি?’’
আমি বললাম, ‘‘shorter version মানে তো বিদেশি দর্শকদের জন্য। তা, ওই শ্রেণির দর্শক এ ধরনের ছবির কোন কোন অংশ ছাঁটাই করলে—’’
উনি আমার কথাটা শেষ করতেও দিলেন না। হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে সোজা চলে গেলেন একটা ড্রয়ারের কাছে। একটা কাগজ বার করে আমার সামনে বাড়িয়ে ধরলেন। অবাক হয়ে দেখলাম, বাদামি কালিতে ১, ২, ৩, ৪ করে অনেকগুলি মন্তব্য। ওঁর মতে কোন কোন অংশ সংক্ষিপ্ত করা উচিত— তার একটা বিস্তৃত তালিকা।
যে কাজ আমি শুরুই করিনি, মাত্র এক বার দেখেই উনি সেই কাজ সেরে রেখেছেন আমার হয়ে! এই ভালবাসা পেয়ে আমি গর্বিত। কাগজটা আজও সযত্নে রেখে দিয়েছি। পরের প্রজন্মের পরিচালকদের জন্য আমরা হয়তো কিছুই করতে পারি না, কিন্তু আগের প্রজন্মের উনি একটা দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এ-ও এক ধরনের শিক্ষা যা আমরা ওঁর কাছ থেকে শিখেছি।
অনেক ঋণ থাকে, যা শোধ দেওয়া যায়। আবার কোনও কোনও ঋণ হাজার চেষ্টা করলেও ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। এই বলে আজকের মতো আমার বক্তব্য শেষ করছি। ভাল থাকবেন।
(২৭ এপ্রিল ২০১৯ শিশির মঞ্চে সত্যজিৎ রায় সোসাইটি আয়োজিত ‘দ্য পেঙ্গুইন সত্যজিৎ রায় মেমোরিয়াল লেকচার’)