অধিনায়ক: পূরণ চন্দ জোশী। বামপন্থী আন্দোলনকে গলি থেকে রাজপথে আনার রূপকার।
স
ালটা ১৯৪৩। কালান্তক মন্বন্তর চলছে। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক চষে বেড়াচ্ছেন বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জ। পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছেন অভুক্ত, কঙ্কালসার, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষজনের। কলকাতায় পার্টির এক সভায় তাঁর সঙ্গে আলাপ হল ফোটোগ্রাফার সুনীল জানার। পূরণ চন্দ জোশী তাঁকে দ্রুত নির্দেশ পাঠালেন ক্যামেরা নিয়ে তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়তে। দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বিষয়ে জোশীর মর্মস্পর্শী লেখাগুলো বেরোতে শুরু করল পার্টি-মুখপত্র ‘পিপলস ওয়ার’-এ, সঙ্গে সুনীল জানার তোলা ক্ষুধার্ত মানুষের মর্মস্পর্শী সব ছবি। একই ঘটনা ঘটেছিল চট্টগ্রামের শিল্পী চিত্তপ্রসাদের ক্ষেত্রেও। বঙ্গীয় প্রাদেশিক পার্টির সম্পাদক ভবানী সেন চিত্তর আঁকা বেশ কিছু রাজনৈতিক পোস্টার বোম্বেতে পাঠান, জোশীর কাছে। জোশী কালবিলম্ব না করে চিঠি লিখলেন— ‘অবিলম্বে চিত্তকে বোম্বে পাঠাও।’ চিত্তপ্রসাদ যখন বোম্বে গেলেন, দেখলেন, পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসের সিঁড়ি ও বারান্দা তাঁর আঁকা ছবি, লিনোকাট আর সুনীল জানার তোলা ফোটোগ্রাফ দিয়ে সাজানো। তখন পার্টির কিষানসভার বেজওয়াড়া সম্মেলনের তোড়জোড় চলছে। পার্টি মুখপত্র ‘পিপলস ওয়ার’ এবং ‘পিপলস এজ’-এর পৃষ্ঠায় এই দুই অসামান্য শিল্পীকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দিলেন জোশী। বাকিটা ইতিহাস।
কমিউনিস্ট পার্টি শুরুর সেই অস্থির দিনগুলোয় তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বেই একের পর এক ভুল বিচ্ছিন্নতাপন্থী রাজনৈতিক লাইন ও সিদ্ধান্তের পিছুটান কাটিয়ে পার্টি ক্রমশ বড় হচ্ছিল এবং মূলধারার জাতীয় রাজনীতিতে উজ্জ্বল জায়গা করে নিতে পেরেছিল। ১৯০৭ সালের ১৪ এপ্রিল আলমোড়ায় জন্ম পূরণ চন্দ জোশীর। কম বয়সেই জড়িয়ে পড়েন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে। কমিউনিস্ট পার্টি তখন ছোট্ট গ্রুপ। ১৯২৯ সালে ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’য় পার্টির ১৩ জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে জেলে গেলেন তিনি, সম্পূর্ণ হল রাজনৈতিক দীক্ষাগ্রহণ। মামলার আইনি প্রেসনোট জোশী নিজেই তৈরি করতেন, যাতে সংবাদমাধ্যম কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক বক্তব্য জানতে পারে। আত্মপক্ষ সমর্থনে যে ৬৫ পাতার ড্রাফ্ট জমা দেন ব্রাহ্মণসন্তান জোশী, তার শুরুতেই বলা ছিল—‘আই অ্যাম বাই কাস্ট নো কাস্ট’। ১৯৩৬ সালে পার্টি-সম্পাদক হন জোশী। ১৯৪৩ সালে বোম্বেতে যখন পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তত দিনে ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্ট এবং কৃষক ফ্রন্টে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে পার্টি। অংশগ্রহণ করছে একের পর এক গণ-আন্দোলনে। এই ঐতিহাসিক অগ্রগতির নেপথ্য কান্ডারি হিসেবে চওড়া কাঁধে পার্টির ভার নিয়েছিলেন পি সি জোশী। যাঁর দূরদৃষ্টি ও বিস্তৃত চিন্তাশক্তি তাঁকে অবিসংবাদী নায়কের উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল।
মহাত্মা গাঁধী পরিচালিত দ্বিতীয় অসহযোগ আন্দোলনে (১৯৩০-৩৪) যোগ দিল না পার্টি। জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সার্বিক দূরত্ব বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন বি টি রণদিভে এবং দেশপাণ্ডে, যাঁরা ছিলেন পার্টিতে জোশীর বিপরীত শিবিরের নেতা। জোশী পরবর্তী কালে পার্টির তৎকালীন লাইনকে ‘শিশুসুলভ বোকামির ঐতিহাসিক মূল্য’ (দ্য হিস্টোরিক প্রাইস অব ইনফ্যান্টাইল ফলি) হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয় ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্রে জোশীর চিন্তাভাবনা ছিল অত্যন্ত কার্যকর। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও গাঁধী সম্পর্কে জোশী শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি মনে করতেন, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে গাঁধীর ভূমিকা অনিবার্য এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে রাজনীতির মূলস্রোতে নিয়ে আসতে গেলে গাঁধীর কর্মপন্থা ও জনসংযোগ অনুধাবন করা প্রয়োজন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি পরে পার্টিতে তীব্র ভাবে সমালোচিত হয়। কিন্তু জোশী ভারতীয় সমাজকে অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতার চেয়ে অনেক বেশি গভীর ভাবে বুঝতেন। ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মূলস্রোতে থাকতে গেলে এবং দেশ জুড়ে পার্টির প্রসার ঘটাতে গেলে গাঁধীর সঙ্গেই যে থাকা প্রয়োজন— এটা তিনি বুঝেছিলেন। ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনে’ গ্রেফতার হওয়ার পর, জেলে অনশনরত গাঁধীর মুক্তির দাবিতে সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছিলেন পি সি জোশী।
জোশীই সেই নেতা, যাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আঞ্চলিক গোষ্ঠীভিত্তিক গ্রুপ-রাজনীতি থেকে বেড়ে উঠে এক সর্বভারতীয় পার্টি হয়ে ওঠে। জোশী নিজেও হয়ে ওঠেন জাতীয় স্তরের নেতা। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৮— এই বারো বছরে মাত্র কয়েকশো কর্মীর একটি ক্ষুদ্র আঞ্চলিক গ্রুপ, প্রায় আশি হাজার সদস্যের একটি গণ-পার্টিতে পরিণত হয়। চল্লিশের দশকেই পি সি জোশীর নেতৃত্বে একের পর এক কৃষক অভ্যুত্থান ও শ্রমিক ধর্মঘট দেশের মানুষের কাছে পার্টির গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়। ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে কেরলে ‘কায়ুর কৃষক অভ্যুত্থান’ শুরু হয়। ব্রিটিশ পুলিশ ও মিলিটারির বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিরোধে নামেন কৃষকেরা। মোট ৬০ জন হিন্দু-মুসলিম কৃষক গ্রেফতার হন এবং তাঁদের মধ্যে চার জনের ফাঁসির হুকুম হয়। এই সময়েই সারাভারত কিষানসভার নবম অধিবেশন হয় পূর্ববঙ্গের নেত্রকোনায়। এর আগে ময়মনসিংহ-হাজং এলাকা জুড়ে ব্যাপক কৃষক আন্দোলন পুলিশ-প্রশাসনের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে। অভূতপূর্ব উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল সে দিনের সম্মেলন ঘিরে। বৃষ্টি মাথায় করে হাজার হাজার কৃষক নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ এসেছিলেন বাসে, পায়ে হেঁটে, এমনকি ট্রেনের মাথায় চেপেও। জোশীর বক্তৃতা শোনার জন্য এক আশি বছরের বৃদ্ধা অপেক্ষা করেছিলেন তিন মাস ধরে। মহারাষ্ট্রের ওরলিতে গোদাবরিবাই পারুলেকরের নেতৃত্বে যে বিশাল কৃষক-অভ্যুত্থান হয়েছিল, বাংলার ১৯টি জেলা জুড়ে উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের দাবিতে যে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন হয়, প্রতিটিরই পিছনেই ছিল পি সি জোশীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ও রণকৌশল। ওরলি ও তেভাগা আন্দোলন পূর্ণ সাফল্য পায় এবং কৃষক জনতার ভিতর কমিউনিস্ট পার্টির স্থায়ী গণভিত্তি গড়ে ওঠে। জোশী সম্পাদক থাকাকালীন সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক কৃষক অভ্যুত্থান ঘটেছিল অন্ধ্রের তেলঙ্গানায়। নিজামশাহি এবং বৃহৎ জমিদারদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন সশস্ত্র পথে পরিচালিত হয়। যাঁরা পরবর্তী কালে জোশীকে শান্তিপূর্ণ ‘রিফর্মিস্ট’ পথের দিশারি বলে আক্রমণ করেছেন, তাঁরা হয়তো আজ ভুলে গেছেন, তেলঙ্গানা কৃষক অভ্যুত্থানে কৃষক-গেরিলাদের গোপনে অস্ত্র জোগানোর কাজটিও করেছিলেন পি সি জোশী এবং গঙ্গাধর অধিকারী। গণেশ শুক্লর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, কী ভাবে আর্মি অফিসারদের সঙ্গে জোশীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্রে ভারতীয় ফৌজের অস্ত্র পৌঁছে যায় কৃষকদের কাছে। জোশীর এই সংগ্রামী ইতিহাসও পরে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বিস্তর।
গণসংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট গড়ে তোলা জোশীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। শিল্পজগতের সমকালীন সেরা ব্যক্তিদের একত্রিত করে পার্টির কালচারাল ফ্রন্টের দায়িত্ব তাঁদের হাতে দেওয়ার দুরূহ কাজটি তিনি করতে পেরেছিলেন। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশ না নেওয়ায় পার্টি তখন একঘরে, মন্বন্তরের কাজে সর্বতোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কর্মীরা, সেই সময়েই জোশী পার্টির সেন্ট্রাল কালচারাল স্কোয়াড গঠনের ডাক দিলেন, যে স্কোয়াড অচিরেই ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ বা ‘আইপিটিএ’ হিসেবে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কে ছিলেন না সেই সঙ্ঘে সে দিন? ‘ইপ্টা’ তৈরি হওয়ার আগেই এতে যুক্ত হয়েছেন বিনয় রায়, শম্ভু মিত্র। বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দী’ নাটকের হিন্দি রূপান্তর করেছেন নেমিচাঁদ জৈন। যোগ দিয়েছেন শান্তি বর্ধন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, অবনী দাশগুপ্ত, শচীন শঙ্কর, নরেন্দ্র শর্মা। মে, ১৯৪৩-এ প্রতিষ্ঠার পর, ‘ইপ্টা’র প্রথম সম্মেলন হয় বোম্বে শহরে, পার্টির প্রথম কনফারেন্সের ঠিক এক মাস আগে, ১৯৪৩ সালেই। ৮ জানুয়ারি, ১৯৪৫ ‘ইপ্টা’র বোম্বে কনফারেন্সে প্রদর্শিত হল সেই অবিস্মরণীয় পারফরম্যান্স— ‘দ্য স্পিরিট অব ইন্ডিয়া’। কথানাট্য লিখেছিলেন প্রেম ধওয়ন, ‘জুবেইদা’ নামের একটি হিন্দুস্থানি নাট্য প্রযোজিত হয়, যাতে অংশ নেন খাজা আহমেদ আব্বাস, পরিচালনা করেন বলরাজ সাহনি। বিজন ভট্টাচার্যর মাইলস্টোন প্রযোজনা ‘নবান্ন’-ও প্রদর্শিত হয় এখানে। স্বয়ং জওহরলাল নেহরু এই সম্মেলনে পাঠিয়েছিলেন তাঁর শুভেচ্ছাবাণী। কিন্তু স্বাধীনতার ঠিক পরেই পার্টি-সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণের পর ‘ইপ্টা’র গৌরবোজ্জ্বল বাহিনী ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। বেরিয়ে আসেন ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, শম্ভু মিত্রের মতো শ্রেষ্ঠ নক্ষত্রেরা। যে সংগঠন ও গণভিত্তি জোশী তৈরি করে গিয়েছিলেন, পার্টি-সম্পাদক পদ থেকে তাঁকে অপসারিত করার অব্যবহিত পরেই সেই সাংগঠনিক ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যায়। পার্টি ফের মূলস্রোত থেকে বেরিয়ে এসে বিচ্ছিন্ন কানাগলির রাজনীতিতে ফিরে যায় বি টি রণদিভের আমলে।
স্বাধীনতার আগে থেকেই পার্টির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। পার্টির মধ্যে জোশী-বিরোধী অংশ একজোট হচ্ছিল কট্টরপন্থী বি টি রণদিভের নেতৃত্বে। জোশীকে ‘কংগ্রেসের সঙ্গে আপসকামী’ এবং ‘সংশোধনবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে পার্টি সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। ১৯৪৮-এর কলকাতা পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চে তাঁকে তুলোধোনা করলেন রণদিভে। সভামঞ্চে বসে স্বয়ং জোশী শুনলেন উগ্র হঠকারী নতুন নেতৃত্ব তাঁর নিন্দায় পঞ্চমুখ। কিন্তু এক জন নিষ্ঠাবান পার্টি-সৈনিক হিসেবে তিনি পাল্টা-গোষ্ঠী তৈরির রাস্তায় হাঁটেননি। নীরবে হজম করলেন অপমান, লাঞ্ছনা। রণদিভের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি এক সার্বিক কংগ্রেস-বিরোধী সশস্ত্র ও জঙ্গি-আন্দোলনের ডাক দেয়, ভারতের স্বাধীনতাকে ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগানে চিহ্নিত করে এবং অতি দ্রুত ভারতীয় রাজনীতির মূলস্রোত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রথমে বাংলায়, তার পর দ্রুত গোটা দেশে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। পার্টির সদস্য-সংখ্যা ৯০ হাজার থেকে কমে ৯ হাজারে এসে ঠেকে। বিরাট সংখ্যক কর্মী সম্পূর্ণ বসে যান অথবা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। সার্বিক বিপর্যয় নেমে আসে পার্টির সামনে। বছর দুয়েকের মধ্যেই উগ্র বাম-হঠকারী লাইন থেকে পার্টি ফের সরে আসে। প্রথমে সি রাজেশ্বর রাও, পরে অজয় ঘোষকে পার্টি-সম্পাদক করা হয়। বি টি রণদিভে অপসারিত হন। জোশী সম্পর্কে ফের কিছুটা নরম হন নেতৃত্ব। রণদিভের আমলে জোশীকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার উগ্র প্রচেষ্টা চলেছিল। এমনকি তাঁর স্ত্রী কল্পনা জোশীর উপরে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, জোশীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য। পার্টির মধ্যে যাঁরাই জোশীর পক্ষে বলতেন, তাঁদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে বহিষ্কার করা হয়।
জোশী ফের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পুনর্বাসন পান ১৯৫৮-তে। কানপুরে বিরাট শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু আবার উদ্দেশ্যমূলক ভাবে তাঁকে সরিয়ে আনা হল দিল্লিতে, ‘নিউ এজ’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়ে। পারিবারিক জীবনে, পার্টি-রাজনীতিতে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছিলেন জোশী। তাঁর সহজ, নিরলঙ্কার জীবনাদর্শ মানতে চাননি তাঁর সন্তানসন্ততিও। শেষজীবনে ভগ্নস্বাস্থ্য জোশী চলে আসেন আলমোড়ায়। বিনসার ফরেস্টের পাশে, সিরকোট গ্রামে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বহুগুণা এবং বন্ধু বলরাজ সাহনির সাহায্যে তিনি গড়ে তোলেন তাঁর শেষ স্বপ্নের প্রকল্প— ‘হিমালয়ান সোশ্যালিস্ট আশ্রম’। পার্টি কোণঠাসা করে দিলেও রাজনীতি থেকে তিনি সরে যাননি। আসলে জোশী স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েই উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতীয় রাজনীতিতে ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে চলেছে অতি-দক্ষিণপন্থী হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি। ১৯৬১-তে ‘নিউ এজ’ পত্রিকায় জবলপুর দাঙ্গার অন্তর্তদন্তমূলক বিশ্লেষণে তিনি দেখান, ভারতীয় জনসঙ্ঘ কী ভাবে দেশে ঘৃণার রাজনীতি শুরু করেছে। জোশী যোগ্য পার্টি-সম্পাদক হিসেবে জোশী আরও কিছু কাল কাজের সুযোগ পেলে হয়তো এই ঘৃণার রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত হত না। জোশীর ট্র্যাজেডি তাই শুধু ব্যক্তিগত নয়, গোটা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজেডি। ৯ নভেম্বর ১৯৮০, এই নিঃসঙ্গ, ভগ্নস্বাস্থ্য কমিউনিস্ট নেতার মৃত্যু হয়। ভারতের বামপন্থী আন্দোলনের ইতিহাসে আজও এই সংগ্রামী মানুষটির যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি।
কৃতজ্ঞতা : বাসু আচার্য