Foreign Ministers Summit

বিদেশমন্ত্রীদের শীর্ষ সম্মেলনে

ঘটে নানা আশ্চর্য ঘটনা। কখনও মজার, কখনও বিস্ময়ের। প্রশাসনিক প্রধানদের মেজাজ-মর্জি ধরতে পারা এক কঠিন দায়িত্ব।

Advertisement

অরিজিৎ ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৫৬
Share:

প্রধান: ইয়াসের আরাফত এবং ইন্দ্রকুমার গুজরাল (ডান দিকে)।

বিদেশমন্ত্রীদের গাড়ি-কাণ্ড

Advertisement

এপ্রিল, ১৯৯৭, নয়াদিল্লি। নির্জোট আন্দোলন তখনও বহাল তবিয়তে। নির্জোট আন্দোলনের দ্বাদশতম বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ের শীর্ষ সম্মেলন সে বছর দিল্লিতে। ৭৫টি দেশ যোগ দেবে।

আমরা তখন ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের প্রশিক্ষণরত ব্যাচ বা ‘প্রবেশনার’। এই শীর্ষ সম্মেলনের মহাযজ্ঞে আমাদেরও দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দায়িত্ব। আমি দিল্লিতে তাজ হোটেলে বিদেশমন্ত্রী ও মান্যগণ্যদের ‘লিয়াজ়ঁ’ অফিসের দায়িত্বে। হোটেলেই একটা স্যুইট হলে স্টেনো, দোভাষী, ফ্যাক্স ও টেলেক্স মেশিন প্রভৃতি সহযোগে আমাদের অফিস।

Advertisement

উদ্বোধনের দিনের পরিকল্পনা ছিল, ৭৫টি দেশের বিদেশমন্ত্রী ও বিদেশি প্রতিনিধি দলের নেতারা সকাল ৯টা বেজে ১৫ মিনিটে হোটেল থেকে তাঁদের পূর্বনির্ধারিত গাড়িতে চাপবেন। ৭৫টি গাড়ির সুদীর্ঘ কনভয় তৈরি হবে দেশের নামের আদ্যক্ষরের ক্রমানুসারে। অর্থাৎ সবার প্রথমে আফগানিস্তান, আর সব শেষে জ়িম্বাবোয়ে। আর সেই কনভয় এসে পৌঁছবে বিজ্ঞান ভবনে কাঁটায় কাঁটায় ৯টা ৪৫-এ। সিঁড়িতে অপেক্ষা করবেন বিদেশমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল। বিদেশি নেতাদের একে একে সাদর অভ্যর্থনা জানাবেন তিনি।

পরিকল্পনা রইল পরিকল্পনার জায়গাতেই, গাড়ি ধরার মুহূর্তে পর পর তৈরি হতে থাকল নানা মুহূর্ত— সকাল ৯টা বেজে ৫ মিনিট। ব্রেকফাস্ট হলে টেবিল থেকে টেবিলে মন্ত্রী মহোদয়দের জনে জনে ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলের জাহাঙ্গির হলে সমবেত হওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন করছি। পাকিস্তানি বিদেশমন্ত্রী গওহর আয়ুব খান— ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির বিশাল চেহারা। দেখি তিনি আর এক প্লেট ‘স্ক্র্যাম্বলড এগ’ নিয়ে জমিয়ে বসতে চলেছেন। তাঁকে নিরত করার জন্য ছুটে যেতে গিয়ে আমার ধাক্কায় পড়ে গেলেন কম্বোডিয়ার ছোটখাটো চেহারার বিদেশমন্ত্রী! আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে কনভয় রওনা করাতে হবে যে! হোটেলের তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে সমস্ত ট্র্যাফিকে দাঁড়ি টানা হয়েছে। ডিসি (ট্র্যাফিক) ওয়্যারলেসে বার বার জানতে চাইছেন, কনভয়ের সর্বশেষ অবস্থান।

ইতিমধ্যে, ইথিয়োপিয়ার গাড়ি পিছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে মিশরের পতাকাবাহী গাড়িকে। ভেনেজ়ুয়েলার মন্ত্রীমশাই কোনও কারণে কলম্বিয়ার বিদেশমন্ত্রীকে উচ্চৈঃস্বরে উত্তেজিত হয়ে কিছু বলছেন। বার্বাডোসের মহিলা বিদেশমন্ত্রী আবার গিয়েছেন স্কার্ফ বদলাতে। ইরানের বিদেশমন্ত্রী আলি আকবর বিলায়েতির সহকারী জানতে চাইছেন যে, বিলায়েতি সাহেবের চিকেন সসেজ যে হালাল মিট, তা কোথায় লেখা আছে।

উপায়ান্তর না দেখে ঠিক তখনই গলার স্বর চড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, “এক্সেলেন্সিগণ, সবাই বারান্দার দিকে চলুন। কনভয় আর দু’মিনিটে রওনা হবে। যাঁরা উদ্বোধনী অধিবেশনে পরে যেতে চান, তাঁদের নিজস্ব পরিবহণের ব্যবস্থা করতে হবে।” মন্ত্রীদের সাধারণত এই রকম কোনও কাজ করতে ‘হুকুম’ করা হয় না। পরামর্শ দেওয়া হয় মাত্র। যাই হোক, ঘোষণা অথবা হুমকিতে সবাই তড়িঘড়ি করে ছুটলেন বারান্দার দিকে, যার সামনে এক এক করে গাড়ি আসবে। বিদেশি প্রোটোকল অফিসাররা আমার ঘোষণায় অবাক হয়েছিলেন বটে, তবে কাজ হয়েছিল।

কিন্তু এক আফ্রিকান দেশের মন্ত্রীমশাইয়ের ব্রিফকেস পড়ে অনেক ডলার চার দিকে ছড়িয়ে পড়ল। মন্ত্রীমশাই তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, সারা বারান্দা থেকে ডলার উদ্ধার করে বাক্সে পোরা এই নির্জোট অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার থেকে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সারা সকাল ধরে অতঃপর তিনি নোট পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করলেন!

কনভয় বর্ণানুক্রমে প্রস্থান করতে শুরু করেছে। আচমকা দেখি, কলম্বিয়ার বিদেশমন্ত্রী আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। কিন্তু কলম্বিয়া অর্থাৎ ‘সি’ বর্ণের ক্রমের গাড়ি তত ক্ষণে চলে গিয়েছে। সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল উগান্ডা। আসতে থাকল ভেনেজ়ুয়েলা। দেখি ভেনেজ়ুয়েলার বিদেশমন্ত্রী, যাঁর সঙ্গে কলম্বিয়ার মন্ত্রী মহোদয়ের কিছুক্ষণ আগেই বচসা হচ্ছিল, গাড়ির দরজা খুলে শ্রীযুক্ত কলম্বিয়াকে টেনে নিলেন নিজের গাড়িতে। দু’জনেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন।

গুজরাল সাহেবও নিশ্চয়ই একটু অবাক হয়েছিলেন ভেনেজ়ুয়েলার গাড়ি থেকে কলম্বিয়ার মন্ত্রীকে নামতে দেখে!

আরাফত ও ইঁদুর

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন। রাতে কন্ট্রোল রুমেই চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।

“আসসালাম আলাইকুম। জিয়াদ ওয়াহাব বলছি প্যালেস্টাইন ডেলিগেশন থেকে।”

“বলুন কী করতে পারি?”

“আমাদের চেয়ারম্যান হোটেল বদলাতে চান। ওঁর ঘরে ইঁদুর।”

প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজ়েশনের চেয়ারম্যান ইয়াসের আরাফতের থাকার ব্যবস্থা দিল্লির সরকারি মালিকানাধীন অশোকা হোটেলে। সবিনয়ে জানালাম, দিল্লির সব পাঁচতারা হোটেল, এই মুহূর্তে শীর্ষ সম্মেলনের জন্য ভর্তি। কোনও ঘর খালি নেই। কিন্তু জিয়াদ নাছোড়বান্দা। জানালেন, খোদ আরাফতকেই সে কথা বলতে! ও পার থেকে ভেসে এল আরাফত সাহেবের গলা।

“আসসালাম আলাইকুম। কেমন চলছে সব?”

“ওয়ালেকুম আসসালাম। এখনও পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। ৭৫টি ডেলিগেশনের প্রায় ১০০০ জন অতিথি এখন আমাদের মন্ত্রকের দায়িত্বে। কিছু সমস্যা তো থাকবেই। তবে কিনা আমাদের অতিথিরা খুব সদাশয় এবং আমাদের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করছেন। আমরা তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ, ইয়োর এক্সেলেন্সি।”

“শুনে খুশি হলাম। টেক কেয়ার।”

তাঁর বক্তব্যে কোথাও ইঁদুরের উপদ্রব ছিল না।

সুলতানি পেটিকা

উদ্বোধন-অনুষ্ঠান ভাল ভাবেই মিটল। তাজ হোটেলে, যত দূর মনে পড়ে, ২৩ জন বিদেশমন্ত্রী-সহ ৩৪টি দেশের প্রতিনিধি দলের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। আমার অফিস, মানে কন্ট্রোল রুমে প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধিদের জন্য রাখা ছিল ভারত সরকারের তরফ থেকে দেওয়া উপহার। আর প্রত্যেক বিদেশমন্ত্রীর জন্য রাখা ছিল বিশেষ ভাবে তৈরি মূল্যবান এবং বিরল ভারতীয় হস্তশিল্প সামগ্রী। বিদেশ মন্ত্রণালয়ের প্রোটোকল ডিপার্টমেন্ট থেকে দেওয়া নির্দেশে বলা ছিল, “এই বিশেষ উপহার দেওয়া হবে শুধুমাত্র যদি প্রতিনিধি দলের নেতা বিদেশমন্ত্রী বা তার উপরের স্তরের কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি হন।”

রাত প্রায় ১১টা। আরব দেশের দিল্লিস্থিত দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব কন্ট্রোল রুমে এলেন। তাঁর দেশের প্রতিনিধি দলের নেতার জন্য ওই উপহারই দাবি করলেন। ঘটনাস্থলে তখন আমি ছিলাম না। আমার থেকে এক বছরের জুনিয়র, সিমরন ‘সিম্মি’ কপূর ছিল দায়িত্বে। সিম্মি প্রতিনিধি দলের তালিকা থেকে দেখলেন যে, ওই প্রতিনিধি দলের নেতা বিদেশমন্ত্রী বা কোনও মন্ত্রী নন। সুতরাং, সবিনয়ে তাঁকে জানান, ওই বিশেষ উপহার দিতে আমরা অপারগ। আমি কন্ট্রোল রুমে ফিরতেই সিম্মি ঘটনাটি আমাকে বলেন। তালিকা মিলিয়ে দেখলাম যে, ওই দেশের প্রতিনিধি দলের নেতা জনৈক মেজর জেনারেল। সুতরাং আমরা নির্দেশ মতোই কাজ করেছি।

শীর্ষ সম্মেলনের শেষ দিন। আচমকা এক প্রৌঢ় বিদেশি হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন কন্ট্রোল রুমে।

“আপনি এখানকার ইন-চার্জ?”

আমি তত ক্ষণে তাঁর কোটের উপরে আটকানো হলুদ পরিচয়পত্র থেকে বুঝে নিয়েছি যে, ইনি ওই আরব মুলুকের দিল্লিস্থিত রাষ্ট্রদূত। তিনি চার মিনিট ধরে অনর্গল আমাকে ভর্ৎসনা করে গেলেন যে, আমি তাঁর নেতাকে যথাযথ উপহার না দেওয়ায় শুধু তাঁর দেশেরই অবমাননা হয়নি, তাঁর ব্যক্তিগত অমর্যাদাও হয়েছে। ভারত ও ওই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও এই অবমাননার ছায়া পড়তে বাধ্য। ওঁর কথা শেষ হলে আমি ব্যাখ্যা করলাম যে, ওই বিশেষ উপহার শুধু বিদেশমন্ত্রী ও তাঁর উপরের স্তরের নেতৃত্বের জন্য সংরক্ষিত।

এতে যেন আগুনে ঘি পড়ল। রাষ্ট্রদূত মহোদয় কেটে কেটে বললেন, “আমার নেতা দেশের যুবরাজ। শুধু বাদশাহ তার উপরে।”

আমি বুঝলাম, দেশের যুবরাজ কোনও মন্ত্রক হাতে না রাখতে পারেন। হয়তো তাঁর মেজর জেনারেল পদটাও সাম্মানিক। কিন্তু তিনি বিদেশ বা অন্য মন্ত্রীদের থেকে বেশ কয়েক ধাপ উপরে। এই সব মন্ত্রী-ফন্ত্রীদের উনি যখন খুশি বরখাস্ত করতে পারেন, এমনকি হয়তো গর্দানও নিতে পারেন বেয়াদবি করলে। মোটের উপরে এই উপহার ওঁর প্রাপ্য।

আমি রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের কাছে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমাপ্রার্থনা করে নিলাম। উপহারের বাক্স নামিয়ে তাঁর হাতে তুলে দিতে যাব, তিনি বললেন, “যুবরাজ কিছুটা অপমানিত বোধ করেছেন। ভাল হয়, যদি আপনি নিজে গিয়ে উপহারটি ওঁকে গিয়ে দিয়ে আসেন।”

অতএব, চটপট টাই লাগিয়ে চললাম রাষ্ট্রদূতের পিছন পিছন যুবরাজের স্যুইটের দিকে। সিম্মি উপহারের বাক্স নিয়ে আমার পিছনে।

হিজ় হাইনেস মহম্মদ অল শফি (যাঁর নামের পরে আমির-উল-মোমিন, হিসাম-উল-সুলতানাৎ, মুখতার-উল-মুলক এই ক’টি উপাধি বসানো হয়) আমাদের স্বাগত জানালেন। ভারত এবং তাঁর দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি কামনা করে দু’টি কথাও বললেন। আর তার পরে সেই ‘আরব্য রজনীর’ গল্পের মতো হাতে তালি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এক সহকারী এসে ঢুকলেন হাতে দু’টি রৌপ্যপেটিকা নিয়ে। জাঁহাপনা একটি আমাকে এবং একটি সিম্মিকে দিলেন।

আমার বাক্সের মধ্যে ছিল একটি সোনার পত্রফলক। তার উপরে লাল পাথরের নকশা। সিম্মিও ওই সোনার ফলক পেয়েছিল। তবে তাতে লাল পাথরের কারুকাজ ছিল না।

পুনশ্চ: যুবরাজ বর্তমানে সে দেশের সুলতান, দেশের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। ওই সোনার পত্রফলক আমরা সাউথ ব্লকের বেসমেন্টে অবস্থিত সরকারি তোষাখানায় জমা করি। সরকারি কর্মচারীরা বিদেশি অতিথির থেকে কোনও উপহার পেলে তার একমাত্র প্রাপক ভারত সরকার। এ রকমই নিয়ম।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement