দু’বছর আগেই ভুগেছেন ক্যানসারে। দেড় বছর আগে ভেঙেছে কোমর। ওয়াকার ছাড়া হাঁটতে পারেন না। তাও খুব ধীরে ধীরে। তবু হাঁটবেন তিনি। কারণ বেসামাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য তুলতে হবে এক হাজার পাউন্ড। এ যেন শতবর্ষী ক্যাপ্টেন টম মুরের সত্যিকারের রূপকথা।
একশো বছর বয়সে গোটা দেশকে শোকে ডুবিয়ে চলে গেলেন ব্রিটেনের একুশ শতকের এই হিরো। সিনেমার পর্দায় যাঁদের দেখে আমরা মুগ্ধ হই, সত্যিকারের হিরো কি তাঁরাই? তা হলে তো আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষের কোনও দিন হিরো হওয়া হবে না। অবশ্য সময়বিশেষে সেনাদল থেকে বা পুলিশ থেকেও হিরো বেরিয়ে আসেন, কদাচিৎ ডাক্তার কিংবা নার্স, তাঁরাও। কিন্তু ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের টম মুর একেবারে সাধারণ এক জন বৃদ্ধ। পুরো একশো বছর বয়স হল গত এপ্রিলের তিরিশে— প্রাক্তন সেনানী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও লড়াই করেছেন, ভারতে পোস্টিং ছিল, ছিল বর্মা মুলুকেও। আর ভারতে থাকার সময় কলকাতায় পোস্টিং ছিল। সাধারণ ক্যাডেট হয়ে ঢুকে, দু’-একটা প্রোমোশন পেয়ে ক্যাপ্টেন অবধি হয়েছিলেন।
গত বছর এই করোনাভাইরাসের প্রকোপে যখন গোটা ব্রিটেন ভয়ে কাঁপছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধুঁকছে, তখন আর পাঁচ জনের মতো টম মুরও ঠিক করলেন তিনি স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করবেন। দু’-একটা চ্যারিটির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। টার্গেট এক হাজার পাউন্ড। কম নয় মোটেও। টাকার হিসেবে এক হাজার পাউন্ড অর্থাৎ মোটামুটি নব্বই হাজার টাকা। সুতরাং ফেলনা নয় একেবারেই। কিন্তু টাকাটা উঠবে কী করে? কে-ই বা টাকা দেবে আর কেনই বা দেবে? সুতরাং একটা চ্যালেঞ্জ ঠিক করা হল। ৩০ এপ্রিল তাঁর শততম জন্মদিন, তাই এপ্রিলের ছ’তারিখ থেকে তিনি তাঁর বাগানে দশ চক্কর হাঁটবেন। প্রতিদিন আড়াইশো মিটার। দশ দিন তিনি হাঁটবেন। এ আর এমন কী কঠিন কাজ? মাত্র আড়াইশো মিটার তো! কিন্তু সেই থুত্থুড়ে বুড়ো টম মুর তো ভাল করে হাঁটতেই পারেন না। বছর দেড়েক আগেই তো কোমর ভেঙেছিলেন তিনি, আর মাত্র দু’বছর আগেই ক্যানসারে ভুগছিলেন। জিমার ফ্রেম নিয়ে খুব ধীরে ধীরে সন্তর্পণে হাঁটেন, পড়ে গেলে আবার কোমর ভাঙবেই আর এই বয়সে আবার ভাঙলে আর জোড়া লাগবে না। তাঁর এই চ্যারিটির নাম দিলেন ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য টমের একশো বছরের জন্মদিনের হাঁটা’। এর পর আরম্ভ হল ক্যাপ্টেন টম মুরের আশ্চর্য রূপকথা। এ বারে দেখা যাক সেই সময়ের দিনপঞ্জি। যে কোনও থ্রিলারের মতোই দম-বন্ধ-করা সে গল্প। শুধু পার্থক্য হল, গল্পটা এই করোনা-বিধ্বস্ত ব্রিটেনের অন্যতম মন-ভাল-করা গল্প।
১০ এপ্রিল: মাত্র চার দিন হেঁটেই এক হাজার পাউন্ড উঠে গেছে। টম মুর এখন টুইটারে ট্রেন্ডিং। টাকা এখনও লোকে দান করে যাচ্ছে। তাঁর মেয়ে-জামাই ঠাট্টা করে এই এক হাজার পাউন্ডের টার্গেট রেখেছিলেন। কিন্তু লোকে একটু একটু করে দান করেই যাচ্ছে। সুতরাং টার্গেট বদলে দেওয়া হল। এ বার তাঁর টার্গেট পাঁচ হাজার পাউন্ড। টম মুর উৎসাহিত এবং তিনি হাঁটছেন।
১২ এপ্রিল: পাঁচ হাজার পাউন্ড উঠে গেছে। টম মুর এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। তিনি তাঁর আনন্দ এবং বিস্ময় কোনওটাই গোপন করছেন না। অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়েছেন যাঁরা তাঁর জন্য দান করেছেন তাঁদের। শেষ পর্যন্ত কাজে লাগবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই তো! এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে ব্রিটেনের লোকের গর্বের অন্ত নেই। সরকার বদলায়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা এনএইচএস (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) নিয়ে গর্ব একই রকম থেকে যায়। বিখ্যাত সাংবাদিক এবং সঞ্চালক পিয়ের্স মরগ্যান নিজে তাঁর জনপ্রিয় শো-তে টম মুরকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। তিনি নিজেই দান করলেন দশ হাজার পাউন্ড।
১৪ এপ্রিল: রয়টার্স লিখল, ‘চার মিলিয়ন পাউন্ড উঠে গেছে।’ পরের দিন আরও তিন মিলিয়ন পাউন্ড। এ দিকে করোনায় ব্রিটেনে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়ে গেছে প্রায় বারো হাজার। এ যেন সময়ের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতা। অনেক টাকা লাগবে। হাসপাতালগুলোয় করোনা রোগীর ভিড়। এই সময়ে তো থামা যাবে না। টম মুর ইন্টারভিউতে বললেন, “যত ক্ষণ লোকে টাকা দিয়ে যাবে, আমি হেঁটে যাব।”
১৬ এপ্রিল: একশো চক্কর প্রায় হয়ে এল। টাকা আসছে বন্যার জলের মতো, টার্গেট বাড়িয়ে দশ লক্ষ পাউন্ড করা হয়েছিল, সেও পেরিয়ে গেছে। সমস্ত খবরের কাগজে তাঁর ছবি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক বৃদ্ধ হাঁটছেন। সেই দিন তাঁর শেষ পরিক্রমার সময় গার্ড অব অনার দিল ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ন। কিন্তু টম মুর থামার পাত্র নন, আবার একশো পাক হাঁটবেন। পাউন্ড আসছে যে! আজ দেশের এই দুর্দিনে টাকা যে অত্যন্ত দরকারি।
১৭ এপ্রিল: ইংল্যান্ডের বিখ্যাত গায়ক মাইকেল বল সকালে টিভিতে লাইভ গাইলেন লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের থিম ‘ইউ উইল নট ওয়াক অ্যালোন’! সত্যিই তো! টম মুরের এই হাঁটা যেন সমস্ত ব্রিটেনের মানুষের হাল না-ছাড়া মানসিকতার প্রতিফলন। এই গানেও অংশ নিলেন টম মুর। ডেকা রেকর্ডস সেটা রিলিজ় করে। পরের ৪৮ ঘণ্টায় এ গান ৩৬০০০ কপি বিক্রি হল, সমস্ত অর্থ আবার চ্যারিটিতে। ২৪ এপ্রিল এই গান সাপ্তাহিক চার্টে একেবারে বেস্টসেলার হয়ে উঠল, টমসাহেব সবচেয়ে বয়স্ক গায়ক হিসেবে এই রেকর্ডের অধিকারী হয়ে উঠলেন আর নিজের শততম জন্মদিনে গায়ক হিসেবে ব্রিটেনে এক নম্বরে রইলেন।
১৮ এপ্রিল: পাঁচ মিলিয়ন পেরিয়ে গেছে। টম মুর আজ নিজের মোটিভেশনের কারণটা বললেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কর্মরত সকলে মিলে অসাধারণ সেবা করছেন মানুষের। এই সাহসী সহনাগরিকদের জন্য কোনও কৃতজ্ঞতাই যথেষ্ট নয়। প্রত্যেক দিন তাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখে সেবা করছেন লোকের। এই যুদ্ধে এঁরাই আমাদের সৈনিক। এঁদের দেখাশোনার ভার আমাদেরই নিতে হবে। তাঁর কন্যা হানা বলেন, আমরা অভিভূত যে, এত লোক নিঃস্বার্থ ভাবে দান করেছে করোনা মোকাবিলার জন্য। তাঁর সম্মানে লন্ডনের পিকাডিলি সার্কাসের বিখ্যাত সেই বিশাল বিলবোর্ডে, যেখানে প্রায় সোনার দামে বিজ্ঞাপনের সময় কিনতে হয়, সেই বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর হাঁটার গল্প দেখানো হচ্ছে প্রতি ঘণ্টায় চল্লিশ সেকেন্ড করে।
২৩ এপ্রিল: সকালবেলা আবার তিনি হাঁটতে বেরিয়েছেন বাগানে, নিজের ওয়াকার ফ্রেম নিয়ে। ইতিমধ্যে পঁচিশ মিলিয়ন পাউন্ড উঠে গেছে এবং আরও টাকা আসছে এখনও। ইয়ান বোথাম বলেন, “এই দুর্দিনে দেশের এমনই এক জনকে দরকার।” বিকেলে জানতে পারলেন তাঁকে ‘প্রাইড অব ব্রিটেন’ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। চ্যারিটি ওয়াক-এ সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের জন্যে গিনেস বুকে তাঁর নাম লেখা হয়ে গেছে। কবে গাওস্কর দশ হাজার রান করে বলেছিলেন ‘রেকর্ড তৈরিই হয় ভাঙার জন্য,’ কিন্তু টম মুরের এই রেকর্ড ভাঙা এক রকম অসম্ভব। একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বয়সে হিট গান গাওয়ার রেকর্ডটাও গিনেস বুকে তাঁর নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে।
৩০ এপ্রিল: সব মিলিয়ে ৩২ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি উঠেছে এবং তার সবটাই যাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে। টম রাখবেন না একটুও। সবই দানের টাকা। এবং সবই তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে। সুতরাং কয়েক লাখ এ দিক-ও দিক হলেই বা কী এসে যায়? এই পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ অবশ্যই এক রেকর্ড। এর আগের রেকর্ড? পাঁচ মিলিয়ন! পাঁচ মিলিয়ন পাউন্ড অনেকে অনেক টাকা, কিন্তু টমসাহেবের তোলা টাকার কাছে প্রায় কিছুই নয়। টমসাহেবের তোলা এই টাকা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা আরও সুখকর করে তোলার জন্য। স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশ্রামের জায়গা করতে হবে, আরও আইপ্যাড কিনতে হবে যাতে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীরা পরিবারের সঙ্গে শেষ দেখা বা কথা বলতে পারেন, বা করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের সাপোর্ট— এই সব কাজে টাকা খরচ হবে। সেনাবাহিনীর জেনারেল মার্ক কার্লটন স্মিথ তাঁকে সাম্মানিক কর্নেল পদে সম্মানিত করলেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বললেন, “সেনাবাহিনীর নবীন এবং প্রবীণ, সকলের কাছেই টম মুর এক অনুপ্রেরণা।”
এর মধ্যে টম মুর পঞ্চাশেরও বেশি ইন্টারভিউ দিয়েছেন জনমাধ্যমে। রাতারাতি সেলেব্রিটি হয়ে গেছেন তিনি। সাত লক্ষেরও বেশি লোক তাঁকে ‘নাইটহুড’ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তাঁর জন্মদিনেই তাঁকে প্রথম সাম্মানিক কর্নেল পদে বরণ করা হল। বিবিসির সম্পাদক রিচার্ড ফ্রেডিয়ানি বললেন, “আমাদের সময়ের (টম মুর) সত্যিকারের হিরো। তাঁর মধ্যে কোনও রকম স্বার্থপরতা বা আহামরি ব্যাপার নেই। তিনি এক জন প্রকৃত ভদ্রলোক।”
৩০ এপ্রিল তাঁর জন্মদিনে যে তিনি কিছু বেশি কার্ড পাবেন, তা জানাই ছিল। কিন্তু এত কার্ড আসতে লাগল যে, তার জন্যে একটা স্কুল বিল্ডিং খুলে দেওয়া হল। তাঁর নাতি বেঞ্জির স্কুল বেডফোর্ড প্রাইমারি স্কুল। কুড়ি জন স্বেচ্ছাসেবক সেই দেড় লক্ষের উপর কার্ড খুলে সাজিয়ে রাখার কাজে নিযুক্ত হল। ব্রিটেনে কারও শততম জন্মদিন হলে রানি এলিজ়াবেথ একটা চিঠি পাঠান। সই-সহ বয়ান আগে থেকেই তৈরি থাকে। কিন্তু কর্নেল টম মুরকে তিনি পাঠালেন ব্যক্তিগত চিঠি— শুভ জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আর সংযুক্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রধান আন্তনিয়ো গুত্তেরেস। বিপুল অর্থসাহায্য করলেন যুবরাজ চার্লস এবং প্রিন্স উইলিয়াম। উইলিয়াম আর কেট নানা রকম সমাজসেবায় যুক্ত থেকে জনগণের মন জয় করে নিতে এমনিতেই সমর্থ হয়েছেন, ক্যাপ্টেন মুরের প্রতি তাঁদের এই সম্মান সমগ্র ব্রিটিশ জনগণের কাছে ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা নিঃসন্দেহে বাড়াবে। টম মুর ‘ডেলি এক্সপ্রেস’-কে বললেন, আমাদের সবাইকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। এই অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলায় জাতি ধর্ম বা শ্রেণিবৈষম্য থাকলে চলবে না। নাইটহুড পেলেন স্যর টম মুর। তাঁর নাম সুপারিশ করে বরিস জনসন তাঁকে ‘ন্যাশনাল ট্রেজ়ার’ বলে অভিহিত করেন। বিরোধী পার্টির নেতা স্যর কিয়ের স্টার্মার একমত বরিস জনসনের সঙ্গে, “স্যর টম এই ক্রাইসিসের সময় আমাদের সুদৃঢ় জাতীয় সংহতির প্রতীক।”
এত দিনে টমসাহেব পুরো ভ্যাবাচ্যাকা, “জীবনে কখনও ভাবিনি এমনও হতে পারে।” তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছের জোর থাকলে আর নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের কথা ভাবলেও হিরো হওয়া যায়। সব মিলিয়ে টম মুর নিজের জন্য এক পয়সাও না রেখে দান করেছেন তেত্রিশ মিলিয়ন পাউন্ড, মাত্র তিনশো তিন কোটি টাকা!
৩১ জানুয়ারি, মানে গত রবিবারই, নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য তাঁকে বেডফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তার পর, তাঁর করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। গত মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারি, করোনায় তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু সে এক তাৎপর্যহীন তথ্যমাত্র। বৃদ্ধ বয়স ও অসুস্থতা উপেক্ষা করে মানুষের জন্য যে লড়াই তিনি একা লড়েছেন, করোনার সাধ্য কি যে তাঁকে হারাবে!