Rabindranath Tagore

কেউ মনে রাখেনি কবির প্রিয় গৌরীপুর হাউসকে

এখান থেকেই জন্মদিন উপলক্ষে টেলিফোনের মাধ্যমে তিনি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। দূরভাষে পড়া সেই কবিতা সম্প্রচার হয় আকাশবাণী কলকাতার মাধ্যমে।

Advertisement

প্রবীর সরকার

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২১ ০৭:৩০
Share:

দূরভাষে কবিতা পড়ছেন রবীন্দ্রনাথ।

সে দিন জনবিরল কালিম্পঙের গৌরীপুর লজে সকাল থেকেই তুমুল ব্যস্ততা। সময়টা ইংরেজি ১৯৩৮ সাল। ব্যস্ততার কারণ দু’টি। প্রথমত, সেখানে উপস্থিত রবীন্দ্রনাথ, দ্বিতীয়ত, তারিখটি ২৫ বৈশাখ। কবিকে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানতে মংপু থেকে এসেছেন মৈত্রেয়ী দেবী, মনমোহন সেন। কলকাতা থেকে এসেছেন প্রবোধকুমার সান্যাল, সঙ্গে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা আর অমল হোমের পাঠানো উপহার, একটি সুদৃশ্য কলম। সকাল থেকেই মাঝে মাঝে ফুল হাতে আসছেন স্থানীয় পাহাড়ি মানুষ। আজ তো কেবল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন নয়, কালিম্পঙের ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই দিন। আজ প্রথম টেলিফোন সংযোগ স্থাপিত হবে এই পাহাড়ি শহরে এবং তাতে প্রথম কথা বলবেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। ৭৮তম জন্মদিনে আকাশবাণী কলকাতা এবং টেলিফোন দফতর এমন করেই জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাচ্ছে কবিকে। স্থির হয়েছে, জন্মদিন উপলক্ষে সদ্যরচিত একটি কবিতা আবৃত্তি করবেন রবীন্দ্রনাথ। টেলিফোনে উচ্চারিত সেই কবিকণ্ঠ প্রথমে ধারণ করবে কলকাতা রেডিয়ো স্টেশন, তার পর সেখান থেকে বেতারমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র।

Advertisement

তার ব্যবস্থা করতে তত ক্ষণে এসে গেছেন অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো কলকাতা কেন্দ্রের স্টেশন ডিরেক্টর নিরঞ্জন মজুমদার। যন্ত্রবিদ অশোক সেন আগেই পাকা করে গেছেন সব যান্ত্রিক ব্যবস্থা। টেলিফোন লাইনও পাতা হয়েছে কয়েক দিন আগে, আগের রাতের পাহাড়ি কালবৈশাখী তার ক্ষতি করতে পারেনি। পূর্ব নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত। কাচের দরজা দেওয়া ধ্বনি-নিরোধক ঘরে নির্দিষ্ট যন্ত্রের সামনে এসে বসলেন রবীন্দ্রনাথ। পরনে গাঢ় নীল রঙের সেই দীর্ঘ জোব্বা। ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান, ভেসে উঠল লাল আলোর সঙ্কেত, সঙ্গে সঙ্গেই বেতার তরঙ্গে ধ্বনিত হল কবিকণ্ঠ,

“আজ মম জন্মদিন।

Advertisement

সদ্যই প্রাণের প্রান্তপথে/ ডুব দিয়ে উঠেছে সে/ বিলুপ্তির অন্ধকার হতে

মরণের ছাড়পত্র নিয়ে।”

এমনই বহু বিচিত্র আবেগে নানা বছর দেশে-বিদেশে পালিত হয়েছে চিরনূতনের ২৫ বৈশাখ। শুধু শান্তিনিকেতন বা কলকাতায় নয়, পাহাড়ে, সমুদ্রে, মরুরাজ্যে, রাজপ্রাসাদে, জাহাজে বা মহাসমুদ্রের কোনও দ্বীপে— বিশ্বজোড়া ছিল তার বিস্তার। তবু কালিম্পঙের রবীন্দ্রজয়ন্তী এবং গৌরীপুর হাউস একটু যেন ভিন্ন।

দার্জিলিং, কালিম্পং আর কার্শিয়াং— বাঙালির বৃহত্তর দার্জিলিং ছড়িয়ে আছে এই তিন শৈলশহরে। মধ্যমণি অবশ্যই দার্জিলিং। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন, ‘ভালে কাঞ্চন শৃঙ্গমুকুট...’ কত কাল ধরে কত খ্যাতি তার, কত মানুষের সুখস্মৃতিতে আজ সে পাহাড়ের রানি। অথচ কাছেই কালিম্পং, সে যেন সুয়োরানির ছায়ায় ঢাকা দুয়োরানি। সুন্দরী কি সে-ও কিছু কম? তবু যে কেন রবীন্দ্রনাথ তাকে দেখতে, তার কাছে যেতে এত দেরি করেছিলেন কে জানে! অথচ দার্জিলিঙে প্রথম এসেছেন একুশ বছর বয়সে (১৮৮২), আর কার্শিয়াং দেখেছেন ৩৬ বছর বয়সে (১৮৯৭), কেবল ‘দেখা হয় নাই’ কালিম্পং।

কার্শিয়াং এবং কালিম্পং দুটিই বেশ পুরনো শৈলশহর। সেই কালিম্পঙে রবীন্দ্রনাথ প্রথম এলেন জীবনের একেবারে শেষ পর্বে, ৭৮ বছর বয়সে, ১৯৩৮-এ। এবং এসেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই দেখি ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০, মাত্র দু’-বছরের মধ্যে তিন বার কবির সান্নিধ্য পেয়েছে এ শহর। তাও দু’-চার দিনের ট্যুরিস্ট হিসেবে নয়, তিন বারে মোট ১৩০ দিন এই শৈলশহরে কাটিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, আর মৃত্যুর আগে এখানেই ছিল তাঁর শেষ ভ্রমণ। অথচ মাত্র আশি বছরের মধ্যেই সে কালিম্পং ভুলে গেছে কবির গৌরীপুর হাউস, যে ভবন তাঁকে আতিথ্য দিয়েছিল, যে ভবন এক ভিন্নতর ইতিহাসেরও সাক্ষী।

কালিম্পঙে এখন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি খুঁজতে গেলে গাড়ি সোজা নিয়ে যাবে ‘চিত্রভানু’। প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই ডান দিকে পাথরের ফলক। তাতে কবির ফ্রেস্কো, নীচে উৎকীর্ণ সেই গৌরীপুর হাউসে বসে লেখা কবিতার অসাধারণ দু’টি চরণ—

‘আমার আনন্দে আজ একাকার সব ধ্বনি আর রঙ

জানে কী তা এ কালিমপঙ?’

অথচ কবির জীবৎকালে ‘চিত্রভানু’ তৈরিই হয়নি। পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর সাধের এ বাড়ির ‘চিত্রভানু’ নামটি অবশ্য রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া, কিন্তু থাকেননি কখনও। শহরের প্রান্তে অনেকটা উঁচুতে, অনেকটা জায়গা জুড়ে সুদৃশ্য বাংলো। পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায় মেঘ আর রোদের খেলা। এখনকার দিনের ট্যুরিস্টরা অবশ্য তার চেয়েও
বেশি উৎসাহী পাশের ক্যাকটাস গার্ডেন দেখতে।

এ তো গেল চিত্রভানুর কথা, কিন্তু কোথায় গেল সেই বিখ্যাত ‘গৌরীপুর হাউস’? কালিম্পঙে তিন বারই এই গৌরীপুর ভবনে থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ, অথচ আজকের কালিম্পঙ জানে না কোথায় গেল সে বাড়ি। কেমন আছে সে গৃহ?

কেউ খবর রাখে না।

ঐতিহাসিক: কালিম্পঙের গৌরীপুর হাউস।

ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর শৈলনিবাস ছিল এই ‘গৌরীপুর হাউস’। ১৯৩৮-এর গ্রীষ্মে যখন স্থির হল কবি আসছেন কালিম্পঙে, তখন ব্রজেন্দ্রকিশোর সমস্ত বাড়িটিই ছেড়ে দিয়েছিলেন রsKev LsksFবীন্দ্রনাথের ব্যবহারের জন্য। এই বাড়িতে বসেই লেখা হয়েছে ‘জন্মদিনে’, ‘সেঁজুতি’র অনেক কবিতা, কিছু চিঠি আর প্রবন্ধ। সম্পাদনার কাজ করেছেন, বইয়ের নামকরণও করেছেন, প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন, হিংসায় উন্মত্ত বিশ্বব্যাপী যুদ্ধকামীদের প্রতি মৈত্রীর বার্তা দিয়েছেন এইখানে বসে। আবার এখান থেকেই ২০ দিনের জন্য বেড়াতে গেছেন মংপুতে, মৈত্রেয়ী দেবীর আতিথ্য গ্রহণ করতে। তাঁর জীবনের শেষ ভ্রমণও এখানেই, এই গৌরীপুর হাউস থেকেই অসুস্থ কবিকে শেষ বারের মতো নামিয়ে আনা হয়েছিল সমতলে।

কালিম্পং থেকে কিছু দূরে সম্প্রতি বিখ্যাত ডেলো পাহাড়। তার কাছে সেন্ট এন্ড্রুজ় কলোনিয়াল হোম। সারা দুনিয়া তাকে চেনে ‘গ্রাহাম্স হোম’ নামে। তার গির্জার চুড়ো আজও দেখা যায় অনেক দূর থেকে। বৃদ্ধ ডক্টর গ্রাহাম ঘোড়ায় চড়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন এই গৌরীপুর হাউসে। আসতেন দার্শনিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। দেখা করে গেছেন প্রবোধকুমার সান্যাল, আরও কত খ্যাত-অখ্যাত মানুষ। দলে দলে এসেছেন পাহাড়ি বৌদ্ধ ভক্তরা। শেষ ভ্রমণে এখান থেকে চিঠি লিখেছেন অমিয় চক্রবর্তীকে— ‘শারদা পদার্পণ করেছেন পাহাড়ের শিখরে, পায়ের তলায় মেঘপুঞ্জ কেশর ফুলিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। মাথার কিরীটে সোনার রৌদ্র বিচ্ছুরিত। কেদারায় বসে আছি সমস্ত দিন, মনের দিকপ্রান্তে ক্ষণে ক্ষণে শুনি বীণাপাণির বীণার গুঞ্জরণ।’

তার পর কবিতা লিখেছিলেন,

‘পাহাড়ের নীলে আর অরণ্যের নীলে

শূন্য আর ধরাতলে মন্ত্র বাঁধে ছন্দে আর মিলে

বনেরে করায় স্নান শরতের রৌদ্রের সোনালি।

হলদে ফুলের গুচ্ছে মধু খোঁজে বেগুনি মৌমাছি।

মাঝখানে আমি আছি,

চৌদিকে আকাশ তাই নিঃশব্দে দিতেছে করতালি।’

যে গৌরীপুর ভবনের উদার প্রাঙ্গণ এতটা আনন্দ দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে, সে ভবন আজ লুপ্ত হয়ে গেছে কালিম্পংয়ের স্মৃতিপট থেকে। হাস্যময়ী পাহাড়েরও হয়তো আজ আর মনে পড়ে না রবীন্দ্রনাথকে, এই সূর্যালোকিত পঁচিশে বৈশাখেও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement