ব্রিটিশ হাতফেরতা নেটিভ দেশের প্রথম দু’চাকা। এতেই যৌবনের রোদ্দুর এবং স্বপ্ন পাড়ি। দেশে-দেশে বেড়ানোর অ্যাসোসিয়েশন। শহরের নানা প্রান্তে সাইকেল-বিপণি। সে রোমাঞ্চ আর শিহরন আজ কোথায়!
Cycle

বাঙালির বাইসাইকেল

১৮৮০-র দশকেই এ শহরে সাইকেলের অবতরণ, অব্যবহিত পরেই গজিয়ে উঠেছে একের পর এক সাইকেল-বিপণি।

Advertisement

শিমূল সেন

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২২ ০৫:৪৫
Share:

রসিককে কি তা হলে ভুলে গেল বাঙালি পাঠক? পৌষ ১৩১৮, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প বেরোল, নাম ‘পণরক্ষা’। প্রধান চরিত্র রসিক, সহসা যার মোলাকাত ঘটে গিয়েছিল সাইকেলের সঙ্গে! গ্রামের এক জনের থেকে নিয়ে রসিক মকশো করছিল দ্বিচক্রযানে। বাইসাইকেলে কিয়ৎক্ষণ অনভ্যস্ত পা-চালির পর তার ঝটিতি উপলব্ধি: “কী চমৎকার, কী স্বাধীনতা, কী আনন্দ! দূরত্বের সমস্ত বাধাকে এই বাহনটা যেন তীক্ষ্ণ সুদর্শনচক্রের মতো অতি অনায়াসেই কাটিয়া দিয়া চলিয়া যায়।” সাইকেল-প্রলুব্ধ রসিক তার দাদা বংশীবদনকে সাধাসাধি করে বস্তুটি কিনে দেওয়ার জন্য, দাম শুনে দাদাও বিমূঢ় ও হতচকিত, “এক-শো পঁচিশ টাকা আমি কোথায় পাইব।”

Advertisement

তথ্য বলছে, রবীন্দ্রনাথ ‘পণরক্ষা’ লেখার ঢের আগেই সাইকেল-সংস্কৃতি জাঁকিয়ে বসেছিল ঔপনিবেশিক কলকাতায়। অবশ্যই, তা বাঙালির নিজস্ব নয়— ব্রিটিশের হাতফেরতা শৌখিন কেতা। ১৮৮০-র দশকেই এ শহরে সাইকেলের অবতরণ, অব্যবহিত পরেই গজিয়ে উঠেছে একের পর এক সাইকেল-বিপণি। ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা— সাহেবি কলকাতার এই ঘেরাটোপেই তখন সাইকেলের বাড়বৃদ্ধি। ওই দশকেই কলকাতা গজিয়ে উঠতে দেখেছে একের পর এক সাইকেল-সঙ্ঘ, ময়দানে ওয়াইএমসিএ, ক্যালকাটা রেঞ্জার্স বা হাওড়া ইউনাইটেড, উত্তরপাড়ায় ‘পিকউইক’-এর মতো সাইকেল-গোষ্ঠী, নেতৃত্বে এদেশি নেটিভরা।

বিশ শতকের আগে সাইকেল কেবল বাহন নয়, ব্রিটিশ পরিচিতির স্মারকও। ১৮৯৮ সাল, ‘বেঙ্গল সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ বার করল সাইকেল-প্রসারের স্বার্থে একটি গাইডবই। লেখক, ডব্লিউ এস বার্ক। বাংলার ভূগোল, জলবায়ু আর রাস্তাঘাট যে কেন সাইকেল-চালনার অনুকূল, তা দেখিয়ে বই জুড়ে যুক্তি সাজালেন বার্ক। “পা-হাঁটার চেয়ে দ্রুততর, আবার ঘোড়া পোষার থেকেও সস্তা— সাইকেল লা-জবাব! ধরা যাক, এই মাত্র কলকাতা থেকে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত যে পথিক এসে পৌঁছলেন শ্রীরামপুর, তিনি জানেনও না, তাঁর সহগামী সাইকেল-আরোহী তত ক্ষণে পৌঁছে গেছেন ঘুসুড়ি!” বার্ক অঙ্ক কষে দেখালেন, সাইকেল-চালনা বস্তুত পায়ে হাঁটার তিন গুণ দ্রুততর। তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছনো বার্কের উদ্দেশ্য হলেও রেলপথ নিয়ে তিনি নিশ্চুপ, কারণ বার্কের চোখে সাইকেল কেবলই গণ-পরিবহণের মাধ্যম নয়, তা ব্রিটিশের ভারতদর্শন-প্রকল্পের উপাদান-বিশেষ। ট্রেনে চাপলে ততটা খোলে না চার পাশের আবহ, চতুর্দিকের জনসমাজ সম্পর্কেও হয় না কোনও সার্বিক মূল্যায়ন। অতঃপর বার্কের অনুসিদ্ধান্ত: ভারতের গ্রামদেশ চেনাতে সাইকেলের জুড়ি নেই!

Advertisement

বস্তুত, সাইকেলের মোদ্দা ব্যঞ্জনা লুকিয়ে আছে সাইকেল-আরোহীর আত্মনিয়ন্ত্রণ আর শৃঙ্খলার তালিমে। ওই কসরত যাঁর যত বেশি, তিনি ততই পোক্ত। ১৮৯০ দশকের পরেই ইংল্যান্ড গেলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, অবলা বসু-রা। লন্ডনের রাস্তায় কাতারে কাতারে গাড়িঘোড়া ও যানজটের ভিতর সাইকেলের মিছিল, ব্রিটিশের শৃঙ্খলা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ জরিপ করে দু’জনেই চমৎকৃত! ব্রহ্মবান্ধবের টিপ্পনী, “শৃঙ্খলার বিশেষ পরিণতি না হোলে এরূপ বৃহৎ ব্যাপার অত সুনিয়মে চলে না।”

অবশ্য, বাঙালি এলিটের জবান যখন আঁকড়ে রাখছে শৃঙ্খলা আর আত্মোন্নতির উদ্‌যাপন, তখনই শহরে ঘটে চলেছে একের পর এক দাঙ্গা। আর, আক্রান্ত হচ্ছেন সাইকেল-আরোহী সরকারি কর্মচারীরা। ১৮৯৭ সালে চিৎপুরে বিপুল দাঙ্গা, সাইকেল-উপবিষ্ট সৈনিকদের তাক করে নাগাড়ে পাথর ছুড়েছিল বিদ্রোহীরা। বস্তুত, ভারতব্যাপী হুজ্জুতির ইতিহাসে বাইসাইকেল বরাবরই বজ্রকঠিন ও জরদ্গব শাসনতন্ত্রের দ্যোতক!

ডেভিড আর্নল্ডের গবেষণা ঘাঁটলে দেখা যাবে, সাইকেল-আরোহী স্বাস্থ্যকর্মীদের লক্ষ করে ইট-পাটকেল পড়েছে বিশ শতকেও। ভারতব্যাপী এই ছবিতে কলকাতাও বিশেষ ব্যতিক্রম নয়! সাইকেল যে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলার দোসর, এই মনোভাবের প্রমাণ অজস্র।

বিশের দশকের মাঝামাঝি সুনির্মল বসু তাঁর ছড়ায় তির্যক ভঙ্গিতে লিখেছেন, “বলিয়া গেছেন তাই মহাকবি মাইকেল/ যেয়ো না যেয়ো না সেথা, যেথা চলে সাইকেল।” সতর্কবার্তার পর ফুকরে ওঠে জাতিসত্তার জিগির: “তাই আমি বলিতেছি, পালা না রে এখনি/ বাঙালী হয়েছ বাপু, পলায়ন শেখনি?”

এহ বাহ্য। এই ব্রিটিশসুলভ পণ্যটিকে বাঙালি কবে থেকে ঘরে তুলল? কলকাতা পুরসভার তামাদি দলিল ঘাঁটলে দেখা যাবে, ১৯০৬-০৭’এর সময় থেকেই কর্তৃপক্ষের তরফে মুফতে সাইকেল বিলোনো আরম্ভ হয়েছিল, প্রাপক ছিলেন মূলত পিওন, টেলিগ্রাম-বাহক গোছের অধস্তন কর্মীরা। বিশ্বযুদ্ধের আগেভাগেই এ রেওয়াজ আরও পোক্ত হয়ে ওঠে। এই পর্যায়ে এসে সাইকেল আর বড়লোকি ঠাটের বিলাসসামগ্রী নয়, বরং দৈনন্দিন বাহন। ১৯১৮ সাল, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হব-হব। মাত্র ক’বছরেই সাইকেলের পুরনো প্রতিমা ভেঙেচুরে খানখান, নতুন আমলে এসে সে ক্লান্তিকর কেরানি-জীবনের দ্যোতক। এই ক্রান্তিতে, ‘যমুনা’ পত্রিকায় যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত লেখেন তাঁর বারোমাস্যা: “বৈশাখে চূতশাখে ডাকে পিককুল/ তরুছায়ে মধুবায়ে ফুটে কত ফুল/... আমি কি করি?/ যা-তা উদরে ভরি,/ খুঁজিতে পথের ত্রুটি/ ‘বাই-সাইকেলে’ উঠি–/ সাড়ে-দশ ক্রোশ ছুটি;– এই চাকুরি!” বুদ্ধদেব বসুর পর্যবেক্ষণ-মোতাবেক, যতীন্দ্রমোহনের কবিতা আশ্রয় করে ছিল ‘আবেগের রুদ্ধশ্বাস জগৎ’ নয়— বরং, রোজকার সাংসারিক সমতল।

সাইকেলের কেরানি-ইমেজ অবশ্য বেশি দিন টেকেনি। হুজুরের খিদমত খাটার বদলে, সাইকেল দ্রুত হয়ে উঠল পাল্টা প্রভুত্ব ফলানোর ফিকির। নতুন দশকে পা রাখল সে, আর এক ধাক্কায় বদলে গেল বাঙালির এতাবৎ ভ্রমণ-ইতিবৃত্ত। এর আগে, শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, চন্দ্রশেখর সেনরা ইংল্যান্ডে গিয়ে চমৎকৃত হতেন, অনেক ক্ষেত্রে বিলেতকেই ঠাউরে নিতেন ব্রহ্মাণ্ডের আদর্শ জায়গা হিসাবে। ওই কারণে, এঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বইয়ের শিরোনামে মিলবে ‘ওয়ার্ল্ড-টুর’-গোছের শব্দবন্ধের আকছার ব্যবহার। ১৯৩০-এর দশক থেকে বিশ্বদর্শন তার খোলনলচে পাল্টেছে ক্রমশ, নতুন সংজ্ঞা পেয়েছে সাইকেল, উঠে এসেছে দুনিয়াদারির অভিনব ধুয়ো: ‘গ্লোবট্রটিং’। সাম্রাজ্য আর সর্বভারতীয় রাজনীতির জোড়া ধাক্কায় প্রহৃত বাঙালির শেষ খড়কুটো! সাইকেল-বিপণি তত দিনে মধ্য কলকাতার আগল ডিঙিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে শহরের নানা প্রান্তে। প্রেসিডেন্সি কলেজের সাবেক ছাত্র, সাইকেল-উৎসাহী সুধীরকুমার সেনের অধিনায়কত্বে জাঁকিয়ে বসছে ‘সেন অ্যান্ড পণ্ডিত’ কোম্পানি, সাইকেল-বিষয়ক নিয়মিত মাসিক জার্নালও বার করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনী প্রচারেও ক্রমশ মান্য ভাষা হিসেবে উঠে আসছে, ইংরিজি নয়— বরং, বাংলা।

১৯৩১। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পল্টন-পালানো সৈনিক রামনাথ বিশ্বাস সিঙ্গাপুর থেকে একটি ছোট বাইসাইকেলে শুরু করলেন তাঁর দুনিয়া-জরিপ। সাইকেলের গায়ে, অর্ধবৃত্তে লেখা: ‘রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, হিন্দু ট্রাভেলার!’ এর পরবর্তী কয়েক দশকে, দফায় দফায় তামাম ভূমণ্ডল উজিয়ে এলেন শ্রীহট্টের ভূমিপুত্র, বাংলার অন্যতম বেস্টসেলার হয়ে উঠল তাঁর রুদ্ধশ্বাস চরণিক-জীবন। আমেরিকার স্মৃতি-রোমন্থনে রামনাথ গর্বিত, “মাইলের হিসাবে অর্ধলক্ষ মাইল আমার ভ্রমণ করা হয়েছে। বাইসাইকেল পর্যটক হিসাবে, বাইসাইকেলে ভ্রমণের ইতিহাস শুরু হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত আমিই সকলের চেয়ে বেশী দেশ ও মাইল ভ্রমণ করেছি।” বইয়ের পর বই, অনুশীলন সমিতির প্রাক্তন সদস্য রামনাথ উঁচিয়ে রেখেছেন বাঙালিয়ানার নিশান।

অবশ্য, রামনাথ একা নন। ১৯২৬-এর সেপ্টেম্বরেই চার হাজার মাইলব্যাপী দীর্ঘ যাত্রায় যোগ দিয়েছেন চার বাঙালি যুবক: অশোক মুখোপাধ্যায়, অন্নদাবর্ধন মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্রনাথ ঘোষ ও নিরঙ্কনাথ মজুমদার। ওই বছরেরই ডিসেম্বরে, আরও চার বাঙালি তরুণ নেমে পড়েছেন ভূপ্রদক্ষিণের ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে! অশোক মুখোপাধ্যায়, বিমল মুখোপাধ্যায়, আনন্দ মুখোপাধ্যায় আর মণীন্দ্র ঘোষ। ছিলেন আরও অনেকেই। সাইকেল-চালনায় দুর্দান্ত নৈপুণ্য কালক্রমে হয়ে উঠল বাঙালি জাতিসত্তার তরফে পৌরুষ জাহির করার মোক্ষম অস্ত্র। তখনও অবশ্য কন্যাশ্রী হয়নি।

গ্লোবট্রটিংয়েরই সমান্তরালে, বাঙালি গড়ে তুলেছে একের পর এক সাইকেল-ক্লাব, দু-চাকার সূত্রে চারিয়ে দিয়েছে শৃঙ্খলিত সামাজিকতার বিচিত্র সব কিসিম। বিমল মুখোপাধ্যায়দের গোলক-সফরেরও আগে, উত্তর কলকাতার চার বাসিন্দা: দেবেন্দ্রনাথ ও মণীন্দ্রনাথ মুস্তোফী, জহরলাল দত্ত আর লাবণ্যকুমার সরকার তৈরি করে ফেলেছেন ‘ক্যালকাটা হুইলার্স’— সাইকেল-পর্যটনের স্বার্থে একটি আস্ত ক্লাব। সেই সঙ্ঘের পৃষ্ঠপোষক তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার এডি গর্ডন বা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার নলিনীনাথ সেন। দামাল সাইকেল-আরোহীদের উৎসাহ জোগান রাজশেখর কিংবা গিরীন্দ্রশেখর বসুরা। মণীন্দ্রনাথের জবানে এই অভিজ্ঞতা ‘ভ্রমণের নেশা’-শীর্ষকে বেরিয়েছিল ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায়। বই-আকারে তার ভূমিকা লিখেছেন জলধর সেন, আর ছবি এঁকেছেন যতীন্দ্রকুমার সেন। ভূমিকায় জলধরের স্বীকারোক্তি: “এঁদের ভ্রমণে, আর আমাদের সখের ভ্রমণে ঢের তফাত।” একদা দাপুটে পর্যটক ও ‘হিমালয়’-রচয়িতার টীকা: ‘এঁদের লিখিত বিবরণই প্রকৃত ভ্রমণকাহিনী’! সাইকেলের জেরে এক ধাক্কায় পাল্টে গেল বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের ধাঁচ। এখন থেকে রামনাথ, বিমল মুখোপাধ্যায় বা মণীন্দ্র মুস্তোফীর বইয়ে লেজুড় যাত্রার খুঁটিনাটি, অনুপুঙ্খ তথ্য, ফোটোগ্রাফ, এমনকি ম্যাপ। নথিবদ্ধ হল সাইকেল-ভ্রমণের নির্দেশিকা— ডায়েট, ঘুমের আদর্শ সময়, শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম বা ওষুধের ফিরিস্তি।

এত দিন বাঙালির সাইকেল-প্রীতির গল্প শুনিয়েছেন বহু গবেষক। রাধারমণ মিত্র, সিদ্ধার্থ ঘোষ, মণি বাগচী, হরিপদ ভৌমিক বা বিশ্বকর্মারা আলো ফেলেছেন সাইকেলে। কিন্তু সেই আলোচনার ভরকেন্দ্রে থেকে গেছে উৎপাদন, প্রযুক্তি আর ব্যবসার খতিয়ানটুকুই। সাইকেল-চড়ার আনন্দ, উত্তেজনা বা ক্লান্তিকে খুব একটা ধরেনি ইতিহাস। অতঃপর ১৯৪৭-এ ক্ষমতার পালাবদল। ব্রিটিশবিরোধী পৌরুষ ফলানোর আয়না হিসেবে সাইকেলের যে প্রাসঙ্গিকতা, তা যেন মিইয়ে গেল কিছুটা। নতুন দেশে সাইকেলের তুমুল জনপ্রিয়তায় নেহরু পর্যন্ত উচ্ছ্বসিত, র‌্যালে সংস্থার সঙ্গে যৌথ অংশিদারিত্বে কারখানা গড়লেন খোদ সুধীরকুমার সেন। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আজ্ঞায় সুধীরকুমারের স্বরাজসাধনার যে দৌড় আরম্ভ, তা সমে পড়ল স্বাধীন ভারতে এসে। ব্যবসার কথা তোলা রইল না-হয়। সাইকেল-প্রযুক্তি নিয়ে বাঙালির নিরীক্ষা অবশ্য স্রেফ ব্যোমকেশের গল্পেই থেমে থাকেনি! ষাটের দশকের গোড়ায়, চব্বিশ পরগনার বাসিন্দা শ্রীকৃষ্ণজীবন বন্দ্যোপাধ্যায় রাশিয়া থেকে বিস্তর দলিল এনে বানাতে গেলেন ‘আকাশচারী সাইকেল’। ‘অরনিথপটর’ নামে একটি খুদে যন্ত্র সেই সাইকেলে সাঁটা, সঙ্গে এক জোড়া এরোপ্লেন-সুলভ ডানা। প্যাডেল করলেই আকাশে গতি নেবে বিচিত্র উড়ো-সাইকেল! প্রযুক্তিস্বপ্নের এ-হেন আনকোরা উদ্যোগ আদৌ সফল হয়েছিল কি না, তার কোনও নিরেট সাক্ষ্য মেলে না। যদিও, বাঙালির সাইকেল-জীবন অব্যাহত থেকেছে তার পরের কিছু দশক।

সাইকেলের সমাজজীবন স্থগিত হয়ে যায় নব্বইয়ের দশকে এসে। বিশ্বায়নের একচ্ছত্র প্রতাপ, অর্থনীতিতে নাটকীয় বদল, ছাপোষা মধ্যবিত্ত ঘরে আবির্ভূত হল বিলাসবহুল চার চাকার গাড়ি। উল্টো দিকে, বিশ্ব-উষ্ণায়নে ক্রমেই তপ্ত-হয়ে-ওঠা ভূমণ্ডলে, যাতায়াতের নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে উঠে এল সাইকেল। সেই সুবাদে, বাইসাইকেল অধুনা জ্বালানি-রহিত গণ-পরিবহণের মাধ্যমও বটে! বিশ্বায়ন-উত্তর বাঙালি জীবনে এসেছে প্রাচুর্য, সম্ভোগ ও পণ্যরতি। বিনিময়ে খোয়া গিয়েছে আম-গেরস্তের প্রিয় যানটুকু! যৎকিঞ্চিৎ রেস্তের বিনিয়োগে, নগণ্য একটি দ্বিচক্র-সহ আন্তর্জাতিক হতে-চাওয়ার উত্তুঙ্গ স্পর্ধা একুশ শতকের প্লাস্টিক-বাঙালিয়ানায় নিছকই অতীতের কেয়ারি।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর এক কবিতায় লিখেছিলেন, “বরবটির খেত ঘুরে রামনাথ বিশ্বাস রোদ্দুর।/ তুমি খুশি হও, তুমি অভিযোগ কোরো না,/ বোলো না ‘অভাব’, বল ‘বাড়ন্ত’ সকলই...।” একুশ শতকের অবশিষ্ট বাঙালি গেরস্তজীবনে সাইকেল-সহ ওই রোদ্দুরটি উধাও! সে আর মিলবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement