ঐতিহাসিক: জল সরে গিয়ে সমুদ্রের বুকে প্রকাশিত রাপতা-র প্রাকারভিত্তি।
আমরা ছোটবেলা থেকেই সাত সমুদ্র তেরো নদীর কথা শুনে আসছি। পৃথিবীতে সমুদ্রের সংখ্যা সাতের অনেক বেশি, কিন্তু মহাসাগর ঠিক সাতটি। আর কেবল একটিরই নাম এক দেশের নামে। আমাদের ভারত মহাসাগর বা ইন্ডিয়ান ওশ্যান। কেন পৃথিবীর একটি মাত্র মহাসাগরেরই নাম একটি নির্দিষ্ট দেশের নামে— অন্য ছ’টির নয়?
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ অনুসারে, প্রাক্-হরপ্পা যুগ থেকেই এই মহাসাগরের তীরবর্তী ও দূরবর্তী দেশগুলিতে নানা ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল ভারত। ভারতীয় নাবিক এবং বণিকরা আফ্রিকা, এশিয়ার এই সব বিভিন্ন দেশের অধিবাসীদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় যোগ করেছিল চাল-ডালের মতো বিভিন্ন খাদ্যশস্য এবং মুরগির মতো প্রাণিজ প্রোটিন। মৃত্তিকানির্মিত লাল বা কালো ভারতীয় তৈজসপত্র ছিল সে সব দেশে খাদ্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশনের প্রধান উপকরণ। দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য এবং মসলিনজাতীয় সুতি, পশমবস্ত্র, অ্যাগেট পাথর, কার্নেলিয়ান পুঁতির মালা কিংবা হাতির দাঁতের চিরুনির মতো মূল্যবান সামগ্রীও থাকত ভারতীয় বণিকদের রফতানির তালিকায়। একই সঙ্গে ভারতীয় সুগন্ধি এবং মশলার কথাও বাদ দিলে চলবে না। কয়েক সহস্রাব্দ ধরে ভারতীয় বণিকরা দেশের উৎকৃষ্ট বাণিজ্যসামগ্রী নিয়ে পৌঁছে যেত ভারত মহাসাগরের বন্দরে বন্দরে। পরে বিদেশি বণিকেরা ও তাদের নৌপোতসমূহ ক্রমশ যুক্ত হয় ভারতের সঙ্গে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে এই ভারতকেন্দ্রিক মহাসাগরীয় বাণিজ্য বহুগুণ বেড়ে যায়। এই অগ্রগতির প্রাথমিক কারণ মৌসুমি বায়ুর গতিবিধি সম্পর্কে তৎকালীন বিদেশি নাবিকদের জ্ঞানার্জন। এই নির্দিষ্ট বায়ুপ্রবাহ আর কোনও মহাসাগরে এত স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় না। সে যুগের বণিক এবং নাবিকেরা উত্তাল ভারত মহাসাগরে তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য বিস্তারের কৌশল হিসেবে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক তত্ত্ব সফল ভাবে কাজে লাগিয়েছিল। গ্রিক ইতিহাসবিদ স্ট্র্যাবো (৬৪ খ্রিস্টপূর্ব-২৪ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর ‘জিয়োগ্রাফিকা’ গ্রন্থে লিখেছেন, তিনি এক বার আলেকজ়ান্দ্রিয়া বন্দরে কমপক্ষে একশো কুড়িটি জাহাজকে ভারতে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে দেখেছিলেন। আবার রোমান দার্শনিক প্লিনি (২৪-৭৯ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ বইতে লেখেন, ভারতীয় পণ্যের অত্যধিক দামের জন্য রোম সাম্রাজ্যকে সে যুগে বছরে ৫৫ হাজার কোটি সেস্টারসেস (এক ধরনের প্রাচীন রোমান মুদ্রা) ব্যয় করতে হত। এক কথায়, কয়েক সহস্রাব্দ ধরে এই মহাসাগরে ভারতই ছিল আকর্ষণের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু, তাই ভারতকেন্দ্রিক এই মহাসাগর বহু যুগ আগেই চিহ্নিত হয়েছিল ভারত মহাসাগর হিসেবে।
খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে লোহিত সাগরের এক অজ্ঞাতনামা গ্রিক নৌপথ-প্রদর্শকের লেখা পথ-সহায়িকা ‘পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি’। এই অসাধারণ বইটি আফ্রিকার পূর্ব উপকূল, আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের আশপাশে অবস্থিত বন্দরগুলির নাম, ব্যবসায়িক জিনিসপত্র, সেই অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বহু তথ্য নির্ভুল ভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে। অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধ অঞ্চলে অবস্থিত ‘বারবারিকম’ থেকে বাংলার ‘গাঙ্গে’ বন্দর পর্যন্ত সে যুগের সব ক’টি গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় বন্দরের নির্দিষ্ট খবর পাওয়া যায় এই বইটিতে। পেরিপ্লাসের সময়, রোমান জাহাজগুলি সাধারণত ‘হর্ন অব আফ্রিকা’র বাইরে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের অন্য কোথাও যেত না। সেই সময় এই বাণিজ্যপথটি আরব বণিকদের দখলে ছিল এবং তারা ছোট ‘ধাও’ (আফ্রিকার পূর্ব উপকূল এবং আরব সাগরে ব্যবহৃত এক ধরনের নৌকো) সদৃশ জলযানে এই পথে যাতায়াত করত। তার পরেও ‘পেরিপ্লাস’-লেখক যতটা সম্ভব খবর সংগ্রহ করে প্রথম লেখেন পূর্ব আফ্রিকা উপকূলের বন্দরসমূহের কথা। আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় পেরিপ্লাসে উল্লিখিত আজানিয়ার উপকূলে অবস্থিত আফ্রিকার পূর্ব প্রান্তের ‘শেষ বন্দর’ রাপতা। ‘রাপতা’ শব্দটির অর্থ সেলাই করা নৌকো। এই রাপতা বন্দরকে আফ্রিকার আটলান্টিসও বলা যেতে পারে। কারণ কোনও এক অজানা কারণে ১৬০০ বছরেরও বেশি আগে হঠাৎই, সম্ভবত সুনামি বা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলেই সমুদ্রগর্ভে নিখোঁজ হয়ে যায় আফ্রিকার সবচেয়ে বড় এবং দু’হাজার বছরের প্রাচীন এই বন্দর।
‘হর্ন অব আফ্রিকা’ থেকে রাপতা-র দূরত্ব ১৪০০ মাইল, সে যুগে জলপথে চব্বিশ দিনের যাত্রাপথ। বন্দরটি ছিল ইয়েমেনের এক রাজার অধীনে। রাপতার সঙ্গে আরবের মুজা নামক একটি বন্দরের নিয়মিত বাণিজ্য হত, যার অবস্থান ছিল লোহিত সাগরের প্রবেশপথে। ৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মুজার বণিকদের একটি সঙ্ঘ রাপতা বন্দরের কর আদায়ের জন্য রাজকীয় সনদ সংগ্রহ করে।
‘পেরিপ্লাস’-এর লেখা থেকে জানা যায়, রাপতা থেকে ‘প্রচুর পরিমাণে হাতির দাঁত এবং কচ্ছপের খোলস’ রফতানি হত। রাপতার রফতানিকারকেরা গন্ডারের শিং এবং অল্প পরিমাণে নটিলাসের (এক ধরনের রঙিন ঝিনুক) খোলাও বিদেশে পাঠাত। আরব বণিকরা মুজা থেকে রাপতা-য় অস্ত্রের সঙ্গে বর্শা, কুড়ুল, ছুরি প্রভৃতি সরঞ্জাম সরবরাহ করত। আরব বণিকরা রাপতায় প্রচুর পরিমাণে শস্য ও মদ পাঠাত। ‘পেরিপ্লাস’-এ লেখা আছে, এগুলি বন্দরের নিকটবর্তী স্থানীয় আফ্রিকান ব্যবসায়ীদের পারিতোষিক হিসেবে দেওয়া হত।
প্রখ্যাত ভৌগোলিক টলেমি (১০০-১৭০ খ্রিস্টাব্দ) ‘পেরিপ্লাস’-এর পরবর্তী যুগে রোমান বণিকরা কেমন করে সরাসরি রাপতা-তে পৌঁছনোর পথ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছিল এবং রাপতা-তে ভারতীয় সামগ্রী পৌঁছতে পেরেছিল, তার এক কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনি বর্ণনাকরেছেন। তিনি লেখেন, ‘ডায়োজেনিস’ নামে এক জন গ্রিক নাবিকের জাহাজ ভারত থেকে ফেরার সময় ‘হর্ন অব আফ্রিকা’য় শীতকালীন তীব্র বায়ুপ্রবাহের কারণে লোহিত সাগরে যাত্রা করতে সক্ষম হয়নি। তার বদলে তিনি আফ্রিকার পূর্ব উপকূল অনুসন্ধান করার কথা ভাবেন এবং রাপতা-তে ভারতীয় পণ্যসামগ্রী-সহ পৌঁছে যান। এর পর থেকে গ্রিক নাবিকরা সরাসরি রাপতা-তে ভারতীয় সামগ্রী রফতানি করতে থাকে। টলেমি আরও লিখেছেন খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে, রাপতা আঞ্চলিক রাজধানীতে পরিণত হয়েছিল এবং তাকে তিনি ‘মেট্রোপোলিস’ বা সে যুগের মহানগর হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আন্দাজ করা যায়, এই বন্দরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে গাঙ্গেয় বঙ্গ থেকেও পণ্য রফতানি হত, সম্ভবত চন্দ্রকেতুগড় বা তমলুক থেকেই।
তানজানিয়ার পূর্ব উপকূলে রুফিজি নদীর মোহনা সংলগ্ন ৩৯৪ বর্গ কিমি আয়তনের একটি স্বল্প পরিচিত দ্বীপ হল ‘মাফিয়া’।
জনৈক জার্মান অনুসন্ধানকারী ১৮৯০ সালে এখানে অবস্থিত একটি পর্তুগিজ কেল্লার কথা লিখে যান। কেল্লাটির বর্তমানে অস্তিত্ব নেই। ২০১৬ সালে ডুবুরি অ্যালেন সাটন ডুবুরি সেই হারানো কেল্লার খোঁজ করতে গিয়ে মাফিয়া দ্বীপের সাত কিলোমিটার উত্তরে সমুদ্রের নীচে প্রায় বৃত্তাকৃতি এক প্রাকারভিত্তির সন্ধান পান। অ্যালেন বোঝেন, এটি প্রাকৃতিক প্রবালপ্রাচীর নয়। এই প্রাকারভিত্তি কয়েক হাজার বর্গক্ষেত্রাকার এবং আয়তাকার ব্লক দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে নির্মিত। এটি কোনও কোনও স্থানে বর্তমানে বিলুপ্তও। প্রাকারের উপরাঞ্চলে সবচেয়ে বড় ব্লকগুলির ক্ষেত্রফল প্রায় ২৫ বর্গমিটার এবং ৪০ সেন্টিমিটার পুরু। অ্যালেনের মতে, প্রাকারভিত্তির ব্লকগুলি আধুনিক কংক্রিটের মতো কোনও মিশ্রণ দিয়ে তৈরি। এগুলি তৈরির সময় সেগুলিতে সিমেন্টের মতো কিছু মেশানো হত, যা এই কৃত্রিম পাথর তৈরিতে সাহায্য করত। কিছু ব্লকের মধ্যে ছোট নিখুঁত বর্গাকার ছিদ্র রয়েছে এবং সেই সঙ্গে প্রান্তের কাছে আয়তাকার গর্তও রয়েছে। এই প্রাকারভিত্তি এখন জলে নিমজ্জিত একটি বালির দ্বীপকে ঘিরে অবস্থিত।
অ্যালেন সাটন এবং দার-এ সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রফেসর ফেলিক্স চামি— দু’জনেই এই স্থানটিকে আফ্রিকার প্রাচীন রাপতা বন্দর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। চামি বলেন, রোমান নথির বর্ণনায় রাপতার অক্ষাংশ ছিল ৭.৭ ডিগ্রি দক্ষিণ এবং এটি নদীমোহনায় অবস্থিত, যে বর্ণনা এই স্থানটির সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে। মূল মহানগরটি সম্ভবত মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত ছিল। বর্তমানে জলে নিমজ্জিত স্থানটি ছিল গভীর সমুদ্রবন্দর। বৃহৎ বাণিজ্যপোত অগভীর জলে যেতে না পেরে হয়তো এখানে নোঙর ফেলে সামগ্রী নামাত, তার পর ধাও-এর সাহায্যে সেগুলিকে রাপতা নগরীতে পৌঁছনো হত।
এই কাহিনি জানার পর থেকেই আফ্রিকার সেই বিখ্যাত বন্দরের প্রত্নাবশেষ দেখার ইচ্ছে ছিল। শুনেছিলাম, শুধুমাত্র অত্যধিক ভাটার সময়ই জলের মধ্যে সেই লুপ্ত বন্দরের সুপ্ত প্রাকার দেখতে পাওয়া যায়। তাই গত ১৪ জুন, ২০২২ পৌঁছেছিলাম তানজানিয়ার অন্তর্গত মাফিয়া দ্বীপে। সঙ্গে দার-এ সালাম ভারতীয় দূতাবাসের সোয়াহিলি দোভাষী জর্জ ফিলিপ। ১৪ জুন ছিল পূর্ণিমা। তাই আশা করা যায়, মহাসাগরে অত্যধিক ভাটা থাকবে ১৫ জুন। ১৫ জুন, ২০২২ সকালে মাফিয়া দ্বীপের তুম্বুজু সমুদ্র সৈকতের নারকেল গাছের সারি, পাতায় ছাওয়া মৎস্যজীবীদের বসতি আর কয়েকটি সাগর-ফেরত ধাও পিছনে ফেলে স্পিডবোটে যাত্রা করলাম নিমজ্জিত বন্দর রাপতা-র উদ্দেশে। ২০১৬ সালে এই প্রাচীন বন্দরটি আবিষ্কৃত হলেও স্থানীয় মৎস্যজীবীরা সোয়াহিলিতে ওই প্রত্নাবশেষকে পরম্পরাগত ভাবে বলে ‘মুকুতানি’। ‘মুকুতানি’ শব্দের অর্থ ‘প্রাকারবেষ্টিত স্থান’।
স্পিডবোট নীল সমুদ্রের জল কেটে এগিয়ে চলল। কয়েকটি মাছ ধরার নৌকোকে পিছনে ফেলে মিনিট কুড়ি চলার পর আমরা দূর থেকে মাঝসমুদ্রের অনেকটা এলাকা জুড়ে সমান্তরাল খাড়া বিক্ষিপ্ত কালো পাথর দেখতে পেলাম। কাছাকাছি যেতে বোঝা গেল সব পাথর খাড়া নয়, এক বিস্তীর্ণ সমতল স্থানও সেখানে আছে। নৌকোচালক বলল, আমরা ওখানে নামতেও পারব, তবে তা আরও কিছুটা পরে। কারণ ভাটাতে সব জল এখনও নামেনি। মিনিট কুড়ি সমুদ্রে পাক খাওয়ার পর বোট ভিড়ল ওই পাথরের প্ল্যাটফর্মে। সদ্য জল নামা পুরু শেওলার আস্তরণে ঢাকা এক পিচ্ছিল পাথরের চৌকো ব্লকে তৈরি পথে আমরা নামলাম। পথের দু’ধারে নানা মাপের হেলে থাকা পাথরের স্ল্যাব। কোনওটা খাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে, কোনওটা সমান্তরাল ভাবে হেলে রয়েছে। বর্তমানে পথ মনে হলেও আসলে এটি বৃত্তাকার রাপতা বন্দরের প্রাকারভিত্তির একাংশ। পথের দু’দিকে আধডোবা পাথরগুলি গেঁথে গেঁথেই এক দিন নির্মিত হয়েছিল এই বন্দরের এক বিশাল প্রাকার। পথের ধারে অগভীর সমুদ্রের অনেকটা জুড়ে ঘন সবুজ সামুদ্রিক ঝাঁঝি। কখনও সমতলে, কখনও আবার পাথরের উপর পাথর উঠে এখানে আমাদের চলনপথকে বন্ধুর করে তুলেছে। আমরা যখন ওখানে নামলাম, তখনও পাথরের খাঁজে ভাটার জলের সঙ্গে পালাতে না পারা কয়েকটি মাছ খাবি খাচ্ছিল। কোথাও পাথরের ফাঁকে জমা জলে ছোট ছোট মাছ খেলা করে বেড়াচ্ছে। ইতস্তত ছড়িয়ে আছে লাল বা হলুদ স্টারফিশ। পথের উপর সূর্যের তীব্র আলোয় রং খোয়ানো, কয়েকশো বছরের প্রাচীন প্রবালগুচ্ছ জমে পাথর হয়ে চলার পথ এবড়োখেবড়ো করেছে। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে জলের ভিতর রংবেরঙের নানা আকৃতির নরম প্রবাল, পাথর আঁকড়ে শোভা বৃদ্ধি করছে। পায়ের শব্দে সাদা বা লাল কাঁকড়া অথবা শামুক তড়িঘড়ি নিজেদের লুকোতে ব্যস্ত। সমুদ্রের লুকোনো জগৎ যেন আজ আমাদের সামনে সূর্যালোকে প্রকাশিত।
গিয়ে নেমেছিলাম প্রাকারভিত্তির উত্তর-পশ্চিম কোণে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছি আরও উত্তরে। হেঁটে ফেলেছি প্রায় দু’কিমি পথ। এর পর আর পথ নেই। প্রাকারভিত্তি বসে গেছে মহাসাগরে। মেপে দেখা গেছে, যে পথ ধরে আমরা এত ক্ষণ হেঁটে এসেছি সেই পথের প্রস্থ সর্বোচ্চ ৪০ মিটার এবং সর্বনিম্ন ১৭ মিটার। এ বার ফিরতে হবে। চুপ করে এক জায়গায় দাঁড়ালাম। অখণ্ড নিস্তব্ধতা ভেদ করে শুধু পাথরে সমুদ্রের জলের ঝাপটার শব্দ। মাথার উপর উজ্জ্বল সূর্য আর নীলাকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। পায়ের নীচে কয়েক মিটারের সরু পথ। চার পাশে ভারত মহাসাগরের উত্তাল জলরাশি।
পথের ধারে ইতিমধ্যেই চোখে পড়েছিল প্রবালের আস্তরণে ঢাকা একটি প্রাচীন ভগ্ন মাটির জালা এবং ইতস্তত ছাড়ানো মৃৎপাত্রের অবশেষ। এগুলি ঠিক কত পুরনো তা পরীক্ষা না করে বলার উপায় নেই। নৌকোয় ওঠার আগে হঠাৎ প্রবাল ও বার্নাকলসের (শক্ত খোলাবিশিষ্ট এক প্রকার সামুদ্রিক প্রাণী) ঘন আস্তরণে লুকিয়ে থাকা কয়েকটি লোহার পাইপ দেখতে পেয়ে বুঝতে পারলাম এটি সম্ভবত প্রাচীন এক জাহাজডুবির অবশেষ। এগুলোর ভিতর একটি বাঁকানো পাইপ আমরা মেপে দেখেছিলাম, প্রায় ছ’মিটার। প্রবাল ও বার্নাকলসের কঠিন আস্তরণ সরালে ওই নৌকো বা জাহাজের আরও অনেক কিছু দৃষ্টিগোচর হত হয়তো।
তত ক্ষণে জল আরও নামতে বৃত্তাকৃতি প্রাকারভিত্তির আরও কিছু অংশ মহাসাগরে উঁকি দিতে শুরু করল। পূর্ব দিকে তেমনই আর একটি অংশে নৌকোয় পৌঁছে নেমে হাঁটলাম। জিপিএস, স্যাটেলাইট মানচিত্র থেকে নেওয়া মাপে দেখা গেল, তাতে দৃশ্যমান প্রাকারভিত্তির দৈর্ঘ্য ৪.৩ কিমি। আর এই ভিত্তির আবদ্ধ এলাকার পরিধি ৭.৫ কিমি, আবদ্ধ এলাকার ক্ষেত্রফল ১.৬৩ বর্গকিমি। সব মিলিয়ে ঘণ্টাতিনেক ‘মুকুতানি’তে কাটিয়ে আমরা পাড়ি দিলাম মাফিয়া দ্বীপের উদ্দেশে।
ভারত মহাসাগরের প্রাচীন সামুদ্রিক বাণিজ্যের অান্তর্জালে আজও একটি স্বল্প আলোচিত অঞ্চল পূর্ব আফ্রিকা উপকূল। অথচ এই অঞ্চলটি খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দেরও বহু আগে থেকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের সোমালিয়া থেকে মোজাম্বিক পর্যন্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও উৎখননে ভারতীয় মৃৎপাত্র, পুঁতির মালা, শস্য, মুরগির হাড় প্রভৃতির খোঁজ মিলেছে। এই নিদর্শন থেকে নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, ভারত-পূর্ব আফ্রিকার সম্পর্ক অতি প্রাচীন। হুইলার, কাসাল প্রমুখ পাশ্চাত্যের প্রত্নবিদ ভারত মহাসাগরের ঔপনিবেশিক প্রত্নতত্ত্ব চর্চার যে নকশা তৈরি করেছিলেন, তাতে এই বাণিজ্যে পাশ্চাত্যের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে ভারতের ভূমিকাকে অকিঞ্চিৎকর প্রমাণের এক সচেতন প্রয়াস ছিল। তার কিছুটা পরে সংশোধনের চেষ্টা হলেও এখনও অনেক কাজ বাকি। প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রফেসর ফেলিক্স চামির মতে, আজ অন্য কারও উপর ভরসা না করে ভারত এবং আফ্রিকার ইতিহাসবিদ ও প্রত্নবিদদেরই একত্রে এগিয়ে আসতে হবে। রাপতার প্রত্নাবশেষ অন্বেষণে যৌথ প্রয়াসের ক্ষেত্রে এই সহযোগিতা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।