লন্ডন সায়েন্স মিউজ়িয়ামে নির্মিত ডিফারেন্স ইঞ্জিন। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স
আঠারোশো একুশ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকাল। লন্ডনের ৫ ডেভনশায়ার স্ট্রিটে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। নামলেন কেতাদুরস্ত এক ভদ্রলোক। বয়স তিরিশ ছুঁইছুঁই। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী। নাম জন ফ্রেডরিক উইলিয়াম হার্শেল। শনি এবং ইউরেনাস গ্রহের উপগ্রহ আবিষ্কারের জন্য যিনি পরে বিখ্যাত হয়েছেন। বিখ্যাত বাবার সুযোগ্য সন্তান। বাবা ফ্রেডরিক উইলিয়াম হার্শেল। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কার করেন।
জন কার বাড়িতে এসেছেন? চার্লস ব্যাবেজ। তাঁর বয়সও তিরিশ। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক এবং রয়্যাল সোসাইটির ফেলো। ইউরোপের গণিতজ্ঞরা একডাকে চেনেন। সেই ব্যাবেজের কাছে জন কেন এসেছেন? এসেছেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। জন বগলদাবা করে নিয়ে এসেছেন গাদাগাদা হিসেব লেখা কাগজপত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-কিতাব। সুবিধে হল, এ সব হিসাব-কিতাব ফরমুলা-নির্ভর। ফরমুলায় ফেলে দিলেই, আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের কে কোথায় আছে— বা হাজার বছর পরে কোথায় থাকবে— তা জানা যাবে। মুশকিল হল, সেই গণনার কাজ করে কম্পিউটার। যন্ত্র নয় তারা, মানুষ। কম্পিউট (গণনা) যারা করে, তারা হল কম্পিউটার। সে গণনায় ভুল হয় মানুষের। স্বাভাবিক, কারণ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গণনা যে। সে সব ভুল শোধরাতেই জন এসেছেন চার্লস ব্যাবেজের কাছে। ভুল সংশোধন প্রয়োজন। জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় মজে থাকতে হলে ভুল করা চলবে না। গণনায় ভুল থাকলে বাস্তবের সঙ্গে তা মিলবে না। আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান হবে বাস্তবে এক রকম, আর ভুল গণনার উপর ভিত্তি করে তা পাওয়া যাবে আর এক রকম। ফলে থেকে যাবে গরমিল।
ভুল শোধরাতে দুই বন্ধু বসলেন ব্যাবেজের ড্রয়িং রুমে। কেমন করে গণনায় ভুল ধরবেন ওঁরা? যে যে গণনা করেছেন দু’জন কম্পিউটার, এবং অমিল হচ্ছে ফলাফলে, সেই সেই জায়গায় নিশ্চয়ই ভুল করেছেন কোনও এক জন কম্পিউটার। আর যে সব জায়গায় একাধিক কম্পিউটার একই ফল পেয়েছেন, সে সব জায়গায় গণনায় কোনও ভুলই নেই। ভুল হলে একাধিক কম্পিউটারের একই ফলাফল আসত না।
বগলদাবা করে আনা কাগজপত্রের তাড়া সমান দু’ভাগে ভাগ করলেন জন। এক ভাগ রাখলেন নিজের কাছে, অন্য ভাগ দিলেন ব্যাবেজের জিম্মায়। দু’জন কাছে রাখলেন দু’জন কম্পিউটারের গণনা। তার পর মিলিয়ে দেখতে লাগলেন সে সব। গণনায় অমিল, মানে ভুল। জন পড়ে যান, ব্যাবেজ মিলিয়ে দেখেন। লাইনের পর লাইন। এ ভাবে কম্পিউটারদের প্রচুর ভুল খুঁজে বার করলেন জন এবং ব্যাবেজ। ব্যাবেজ বিরক্ত হয়ে বলে ফেললেন, “ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, গণনা যেন স্টিম দিয়ে হয়।” স্টিম দিয়ে গণনা? মানে, মানুষ গণনা না করে যদি যন্ত্র তা করত! তখন শিল্পবিপ্লবের যুগ। যন্ত্র চলে জলীয় বাষ্পের শক্তিতে। যেমন জলীয় বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিন। সেই সাধ ব্যক্ত হল ব্যাবেজের মন্তব্যে। যন্ত্র যদি গণনা করত, তা হলে আর ভুল হত না।
নির্ভুল গণনার ওই সাধ বা স্বপ্ন তাড়া করে ফিরেছিল ব্যাবেজের সারাটা জীবন। রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট স্যর হামফ্রে ডেভিকে অবশেষে একটি চিঠি লিখলেন ব্যাবেজ। তারিখ ৩ জুলাই, ১৮২২, আজ থেকে ঠিক ২০০ বছর আগে। লিখলেন, “আমি এমন এক ইঞ্জিনের [আসলে যন্ত্রের] নকশা করেছি, যা কোনও সংখ্যাকে (m) অন্য সংখ্যা (n) দিয়ে গুণ করতে পারবে।... আমি এমনও ইঞ্জিনের নকশা ভেবেছি, যা চাইলে ০ থেকে এক কোটির মধ্যে যে কোনও মৌলিক সংখ্যা [যে সব সংখ্যার এক এবং সেই সংখ্যাটি ব্যতীত আর কোনও উৎপাদক নেই] নির্ণয় করতে পারবে।”
যন্ত্রগণক বা আধুনিক কম্পিউটারের বীজ ওই চিঠির মধ্যেই নিহিত। সেই অর্থে কম্পিউটার যন্ত্রের পরিকল্পনার ২০০ বছর পূর্ণ হল আজ। কলকব্জার জনক বলে মনে করা হয় ব্যাবেজকে। স্যার হামফ্রে-কে লেখা ওই চিঠির সুবাদে। ডিজিটাল কম্পিউটার তৈরির ক্ষেত্রে অন্তত তিন জন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ব্যাবেজের জয়গানে মুখর হয়েছেন— অ্যালান ম্যাথিসন টুরিং, ডগলাস রেনার হারট্রি এবং বারট্রাম ভিভিয়ান বাওডেন।
কে এই চার্লস ব্যাবেজ? জন্ম ২৬ ডিসেম্বর, ১৭৯১। সারে জেলার ওয়ালওয়ার্থে। বাবা বেঞ্জামিন ব্যাবেজ। লন্ডনে ব্যাঙ্ক-মালিক। মা এলিজ়াবেথ প্লুমলে টিপে। দুই ভাই মারা যান শৈশবে। এক বোন বেঁচে ছিলেন অনেক দিন। তাঁর আত্মজীবনী ‘প্যাসেজেস ফ্রম দ্য লাইফ অব আ ফিলোজ়ফার’ পড়লে বোঝা যায়, শৈশব থেকেই অনুসন্ধিৎসু। স্কুলের বন্ধুরা বলেছিল, ভূত আছে, দত্যি আছে। ওরা নাকি খরগোশ, পেঁচা, কালো বেড়াল, দাঁড়কাকের বেশ ধরে আসে। আর, রক্তপাত ঘটলে নাকি ওদের দেখা পাওয়া যায়। বন্ধুদের কথামতোই এক দিন ঘোর রাতের অন্ধকারে একটি পোড়ো বাড়িতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলেন ব্যাবেজ। রক্তপাতের প্রয়োজনে কাটলেন নিজের আঙুলও। এক দিকে রক্তারক্তি, অন্য দিকে ভোঁ ভাঁ। ভূতপ্রেতের দেখা মিলল না। ভূতে বিশ্বাস গেল, কিন্তু আস্থা রয়ে গেল আধিভৌতিকতায়।
এই ব্যাবেজ পরিণত বয়সে হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি নির্বাচিত হন ‘লুকাসিয়ান প্রফেসর অব ম্যাথমেটিক্স’। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সদস্য হেনরি লুকাস-এর নামে ওই পদ চালু হয় ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। ‘দি ডেলি টেলিগ্রাফ’ কাগজের মতে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত অধ্যাপক পদ। একদা এই পদে আসীন ছিলেন আইজ়্যাক নিউটন, পল অ্যাড্রিয়েন মরিস ডিরাক এবং স্টিফেন উইলিয়াম হকিং।
গণিতের অধ্যাপকের তো গণনায় ভুল নিয়ে চিন্তিত হওয়ারই কথা। আসলে ঊনবিংশ শতকের শুরুতে গণনার জন্য ব্যবহৃত হত নানা রকমের টেবিল। গণনার তালিকা। সেই তালিকা কাজে লাগাতেন সবাই। বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়র, সার্ভেয়ার, স্থপতি, ব্যাঙ্কার, ঋণদাতা এবং ঋণগ্রহীতা। গণনা প্রয়োজন সব পেশার লোকদের।
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় নাবিকদের। ইংল্যান্ড তখন সমুদ্র-নির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি অনেকটা ব্যবসা-কেন্দ্রিক। আর, ব্যবসা পণ্যবাহী জাহাজ-নির্ভর। এখন, মাঝসমুদ্রে জাহাজ চলাচলে অনেক অসুবিধে। চার দিকে শুধু জল। জাহাজ যাবে কোন দিকে? কোন দিকে চললে পৌঁছনো যাবে নির্দিষ্ট বন্দরে? কম্পাসে কাজ চলে না। উপায় রাতের অন্ধকারে আকাশ দেখে চলা। অক্ষাংশআর দ্রাঘিমাংশ অনুযায়ী, গ্রহ-তারার অবস্থান অনুযায়ী অভিমুখ নির্ণয়। না হলে জাহাজ রাস্তা হারিয়ে ফেলবে। গ্রহ-তারার অবস্থান পুরোপুরি গণনার ব্যাপার।
গণনায় ভুলের শুদ্ধিপত্রও ছাপা হত। লন্ডন ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডায়োনিসিয়াস লার্ডনার গ্রহ-তারার অবস্থানের গণনায় ৪০ খণ্ডের বইতে অন্তত ৩০০০টা ভুল শনাক্ত করেন। তিনি ব্যঙ্গ করেন শুদ্ধিপত্রের শুদ্ধিপত্র নিয়েও। তাই ব্যাবেজের যন্ত্র দিয়ে গণনা করানোর স্বপ্ন স্বাভাবিক।
গণনা অনেক কাজে লাগে। ব্যাঙ্কে, বিজ্ঞানীদের গবেষণায়, সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন নৌযাত্রায়। তারাদের চলনের খুঁটিনাটি হিসেব জানা চাই। তারাদের চলন বুঝতে ত্রুটি হলে শুধু প্রাণহানিই হয় না, ব্যবসাও লাটে ওঠে। দুর্ঘটনায় জাহাজডুবি হলে লাইফসেভারের ফলাও বিজ্ঞাপন পত্রপত্রিকায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী হার্শেল চিঠি লিখলেন অর্থমন্ত্রী হেনরি গুলবার্নকে—‘হিসেবে ভুল যেন সমুদ্রে হিমশৈল। কখন যে কোন ভুলের জন্য জাহাজডুবি হবে, তা বলা যায় না।’ উপমাটি সার্থক। গণনায় ভুল থেকে জাহাজডুবি।
ব্যাবেজ নামলেন তাঁর স্বপ্নপূরণে। যন্ত্রগণক তৈরি করতে। এমন মেশিন তৈরি করতে, যা মানুষের মতো ‘ভাবতে’ পারবে। ওই ১৮২২ খ্রিস্টাব্দেই তিনি তৈরি করে ফেললেন এক মডেল। সেই মডেলের নাম তিনি দিলেন ‘ডিফারেন্স ইঞ্জিন’। কারণ সেই মেশিন কাজ করত ধাপে ধাপে বিয়োগফলের উপর ভিত্তি করে।
যেমন, কোনও সংখ্যার ত্রিঘাত বা ঘন বের করতে হবে। আমরা জানি, ১৩=১×১×১=১; ২৩=২×২×২=৮; ৩৩=৩×৩×৩=২৭; ৪৩=৪×৪×৪=৬৪; ৫৩=৫×৫×৫=১২৫। এখন ৮-১=৭; ২৭-৮=১৯; ৬৪-২৭=৩৭; ১২৫-৬৪=৬১। আবার ১৯-৭=১২; ৩৭-১৯=১৮; ৬১-৩৭=২৪। এ বার, ১৮-১২=৬; ২৪-১৮=৬। সুতরাং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অন্তরফল ৬। এটা পরের ঘনসংখ্যা— অর্থাৎ, ৬৩=৬×৬×৬=২১৬— এর ক্ষেত্রেও দেখানো যায়। এখন ২১৬-১২৫=৯১; ৯১-৬১=৩০; ৩০-২৪=৬। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অন্তরফল হচ্ছে ৬। এই ৬ কে অন্তরফল হিসেবে কাজে লাগিয়ে ব্যাবেজ তাঁর ডিফারেন্স ইঞ্জিন তৈরি করেন। এই ভাবেতিনি গুণ ও ভাগের প্রক্রিয়াকে (গণিতে যেসব কাজ কষ্টসাধ্য) যোগ এবং বিয়োগের কাজে পরিণত করেন।
সব চেয়ে বেশি অসুবিধে হাতে রাখার ক্ষেত্রে। ৮৮৯ এবং ১১১ যোগ করলে কী হয়? একক, দশক আর শতকের প্রত্যেকের ঘরে হাতে এক থাকে। যোগফল হয় ১০০০। ৯ এবং ১ যোগ করলে যে ১০ হয়, তার ০ বসে আর ১ পাশের ঘরে যোগ হওয়ার সময় চলে যায়, এ নিয়ম মানুষের পক্ষে মানা সহজ, কিন্তু যন্ত্রের পক্ষে? মানুষের চিন্তাশক্তি যন্ত্রের মধ্যে ঢোকাতে ব্যাবেজ একের পর এক যন্ত্রাংশ বাড়াতে শুরু করেন। ডিফারেন্স ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫০০০। ডিফারেন্স ইঞ্জিনের সাইজ় দাঁড়ায় লম্বায় আড়াই মিটার, চওড়ায় দু’মিটার এবং পুরুত্বে এক মিটার। শুধু গণনা নয়, গণনার ফল (আউটপুট) প্রিন্ট করারও ব্যবস্থা ছিল ওই যন্ত্রে।
লন্ডন শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এক দিন ব্যাবেজ আমন্ত্রণ জানালেন যন্ত্রের কার্যক্ষমতা দেখাতে। প্রিন্ট আউটে দেখা গেল, এই ক’টি সংখ্যা ফুটে উঠেছে।
৯৯,৯৯৯,৯৯৫
৯৯,৯৯৯,৯৯৬
৯৯,৯৯৯,৯৯৭
৯৯,৯৯৯,৯৯৮
৯৯,৯৯৯,৯৯৯
১০০,০০০,০০০
১০০,০০০,০০১
ফের যন্ত্রের হাতল ঘোরালেন ব্যাবেজ। পেলেন এই ক’টি সংখ্যা—
১০০,০১০,০০২
১০০,০৩০,০০৩
১০০,০৬০,০০৪
১০০,১০০,০০৫
১০০,১৫০,০০৬
হাতল ঘুরিয়ে এক সুশৃঙ্খল সংখ্যা থেকে আর এক সংখ্যা— কিন্তু সুশৃঙ্খল— দেখে ব্যাবেজের আমন্ত্রিত অভ্যাগতরা অবাক। আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন তরুণ রবার্ট চার্লস ডারউইন।যিনি পরে লিখেছিলেন, ‘অন দ্য ওরিজিন অব স্পিসিস বাই মিন্স অব ন্যাচারাল সিলেকশন, অর দ্য প্রিজ়ারভেশন অব ফেভার্ড রেসেস ইন দ্যস্ট্রাগল ফর লাইফ’ শিরোনামের বইটি এবংজগদ্বিখ্যাত হয়েছিলেন।
আর একটি যন্ত্রগণকও পরিকল্পনা করেন ব্যাবেজ। অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন। যা আধুনিক কম্পিউটারের কাছাকাছি। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ব্যাবেজের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে যন্ত্রের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। অথচ ব্যাবেজ অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের পরিকল্পনা করেছিলেন ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে। ৩৭ বছর ধরে তিনি অনেক প্ল্যান করেন। ৫০, ১০০-অঙ্কের সংখ্যা নিয়ে কাজ সে সব প্ল্যানের মধ্যে ছিল। ছিল আধুনিক কম্পিউটারের ধরনে ‘স্টোর’ (মেমারি) এবং ‘মিল’ (সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট)-এর ব্যবস্থা। তা ছাড়াও ছিল আধুনিক কম্পিউটারের মতো ‘যদি-তবে’-র কম্পিউটারের ব্যবস্থা। আধুনিক কম্পিউটারে থাকে ‘যদি-তবে’-র ব্যবস্থা। যদি এটা হয়, তবে কম্পিউটার এই পথে এগোবে। কম্পিউটার যদি দেখে ওটা, তবে অন্য পথে এগোবে। এ-পথ, ও পথ— দু’রকম পথেরই ব্যবস্থা থাকে কম্পিউটারে। যন্ত্র নিজে পরিস্থিতি বিচার করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করে। এমন ব্যবস্থা অ্যানলিটিক্যাল ইঞ্জিনেও ছিল।
তখন লন্ডন শহরের গণ্যমান্যদের বাড়িতে সান্ধ্য পার্টি আয়োজনের রেওয়াজ ছিল। এ রকমই একটি পার্টি আয়োজিত হয়েছিল ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন তারিখে। সেখানে ব্যাবেজের সাক্ষাৎ হয় এক জনের সঙ্গে। অ্যাডা লাভলেস। বিখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের কন্যা। লর্ড বায়রন বিয়ে করেছিলেন গণিতজ্ঞ অ্যানাবেলা মিলবাঙ্কে-কে। বিয়ে টেঁকে মাত্র ১১ মাস। কারণ অ্যানাবেলার তুতো-বোন ক্যারোলিন ল্যাম্ব খবর আনেন যে, বায়রন অন্য মহিলার শয্যাসঙ্গী হচ্ছেন। অ্যানাবেলা বায়রনকে ডিভোর্স দেওয়ার পর ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বায়রন ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যান। তারআগে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর অ্যাডারজন্ম হয়। কবি বায়রন নিজের মেয়েকে আরকখনও দেখেননি।
অ্যাডার জন্মের পর থেকেই অ্যানাবেলা চেষ্টা করেন তাঁকে বায়রনের প্রভাবমুক্ত রাখতে। নিজের দিকে টানতে। সে কারণে অ্যাডার সাহিত্যের ঝোঁক কমিয়ে অঙ্ক শিখতে অ্যানাবেলা পাঠান ইংল্যান্ডের বিখ্যাত গণিতজ্ঞদের কাছে। অ্যাডা গণিত শেখেন প্রথমে মেরি সামারভিলের (যিনি ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ের-সিমোঁ লাপ্লাস-এর রচনাবলি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন) এবং পরে প্রখ্যাত ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ অগস্টাস ডি মরগ্যান-এর কাছে। তাঁদের কাছে পড়ে অ্যাডা নিজেও হয়ে ওঠেন গণিতে পারদর্শিনী। বিশেষ করে বীজগণিত এবং ক্যালকুলাসে। বড়লোক জামাই আনতে অ্যাডার মা অ্যানাবেলা অ্যাডার বিয়ে দেন লাভলেসের আর্ল উইলিয়াম কিং-এর সঙ্গে। বিয়ের পর অ্যাডা হলেন লাভলেস-এর কাউন্টেস। অ্যাডা বায়রন হয়ে গেলেন অ্যাডা লাভলেস। প্রচুর মদ্যপান, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত অ্যাডা মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যান। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ব্যাবেজের সঙ্গে অ্যাডার যোগাযোগ অটুট থাকে।
ব্যাবেজ অ্যাডাকে বলতেন ‘ইন্টারপ্রিট্রেস’। মানে, তাঁর ‘ব্যাখ্যাকারিণী’। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে ইটালির তুরিন শহরে ব্যাবেজ ব্যাখ্যা করেন অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের কাজকর্ম। শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন গণিতজ্ঞ লুইসি ফেডেরিকো মেনাব্রিয়া (পরে যিনি ইটালির প্রধানমন্ত্রী হন)। এই মেনাব্রিয়া ফরাসি ভাষায় একটি প্রবন্ধ ছাপেন। শিরোনাম ‘অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের খসড়া’। মোটামুটি ভাবে অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের মূল নীতি এবং তার বিভিন্ন যন্ত্রাংশের কাজকর্মের বর্ণনা। অ্যাডা মেনাব্রিয়ার প্রবন্ধ পড়ে তা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। টীকা সহযোগে। অ্যাডার রচিত সেই পেপারকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের প্রথম প্রবন্ধ হিসেবে ধরা হয়।
সেই প্রবন্ধে অ্যাডা উড়িয়ে দেন এই ধারণা যে, অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন ‘ভাবছে’, যে ভাবে মানুষ ভাবে। মানুষের চিন্তাশক্তি অনেক বেশি উন্নত মেশিনের চিন্তাশক্তির চেয়ে। অ্যাডা লেখেন, ‘মেশিন কেবল সেটাই পারে, যেটা আমরা মেশিনকে দিয়ে করানোর কায়দা জানি।’ সে কারণে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিংশ শতকে অ্যালান ম্যাথিসন ট্যুরিং (যাঁকে কম্পিউটারের অন্যতম জনক বলে মনে করা হয়) এক বার তাঁর বক্তৃতার শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘লেডি লাভলেস’স অবজেকশন’।
অ্যাডা দেখান, অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন কী ভাবে ‘বারনুলি সংখ্যা’-র মতো একটি জটিল সংখ্যার গণনা করতে পারে। সুইটজ়ারল্যান্ডের গণিতজ্ঞ জেকব বারনুলি ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘আরস কনজেকটানডি’ গ্রন্থে ওই ধরনের সংখ্যার কথা লিখেছিলেন। ত্রিকোণমিতির ফরমুলায় ওই সংখ্যার দেখা পাওয়া যায়। ওর প্রয়োজন আছে নৌযাত্রায়। ও রকম একটা জটিল সংখ্যার গণনায় কী ভাবে সাহায্য করতে পারে অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন, তা দেখালেন অ্যাডা।
আবিষ্কারক: চার্লস ব্যাবেজ। ডান দিকে, তাঁর মতবাদের ব্যাখ্যাকারিণী অ্যাডা লাভলেস।
দুঃখের কথা, ডিফারেন্স ইঞ্জিন আর অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের মডেল তৈরি করা ছাড়া আর বেশি দূর এগোতে পারেননি ব্যাবেজ। তা নিয়ে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত বড়ই অসুখী ছিলেন তিনি। নানা দিক থেকে এসেছিল বাধা। ডিফারেন্স ইঞ্জিন তৈরির ভার ব্যাবেজ দিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার জোসেফ ক্লিমেন্টকে। মোট ২৫০০০ যন্ত্রাংশের মধ্যে ১২০০০ টি তৈরি করেই তিনি কাজ বন্ধ করে দেন। ব্যাবেজের হিসেবের খাতা থেকে দেখা যাচ্ছে, এই ১২০০০ যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য তিনি ক্লিমেন্টকে পেমেন্ট করেছিলেন ১৭৪৭০ পাউন্ড। অথচ, জন বুল ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে যে স্টিম ইঞ্জিন তৈরি করেছিলেন, তাতে খরচ পড়েছিল মাত্র ৭৮৪ পাউন্ড! কেন ক্লিমেন্ট বন্ধ করেছিলেন কাজ? সামান্য বিষয়ে কাজিয়া। ক্লিমেন্ট নতুন কায়দায় ডিফারেন্স ইঞ্জিন তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ব্যাবেজ রাজি হননি। তাই নিয়ে বিবাদ। কাজ বন্ধ।
ও দিকে বন্ধ সরকারি অনুদান। সে আর এক গল্প। ব্রিটেনের জ্যোতির্বিজ্ঞানী রয়্যাল জর্জ বিডেল এয়ারি ঘোষণা করলেন, ‘ডিফারেন্স ইঞ্জিন কোনও কম্মের নয়। ও দিয়ে কিস্যু হবে না।’ অ্যাস্ট্রোনমার রয়্যালের এ ধরনের মন্তব্যে বেঁকে বসল ইংরেজ সরকার। বন্ধ করে দিল অনুদান। আসলে স্বভাবে দুর্মুখ প্রকৃতির ছিলেন ব্যাবেজ। যাকে যা-খুশি তাই বলে দিতেন। এক বার এয়ারিকেও কটুকাটব্য করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে ভুল করায়। শোধ তুলতেই ডিফারেন্স ইঞ্জিন সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেছিলেন এয়ারি। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় ব্যাবেজের প্রথম জীবনী। শিরোনাম ‘ইর্যাসিব্ল জিনিয়াস : আ লাইফ অব চার্লস ব্যাবেজ’। লেখক মাবোথ মোজ়লি। ‘ইর্যাসিব্ল’ শব্দটির অর্থ বদমেজাজি। জীবনীর শিরোনাম থেকেই মালুম, কেমন মানুষ ছিলেন ব্যাবেজ।
নিজের স্বপ্নপূরণ না হলে কী হবে, ব্যাবেজ আমৃত্যু চাইতেন গণনার কাজ মেশিন দিয়েই হোক। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে ‘এডিনবরা রিভিউ’ কাগজে প্রকাশিত হয় ডিফারেন্স ইঞ্জিনের পরিকল্পনা। প্রবন্ধটি পড়ে উৎসাহিত হন সুইডেনের ইঞ্জিনিয়ার জর্জ স্কেয়াৎজ এবং তাঁর ছেলে এডওয়ার্ড স্কেয়াৎজ। সুইডিশ সরকার এবং দেশের বিজ্ঞানীদের অনুদানে ওঁরা বাপ-বেটায় তৈরি করে ফেলেন যন্ত্রগণক মেশিন। সময় লাগে অনেক বছর। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে এক প্রদর্শনীতে দেখানোর জন্য জর্জ ও এডওয়ার্ড তাঁদের মেশিনটি নিয়ে এসেছিলেন। ওঁদের বিস্মিত করে ব্যাবেজ দু’জনকেই সাহায্য করেন। শুধু তাই নয়, রয়্যাল সোসাইটিতে উমেদারি করে পিতাপুত্রকে সোনার মেডেলও পাইয়ে দেন।
চার্লস ব্যাবেজ মারা যান ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে। আগেই বলা হয়েছে, তাঁর আত্মজীবনীর নাম ‘প্যাসেজেস ফ্রম দ্য লাইফ অব আ ফিলোজ়ফার’। চার্লস ডারইউন তাঁর আত্মজীবনী ‘দি অটোবায়োগ্রাফি অব চার্লস ডারউইন’ লিখেছিলেন ছাপানোর জন্য নয়। তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্য। তিনি কেমন বাবা, তা জানাতে। আর ব্যাবেজ ‘প্যাসেজেস’ লিখেছিলেন গণনার যন্ত্র নির্মাণের ইতিহাসকে ‘একটু কম তিক্ত’ করতে। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষকে চেনাতে। বাস্তবে এতটাই তিক্ত ছিল তাঁর অভিজ্ঞতা!