protest

প্রথম বিদ্রোহিণী

তিনি রামপ্রিয়া ঠাকুরানি। সম্পর্কে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের এক পিতামহী। কোম্পানির আমলের সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকার আদায় করেছিলেন। প্রায় আড়াইশো বছর পুরনো, ঐতিহাসিক সেই মামলার কয়েকটি নথি পাওয়া গেল সম্প্রতি। অরিন্দম মুখোপাধ্যায়তিনি রামপ্রিয়া ঠাকুরানি। সম্পর্কে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের এক পিতামহী। কোম্পানির আমলের সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকার আদায় করেছিলেন। প্রায় আড়াইশো বছর পুরনো, ঐতিহাসিক সেই মামলার কয়েকটি নথি পাওয়া গেল সম্প্রতি। অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২০ ০০:৫২
Share:

ঐতিহাসিক: কোম্পানির আমলের সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ছবি।

এই শহরের নারীবাদীরা তাঁর কথা ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি, গোবিন্দরাম ঠাকুরের স্ত্রী রামপ্রিয়া ঠাকুরানিই সম্ভবত কলকাতার প্রথম প্রতিবাদিনী। মৃত স্বামীর সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে, দুই ভাশুর নীলমণি ও দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রুজু করতেও পিছপা হননি তিনি।

Advertisement

এই ইতিহাস অষ্টাদশ শতকের। তখনও কলকাতা শহর ঠিক মতো গড়ে ওঠেনি। মরাঠা আক্রমণ ঠেকাতে এখনকার সার্কুলার রোডের ‘মারহাট্টা ডিচ’, উত্তরে অস্বাস্থ্যকর ‘ব্ল্যাক টাউন’-এই ছিল সীমাবদ্ধ। ছিল সেন্ট জন’স চার্চে জোব চার্নকের সমাধি, সুপ্রিম কোর্ট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দু কলেজ, স্বামী বিবেকানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— তখন ভবিষ্যতের গর্ভে।

রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরিদের সঙ্গে অবশ্য এই কাহিনির প্রগাঢ় যোগাযোগ। মামলার বাদী রামপ্রিয়া ঠাকুরানি, ঠাকুরবাড়ির এক বিধবা স্ত্রী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর বঞ্চনার বিরুদ্ধে রামপ্রিয়ার প্রতিবাদের রেশ ঠাকুর পরিবারে দীর্ঘ দিন পরেও গুঞ্জরিত হয়েছিল। রামপ্রিয়ার দুই পুরুষ পরে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী দিগম্বরী দেবীও তাঁর দেখানো পথেই হেঁটেছিলেন বললে অত্যুক্তি হবে না। নিজের বিশ্বাস, আদর্শ ও পরম্পরার পরিপন্থী কাজের জন্য স্বামী দ্বারকানাথকে ত্যাগের মাধ্যমে ঠাকুর পরিবারের কুলবধূ দিগম্বরী যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা আজ প্রবাদে পরিণত। দ্বারকানাথের ইংরেজ-সংসর্গ তাঁর মা বা স্ত্রী কেউই ভাল চোখে দেখেননি। দ্বারকানাথ এ ব্যাপারে স্ত্রীর মতামত অগ্রাহ্য করলে দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতেও ইতি টানেন। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, দিগম্বরী হিন্দু পণ্ডিতদের ডেকে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে একত্রে পানভোজন করা স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের বিধানও চেয়েছিলেন। পণ্ডিতেরা নিদান দেন, ‘স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্তব্য।’ স্ত্রীর সাংসারিক দায়িত্বটুকু পালন করা ছাড়া দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখেননি। কাজের সূত্রে দ্বারকানাথের সঙ্গে যত বার কথা বলতে হত, তত বারই নাকি তিনি গঙ্গাজলে চান করতেন, এমন কথাও শোনা যায়। ইতিহাসেরও যেমন ইতিহাস থাকে, তেমনই দিগম্বরীর ছক ভাঙার পিছনেও হয়তো ছিল রামপ্রিয়ার দৃষ্টান্ত।

Advertisement

আরও পড়ুন: শতাধিক সোমনাথের এ যেন এক অন্য মহাকাশ

যশোর জেলার মহেশ্বর কুশারী ও তাঁর ছেলে পঞ্চানন জ্ঞাতিকলহের ফলে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় চলে আসেন। সময়টা সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগ, কলকাতা তখন সবে গড়ে উঠছে। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ বণিকদের যাতায়াত, বড়বাজারের কাছে শেঠ, বসাকদের সুতাবস্ত্রের হাট তখন বহু লোককে এ দিকে বসতি স্থাপনে আকৃষ্ট করেছিল। পঞ্চানন এই আকর্ষণেই কলকাতা গ্রামের দক্ষিণে, আদিগঙ্গার তীরে গোবিন্দপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আদিগঙ্গার মুখে নোঙর ফেলা ইউরোপীয় জাহাজে নানা জিনিসপত্র সরবরাহ করে সে সময় বেশ রোজগারও করতে থাকেন। এর পর বর্গিদের হাঙ্গামার সময় ইংরেজদের কলকাতার কুঠি কেল্লায় পরিণত হলে সেখানেও প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের সুযোগ পান তিনি। এই সূত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্তাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। ঘটনাচক্রে এই সময় পতিত ব্রাহ্মণ কুশারীরা তাঁদের নিম্নশ্রেণির প্রতিবেশীদের কাছে ‘ঠাকুরমশাই’ নামে অভিহিত হতেন, তাঁদের দেখাদেখি ইংরেজ সাহেবরাও তাঁকে ‘ঠাকুর’ বলতেন। পঞ্চানন কুশারী এ ভাবেই হয়ে গেলেন পঞ্চানন ঠাকুর।

মূল ছবি, টমাস ড্যানিয়েলের আঁকা অষ্টাদশ শতকের কলকাতা। ডান দিকে দেখা যাচ্ছে ওল্ড কোর্ট হাউস, বাঁ দিকে রাইটার্স বিল্ডিং।

পঞ্চাননের দুই ছেলে। জয়রাম ও রামসন্তোষ। কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর ইংরেজদের অধীনে আসার পর ১৭০৭ সালে প্রথম এখানে জরিপের কাজ হয়। জরিপের কাজে দু’জন আমিনের প্রয়োজন ছিল, পঞ্চাননের অনুরোধে তৎকালীন কালেক্টর শেল্ডন জয়রাম ও রামসন্তোষকে ওই কাজে নিয়োগ করেন। এর পর ১৭১৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার দক্ষিণে ৩৮টি গ্রাম কেনে। জয়রাম ও রামসন্তোষ সেখানেও জরিপের দায়িত্ব পান। ঠাকুর গোষ্ঠী এ ভাবেই বিত্তশালী হয়ে ওঠে। ১৭৪১-৪২ সালে বর্গি আক্রমণ রুখতে কলকাতায় যে মারহাট্টা খাল খনন করা হয়, পঞ্চানন-তনয় জয়রাম ঠাকুর ছিলেন তার অন্যতম পরিদর্শক, এমন মতও প্রচলিত।

জয়রামের চার পুত্র— আনন্দীরাম, নীলমণি, দর্পনারায়ণ, গোবিন্দরাম। এক কন্যা, সিদ্ধেশ্বরী। প্রথম পুত্র আনন্দীরাম নাকি অতিরিক্ত মদ্যপান করে কুলগুরুকে অপমান করেছিলেন, তাই জয়রাম তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে তাড়িয়ে দেন। ১৮১৩ সালে আনন্দীরামের পৌত্র রাধাবল্লভ অবিভক্ত সম্পত্তির ভাগ পেতে সুপ্রিম কোর্টে যে মামলা করেন, সেখানে এক সাক্ষী জানিয়েছিলেন, স্বয়ং জয়রামের নাকি পুত্র-জামাতা সমেত একত্রে বসে মদ্যপানের অভ্যেস ছিল। তাই ঠিক কী কারণে আনন্দীরাম ত্যাজ্য হন, তা বলা মুশকিল। জয়রামের দ্বিতীয় পুত্র নীলমণি ঠাকুর ক্লাইভের আমলে ওড়িশায় কালেক্টরের অধীনে সেরেস্তাদার ছিলেন। নীলমণির পরের ভাই দর্পনারায়ণ ছিলেন ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান, এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য সূত্রেও তিনি প্রভূত বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন।

জয়রাম ঠাকুরের সবচেয়ে ছোট ছেলে গোবিন্দরাম। তিনিও এক জন কৃতী পুরুষ ছিলেন। রামপ্রিয়া ঠাকুরানি ছিলেন তাঁরই স্ত্রী। সম্পত্তির অধিকার ফিরে পেতে তিনি তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টে যে মামলা করেন, সেখানে গোবিন্দরামের ব্যবহৃত জিনিসের একটি তালিকা ছিল। এই অপ্রকাশিত তালিকাটিতে অন্যান্য নানা জিনিসের সঙ্গে ২৯টি ইংরেজি বইয়ের কথাও জানা যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, কৃতবিদ্য গোবিন্দরাম শুধু ইংরেজি বলতে পারতেন তা-ই নয়, ইংরেজি বই পড়তেও রীতিমতো অভ্যস্ত ছিলেন।

আরও পড়ুন: টুকরো কথার সত্যজিৎ

পলাশির যুদ্ধের আগের বছর, ১৭৫৬ সালে জয়রাম ঠাকুরের মৃত্যু হয়। তিনি এখনকার ধর্মতলা অঞ্চলে বাড়ি, বৈঠকখানা, জমাজমি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু সে বছরই সিরাজউদৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময় পরিবারটির সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরের বছর পলাশির যুদ্ধে সিরাজ হেরে যান। মিরজাফর নবাব হওয়ার পর কলকাতা জয়ের ক্ষতিপূরণ হিসেবে কোম্পানিকে যে টাকা দেন, নীলমণি ঠাকুর তা থেকে ১৮ হাজার টাকা পান, এবং ডিহি কলকাতা গ্রামে জমি কিনে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। এই ভাবেই ১৭৬৫ সাল নাগাদ পাথুরিয়াঘাটায় ঠাকুরদের বসবাসের সূত্রপাত। সিরাজউদ্দৌলার আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কলকাতার পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম পলাশির যুদ্ধের পর আবার নতুন করে তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। গোবিন্দরাম এই নতুন কেল্লা নির্মাণের পরিদর্শক নিযুক্ত হয়েছিলেন। জানা যায়, এ কাজে তিনি ভাল অর্থ উপার্জন করেছিলেন। গোবিন্দরামের মৃত্যু হয় ১৭৭৭ সালের ২৫ মে। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই ঠাকুর পরিবারের পারিবারিক বন্ধন আলগা হতে থাকে। সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে গোবিন্দরাম ঠাকুরের স্ত্রী ও ভাইপোদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে মামলা শুরু হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদালতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল এই মামলা।

সম্প্রতি এই মামলা বিষয়ক বেশ কিছু অপ্রকাশিত নথি প্রকাশ্যে এসেছে, যা আমাদের বহু অজানা তথ্যের সন্ধান দেয়। ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থে নগেন্দ্রনাথ বসু ও ব্যোমকেশ মুস্তফী এই মামলা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ঠাকুর পরিবারের প্রথম বিভাজনকারী হিসেবে রামপ্রিয়া ঠাকুরানির দিকেই আঙুল তুলেছিলেন। তাঁরা লিখেছেন, রামপ্রিয়াই সম্পত্তির ভাগ আদায় করতে তাঁর দুই ভাশুর নীলমণি ও দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করেন। তাঁরা আরও বলেন, জয়রামের ত্যাজ্যপুত্র আনন্দীরামের বড় ছেলে রামতনু ঠাকুর কাকিমাকে হিন্দু বিধবার অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নাকি এই মামলা করতে প্ররোচিত করেছিল। ঠাকুরবাড়ির আদি পর্বের গল্প শোনাতে গিয়ে সব লেখকই কমবেশি নগেন্দ্রনাথদের কথিত ইতিহাসকেই অনুসরণ করেছেন। কিন্তু আসল কাহিনি এই তথাকথিত ইতিহাসের থেকে অনেকটাই আলাদা।

এই মামলা সংক্রান্ত সর্বপ্রাচীন যে নথিটি আমাদের হাতে এসেছে, সেটি ১৭৮০ সালের ৮ মে সুপ্রিম কোর্টে করা একটি আবেদনপত্র। প্রয়াত গোবিন্দরাম ঠাকুরের সম্পত্তির আইনি অধিকার চেয়ে যৌথ ভাবে এই আবেদন করেন নীলমণির জ্যেষ্ঠ পুত্র রামলোচন (যাঁর পালিত পুত্র ছিলেন দ্বারকানাথ) এবং দর্পনারায়ণের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাধামোহন। দুই আবেদনকারী জানান, প্রয়াত গোবিন্দরাম তাঁর মৃত্যুর আগে কোনও ইচ্ছাপত্র বা উইল রেখে যাননি, তাই গোবিন্দরামের একমাত্র বিধবা স্ত্রী রামপ্রিয়ার অনুমতিক্রমে তাঁরা এই সম্পত্তির অধিকার চাইছেন। এই আবেদনপত্রে তাঁরা সেই সময়ে গোবিন্দরামের সম্পত্তির মূল্য ১০ হাজার ৩০০ টাকা ছিল বলে দাবি করেন। মামলাটি তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত বিচারক জন হাইড-এর এজলাসে ওঠে। এ বিষয়ে আদালতে হলফনামা জমা করলে ২৩ মার্চ তারিখে দুই জ্ঞাতি ভাই যৌথ ভাবে গোবিন্দরামের সম্পত্তির মালিকানাও পেয়ে যান। অর্থাৎ, সম্পত্তি ভাগের জন্য নীলমণি এবং দর্পনারায়ণ ঠাকুরকে রামপ্রিয়া প্রথমে কাঠগড়ায় তোলেননি। বরং নীলমণি এবং দর্পনারায়ণ ঠাকুরই তাঁদের ছেলেদের সামনে রেখে ছোট ভাইয়ের অসহায় বিধবা স্ত্রীর ন্যায্য পাওনা ঠকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

ভাশুরের ছেলেদের দিয়ে তাঁর মৃত স্বামীর সম্পত্তি দখলের প্রচেষ্টার কথা প্রথমে রামপ্রিয়ার জানা ছিল না। তাঁকে ঠকিয়ে রামলোচন এবং রাধামোহনের সম্পত্তি লাভের কথা জানতে পেরে যশোরের এই প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী ১৭৮০ সালের ১৬ মে সুপ্রিম কোর্টে পাল্টা মামলা দায়ের করেন। একই সঙ্গে নিজের অজান্তে এক ইতিহাসও তৈরি করেন তিনি। বাংলার তথা ভারতীয় নারীর স্বাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সম্পূর্ণ বিস্মৃত অধ্যায়। মনে রাখতে হবে, রামপ্রিয়াই প্রথম মহিলা, মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকার আদায় করার জন্য যিনি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন এবং জয়ীও হন।

রামপ্রিয়া ঠাকুরানি আদালতে বলেন, তাঁর অজ্ঞাতে রামলোচন ও রাধামোহনকে তাঁর প্রয়াত স্বামীর সম্পত্তির যে মালিকানা দেওয়া হয়েছে, তা ফিরিয়ে নেওয়া হোক। এবং প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসেবে অবিলম্বে তাঁকে এই সম্পত্তি হস্তান্তরিত করা হোক। রামপ্রিয়া আরও বলেন, তিনি এক জন হিন্দু বিধবা। তাই ধর্মীয় প্রথা অনুসারে তিনি আদালতে উপস্থিত হয়ে কোনও হলফনামা দিতে অক্ষম। এই কারণে তাঁকে আদালতে ব্যক্তিগত উপস্থিতি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। জজসাহেবের কাছে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য একটি কমিশন গঠনেরও আবেদন করেন। রামপ্রিয়ার আবেদনে এই কমিশনের সদস্য হিসেবে জনৈক রামলোচন মুন্সী এবং নিকোলাস জেব-এর নাম প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ঠিক হয় ২০ মে। বলা হয়, এই দু’জন বা এঁদের মধ্য থেকে কোনও এক জনের সামনে তিনি শপথ নিয়ে লিখিত হলফনামা জমা দিতে প্রস্তুত।

আদালত সম্ভবত রামপ্রিয়ার এই দাবি মেনে নিয়েছিল। কেননা আমরা দেখি ২২ মে রামপ্রিয়ার স্বাক্ষরিত হলফনামার ভিত্তিতে পূর্বোক্ত বিচারক জন হাইডকে অন্তর্বর্তীকালীন রায় দান করতে। রামপ্রিয়া হলফনামায় বলেন, আদালতের রায়ে সম্পত্তির অধিকার পেয়ে তাঁর প্রয়াত স্বামীর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র বর্তমানে তাঁকে তাঁর স্বামীর সম্পত্তি থেকে উৎখাত করতে চাইছে। তাই আদালত যেন তার পূর্বোক্ত রায় স্থগিত ও বাতিল করে, নিষ্ঠাবান হিন্দু বিধবা রামপ্রিয়াকে সকল সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করে। এই হলফনামায় আনন্দীরামের পুত্র রামতনু সাক্ষী ছিলেন।

বিচারক জন হাইড এই হলফনামা পড়ে পরবর্তী রায় দানের দিন ধার্য করেন ১৫ জুন ১৭৮০। দুঃখের বিষয়, আমাদের জানা নেই প্রস্তাবিত ১৫ জুন কোনও রায়দান হয়েছিল কি না। কারণ ওই দিনের রায় সংক্রান্ত কোনও নথি পাওয়া যায়নি। আসলে সেই সময় কোম্পানির ‘সুপ্রিম কাউন্সিল অব বেঙ্গল’-এর সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সীমা ও অধিকার নিয়ে এক বিবাদ চলছিল। যার ফলে বিচারপতিদের রায়দানও অনেক সময়ই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল।

যাই হোক, পরবর্তী কালে এই মামলা সংক্রান্ত আরও দু’টি নথি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। প্রথমটি ১৭৮১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রামপ্রিয়ার স্বাক্ষরিত এক পাতার একটি নথি এবং অপরটি স্বাক্ষরবিহীন চার পাতার একটি নথি। এই দু’টি নথিই ছিল প্রয়াত গোবিন্দরামের সম্পত্তির বিস্তারিত তালিকা। সোনা-রুপো-পিতল প্রভৃতির তৈরি বাসনকোসন, আসবাবপত্র থেকে বইখাতা, জমি-বাড়ি-বাগান, সব কিছুরই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে রামপ্রিয়া সেগুলি আদালতে জমা করেছিলেন। এর পরই সম্ভবত কোনও এক দিন আদালত তার চূড়ান্ত রায় শোনায়। যদিও সেই রায়দানের সঠিক তারিখ এবং রায়ের আসল কপি পাওয়া যায়নি। কিন্তু ঠাকুর পরিবারের আদি পর্বের কথাকাররা আদালতের রায়ে রামপ্রিয়ার সম্পত্তির অধিকার লাভের কথাই শুনিয়েছেন।

সস্ত্রীক গোবিন্দরাম আমৃত্যু পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতেই থাকতেন। স্বামীর মৃত্যুর পরেও রামপ্রিয়া এই বাড়ি ছেড়ে যাননি। কিন্তু মামলায় জয়লাভের পর তিনি এই বাড়ি ছেড়ে পাথুরিয়াঘাটার কাছে শিবতলায় একটি স্বতন্ত্র বাড়িতে উঠে যান। রামপ্রিয়া প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেও নরম মনের মানুষ ছিলেন। উপকারীর উপকারও তিনি ভোলেননি। তাঁর মূল হলফনামায় সাক্ষ্যদানকারী রামতনুর পুত্রকে তিনি পরবর্তী কালে অভাবের সময় অর্থসাহায্য করেছিলেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকেও তিনি কলকাতায় গৃহনির্মাণের জন্য অর্থ দিয়েছিলেন। রামপ্রিয়া ঠাকুরানি দীর্ঘায়ু ছিলেন, ১৮১৩ সালে আনন্দীরামের সম্পত্তি লাভের জন্য রাধাবল্লভের করা মামলার সময়েও জীবিত ছিলেন তিনি। তখন তাঁর বয়স ৯৮ বছর। তিনি শতায়ু হয়েছিলেন কি না, আমাদের জানা নেই। কিন্তু অত্যন্ত বিচক্ষণ রামপ্রিয়া আমৃত্যু তাঁর সম্পত্তি রক্ষা করেছিলেন, এ কথা জানা যায়।

প্রশান্তকুমার পাল তাঁর ‘রবিজীবনী’তে জানাচ্ছেন, ওই মামলার ফলে ১৭৮২ সালে রামপ্রিয়া রাধাবাজার ও জ্যাকসন ঘাটে দু’টি বাড়ির মালিকানা পান। হয়তো এই মামলার সূত্রেই নীলমণি ও দর্পনারায়ণ ঠাকুরের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে গোলযোগ দেখা দেয়। পরে আপসে

এই বিবাদ মিটিয়ে নেওয়া হয়। পাথুরিয়াঘাটার বাড়িটি পান দর্পনারায়ণ ঠাকুর, আর নিজস্ব উপার্জনলব্ধ অর্থ, নগদ এক লক্ষ টাকা ও লক্ষ্মীজনার্দন শিলা নিয়ে নীলমণি গৃহত্যাগ করেন। কলকাতার আদি বাসিন্দা বৈষ্ণবচরণ

শেঠ নীলমণিকে মেছুয়াবাজার অঞ্চলে এক বিঘা জমি দান করেন। কিন্তু শূদ্রের দানগ্রহণে নীলমণি সম্মত হননি। বৈষ্ণবচরণ তখন লক্ষ্মীজনার্দন

শিলার নামে ওই জমি দান করেন। এ ভাবেই ১৭৮৪ সাল থেকে জোড়াসাঁকোয় ঠাকুর পরিবারের বসবাসের সূত্রপাত।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement