ছবি: কুনাল বর্মণ Sourced by the ABP
হেমন্তের প্রোডাকশন থেকেই হয় ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিটি। সে সূত্রেই শান্তুকাকার সঙ্গে পরিচয়। আমাদের পারিবারিক বন্ধুদের মধ্যে শান্তুকাকারই গাড়ি ছিল। ওঁরা আমার মা’কে বললেন, “কানাডা থেকে হাওড়ায় একটা খুব সুন্দর নতুন স্টিম ইঞ্জিন আনা হয়েছে। চলুন, বাবুকে দেখিয়ে আনি।” আমি খুবই উত্তেজিত। স্টেশনে গিয়ে ইঞ্জিনটাকে ভাল করে দেখতে একটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা দরজা। তাতে কড়া নাড়া হল। দরজাটি খুলতেই দেখি, বাবা দাঁড়িয়ে!
জানা গেল, কোথাও একটা যাবেন ভেবে বাবা হাওড়া স্টেশন অবধি এসেছিলেন। কিন্তু দেখেন, হাওড়া স্টেশনে ভাড়ায় গেস্টহাউস পাওয়া যায়। তাই ঠিক করলেন, ওখানেই লিখবেন। আশ্চর্য লাগে, হাওড়া স্টেশনে ধোঁয়া, চেঁচামেচি, আওয়াজের মধ্যে কোনও মানুষ কী ভাবে লেখার অনুপ্রেরণা পান!
বাবার পক্ষে কিছুই অবশ্য অসম্ভব ছিল না। আমরা তখন মনোহরপুকুর রোডে থাকি। সেখানেই অদূরে রাস্তা থেকে একটু দূরে ছিল ‘হোটেল রাজ’। দক্ষিণ ভারতীয় কায়দার নিতান্তই মধ্যবিত্ত হোটেল। এখানে বসে কোনও সৃজনশীল কাজ যে হতে পারে, তা ভাবাটাই মুশকিল। কিন্তু ওখানেই গিয়ে উঠলেন বাবা। লিখলেন ‘ভুবন সোম’-এর স্ক্রিপ্ট। আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। প্রতিদিন বিকেলে আমার কাজ ছিল, যত চিঠিপত্র এসেছে তা বাবার কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং জরুরি কিছু থাকলে, তা জানানো। এ সবের বদলে আমার রোজগার, একটি দোসা।
মুহূর্ত: আনন্দবাজার পত্রিকার দফতরে 'চালচিত্র'-র শুটিংয়ে মৃণাল সেন
কিন্তু এ ভাবে কোথাও গিয়ে স্ক্রিপ্ট লেখার পালাটা ‘ভুবন সোম’-এই শেষ হল। হয়তো এর পরে, কিছুটা আত্মবিশ্বাসও বাড়ল বাবার। বাড়িতে থেকে স্ক্রিপ্ট লেখার মস্ত সুবিধেও ছিল। দিনান্তে, সবাই চলে গেলে মা আর আমাকে কী লিখেছেন, তা শোনাতেন। তখন আমি সম্ভবত কলেজে পড়ি। কেন জানি না, বাবা আমাদের কথা খুব মন দিয়েশুনতেন। যৌবনের অহঙ্কার থেকে আমার মনে হত, ভুল ধরাটাই ভাল। সারা ক্ষণ খুঁত ধরতাম। এটা ঠিক হয়নি, ওটা ভাল হয়নি। দেখতামবাবা মন দিয়ে শুনছেন। কতটা মানছেন জানি না।
তবে মূল উপকারটা হত মায়ের দিক থেকে। মা শুনে, এক জন অভিনেতার জায়গা থেকে বলতেন কোন সংলাপগুলি বলা যায়, কোন জায়গাটা ঠিক হচ্ছে না। তা ছাড়া মায়ের দৈনন্দিন মধ্যবিত্ত জীবনের অভিজ্ঞতাটা বাবার থেকে অনেক বেশি। রান্না ঘরে কী হয়, উনুনটা কী ভাবে নেভায়, এ সব নানা খুঁটিনাটি মা বলে দিতেন। বাবা এগুলি খুবই মর্যাদা দিতেন, কাজেও লাগাতেন।
অবিন্যাসেই বিন্যাস
স্ক্রিপ্ট লেখার প্রসঙ্গে মনে পড়ল একটা বিষয়। একটি দলের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’-এর স্ক্রিপ্ট এবং ওঁর রেখে যাওয়া কাগজপত্র ডিজিটাইজ় করার কাজ করেছিলাম। অবাক হয়ে দেখতাম, সত্যজিৎ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে কোন পোশাক কী রকম হবে, কোন সেট কী রকম হবে, গানের সুর কী হবে, সব পরিকল্পনা করে রেখেছেন। অর্থাৎ ছবিটা যখন উনি শুট করছেন, তখন ওঁর চিন্তার মধ্যে পুরো বিষয়টির একটি রূপান্তর ঘটছে। ছবিটি যেন ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে আছে। এ বার বাস্তবে সেট ও অভিনেতার মাধ্যমে সেটি ফুটিয়ে তুলছেন। এটি একটি অদ্ভুত ‘ক্রিয়েটিভ প্রসেস’, যেখানে চিন্তায়, কল্পনায় সবটা তৈরি হয়ে রয়েছে। কিন্তু বাবার ক্ষেত্রে মূলত ‘ভুবন সোম’-এর পর থেকে দেখা গেল, স্ক্রিপ্টের থেকে ছবিটি পাল্টে যাচ্ছে। এটিও একটি অন্য রকম ক্রিয়েটিভ প্রসেস।
আমার খুবই আগ্রহ থাকত, একটা ছবির মূল স্ক্রিপ্ট কী ছিল। আর পরে ছবিটা কী হল। কিন্তু এটা দেখার উপায় বাবা রাখেননি। কাগজপত্র, স্ক্রিপ্ট কিছুই নেই। বাবা এমনিতেই খুব অগোছালো মানুষ ছিলেন। ২০০২-০৩ নাগাদ শেষ বার আমরা যখন বাড়ি পাল্টালাম, আমি সাহায্য করতে এসেছিলাম। কিন্তু আমি আসার আগেই দেখি, বাবা বান্ডিল-বান্ডিল কাগজ ফেলে দিয়েছেন। পুর নিগম থেকে একটা ট্রাক ডাকা হয়েছিল। বাবা প্রথমে বসে বসে কিছু বাছাবাছির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যখন বুঝলেন, প্রচুর সময় লাগবে, তখন ফেলে দিতে শুরু করেন।
এমনকি, মায়ের থেকে এ-ও শুনেছি, পুর নিগমের যাঁরা জিনিসপত্রগুলি নিয়ে যাচ্ছিলেন, এক দিন তাঁদের এক জন এসে বলেন, “একটা বস্তায় কিছু ঠং-ঠং করছে।” অর্থাৎ ধাতব কিছু আছে। মা বস্তা খুলে দেখেন, বাবার বেশ কয়েকটা পুরস্কার, সম্মাননাপত্র!
এ ছাড়া, বহু গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বাবাকে চিঠি লিখতেন। সে সব চিঠিও রাখা নেই। বাবা প্রতি দু’-তিন সপ্তাহ অন্তর ফরমায়েশি প্রবন্ধ লিখতেন। অবশ্যই এটা জানাতেন, আগামী দিনে কোনও প্রকাশক হয়তো সেগুলি জড়ো করে ছাপার কথা ভাববেন। কিন্তু কিছুই রাখেননি। উচিত ছিল, নিজের কাছে একটি করে কপি রেখে দেওয়া। পাশাপাশি, এখন বাবার যে স্ক্রিপ্টগুলি বই আকারে দেখা যায়, সেগুলি সবই ছবি দেখে করা। মূল স্ক্রিপ্ট একটিও নেই।
গুরুত্ব-ভাবনা
সুতরাং প্রশ্ন আসে, ওঁর নিজের জিনিস বাঁচিয়ে রাখতে এতটা অনীহা, অবহেলা কেন ছিল। এমন নয় যে, নামডাকের প্রতি মোহ বা আগ্রহ ছিল না। উল্টোটাই বলব। বাবার যখন নামডাক ছিল না, তখনও উনি নিজেকে এক জন ব্যতিক্রমী, গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবেই ভাবতেন। একটি ছোট্ট বিষয় উল্লেখ করা যায়। বাবার নাম তখন কেউ খুব একটা জানেন না। কিন্তু টেলিফোন সংস্থায় কোনও অভিযোগ জানাতে ফোন করেছেন। ফোনটা তুলেই বাবা বললেন, “আমার নাম, মৃণাল সেন।” তার পরে কিছুটা সময় দিয়ে বাকি কথা বললেন। যেন উনি বেশ নামকরা লোক, লোকজনের ওঁকে চেনা উচিত! এটি কিন্তু অহঙ্কারবোধ নয়। ওই যে নিজেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভাবা, সেটাই বোধহয় কাজ করত।
এটার সাক্ষ্য রয়েছে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম বার ডাক পাওয়ার সময়েও। উৎসবের মূল পর্বে বাবার ছবি দেখানো হবে। খুবই খুশি বাবা। উৎসব থেকে বিমানের যে টিকিটটি পাঠানো হল, সেটি ইকনমি ক্লাসের। বাবা কোনও দিনই ইকনমি ক্লাস ছাড়া বিমানে ওঠেননি। এর আগে বিদেশে খুবই কম, সম্ভবত এক বার অন্য একটা কাজে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাবা ওঁদের লিখে বসলেন, “আমি নিশ্চিত, ইউরোপ-আমেরিকার যে সব নামকরা লোকজনকে আপনারা নিয়ে আসেন, তাঁদের ইকনমি ক্লাসের টিকিট দেন না। তাঁদের ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট দেন। সুতরাং, ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট না দিলে আমি যাব না!” এটা উনি যে ফার্স্ট ক্লাসে যাওয়ার লোভ থেকে করলেন, এমনটা নয়। আসলে উনি ভাবলেন, আমি কম কেন? তোমরা অন্যদের যে টিকিট দাও, আমি ভারতবর্ষের লোক বলেই কি সেটা দেওয়া হবে না! তা ভেনিস থেকে লেখা হল, ওটা করণিকের ভুল। ফার্স্ট ক্লাস টিকিটই পাঠানো হচ্ছে।
বাবার একটু যখন নামডাক হচ্ছে, তখনও দেখেছি, বিদেশে চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে খুবই নামকরা লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন, যেন একটা সমান-সমান জায়গা থেকে।
পুরনোয় ‘না’
অথচ, ওঁর এক বারও জীবনের ভাল কাজগুলি সংরক্ষণ করার কথা মনে হয়নি। সে চেষ্টাটাই ছিল না। ছবিগুলি অবশ্য ওঁর হাতের বাইরে ছিল। মনে আছে, ছবির নেগেটিভ রাখা আছে, এমন সব ল্যাবরেটরি থেকে একটার পর একটা চিঠি আসত। জানাত, ছবির প্রিন্টের যা অবস্থা হয়েছে, এর পর আর ঠিক না করলে নষ্ট হয়ে যাবে। বাবা শুনে কষ্ট পেতেন। কিন্তু বাবা ছবির মালিক নন। আর ছবি সংরক্ষণের জন্য যে বিপুল খরচ, তা তাঁর পক্ষে একা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই বাবার অনেক পুরনো ছবির কোনও কপি নেই। আসলে ডিজিটাল যুগের আগে ছবির ফিল্ম সংরক্ষণ করাটা খুবই কঠিন ছিল। পরে ভারতের ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ বাবার যে ক’টা ছবি বেঁচেছিল, সেগুলি পুনরুদ্ধার করে। তারা ভাল ভাবেই রেখেছে সে সব।
কিন্তু কাগজপত্র যেগুলি রাখার কথা ছিল, সেগুলি উনি কেন রাখেননি জানি না। এই পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়, বাবা যদি আর পাঁচটা বছর বাঁচতেন! বাবার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এই যে এত কিছু হচ্ছে— ওঁকে নিয়ে ছবি, অনুষ্ঠান, লেখালিখি— এ সব দেখে কী প্রতিক্রিয়া হত ওঁর! আসলে কোনও দিনই উনি নিজেকে একটি জাদুঘরের অঙ্গ ভাবেননি। তাই হয়তো পুরনো জিনিস বাঁচিয়ে রাখার আগ্রহ তাঁর ছিল না। নস্টালজিয়া বিষয়টাই যে খুব অপছন্দ করতেন!