ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
মহিলা বোধহয় বুঝতে পেরেছেন যে কেউ তাকে লক্ষ করছে! না কি তাকে হাসতে দেখে, তার দৃষ্টি অনুসরণ করেই লোকটির উপস্থিতি বুঝে ফেললেন?
কিন্তু তার পর তিনি যা করলেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না মারিয়া! পাশ দিয়ে একটা মপিং ট্রলি যাচ্ছিল। লম্বা একটা গাড়ি, ভিতরে উঁচু চেয়ারে বসে আছে চালক, ব্যাটারি চালিত গাড়িটিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে সে। আর নিয়ন্ত্রণ করছে গাড়ির নীচে ঘূর্ণায়মান ব্রাশগুলিকে, যা মেঝে পরিষ্কার করতে করতে চলেছে। মহিলা তাঁর হাতের দুটি চাকা লাগানো সুটকেস অবলীলায় টানতে টানতে দ্রুত পায়ে, প্রায় দৌড়ে যাওয়ার মতো করে হাঁটতে শুরু করলেন মপিং ট্রলিটার সাথে তাল মিলিয়ে! এমন ভাবে হাঁটছেন, ট্রলিটা যেন তাঁকে আড়াল করে রাখে। মারিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে পুরোটা।
ভদ্রলোক এখনও বসে আছেন। কিন্তু তাঁর আর সেই মহিলার মাঝখানে এখন চলমান সাফাইযন্ত্রটির আড়াল। ভদ্রলোক এখন আর কাগজ পড়ার ভান করছেন না। কাগজটা কোলের উপর মুড়ে রেখে উদ্বিগ্ন চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। মেয়েটি কিন্তু ভদ্রলোককে ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। ট্রলিটা একটা জামাকাপড়ের দোকানের সামনে পৌঁছে গিয়েছে। টুক করে দোকানে ঢুকে পড়লেন সুন্দরী তরুণীটি। চকিত দৃষ্টিতে এক বার পিছনে দেখে নিলেন, ভদ্রলোক তাঁর পিছু পিছু আসছেন কি না।
মারিয়া জানে, যে জামাকাপড়ের দোকানটিতে ঢুকেছে ওই ভারতীয় তরুণী, সেটির দুটি দরজা। উলটো দিকের দরজাটা দিয়ে তিনি অনায়াসে বেরিয়ে যেতে পারবেন। ভদ্রলোক এ বার উঠে পড়েছেন সিট ছেড়ে। এদিক-ওদিক পায়চারি করে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছেন, মেয়েটি কোথায় গেল।
মনে মনে মহিলার তারিফ না করে পারল না মারিয়া। অসাধারণ উপস্থিত বুদ্ধি। ভদ্রলোক যে তাঁকে কোনও কারণে লক্ষ করছেন, তা এক লহমায় ধরে ফেলেছেন!
মেয়েদের একটা ষষ্ঠেন্দ্রিয় তো থাকেই।
এই ষষ্ঠেন্দ্রিয়ই যেন আজ বারবার বাঁচিয়ে দিচ্ছে রত্নাকে! দোকানের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির চোখের দিকে দৃষ্টি না পড়লে রত্না হয়তো বুঝতেই পারত না, তাকে কেউ ফলো করছে!
যে দিন মা-বাবা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই চোদ্দো বছর বয়সের নিরাশ্রয় বিভ্রান্তিতে তার রাস্তায় নেমে দাঁড়ানো। তার পর থেকে নানা আঘাত সহ্য করে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠতে হয়েছে তাকে। এর মধ্যে কখন যে তার একটা ষষ্ঠেন্দ্রিয় প্রবল হয়ে উঠেছে, রত্না নিজেই টের পায়নি!
আজ বোধহয় সেই ষষ্ঠেন্দ্রিয়টির জন্যই সে এখনও বেঁচে আছে! এখনও সে মুক্ত। ভিয়েনা! ভিয়েনার মাটিতে পা পড়ল তার! কখনও ভেবেছিল, কোনও দিন ভিয়েনায় আসতে
পারবে সে?
এয়ারপোর্টকে এরা বলে ‘ফ্লুগহাফেন’। ভিয়েনার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি মনোরম। আমস্টারডামের স্কিফোল বা দুবাইয়ের মতো অত বড় না হলেও, ভারী সুন্দর করে সাজানো। প্রদর্শনী-আভিজাত্যে ঝকঝক করছে দোকানপাট। বহু ডিজাইনার ব্র্যান্ড, প্রসাধনী, জুতো, জামাকাপড়ের দোকান তো আছেই। তা ছাড়াও আছে ছোট-বড় নানান রেস্তরাঁ আর ক্যাফে। খয়েরি আর কালো রঙের পাথর দিয়ে তৈরি মেঝেতে মোমের মতো উজ্জ্বল পালিশ। আলো পিছলে পড়ে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, পা হড়কে যাবে।
বিমানবন্দরটি সর্বদাই ব্যস্ত। দিনের কোনও সময়েই জনসমাগমে ভাটা পড়ে না। বেশ কয়েকটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র ভিয়েনা, তাই শহরবাসীরা বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ, বিভিন্ন ধরনের পোশাক-আশাক আর আচার-ব্যবহারে বহু দিন ধরেই অভ্যস্ত। শাড়ি পরা কয়েক জন ভারতীয় মহিলাকে দুবাইয়ের ফ্লাইট থেকে নামতে দেখে কেউ ফিরেও তাকাল না।
দুবাই থেকে এমিরেট্স এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটা নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগেই ভিয়েনায় নেমে পড়েছে। ফ্লাইটে এত ভারতীয় দেখতে পাবে, ভাবেনি রত্না। তাদের মধ্যে আবার বেশ কয়েক জন শাড়ি পরিহিতা। দুজনকে তো বাঙালিই মনে হল। তার ভালই হল। অনেকের মধ্যে মিশে যাওয়ার উপায় থাকলে, দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয় কম। ইউরোপে এর আগে এক বারই এসেছে রত্না। সে বার আমস্টারডামে তার মেয়াদ ছিল এক দিনের, তাই শহরটা দেখা হয়নি। আর যাওয়া-আসার পথে লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে প্লেন বদল করতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা-বেষ্টিত এলাকা থেকে বেরোবার অনুমতি ছিল না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনও বিমানবন্দরের থেকে ইউরোপের এয়ারপোর্টগুলিতে নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যবহার ভাল। ভিয়েনায় তো দেখা গেল খুবই তৎপর, প্রসন্ন ব্যবহার সকলের। লাগেজ আসতেও বেশি
সময় লাগল না।
‘আপনারা ভিয়েনা সফরের কারণ জানতে পারি?’
তার পাসপোর্টের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে যে মেয়েটি চোখে চোখ রেখে প্রশ্নটি করল, রত্না দেখল, তার বয়স বছর পঁচিশের বেশি হবে না। প্রথম প্রথম এই সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি বুক ঢিপঢিপ করত রত্নার। যদি কোনও সন্দেহ হয় কারও? যদি ধরে ফেলে? গলা শুকিয়ে গেছে! বুকের মধ্যে এমন হাতুড়ি মারার মতো গুমগুম শব্দ, মনে হত যেন কাচের ও পার থেকে শুনে ফেলবে পাসপোর্ট কন্ট্রোলে বসে থাকা লোকটি!
এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। মেয়েটির চোখের দৃষ্টি কোনও ভাবে এড়ানোর চেষ্টা করল না রত্না। পরিষ্কার ইংরেজিতে উত্তর দিল, সে ভিয়েনার একটি স্বল্পখ্যাত কালচারাল ইন্সটিটিউটে ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে তিন দিনের একটা ওয়ার্কশপ করতে এসেছে। তার পর দুটো দিন শহরটা ঘুরে দেখবে। সামনের বুধবার এই এয়ারপোর্ট থেকেই আবার তার ফিরতি ফ্লাইট। কথাটা বলতে বলতেই ব্যাগ খুলে রঘুনন্দনলালজির দেওয়া চিঠিটা সে এগিয়ে দিল কাউন্টারের দিকে। ভিয়েনার একটি কালচারাল সেন্টারের ছাপানো আমন্ত্রণপত্র।
ইংরেজিতে কথা বলার সময় অবধারিত ভাবে মনে পড়বে বুলাকিদার কথা। বুলাকিদাই তো বলেছিল, ‘আংরেজি লিখনা-পড়না আতা হ্যায়, থোড়া বহুত? না তো শিখে লে রত্না!’
বুলাকিদাই তো ব্যবস্থা করেছিল সব! কাকে ধরে যেন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া একটি মেয়েকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করিয়েছিল। রত্নাকে সপ্তাহে দু’দিন গিয়ে পড়ে আসতে হত ভবানীপুরের একটি লেডিজ হোস্টেলে।
কাউন্টারের কাচের তলায় একটি যন্ত্র বসানো আছে। মেয়েটি চাইলে বোতাম টিপে সেই যন্ত্র দিয়ে চিঠিটা ভিতরে টেনে নিতে পারে। দেখে আবার একই কায়দায় ফেরত পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু সে তার উত্তরেই সন্তুষ্ট। চিঠির দিকে তাকিয়ে দেখলও না। শুধু নতুন পাসপোর্ট-ভিসার পাতাটা খুঁটিয়ে দেখে সেটা ফেরত দিল। মিষ্টি হেসে বলল, ‘ওয়েলকাম টু ভিয়েনা। হোপ ইউ হ্যাভ আ প্লেজেন্ট স্টে।’
একা চলাফেরা করলে খুব একটা বেশি মালপত্র নিয়ে আসা যায় না। একে তো টানাটানি করাটা অসুবিধে। তা ছাড়া একা এক জন মহিলাকে অনেকগুলো বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে দেখলে কারও সন্দেহ হতে পারে। রত্না তাই দুটি চাকা লাগানো সুটকেস নিয়ে এসেছে। দুটি সুটকেসেরই অবিকল এক মাপ, এক আকার। দুটিরই রং লাল। ফ্যাশন-সচেতন এক জন মহিলার পক্ষে মানানসই।
ক্রমশ