Rabindranath Tagore

কবির মৃত্যুর পর বেশি দিন ভাল লাগেনি শান্তিনিকেতন

বছরখানেক পরই কলকাতায় ফেরেন সত্যজিৎ। তার মধ্যেই পেয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, বিনোদবিহারীর মতো শিল্পীদের। খুঁজে পেয়েছিলেন ছাঁচ-ভাঙার শিক্ষা।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২১ ০৭:৪৪
Share:

সৃজনশিল্পী: সত্যজিতের সামনে শিল্পের নতুন জগৎ খুলে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (ডান দিকে) শান্তিনিকেতন। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্‌স।

এক সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্ল্যানচেটের খুব শখ হয়েছিল। তাঁর সেই পরলোকচর্চার আসরে এসেছিলেন অকালপ্রয়াত সুকুমার রায়। পিতৃহৃদয়ে সন্তানের জন্য যে কী গভীর উদ্বেগ থাকে, তা পিতা রবীন্দ্রনাথের অজানা নয়। তাই সুকুমার বলেন, ‘আচ্ছা, আমার ছেলেকে আপনার আশ্রমে নিতে পারেন?’ কবিগুরুর উত্তর, ‘তোমার স্ত্রী যদি সম্মত হন।’ পরলোক থেকে আসা সুকুমারের অনুরোধ ‘তাঁকেও বলুন না।’ ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’-র সূত্রে অমিতাভ চৌধুরীকে অমিয় চক্রবর্তী একটি চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠিতে মোক্ষম একটি সত্যবাক্য ছিল, ‘কবি যা শুনতে চান, তাই শুনেছিলেন, নিজের কথারই প্রতিধ্বনি তাঁকে মুগ্ধ করেছে।’ হয়তো পিতৃহারা সত্যজিৎ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের উদ্বেগই পরলোকচর্চার আসরে সুকুমারের মুখের কথা হয়ে উঠেছিল। সত্যজিতের আত্মকথন থেকে জানা যাচ্ছে, ‘মা’র কাছে শুনেছিলাম রবীন্দ্রনাথের অনেক দিনের ইচ্ছে আমি কিছুদিন গিয়ে শান্তিনিকেতনে থাকি।’ সত্যজিৎ নিজে অবশ্য কলকাতাপ্রেমী, কবির বিদ্যাপ্রাঙ্গণে থাকার তেমন আকুলতা তাঁর ছিল না। শান্তিনিকেতনে ভাল না লাগলে চলে আসবেন, স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন। পুরোপুরি ভাল লাগেওনি।

Advertisement

কেন অপছন্দ হয়েছিল শান্তিনিকেতন? সত্যজিতের মন্তব্য, ‘শান্তিনিকেতনে থাকার একটা খারাপ দিকও ছিল। ...১৯৪১ সাল, বিশ্বযুদ্ধ একেবারে আমাদের দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছে। অথচ শান্তিনিকেতনে চলছে সেই একইরকম নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রা।... চতুর্দিকের বাস্তব ঘটনাস্রোতের সঙ্গে এর কোন সংগতি আমি খুঁজে পেতাম না।’ শান্তিনিকেতনে এসে সত্যজিৎ ‘গ্রাম-বাংলার রূপ বৈচিত্র্যের সঙ্গে’ পরিচিত হলেন, ‘প্রাচ্য পৃথিবীর শিল্পকলার ঐশ্বর্যময়’ জগতের দরজা তাঁর চোখের সামনে খুলে গেল। খুব কাছ থেকে দেখলেন নন্দলালের আচার্য অবনীন্দ্রনাথকে। মাকে লিখেছেন চিঠিতে, ‘আজকাল উত্তরায়ণে রোজ সন্ধ্যাবেলা বাল্মীকি প্রতিভার rehearsal হচ্ছে— অবনীবাবু direct করছেন— আমি দেখ্‌তে যাই। অবনীবাবু acting আর music-এর দিক দিয়েও যে কত বড় genius সে ওর direction এই বোঝা যায়।’ সন্ধেগুলো কাটত শান্তিনিকেতনের জার্মান-ইহুদি অধ্যাপক অ্যালেক্স অ্যারনসনের বাড়িতে ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীত শুনে। রবীন্দ্রনাথ যত দিন জীবিত ছিলেন, তত দিন অবশ্য সত্যজিৎ তাঁর সঙ্গে দেখা করার খুব একটা চেষ্টা করতেন না। তাঁর সামনে গিয়ে কী যে বলবেন, খুব একটা ভেবে পেতেন না। জন্মদিনে এক বৃদ্ধকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ এবার আশি; আর তার মানেই ত আসি!’ কথাটা মিথ্যে হয়নি। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর বাদে যে দিন জাপানিরা কলকাতায় বোমা ফেলছিল, সে দিন সত্যজিৎ শান্তিনিকেতন ছাড়লেন। বোমা পড়লেও কলকাতা কলকাতাই। সেখানে ‘সিটিজেন কেন’ দেখানো হত, আর সিনেমা-হলবিহীন শান্তিনিকেতনে সত্যজিতের ‘অস্থির অস্থির’ লাগত। যে কলকাতা সত্যজিতের সিনেমার জ্যান্ত বিষয় হয়ে উঠবে, যে কলকাতার রাজনীতি-সমাজ-অর্থনীতি তার সমস্ত পাপপুণ্য নিয়ে সত্যজিতের সিনেমায় ধরা দেবে, সে কলকাতার বিরহ আর কত দিন শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথশূন্য আশ্রমে বসে যাপন করা যায়! সে দিন সত্যজিৎও তা করেননি।

মাঝে মাঝে তাই একটা প্রশ্ন মাথা তোলে। সত্যজিৎ কি শান্তিনিকেতনের? অর্থাৎ সত্যজিৎ যা হয়েছিলেন, তার পিছনে রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের অবদান কতখানি? কয়েক বছর কলাভবনের ছাত্র হিসেবে তাঁর যে শান্তিনিকেতন-যাপন— কী ভাবে সেই পর্বের বিচার করব আমরা? তখন সত্যজিৎ নিতান্তই সাত বছরের। মায়ের সঙ্গে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। বালক সত্যজিতের জন্য একটি পদ্য লিখে দিয়েছিলেন কবিগুরু। পদ্যটি এখন সকলেরই চেনা। এমনকি ‘বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে’ পর্বত সিন্ধু এ সব দেখার পরেও কেন ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু॥’ তা নিয়ে বাংলা পরীক্ষার খাতায় ভাবসম্প্রসারণও লিখতে হত। বালক সত্যজিতের খাতায় এ কবিতাটি লিখে দেওয়ার পর কবি অবশ্য জরুরি একটা কথা বলেছিলেন। ‘এর মানে আরেকটু বড় হলে বুঝবে।’ কথাটা সত্যজিৎ বড় হয়েই বুঝেছিলেন, প্রকাশ করেছিলেন তাঁর শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ। কলাভবনে তাঁর স্বেচ্ছা-অসমাপ্ত ছাত্রজীবনে শান্তিনিকেতনকে এক ভাবে পেয়েছিলেন, এক ভাবে সমালোচনাও করেছিলেন। সেই পাওয়া আর সমালোচনার বাইরে গিয়ে অন্য ভাবে জীবনের শেষ পর্বে পেতে চাইলেন শান্তিনিকেতনকে। সে পাওয়া ওই পর্বত-সিন্ধু ইত্যাদি দেখার পর ‘একটি ধানের শিষের উপরে/একটি শিশির বিন্দু’র কাছে ফেরার মতো পাওয়া। ‘আগন্তুক’ ছবির মনোমোহন, যিনি সত্যজিতেরই কণ্ঠ, তিনি বহু দেশ ঘুরে শেষমেশ ফিরছেন শান্তিনিকেতনে।

Advertisement

কথাটা একটু খোলসা করা চাই। ‘আগন্তুক’ ছবির মনোমোহন মিত্র বিশ্বভ্রমণ করেছেন। দেখেছেন আধুনিক নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার রূপ। ধ্বংসে যে তারা দানবীয়, তা বুঝতে পেরেছেন। বহু দিন নিরুদ্দেশ এই মামা কলকাতায় যখন তাঁর ভাগনির বাড়িতে কিছু দিনের জন্য থাকতে এলেন, তখন স্বভাবতই নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হল তাঁকে। পাসপোর্ট কী আর প্রমাণ করে? তিনি যে প্রতারক নন, বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে মামা সেজে যে ভাগনির বাড়িতে হানা দেননি, তা কে বলতে পারে? তাই ভাগনি-জামাইয়ের এক বন্ধুর জেরার মুখোমুখি হতে হল তাঁকে। কথায় কথায় সেই জেরা শেষ অবধি হয়ে উঠল ‘আধুনিকতা’ ‘নাগরিকতা’ বনাম এই পৃথিবীর বুকে এখনও জেগে থাকা অন্য সভ্যতার মূল্যবোধের বিতর্ক। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে ভিন্ন মূল্যবোধসম্পন্ন দুই পুরুষ-চরিত্রের মধ্যে এমন বিতর্ক আমরা পেয়েছি। সত্যজিতের ছবিতেও পেলাম। মনোমোহন মিত্র বলেছিলেন, তথাকথিত নগর-সভ্যতা গুহামানুষ ও জনজাতির মানুষকে ‘অসভ্য’ বললেও তাঁরা অ-সভ্য নন। তাঁদের বিজ্ঞান ও শিল্পবোধ ছিল। তাঁরা প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, আয়ত্ত করেছিলেন অজস্র বনৌষধির গুণাগুণ। আর আলতামিরার গুহাচিত্র প্রমাণ করে, কী চমৎকার আঁকতে পারতেন তাঁরা। কলকাতায় ভাগনির বাড়ির বসার ঘরে নাগরিক-বাঙালির সঙ্গে এই তর্ক করার পরদিনই মনোমোহন চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শান্তিনিকেতনের সাঁওতাল পাড়ায় কিছুটা সময় কাটানো। নাগরিক সভ্যতার বাইরে এই সাঁওতালদের মধ্যে পুরনো সভ্যতার যে ধারা তখনও বয়ে যাচ্ছে, তা সশ্রদ্ধ মনোমোহন গায়ে মাখতে চান। সত্যজিতের ছবি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে নগর-যুবক যে ভাবে অরণ্যচারী যুবতীকে ভোগ করে, তার সম্পূর্ণ বিপরীত এই মনোমোহনের ফেরা। বহু দেশ ঘুরে বহু ব্যয় করে বিশ্বভ্রমণের পর, কেন ঘরের কাছেই দু-পা ফেলে শান্তিনিকেতনে আসতে হল মনোমোহনকে? আসলে এ তো মনোমোহনের আসা নয়, সত্যজিতেরই শান্তিনিকেতনের কাছে শেষবেলায় ফিরে আসা।

মনোমোহনের মধ্যে আছেন সত্যজিতের শান্তিনিকেতনের এক শিক্ষক। শান্তিনিকেতনে নন্দলাল ছাড়া যাঁর ছবি তাঁকে আকর্ষণ করেছিল তিনি বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। তাঁর বিনোদদাকে নিয়ে ছবি করেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ‘কিঙ্করদার জীবন নিয়ে সিনেমা করার কথা আমি ভাবিনি।’ সত্যজিতের মতে, নন্দলাল ছাড়া সেই সময় কলাভবনে যাঁরা অসাধারণ, তাঁদের এক জন রামকিঙ্কর, অন্য জন বিনোদবিহারী। বিনোদদা তাঁকে টানেন বলেই ১৯৭২-এ করেছিলেন তথ্যচিত্র ‘দ্য ইনার আই’। তবে সেখানেই তাঁর বিনোদবিহারীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন শেষ হয়ে যায়নি। বিনোদবিহারী, শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথকে সত্যজিতের মতোই বিচার করছিলেন। শান্তিনিকেতনি বা কবিগুরু বলে একটি ছাঁচকে অবলম্বন করেননি। বস্তুত এই ছটফটে ব্যাপারটা তো রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও ছিল। নিস্তরঙ্গ শান্তিনিকেতনি ছাঁচ কি রবীন্দ্রনাথ নিজেও ভাঙতে চাইতেন না! বিনোদবিহারী সত্যজিৎকে ১৯৭২ সালে ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অবনীন্দ্রনাথরা ইন্ডিয়ান আর্টে যে এক্সপেরিমেন্ট করে গেছেন, তার পর আর কিছু করার প্রয়োজন নেই, এই ধারণা রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করতেন না। চিঠিতে লিখেছিলেন বিনোদবিহারীকে— তুমি যদি নন্দলালকে ছেড়ে না দাও, তা হলে তুমি যা করেছ, সব শেষ হয়ে যাবে। এই যে ছাঁচ-ভাঙার সাহস জুগিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তা গ্রহণ করেছিলেন বিনোদবিহারী। আটকে থাকেননি। সত্যজিৎকে বলেন বিনোদদা, ‘আমি যখন চলে যাই তখন তো নন্দবাবুর সাংঘাতিক রাগ আমার ওপর...।’ আটকে না থাকা অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন বিনোদদা যেমন আটকে থাকেন না এক জায়গায়, তেমন আটকে থাকেন না সভ্যতার মুখ ও মুখোশেও। বলেন, ‘আলতামিরার ঘোড়া দেখ। গুহার মানুষকে তো আর আজকের হিসেবে সোফিসটিকেটেড বলা যায় না। কিন্তু বুনো লোকেরাও পাথরের এমন ঘোড়া এঁকেছে যার কাছে চিনে ঘোড়া হার মেনে যায়। মানুষের এই স্বাভাবিক ক্ষমতাটা ক্রমে লোপ পেয়ে যাচ্ছে।’ বিনোদবিহারীর কথায় আসে সাঁওতালদের প্রসঙ্গ। তাঁরা এসে দেখছেন বিনোদবিহারীর ছবি। মন্তব্য করছেন। মোষ দিলে মানুষও দিতে হবে। সভ্যমানুষ প্রকৃতিকে আর মানবেতরকে আলাদা করে দেখেন, সাঁওতালরা দেখেন না। এই যে ১৯৭১-৭২-এ বিনোদদার অন্তর্দৃষ্টিতে সত্যজিৎ ছাঁচভাঙা রবীন্দ্রনাথকে, শান্তিনিকেতনে থাকা বিনোদদার অন্য শান্তিনিকেতনকে চিনেছিলেন, তাই ফিরে এসেছিল ‘আগন্তুক’-এর মনোমোহনের কণ্ঠে। সে-কণ্ঠ
তো কেবল মনোমোহনের নয়, সত্যজিতেরও। না-হলে কেনই বা ছবিতে মনোমোহনের গলায় গান গাইবেন সত্যজিৎ?

এই যে জীবনের শেষ ছবিতে আর এক ভাবে, ভাবনায় শান্তিনিকেতনে ফেরা, এর এক রকম প্রস্তুতি কি আগে থেকেই নিচ্ছিলেন না? শান্তিনিকেতন আর রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎকে দু’টি জিনিস শিখিয়েছিল— সব সময় প্রত্যক্ষ ভাবে হয়তো নয়— পরোক্ষ ভাবেও। প্রকৃতির সঙ্গে আধুনিক সভ্যতার সম্পর্ক প্রতিযোগিতার, প্রকৃতিকে জয় করাতেই সভ্যতার গর্ব। এই গর্ব আর অহমিকার বিরোধিতা যেমন রবীন্দ্রনাথের লেখায় মিলবে, তেমন মিলবে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের জীবনযাত্রায়। সত্যজিৎ এই ভাবনা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর শঙ্কু-কাহিনিতে শঙ্কু মস্ত বিজ্ঞানী। তবে প্রকৃতিকে জয় করার, দখল করার বিরোধী। যে বিজ্ঞানীরা টাকাপয়সার লোভে প্রকৃতিকে দখল করতে চান, তাঁদের সঙ্গে ত্রিলোকেশ্বরের লড়াই। আর লড়াই নব্য-নাৎসিদের সঙ্গে। কী ভাবে নব্য-নাৎসি নেতার মগজ বদল করে ভাল মানুষের মগজ ঢুকিয়ে দেওয়া হল, তা শঙ্কুর টানটান কল্প-কাহিনির বিষয়। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে সত্যজিৎ আনলেন স্বৈরাচারী শাসকের মগজধোলাইয়ের দৃশ্য। এই মগজধোলাই কাণ্ডের সঙ্গে, হীরকরাজ্যের নজরদারি ব্যবস্থার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের তলায় তলায় কোথাও মিল আছে। পার্থক্য আছে বিস্তর, তবে মিলটুকুও উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। ‘রক্তকরবী’-র ভয় দেখানো জুজু-সাজা রাজা শেষ অবধি নন্দিনীর প্রভাবে মনবদল করে জালের বাইরে এল অন্য মানুষ হয়ে।

শান্তিনিকেতনে ছাত্র থাকাকালীন মজাদার একটা শোনার যন্ত্র বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ ও তাঁর বন্ধুরা। দুটো দেশলাই বাক্সের মাঝে সুতো দিয়ে যে শোনার ছোট খেলার যন্ত্র, তারই বড় রূপ। দেশলাই বাক্সের বদলে সেখানে টিনের বাক্স, ফলে কথা চলত এক হস্টেলের সঙ্গে অন্য হস্টেলের। মুখোমুখি না-থেকেও চালানো যেত কথা। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সত্যজিতের সম্পর্ক অনেকটা সে রকমই। আড়াই বছর পাওয়া আর না-পাওয়া মিলে যে শান্তিনিকেতন, তার উপরেই সত্যজিৎ গড়ে তুললেন আর এক রকম শান্তিনিকেতন, সভ্যতা-অন্ধ লোকজনকে সে আলো দিতে পারে। তবে সে
আলো পেতে গেলে নির্বিচার ভক্তিতে শান্তিনিকেতনি হলে চলবে না— রবীন্দ্রনাথ, বিনোদবিহারী, সত্যজিতের মতোই ছাঁচভাঙা বিচারশীলতার অধিকারী হতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement