সলমন খানকে নিয়ে এখন যাঁরা মাথা ঘামাচ্ছেন, তাঁরা সম্ভবত জানেন না, ফুটপাতবাস একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, ঋতুপরিবর্তনই এর কারণ। প্রাকৃতিক নিয়মে সলমন-ঋতুতে ফুটপাতে গোটা কতক লোক গাড়িতে চেপ্টে গেলে তবেই দলে-দলে মানুষ ফুটপাতে থাকতে শুরু করে। সেলিব্রিটিরা তখন আকাশ থেকে পড়েন, ‘সে কী, ঘর-বাড়ি, পালকের বিছানা থাকতে লোকে খামখা ফুটপাতে কুকুরের মতো শোয় কেন?’ বলে এই অনাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন, সে নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়। মরমি মানুষরা ফুটপাতবাসীদের অধিকার নিয়ে কাঁদেন, পুলিশ ফুটপাতবাসীদের বাঁচাতে মাতাল ড্রাইভার দেখলেই টপাটপ জেল-জরিমানা শুরু করে। সবই প্রকৃতির লীলা, সমাপ্ত হলেই ঋতু-অবসান। তখন ইস্যু শেষ, ফুটপাতবাসীদের আবার ফিরে আসে গৃহবাসে রুচি। রাস্তায় আর মাতাল ড্রাইভার দেখা যায় না, ফুটপাতে নাকে-পোঁটা গা-ঘিনঘিনে ন্যাংটো ছেলেরা ভদ্রলোকের চোখে অদৃশ্য হয়ে যায়, দল বেঁধে ফিরে যায় সাতমহলা বাড়িতে। সব শান্তিকল্যাণ।
আমাদের ঋতুরা এই রকম। ফুটপাত-ঋতুর আগে ছিল কৃষক-আত্মহত্যা ঋতু। চতুর্দিকের সুখ-সচ্ছলতার মধ্যে এ রকম এক-আধটা কালাহান্ডি মরশুম এলে, কোথাও কিছু নেই, জাটিংগার পাখিদের মতো হঠাৎ করে চাষিভুষিরা আত্মহত্যা করতে শুরু করে। রাজনীতিকরা তখন মঞ্চে উঠে গাছ থেকে ঝুলে পড়া কৃষকের সুইসাইড-নোট পাঠ করেন, টিভিতে প্রাইম-টাইমে ‘চাষিভাইদের বলছি’ অনুষ্ঠান শুরু হয়, আলুচাষ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা চাষিভাইদের উন্নতির পথ নিয়ে আকচা-আকচি করেন। কান পাতা দায় হয়। কিন্তু অনেকেই ভুলে যান, এ-ও নেহাতই মরশুমি। সবই প্রকৃতির নিয়ম। ঋতু শেষ হলেই দেখবেন, আর কোনও অশান্তি নেই। চারিদিকে সমৃদ্ধির চিহ্ন, গ্রাম-শহর নতুন বউয়ের মতো মল ঝলমল। চাষিভাইরা আত্মহত্যার হুজুগ কাটিয়ে উঠে সব ফিরে গেছে ঘরে। শিল্প আর কৃষি, দুই-ই হাসিখুশি।
আমাদের ঋতুরা এই রকমই। যখন ধর্ষণের ঋতু আসে, তখন পণপ্রথা হাওয়া হয়ে যায়, পুরুষরা কেবলই আক্রমণ করে। যখন পুলিশ-ঋতু আসে, তখন কৃষকরা আর আত্মহত্যা করে না, ফুটপাতে কেউ মরে না, দেশে-বিদেশে মরার একটাই রাস্তা, পুলিশি এনকাউন্টার। আবার যখন অমানবিকতার ঋতু আসে, পুলিশ তখন পরম বন্ধু হয়, মানুষ চারদিকে অপকর্ম ঘটাতে থাকে। হরবখত রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা হয়, লোকে লোককে পিটিয়ে মারে। ফুটপাতে পড়ে থাকে ছটফটে লাশ, গড়িয়ে যায় তাজা রক্ত। পাশ দিয়ে চলে যায় নির্বিকার ট্রাম-বাস-টেম্পো। তবে সবই সাময়িক। ঋতু কেটে গেলেই সব পাষণ্ডপনার পরিসমাপ্তি। মানুষ মানুষকে আবার ভালবাসে, রাস্তায় বিলি হয় ফ্রি হাগ (অযৌন)। দেশ জুড়ে ফুত্তির হোলিখেলা হয়। লোকে আর ফুটপাতে থাকে না, চাষিরা না খেয়ে মরে না। ও-সব ইস্যু প্রকৃতির নিয়মে আসে, আবার প্রকৃতির নিয়মেই হাওয়া হয়ে যায়। ঋতুরঙ্গ কি আর সাধে বলে?
bsaikat@gmail.com