Rabindranath Tagore

প্রথম বার ক্যামেরার সামনে অভিনয়েও কবি জড়তাহীন

‘শ্রীনিকেতন’ তথ্যচিত্রে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘মানভঞ্জন’ অবলম্বনে পূর্ণাঙ্গ ছবি। রবীন্দ্রকাহিনি থেকে ছবি সেই প্রথম।

Advertisement

পীতম সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:৩৮
Share:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সালটা ছিল ১৯২৪, সময়টা মার্চ মাস। রবীন্দ্রনাথ চিন সফরে যাবেন, তার প্রস্তুতি চলছে। কবির সঙ্গে সে বার যাওয়ার কথা এলমহার্স্ট, বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, প্রতিমা দেবী, নন্দলাল বসু, কালিদাস নাগ, ঘনশ্যাম সিংহ এবং গ্রেচেন গ্রিন-এর। মার্চের ২১ তারিখ জাহাজে চড়ার আগে ১৬ তারিখে শান্তিনিকেতনের লাইব্রেরি ঘরের বারান্দায় গ্রেচেন গ্রিন-এর বিদায় সম্বর্ধনার আসর বসেছে। বিদায় সভায় চিরাচরিত প্রথা অনুসারে প্রাঙ্গণস্থল সুন্দর আলপনা আর ফুল দিয়ে সাজানো হল। তাঁকে শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে একটি সুন্দর ময়ূরকণ্ঠী রঙের সিল্কের শাড়ি অর্ঘ্য দেওয়ার পর মেয়েরা গান ধরল, ‘ভরা থাক স্মৃতিসুধায় বিদায়ের পাত্রখানি’। শেষে কবির নির্দেশে এবং উপস্থিতিতে আরও একটি গান গাওয়া হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। এই প্রসঙ্গে রাণু অধিকারীকে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখেছিলেন, “মিস্ গ্রিন এবারে দেশে চলে যাচ্চে। আমাদের সঙ্গে চীন পর্য্যন্ত যাচ্চে। তার পরে যাবে আমেরিকায়। আজ তার বিদায় অনুষ্ঠান হ’ল।” আর গানটি সম্বন্ধে লিখলেন, “শেষে একটা গান গাওয়ানো হল, তার আরম্ভটা হচ্চে এই রকম— ‘পাগল যে তুই কণ্ঠ ভ’রে / জানিয়ে দে তাই সাহস করে।’ ওটা আর কিছু নয়, নিজের পরিচয়টা ঘোষণা করে দিলুম।” রবীন্দ্রনাথের রসিকতাটা বোঝা গেলেও এ ক্ষেত্রে গ্রেচেন গ্রিন-এর পরিচয় পাওয়া যায় না।

Advertisement

নির্দেশক: নরেশচন্দ্র মিত্র। বাঁ দিকে, গ্রেচেন গ্রিন-এর ‘দ্য হোল ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড কোম্পানি’ বইয়ে কবির ছবি

নার্সিং এবং ফার্স্ট-এড বিশেষজ্ঞ এই মার্কিন সমাজসেবিকা রবীন্দ্রসহচর এলমহার্স্টের স্ত্রী ডরোথির খুবই পরিচিত ছিলেন। তখন সদ্যপ্রতিষ্ঠিত শ্রীনিকেতনের শ্রীবৃদ্ধিতে রবীন্দ্রনাথ সুরুলের জন্য এক জন দক্ষ সমাজসেবিকার সন্ধান করছিলেন। ডরোথির কানে সে খবর পৌঁছলে তিনি মার্কিন সমাজসেবিকা গ্রেচেন গ্রিনকে কবির কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই অনুযায়ী ১৯২২ সালে শারদোৎসবের সময় গ্রিন-এর শান্তিনিকেতনে আসা। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকায় গার্হস্থবিজ্ঞানে শিক্ষিত গ্রেচেন গ্রিন-এর আগমনবার্তা প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল “আমেরিকা হইতে Miss Gretchen Green নামক একটি বিদুষী মহিলা সুরুলে কৃষিবিভাগে আসিয়া পল্লীসেবা বিভাগের কার্য্যে যোগদান করিয়াছেন— তাঁহার দ্বারা পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির রুগ্ণ ব্যক্তিদের বিশেষ সাহায্য হইতেছে।”

অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই মার্কিন সমাজসেবিকা গ্রামবাসীদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। বীরভূমে সেই সময়কালে ম্যালেরিয়া সাংঘাতিক ছড়িয়ে পড়ায় গ্রেচেন গ্রিনকে সঙ্গে নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সুরুলে ম্যালেরিয়া নিরোধক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া গ্রামের ছোট ছোট মেয়েদের নিয়ে একটি গার্ল-গাইড দল গড়েছিলেন তিনি, কবি যার নাম রেখেছিলেন ‘সহায়িকা’, যদিও প্রথমে ‘গৃহদীপ’ নামটিওতাঁরই দেওয়া।

Advertisement

প্রায় দু’বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৯২৪ সালে দেশে ফেরেন গ্রেচেন গ্রিন। এর এক যুগ পর, ১৯৩৬ সালে ‘দ্য হোল ওয়র্ল্ড অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে একটি বইও লেখেন। সেই বইয়ের একাধিক অধ্যায়ে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গের উল্লেখ আছে। রবীন্দ্রনাথ এই গ্রন্থ সম্পর্কে গ্রিনকে তারিফ করে ১৯৩৬-এর ১৬ জানুয়ারি লেখেন, “তোমার বইটির জন্য বিশেষ ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার শ্রীনিকেতনের দিনগুলি, যে দিনগুলি তোমার সঙ্গে আমি একত্রে ভাগ করে নিয়েছিলাম, সেই সমস্ত স্মৃতি এখানে সঞ্চয় করে রেখেছ তুমি।” এই বইটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে থমকে যেতে হয়। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে, বাংলার এক অখ্যাত গ্রামে এক ইতিহাস গড়ার কথা লিখেছেন তিনি, যা তখনকার কোনও পত্রিকাতেও প্রকাশ পায়নি। কিন্তু কী এমন ইতিহাসের কথা লিখেছিলেন গ্রিন?

শিল্পী লিওনেবেল জেকবস। ডান দিকে, ওই বইটির টাইটেল পেজ

রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ছ’তারিখে সুরুলে গ্রাম পুনর্গঠন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মূলত গ্রামসমাজ ও চাষাবাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে। একই সঙ্গে সামগ্রিক পল্লি পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং লোকশিল্প-স্থাপত্য বিষয়গুলিকে একত্র করে শ্রীনিকেতনকে আদর্শ গ্রাম হিসাবে গড়ে তোলাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যালেরিয়া থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষা করার জন্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাদের সচেতন করার ব্যবস্থাও করেন। জনকল্যাণকর কাজে রবীন্দ্রনাথ জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তুলতে চলচ্চিত্রকে সেই প্রথম কাজে লাগালেন, আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে। গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের ম্যালেরিয়ার বাহক মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ বাতলে দেন।

আর কবির এই উদ্যোগকেই মিলিত ভাবে কাজে লাগালেন এলমহার্স্ট এবং গ্রেচেন গ্রিন। জানা যায়, ১৯২৩-এর মার্চে এলমহার্স্ট চিন, জাপান ও আমেরিকা সফরকালে শ্রীনিকেতনের কাজকর্ম ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়ে দেখাবেন স্থির করেন। সেই উপলক্ষে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখ বিশ্বভারতী সংসদে বকেয়া ২৩০০ টাকা মঞ্জুর করা হয়েছিল। গ্রিন-এর স্মৃতিচারণে জানা যায়, চিত্রনাট্য প্রস্তুত করেন তিনি নিজেই। লিখেছেন, “টেগোর ও তাঁর দর্শন ও কর্মের সমন্বয় নিয়ে আমি একটি চিত্রনাট্য প্রস্তুত করেছিলাম। ‘কলকাতা থেকে একদল সিনেমাকর্মী ক্যামেরা-সহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে (শ্রীনিকেতনে) এসে হাজির।” স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করেছিলেন সেই তথ্যচিত্রে। সে কথাও গ্রিন লিখেলেন, “ছবি তুলতে গিয়ে কবির ব্যবহার চমৎকার ছিল। ধানের খেতের ভিতর দিয়ে হেঁটে গেলেন। চাষিরা তাঁকে দেখে মাথা নুইয়ে পায়ের ধুলো নিল। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে মাস্টারমশাইরা তাঁর পায়ের কাছে বসলেন। শেষে একটি উৎসবের দৃশ্যে অধ্যাপক থেকে ছাত্র, গ্রামবাসী, শ্রোতা, দর্শক সকলেই কবিকে ঘিরে দাঁড়াল। আমরা ছবি তুললাম।” গ্রিনের বর্ণনায় বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের সেই প্রথম ছায়াছবিতে, ক্যামেরার মুখোমুখি হতে কবির কোনও আড়ষ্টতা ছিল না, বরং তিনি সহজ ও সাবলীল ছিলেন। শ্রীনিকেতন-সংলগ্ন সাঁওতাল গ্রামের দৃশ্য ও সাঁওতালদের জীবনযাত্রা, নাচ-গান-বাজনারও ছবি তোলা হয়েছিল তথ্যচিত্রটির জন্য।

গ্রিনের সেই ভাষ্যেই জানা যাচ্ছে, ছবিটির প্রযোজক ছিল কলকাতার তাজমহল ফিল্ম কোম্পানি, এবং ক্যামেরা পরিচালনের দায়িত্বে ছিলেন ননী সান্যাল। ছবির নাম রাখা হয়েছিল ‘শ্রীনিকেতন’। গ্রেচেন গ্রিন-এর পরিচালনায় প্রায় ১২ রিলের ছবিটি প্রদর্শিত হল কলকাতার একটি নাট্যঘরে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন এবং শ’খানেক সুহৃদ-সহ তথ্যচিত্রটি দেখেছিলেন। কলকাতার তৎকালীন গভর্নমেন্ট হাউস অর্থাৎ রাজভবনেও ছবিটি দেখানো হয়েছিল। লর্ড লিটন সপার্ষদ ছবিটি দেখেন। তিনি এলমহার্স্ট এবং গ্রেচেন গ্রিনকে জানিয়েছিলেন, তিনি মনে করেন রবীন্দ্রনাথের এই জাতীয় কাজকর্ম বিদেশে আরও বেশি প্রচার পাক। গ্রিন নিজে লিটনের পাশে বসে ছবির বিষয়বস্তু বুঝিয়েছিলেন লিটনকে।

ঠিক এই সময়েই তাজমহল ফিল্ম কোম্পানি রবীন্দ্রনাথের ‘মানভঞ্জন’ গল্পটি নিয়ে একটি নির্বাক চলচ্চিত্র তৈরি করে। নরেশচন্দ্র মিত্র পরিচালিত এটিই রবীন্দ্রনাথের কাহিনি অবলম্বনে প্রথম ছায়াছবি। অভিনয় করেছিলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশচন্দ্র মিত্র, ইন্দু মুখোপাধ্যায়, তিনকড়ি চক্রবর্তী এবং নীলিমা রানী। ভবানীপুরের রসা থিয়েটারে ১৯২৩ সালের ১১ এপ্রিল ছবিটি প্রথম প্রদর্শিত হলে শোনা যায়, দর্শকরা খুবই আনন্দ পেয়েছিলেন। সে দিন ‘মানভঞ্জন’ দেখানোর আগে ‘শ্রীনিকেতন’ তথ্যচিত্রটিও দেখানো হয়েছিল। মনে রাখা প্রয়োজন, দু’টি চলচ্চিত্রেরই প্রযোজক তাজমহল ফিল্ম কোম্পানি।

এর পর এলমহার্স্ট চিনের উদ্দেশে পাড়ি দেন এবং সেখানে পল্লি উন্নয়নে কবির ভূমিকার পরিচয় দিতে গিয়ে ‘শ্রীনিকেতন’ তথ্যচিত্রটি তিনি বহু জায়গায় দেখিয়েছিলেন। তবে আশ্চর্য হতে হয় এ কথা জেনে যে, শ্রীনিকেতন নির্মাণকালে সুরুলের এমন একটি বিশেষ কাজের কথা কোনও সংবাদপত্র, এমনকি ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকার পাতাতেও স্থান পায়নি। বিদেশের মাটিতে রবীন্দ্রনাথের পল্লি উন্নয়নের সচিত্র বিবরণের এই উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহাসিক ঘটনাটি কেন আলোচিত হয়নি বা সমাদর পায়নি তা ভেবে দেখার। গ্রেচেন গ্রিনের আত্মজীবনী ‘দ্য হোল ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড কোম্পানি’র মাধ্যমেই জগৎবাসী জানতে পারে এমন একটি ঐতিহাসিক সাধুকাজের কথা। আরও বিস্ময়ের কথা, একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গড়ে তোলা এই প্রথম তথ্যচিত্র ‘শ্রীনিকেতন’ এবং রবীন্দ্রকাহিনি অবলম্বনে তৈরি প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র ‘মানভঞ্জন’— দু’টির একটি কপিও কোথাও সংরক্ষিত হয়নি। এমন গুরুত্বপূর্ণ দু’টি ঘটনার শুধুমাত্র এই সংবাদটুকুই ভরসা। এ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল রবীন্দ্রনাথের কাজ ও কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ছায়াছবির শতবর্ষ। এই সম্পদ পুনরুদ্ধার হলে রবীন্দ্রচর্চা এগিয়ে যেতে পারে অনেক পথ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement