ভরসা: শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন মিজোরামের শিক্ষার্থীরা।
দেশের উর্দি গায়ে এক দশক চাকরি করার পর বিদেশের মাটিতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। পেটের দায়ে পাথর ভাঙার কাজ করছেন ৩২ বছরের পুলিশ অফিসার এল এস থাং।
২৪ বছরের রাইফেলম্যান সোংসিয়ান তাঁর এক বছরের মেয়ে, বৌ, বাবা-মায়ের খবর জানেন না। শুধু জানেন, মানবিকতার জন্য, শান্ত প্রতিবাদকারীদের উপরে গুলি না চালিয়ে দেশত্যাগ করে ভুল করেননি।
মহিলা পুলিশকর্মী সি নিয়াং আর তাঁর দমকলকর্মী স্বামী আইজলে দিনমজুরি করছেন। স্বদেশে গণতন্ত্র ফিরলেও দেশে ফিরে আর উর্দি পরতে চান না। কারণ এক কালের গর্বের উর্দি এখন মানুষের ঘেন্নার কারণ।
পর পর পলাতক পুলিশকর্মীর নাম জমছে শরণার্থীর সরকারি খাতায়। নিরীহ আন্দোলনকারীদের সামনে দাঁড় করিয়ে সামরিক শাসকরা গুলি করে মারতে বলেছিল। স্বজনদের মারতে রাজি হননি তাঁরা। বিদ্রোহ করে দেশ ছেড়েছেন। তাই ভারত সরকার ফেরত পাঠালে অবধারিত মৃত্যুদণ্ড।
মায়ানমারের সহস্রাধিক মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে মিজোরাম। সরকারি সাহায্য নেই। ভরসা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আর গ্রামবাসীরা। শরণার্থীরা নির্মাণকর্মী বা পাথর ভাঙার কাজ নিয়েছেন। কেউ পরিবার, শিশুসন্তান, কেউ বা সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে রেখে পালিয়েছেন। তাঁদেরও খবর নেই।
২০১১ সালে থাং পুলিশে যোগ দেন। তত দিনে আং সান সু কি মুক্ত, গণতন্ত্র আসন্ন। কিন্তু ২০২১ সাল যে ফের সামরিক শাসনের চরম আতঙ্ক নিয়ে আছড়ে পড়বে, তা ভাবতে পারেননি। ভাবতে পারেননি ছাড়তে হবে দেশ। মোটা মাইনের আইনরক্ষক গণহত্যায় রাজি না হয়ে এখন ভিনদেশি মজুর! সে দেশের সরকারও তাঁকে রাখতে চায় না। তাঁর সঙ্গেই আরও ১৮ জন পুলিশকর্মী ১১ মার্চ মিজোরামে ঢোকেন। তাঁর স্ত্রী, সন্তানরা, বাবা-মা এক অজ্ঞাত গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন বলে শেষ খবর।
তেডিম প্রদেশের রাইফেলম্যান সোংসিয়ান আপাতত ৩০ জন পলাতক পুলিশের আশ্রয়-শিবিরের রাঁধুনি। বৌ আর ছোট্ট মেয়েকে ফেলে এসেছেন। কর্পোরাল জামখানহাও অন্য ১০ সহকর্মীকে নিয়ে পালিয়ে ১৩ মার্চ মিজোরামে ঢুকেছেন। জানান, প্রতিবাদকারীদের মাথায় গুলি করে মারার নির্দেশ দিচ্ছিল সামরিক অফিসারেরা। সেই কাজ করতে মন সায় দেয়নি। কয়েকদিন জঙ্গলে লুকিয়ে সীমান্ত পেরোন তাঁরা। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কোথায়, কী ভাবে আছেন খবর নেই। আর হয়তো দেখা হবে না। ফিরলেই মৃত্যুদণ্ড।
মায়ানমার ও মিজোরামের সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৫১০ কিলোমিটার। ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম বা এফএমআর অনুযায়ী সীমান্তের দু’পারের মানুষ অন্য পারে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারেন। থাকতে পারেন দু’সপ্তাহ। মায়ানমার ও মিজোরামের সীমান্তবাসীদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মায়ানমারের সাম্প্রতিক অস্থিরতায় সীমান্তবর্তী সেরচিপ, চাম্ফাই, সিয়াহা, লাওঙৎলাইস, নাথিয়াল, সব জেলাতেই পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। পলাতকদের বেশির ভাগই পুলিশ বা দমকলকর্মী।
পুলিশকর্মীদের ফেরত পাঠাতে বলে ইতিমধ্যেই মিজো সরকারকে চিঠি পাঠিয়েছে মায়ানমারের সেনা সরকার। কিন্তু মিজোরাম সরকার অরাজি। শরণার্থীদের জন্য মিজো সংগঠনগুলি আয়োজন করছে চ্যারিটি কনসার্ট। রাস্তায় রাস্তায় তোলা হচ্ছে চাঁদা।
মিজো, চিন, কুকি, জোম সকলেই আদি জো জনগোষ্ঠীর শরিক বলে পরিচিত। মিজোরাম-মায়ানমার-বাংলাদেশের ‘জো’ জনগোষ্ঠীর ঐক্যমঞ্চ ‘জো-রিইউনিফিকেশন অর্গানাইজ়েশন’ বা জোরো দাবি তুলেছে সীমান্ত পেরিয়ে আসা অত্যাচারিত, প্রাণভয়ে ভীত জো-চিন জনগোষ্ঠীর মানুষদের দিতেই হবে শরণার্থীর মর্যাদা। তাঁদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দাগিয়ে ফেরত পাঠানো চলবে না মায়ানমারে। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় সরকারি সবুজ সঙ্কেতের দাবিতে কেন্দ্রকে চিঠি পাঠিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন মিজো সাংসদ ও নেতারা। মুখ্যমন্ত্রীর মত, কেন্দ্র যা-ই বলুক, শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্য দেওয়া মিজো সরকারের ও মিজোরামবাসীর নৈতিক কর্তব্য।
মায়ানমারের শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া-না দেওয়ার দ্বন্দ্বে নতুন করে মিজো-চাকমা দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিচ্ছে। মিজোরা চিন জনগোষ্ঠীকে আপন করলেও চাকমাদের আপন বলে মানতে নারাজ। তাই চলছে দীর্ঘ রেষারেষি। চাকমারা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। মিজোদের দাবি, চাকমারা ভূমিপুত্র নন। বাংলাদেশ থেকে আসা। তার পরেও তাঁরা মিজোরামে শুধু শরণার্থীর মর্যাদা নয়, নাগরিকত্ব পেয়েছেন। পেয়েছেন ভোট-সহ সব ধরনের অধিকার। তা হলে, জো-দের ক্ষেত্রে কেন বৈষম্য?
এমজেডপি বা অন্যান্য মিজো সংগঠনগুলিও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। জোরো যুব শাখার সভাপতি এল রামডিনলিয়ানা বলেছেন, মায়ানমারের শরণার্থীদের জোর করে দেশে পাঠানো মানে হত্যা করা। জো-দের বিরুদ্ধে কেন্দ্র বৈষম্য চালালে মিজো যুবকরা ফের হাতে অস্ত্র তুলে নেবেন।
শরণার্থী পুলিশদের অনুরোধ, স্বদেশি নাগরিকদের উপরে গুলি চালাননি বলে পলাতক তাঁরা, তাঁদের অন্য উদ্দেশ্য নেই। মানবিকতার বিনিময়ে ভারত সরকারের কাছেও মাথা গোঁজার মানবিক অনুমতিটুকুই প্রার্থনা তাঁদের।