ভারতীয় ছবির ‘ফার্স্ট লেডি’ বলা হত তাঁকে। দেবিকা রানি, একটি ছবির দৃশ্যে (বাঁ দিকে)।
আকাশবাণী কলকাতার স্টেশন ডিরেক্টর পি.ভি.কৃষ্ণমূর্তি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এক দিন ডেকে বললেন, ‘বেটা, আজ বিকেলে রাজভবনে আমার আমন্ত্রণ, কিন্তু একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে, তাই তুমি সেখানে গিয়ে আকাশবাণীর প্রতিনিধিত্ব করবে। দেবিকা রানির সংবর্ধনা আছে আজ রাজভবনে।’
রাজভবনের মার্বেল হল-এ ঢুকে চমকে উঠলাম, কী অসামান্য রূপসি! অনুষ্ঠানশেষে তাঁর কাছে গিয়ে আকাশবাণীর পরিচয়সূত্রের কথা জানিয়ে ফস করে বলে ফেললাম, আপনি এখনও এত সুন্দর! সময় যেন আপনার পায়ের কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। দেবিকা তাঁর সেই বিশ্বজয়ী হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আকাশবাণীতে কী কাজ করো?’ সস্নেহে বললেন, ‘বিবিসির অনুষ্ঠান শুনলে অনেক কিছু শিখতে পারবে। জানো তো, বিবিসির শর্টওয়েভ সার্ভিস ওঁরা লন্ডনে আমাকে দিয়ে উদ্বোধন করিয়েছিলেন। বিবিসি তো পৃথিবীতে প্রথম টিভি প্রোগ্রাম টেলিকাস্ট শুরু করেছে, উদ্বোধনের দিনের টেলিকাস্টে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম।’ দেবিকা রানি এক ইতিহাস, তিনি আমার মতো এক নগণ্য তরুণের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে গল্প করছেন! পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। বললাম, আপনি তো সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের প্রদৌহিত্রী। বললেন, ‘হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের দিদি সৌদামিনী দেবীর দিক থেকে।’ বললাম, ‘ম্যাঞ্চেস্টার ডেলি ডেসপ্যাচ’ তো লিখেছিল, দেবিকা রানি এতই সুন্দরী যে হলিউডের সুন্দরীদের একেবারে মুছে দিয়েছেন। সরোজিনী নাইডু আপনাকে ইন্ডিয়ান সিনেমার নাইটিঙ্গল বলতেন। আপনার ‘জীবনপ্রভাত’, ‘ইজ্জত’, ‘আনজান’, এ-সব ফিল্মের কথা জানতে ইচ্ছে করে। বললেন, ‘তুমি তো দেখছি আমার অনেক কথা জানো। পরে যোগাযোগ কোরো।’
এখানে টেলিভিশন আসার পর যখন তিনি কলকাতায় এলেন, আমি তাঁকে নিয়ে টিভিতে অনুষ্ঠান করার ইচ্ছের কথা জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে রাজি। ভারতের প্রথম ফিল্ম ‘হিরোইন’, প্রথম দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে সম্মানিত অভিনেত্রী, অথচ কোনও অহংকার নেই। অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের উপদেশে তাঁর ন’বছর বয়সে লন্ডনে পড়তে গিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা, স্কলারশিপ পেয়ে রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব ড্রামাটিক আর্ট-এ ভর্তি হওয়া, রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব মিউজিক-এ শিক্ষালাভ করা, স্থাপত্য শিল্প নিয়ে শিক্ষানবিশি, টেক্সটাইল ডিজাইনিং-এর কাজ করা, লন্ডনে বিখ্যাত অভিনেতা ও চিত্রপরিচালক হিমাংশু রাইয়ের সঙ্গে আলাপ, তাঁদের বিয়ে, তার পর দেশে এসে একসঙ্গে বম্বে টকিজ-এর প্রতিষ্ঠা করা, এ-সব উজ্জ্বল ইতিহাসের কথা। স্টুডিয়োতে রেকর্ডিংয়ের দিন আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘তুমি রোয়েরিক-কে নিয়ে অনুষ্ঠান করবে না? আমাকে নিয়ে করছ, ও তো অভিমান করবে।’ বিখ্যাত চিত্রশিল্পী স্বতোস্লাভ রোয়েরিক, তাঁর দ্বিতীয় স্বামী। কুলু ভ্যালিতে তাঁদের স্বপ্নের মতো বিয়ের অনুষ্ঠানে ৩৬৫টি মন্দিরের প্রতিনিধিদের সমাবেশ, হলুদ জুঁইফুল দিয়ে সাজানোর গল্প করেছিলেন। রোয়েরিকের সঙ্গে সে দিনই কথা হয়ে গেল। পরের বছর কলকাতায় তাঁর ছবির প্রদর্শনী শেষ হলে রোয়েরিক ও তাঁর অসামান্য সব ছবি সঙ্গে নিয়ে দেবিকা এলেন স্টুডিয়োতে।
‘কর্মা’ ছবিতে দেবিকা রানির বিখ্যাত চার মিনিট ব্যাপী দীর্ঘতম চুম্বনদৃশ্যের কথা তুলেছিলাম। খুব হেসে বলেছিলেন, সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে গিয়েছিল। তাঁর ‘জওয়ানি কি হাওয়া’ ছবির নায়ক নাজম-উল-হাসানের সঙ্গে তাঁর সাংঘাতিক প্রেমপর্বের কথা সরাসরি না তুলে বলেছিলাম, নাজম-উল-হাসানের আর তো কোনও খবর জানতে পারি না! দীর্ঘ নীরবতার পর বিষণ্ণ হেসে বলেছিলেন, ‘তার পর তো আমাদের এক অনিচ্ছুক টেকনিশিয়ানকে জোর করে হিরো করা হল। সে কে, জানো? অশোককুমার। তাঁর সঙ্গে আমার ‘অচ্ছুৎকন্যা’ ছবিটা খুব হিট করে যায়।’ বললাম, ‘অচ্ছুৎকন্যা’ তো এক ইতিহাস। নেহরু, ইন্দিরা গাঁধী, সরোজিনী নাইডু একসঙ্গে বম্বে টকিজ-এ এই ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি দেখেছিলেন ছবিটা? বললেন, ‘কলকাতায় ‘অচ্ছুৎকন্যা’র মুক্তির দিন রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘হমারি বাত’-এর পর কেন ছবি করা ছেড়ে দিলেন? বলেছিলেন, শিল্পের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করতে পারছিলেন না।
দেবিকা রানির জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে উদ্বোধক মৃণাল সেন মজা করে বলেছিলেন, ‘দিল্লিতে একটা মিটিংয়ের পরে আমি দেবিকা রানির কাছ থেকে দেশলাই চেয়ে নিয়ে সিগারেট ধরিয়েছিলাম, এ ছাড়া তাঁর সম্পর্কে আর কিছু জানা নেই। পঙ্কজ ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত, পঙ্কজ বলবে।’ আমি যা বলেছিলাম তার সারমর্ম, দেবিকা রানিকে দেখেছিলাম এক সুন্দরীতম, অভিজাততম, প্রতিভাময়ী, আন্তর্জাতিক বাঙালি রমণী হিসেবে।
pankajsaha.kolkata@gmail.com